ছবি : ইরাকের মসুল নগরী। আইএসের সাথে যুদ্ধে এই নগরী এখন ধ্বংসস্তূপ। এখানেই বসবাস করতেন নবী নূহ আ. এবং তাঁর জাতি।
আদম আ. গত হওয়ার পর প্রায় হাজার বছর পার হয়ে গেল। শেষ শতকে ক্রমবর্ধমান মানবকুলে শিরক ও কুসংস্কারের আবির্ভাব ঘটে এবং তা বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ নূহ আ.-কে নবী ও রাসূল করে পাঠান। তিনি সাড়ে নয়শত বছরের দীর্ঘ বয়স লাভ করেছিলেন এবং সারা জীবন পথভোলা মানুষকে পথে আনার জন্য দাওয়াতে অতিবাহিত করেন। কিন্তু তাঁর কওম তাঁকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। ফলে আল্লাহর গযবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা বলে খ্যাত নূহ আ. ছিলেন পিতা আদম আ.-এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ আ.-এর চারটি পুত্র ছিল। তারা হলেন সাম, হাম, ইয়াফিছ ও ইয়ামিন অথবা কেন‘আন। প্রথম তিনজন ঈমান আনেন। কিন্তু শেষোক্ত জন কাফের হয়ে প্লাবনে ডুবে মারা যায়। নূহ আ.-এর দাওয়াতে তাঁর কওমের হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি সাড়া দেন এবং তারাই প্লাবনের সময় নৌকারোহণের মাধ্যমে বেঁচে যান। ঐতিহাসিকরা বলেন, আমরা বাঙালিরাও নূহ আ.-এর বংশধর।
নুহ আ. ছেলে হামের ছিলো ছয় ছেলে। তারা হলো, হিন্দ, সিন্দ, হাবাস, জানাস, বার্বার ও নিউবাহ। এদের মধ্যে হিন্দের মাধ্যমে ভারতবর্ষ আবাদ হয়েছিলো। হিন্দের সন্তানরা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলো বলেই এ ভুখন্ড ‘হিন্দুস্তান’ নামে পরিচিত। আল্লাহর নবী নুহ আ. ছেলে ও নাতিদের সকলেই ছিলেন ঈমানদার ও ধর্মপ্রচারক। তাঁরা ছিলেন তাওহীদবাদের পূর্ণ বিশ্বাসী। হামের বড় ছেলে হিন্দের ছিলো চার ছেলে। তারা হলেন পূরব, বঙ্গ, দাখিন ও নাহরাওয়াল। বড় ছেলে পূরবের মোট বিয়াল্লিশজন ছেলে ছিলো। তারা ভারতবর্ষ ও এর আশেপাশে বসতি স্থাপন করে এবং অল্পকালের মধ্যেই তাদের বংশবিস্তার হয়। তারা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দের উল্লেখিত দ্বিতীয় ছেলে বঙ্গ ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধরের আবাসস্থলই তাঁর নামে অর্থাৎ ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত হয়।
নূহ আ. ৯৫০ বছর জীবন পেয়েছিলেন। নূহ আ. ইরাকের মসুল নগরীতে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে বসবাস করতেন। তারা বাহ্যতঃ সভ্য হ’লেও শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তিনি তাদের হেদায়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, হযরত নূহ (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২৮টি সূরায় ৮১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এবং নূহ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাও নাজিল হয়েছে।
আদম (আঃ)-এর সময়ে ঈমানের সাথে শিরক ও কুফরের মুকাবিলা ছিল না। তখন সবাই তওহীদের অনুসারী একই উম্মতভুক্ত ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের মধ্য শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটে। নূহের কওম ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূস, ইয়াঊক্ব ও নাসর প্রমুখ মৃত নেককার লোকদের উসিলায় আখেরাতে মুক্তি পাবার আশায় তাদের পূজা শুরু করে। মুহাম্মাদ ইবনু ক্বায়েস বলেন, আদম ও নূহ আ.-এর মধ্যবর্তী সময়কালের এই পাঁচজন ব্যক্তি নেককার ও সৎকর্মশীল বান্দা হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর পর ভক্ত অনুসারীগণকে শয়তান এই বলে প্ররোচনা দেয় যে, এইসব নেককার মানুষের মূর্তি সামনে থাকলে তাদের দেখে আল্লাহর প্রতি ইবাদতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ফলে তারা তাদের মূর্তি বানায়। অতঃপর উক্ত লোকদের মৃত্যুর পরে তাদের পরবর্তীগণ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ঐ মূর্তিগুলিকেই সরাসরি উপাস্য হিসাবে পূজা শুরু করে দেয়। তারা এইসব মূর্তির উসিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতো। আর এভাবেই পৃথিবীতে প্রথম মূর্তিপূজার শিরকের সূচনা হয়।
ইবনু আবী হাতেম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ‘ওয়াদ’ ছিল এদের মধ্যে প্রথম এবং সর্বাধিক নেককার ব্যক্তি। তিনি মারা গেলে লোকেরা তার প্রতি ভক্তিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শয়তান এই সুযোগ গ্রহণ করে এবং লোকদেরকে তার মূর্তি বানাতে প্ররোচনা দেয়। ফলে ওয়াদ-এর মূর্তিই হ’ল পৃথিবীর সর্বপ্রথম মূর্তি, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার পূজা শুরু হয়’।
নূহ আ. স্বীয় কওমকে দিন-রাত দাওয়াত দিতে থাকেন। তিনি তাদেরকে প্রকাশ্যে ও গোপনে বিভিন্ন পন্থায় ও পদ্ধতিতে দাওয়াত দেন। কিন্তু ফলাফল হয় নিতান্ত নৈরাশ্যজনক। তাঁর দাওয়াতে অতিষ্ট হয়ে তারা তাঁকে দেখলেই পালিয়ে যেত। কখনো কানে আঙ্গুল দিত। কখনো তাদের চেহারা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলতো। তারা তাদের হঠকারিতা ও জিদে অটল থাকত এবং চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত’ (নূহ ৭১/৬-৯)। এক সময় কওমের সর্দাররা লোকদের ডেকে বলল, (খবরদার!) ‘তোমরা তোমাদের পূর্ব পুরুষদের পূজিত উপাস্য ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূস, ইয়াঊক্ব, নাসর-কে কখনোই পরিত্যাগ করবে না’। (এভাবে) ‘তারা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করে এবং (তাদের ধনবল ও জনবল দিয়ে) নূহ-এর বিরুদ্ধে ভয়ানক সব চক্রান্ত শুরু করে’ (নূহ ৭১/২১-২৩)।
কওমের অবিশ্বাসী নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য নূহ আ.-এর বিরুদ্ধে পাঁচটি আপত্তি উত্থাপন করেছিল।
(১) আপনি তো আমাদের মতই একজন মানুষ। নবী হ’লে তো ফেরেশতা হতেন।
(২) আপনার অনুসারী হলো আমাদের মধ্যকার হীন ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা
(৩) কওমের উপরে আপনাদের কোন প্রাধান্য পরিদৃষ্ট হয় না।
(৪) আপনার দাওয়াত আমাদের বাপ-দাদাদের রীতি বিরোধী
(৫) আপনি আসলে নেতৃত্বের অভিলাষী। অতএব আপনাকে আমরা মিথ্যাবাদী মনে করি।
অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো একই প্রায় একই অভিযোগ করা হয়েছে রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধেও। শুধু তাই নয় আজকেও আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ করি আমাদের বিরুদ্ধেও প্রথমটি ছাড়া বাকী অভিযোগগুলো জারি রয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা নূহ আ.-কে সাড়ে নয়শত বছরের সুদীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। তিনি এক পুরুষের পর দ্বিতীয় পুরুষকে অতঃপর তৃতীয় পুরুষকে শুধু এই আশায় দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন যে, তারা ঈমান আনবে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্লান্তভাবে দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও তারা ঈমান আনেনি। মূলতঃ এই সময় নূহ (আঃ)-এর কওম জনবল ও অর্থবলে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সংখ্যাধিক্যের কারণে ইরাকের ভূখন্ড ও পাহাড়েও তাদের আবাস সংকুলান হচ্ছিল না।
আল্লাহর চিরন্তন নীতি এই যে, তিনি অবাধ্য জাতিকে সাময়িকভাবে অবকাশ দেন। নূহের কওম সংখ্যাশক্তি ও ধনাঢ্যতার শিখরে উপনীত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তারা নূহ আ.-এর দাওয়াতকে তাচ্ছিল্য ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। নূহ আ. তাদেরকে দিবারাত্রি দাওয়াত দেন। কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অর্থাৎ সকল পন্থা অবলম্বন করে তিনি নিজ কওমকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, এই সুদীর্ঘ দাওয়াতী যিন্দেগীতে তিনি যেমন কখনো চেষ্টায় ক্ষান্ত হননি, তেমনি কখনো নিরাশও হননি। সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানাবিধ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েও তিনি ছবর করেন।
কাফির নেতারা বলল, হে নূহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে পাথর মেরে তোমার মস্তক চূর্ণ করে দেওয়া হবে’ (শো‘আরা ২৬/১১৬)। তবুও বারবার আশাবাদী হয়ে তিনি সবাইকে দাওয়াত দিতে থাকেন। আর তাদের জন্য দো‘আ করে বলতে থাকেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার কওমকে ক্ষমা কর। কেননা তারা জানে না।
একদিন নূহ আ. তার জাতির লোকদের ডেকে বললেন,
‘হে আমার জাতি! যদি তোমাদের মাঝে আমার উপস্থিতি ও আল্লাহর আয়াত সমূহের মাধ্যমে তোমাদের উপদেশ দেওয়া ভারি বলে মনে হয়, তবে আমি আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। এখন তোমরা তোমাদের যাবতীয় শক্তি একত্রিত কর ও তোমাদের শরীকদের সমবেত কর, যাতে তোমাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না থাকে। অতঃপর আমার ব্যাপারে একটা ফায়সালা করে ফেল এবং আমাকে মোটেও অবকাশ দিয়ো না’। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। তবে জেনে রেখ, আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় কামনা করি না। আমার বিনিময় কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। আর আমার প্রতি নির্দেশ রয়েছে যেন আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হই’। ‘কিন্তু তারপরও তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো’ (ইউনুস ১০/৭১-৭৩)।
এরপর আল্লাহ তায়ালা ওহী নাযিল করে বলেন, তোমার কওমের যারা ইতিমধ্যে ঈমান এনেছে, তারা ব্যতীত আর কেউ ঈমান আনবে না। অতএব তুমি ওদের কার্যকলাপে বিমর্ষ হয়ো না’ (হূদ ১১/৩৬)। এভাবে আল্লাহর ওহী মারফত তিনি যখন জেনে নিলেন যে, এরা কেউ আর ঈমান আনবে না। বরং কুফর, শিরক ও পথভ্রষ্টতার উপরেই ওরা দৃঢ় থাকবে।
তখন তিনি প্রার্থনা করলেন,
হে আমার পালনকর্তা! আমাকে সাহায্য কর। কেননা ওরা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছে। অতএব তুমি আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথী মুমিনদেরকে তুমি (ওদের হাত থেকে) মুক্ত করো। তিনি আরো দোয়া করেন, হে প্রভু! পৃথিবীতে একজন কাফের গৃহবাসীকেও তুমি ছেড়ে দিয়ো না। যদি তুমি ওদের রেহাই দাও, তাহলে ওরা তোমার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করবে এবং ওরা কোন সন্তান জন্ম দিবে না পাপাচারী ও কাফের ব্যতীত।
বলা বাহুল্য, নূহ (আঃ)-এর এই দো‘আ আল্লাহ সাথে সাথে কবুল করেন। এ বিষয়ে সূরা হূদে ৩৭ থেকে ৪৮ আয়াত পর্যন্ত এই ১২টি আয়াত নাযিল হয়েছে। চূড়ান্ত গযব আসার পূর্বে আল্লাহ নূহ (আঃ)-কে বললেন,
//তুমি আমার সম্মুখে আমারই নির্দেশনা মোতাবেক একটা নৌকা তৈরী কর এবং জালেমদের ব্যাপারে আমাকে কোন কথা বলো না। অবশ্যই ওরা ডুবে মরবে’। ‘অতঃপর নূহ নৌকা তৈরী শুরু করলো। তার কওমের নেতারা যখন পাশ দিয়ে যেত, তখন তারা তাকে বিদ্রুপ করত। নূহ তাদের বলল, তোমরা যদি আমাদের উপহাস করে থাক, তবে জেনে রেখো তোমরা যেমন আমাদের উপহাস করছ, আমরাও তেমনি তোমাদের উপহাস করছি। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে লাঞ্ছনাকর আযাব কাদের উপরে আসে এবং কাদের উপরে নেমে আসে চিরস্থায়ী গযব।
আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং চুলা উদ্বেলিত হয়ে উঠল, (অর্থাৎ রান্নার চুলা হ’তে পানি উথলে উঠলো), তখন আমি বললাম, সর্বপ্রকার জোড়ার দুটি করে এবং যাদের উপরে পূর্বেই হুকুম নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাদের বাদ দিয়ে তোমার পরিবারবর্গ ও সকল ঈমানদারগণকে নৌকায় তুলে নাও। বলা বাহুল্য, অতি অল্প সংখ্যক লোকই তার সাথে ঈমান এনেছিল। নূহ তাঁদের বলল, তোমরা এতে আরোহণ কর। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি। নিশ্চয়ই আমার প্রভু অতীব ক্ষমাশীল ও দয়াবান। অতঃপর নৌকাখানি তাদের বহন করে নিয়ে চলল পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গমালার মাঝ দিয়ে। এ সময় নূহ তার পুত্রকে (ইয়ামিনকে) ডাক দিল- যখন সে দূরে ছিল, হে বৎস! আমাদের সাথে আরোহণ করো, কাফেরদের সাথে থেকো না। সে বলল, অচিরেই আমি কোন পাহাড়ে আশ্রয় নেব। যা আমাকে প্লাবনের পানি হতে রক্ষা করবে। নূহ বললো, আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কারো রক্ষা নেই, একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন সে ব্যতীত।
এমন সময় পিতা-পুত্র উভয়ের মাঝে বড় একটা ঢেউ এসে আড়াল করল এবং সে ডুবে গেলো। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হলো, হে পৃথিবী! তোমার পানি গিলে ফেল (অর্থাৎ হে প্লাবনের পানি! নেমে যাও)। হে আকাশ! ক্ষান্ত হও (অর্থাৎ তোমার বিরামহীন বৃষ্টি বন্ধ কর)। অতঃপর পানি হ্রাস পেল ও গযব শেষ হলো। ওদিকে জুদি পাহাড়ে গিয়ে নৌকা ভিড়লো এবং ঘোষণা করা হলো, যালেমরা নিপাত যাও’। ‘এ সময় নূহ তার প্রভুকে ডেকে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার পুত্র তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, আর তোমার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য, আর তুমিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফায়ছালাকারী।
আল্লাহ বললেন, হে নূহ! নিশ্চয়ই সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চয়ই সে দুরাচার। তুমি আমার নিকটে এমন বিষয়ে আবেদন করো না, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যেন জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। নূহ বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার অজানা বিষয়ে আবেদন করা হতে আমি তোমার নিকটে পানাহ চাচ্ছি। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর ও অনুগ্রহ না কর, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। বলা হলো, হে নূহ! এখন (নৌকা থেকে) অবতরণ করো আমাদের পক্ষ হতে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সহকারে তোমার উপর ও তোমার সঙ্গী দলগুলির উপর এবং সেই (ভবিষ্যৎ) সম্প্রদায়গুলির উপর- যাদেরকে আমরা সত্বর সম্পদরাজি দান করব। অতঃপর তাদের উপরে আমাদের পক্ষ হতে মর্মান্তিক আযাব স্পর্শ করবে।//
এখানে উল্লেখ্য যে খুব সম্ভবত নূহ আ. -এর জাতির লোকেরা নৌকা সম্পর্কে ধারণা রাখতো না। অর্থাৎ নূহ আ. জানতেন না নৌকা কী? এবং এটা কীভাবে বানাতে হয়। তাই নূহ আ.-কে বলা হয়েছে আমাদের নির্দেশনা মোতাবেক নৌকা বানাও। মুফাসসীররা নানান বর্ণনা থেকে দাবী করেন স্বয়ং জীবরাঈল আ.-এর নির্দেশনায় মুসলিমরা নূহ আ.-এর নেতৃত্বে নৌকা তৈরি করে। আর এই আজব জিনিস দেখে কাফিররা উপহাস ও ব্যঙ্গ করতো মুসলিমদের।
নূহ আ. অনুসারী কতজন ছিলো তা নিয়ে কুরআন কিছু বলে না। আল্লাহ বলেন, তারা ছিল অতি নগণ্য। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে ইবনে আব্বাস রা. দাবি করেন তাদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ জন পুরুষ ও চল্লিশ জন নারী। প্লাবনের পর মসুল নগরীর যে স্থানটিতে তারা আবার বসবাস শুরু করেন তার নাম হয় সামানুন বা আশি।
এখানে জুদি পাহাড়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ পাহাড়টি আজও ঐ নামেই পরিচিত। এর অবস্থান এখন তুরস্কে। তুরস্ক ও ইরাক সীমান্তে মসুলের পাশে এটি অবস্থিত। বস্তুত এটি একটি পবর্তমালার অংশ বিশেষের নাম। এর অপর এক অংশের নাম ‘আরারাত’ পর্বত। প্রাচীন ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইরাকের বিভিন্ন স্থানে উক্ত কিশতীর ভগ্ন টুকরা সমূহ অনেকের কাছে সংরক্ষিত আছে। যা বরকত মনে করা হয় এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যধিতে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মতো যে, নূহের পুত্র কাফিরদের দলভুক্ত হওয়ায় মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু নূহের স্ত্রী সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি। ইবনে কাসির বলেন, এতে স্পষ্ট হয় যে, তিনি আগেই মারা গিয়েছিলেন। তিনি গোপনে কুফরি পোষণ করতেন ও কাফিরদের সমর্থন করতেন। নূহের স্ত্রী ও লূত্বের স্ত্রী স্ব স্ব সঙ্গীর নবুয়াতের উপরে বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে খেয়ানত করেছিল বলে স্বয়ং আল্লাহ অন্য সূরায় বর্ণনা করেছেন। নবীদের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কুফরির কারণে তারা জাহান্নামবাসী হয়েছেন। সম্ভবত মহাপ্লাবনের সময় নূহের স্ত্রী জীবিত ছিলেন না। সেকারণ গযবের ঘটনা বর্ণনায় কেবল পুত্র ইয়ামিনের কথা এসেছে। কিন্তু তার মায়ের কথা আসেনি।
যাই হোক এভাবে নূহ আ. এর জাতি ধ্বংস হলো। পৃথিবী আবার ঈমানদার পদচারণায় মুখরিত হলো। নূহ আ. এর সন্তানেরা ঈমানের সাথে সারা পৃথিবী আবাদ করলেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন