সাইয়্যেদ মুনাওয়ার ছিলেন পাকিস্তান জামায়াতের সাবেক আমীর। যে বছর জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয় সে বছরই দিল্লীতে জন্ম নেন সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান। এরপর সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় পাকিস্তানের করাচিতে চলে আসে তার পরিবার। মাধ্যমিক থেকেই মুনাওয়ার যুক্ত হয়েছেন সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের সাথে। তার ধ্যান জ্ঞান ছিলো কার্ল মার্ক্স, লেনিন এবং তাদের আদর্শ।
ছোটবেলা থেকে পড়ুয়া ও মেধাবী মুনাওয়ার যুক্ত ছিলে পাকিস্তানের বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফোরামের (এনএসএফ) সাথে। ১৯৫৯ সালে তিনি করাচি এনএসএফের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু তার পরের বছরই ঘটে যায় উল্টো ঘটনা। তরুণ মুনাওয়ারের কাছে এসে পড়ে মাওলানা মওদূদী ও নঈম সিদ্দিকীর কিছু বই। বইগুলো পড়ে ব্যকুল হয়ে পড়েন সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসান। নিজের মুসলিম পরিচয় তার কাছে আবার নতুনভাবে ধরা পড়ে।
১৯৬০ সালে তিনি তার বামপন্থী আদর্শ ত্যাগ করেন। ঈমান বিধ্বংসী রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে যুক্ত হন ইসলামের সুমহান আদর্শে। নতুনভাবে তৈরি করেন নিজেকে। মেধাবী মুনাওয়ার হাসান অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন আদর্শকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। শুধু তাই নই ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য যোগ দেন ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন ইসলামী জমিয়তে তালাবাতে।
এর চার বছর পর মুনাওয়ার হাসান পাকিস্তান ইসলামী জমিয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে তিনি তার দক্ষতা ও যোগ্যতার সুস্পষ্ট ছাপ অংকন করেন। ধারাবাহিকভাবে ইসলামী আন্দোলনে ভূমিকা রেখে ২০০৯ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান আমীরে জামায়াত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত শুক্রবার অর্থাৎ ২৬ জুন ২০২০ সালে তিনি মহান প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়ে এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে যান।
জন্ম ও শৈশব
সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান জন্মগ্রহণ করেন ভারতের দিল্লীতে। ১৯৪১ সালের ৫ আগস্টে মুনাওয়ার হাসান জন্ম নেন। তার শিশুবেলাতেই তিনি তার পরিবারের সাথে ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যান। এটা ছিল দেশ ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সময়ের ঘটনা। সেসময়ের পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতেই তার পরিবার সেটেল হয়। তার শৈশব ও শিক্ষাজীবন সবই কাটে করাচিতে।
পড়াশোনা
পড়াশোনায় আগ্রহী ও মেধার সাক্ষর রাখেন সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান। তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুইটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার প্রথম বিষয় ছিলো সমাজবিজ্ঞান। পরে ইসলামী আদর্শে পরিবর্তিত হওয়ায় ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি জ্ঞান হাসিল করার উদ্দেশ্যে তিনি ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করেন। এছাড়াও তিনি ভার্সিটিতে একজন ভালো বক্তা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। একইসাথে তিনি ভালো বিতার্কিকও ছিলেন।
ছাত্র রাজনীতি
স্কুল জীবন থেকেই মুনাওয়ার হাসান বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৫৭ সালে এনএসএফের নেতা হিসাবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি এনএসএফের করাচি'র সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে ১৯৬০ সালে তিনি আদর্শিক মোড় নিয়ে ইসলামী জমিয়তে তালাবাতে যোগ দেন।
১৯৬৭ সালে মূলধারার জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান না করা পর্যন্ত তিনি ইসলামী জমিয়তে তালাবার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে জমিয়তে তালাবার করাচি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। এর পরের বছর তিনি জমিয়তে তালাবার করাচি শাখার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান ইসলামী জমিয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি পর পর তিন বছর একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তানের ছাত্রদের কাছে ও ইসলামপ্রিয় জনতার কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। করাচির লোকেরা তাকে ভালোবেসে দিল্লিওয়ালা ভাই ও মুন্নু ভাই নামে ডাকতো।
জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পন
১৯৬৭ সালে মুনাওয়ার হাসান জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানে মাধ্যমে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে জাতীয় নির্বাচনে করাচির একটি আসন থেকে জামায়াতের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান তার আসন থেকে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কিন্তু এরপর সামরিক শাসন জারি করে এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা হয়।
১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মুনাওয়ার হাসান জামায়াতের করাচি শাখার আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারি সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সেসময় পাকিস্তানের আমীরে জামায়াত ছিলেন কাজী হুসাইন আহমদ। সেসময় থেকে মুনাওয়ার হাসান করাচি থেকে জামায়াতের সদর দপ্তর লাহোরে চলে আসেন। এরপর ২০০৯ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াতের ৪র্থ আমীর হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
সাদাসিদে জীবনযাপন
সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান তার প্রথম জীবনে একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর ইসলামিক রিচার্স একাডেমিতে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি রিচার্স একাডেমির সেক্রেটারি হন। এছাড়াও তিনি নানান সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন। সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে তিনি স্থায়ীভাবে তার পেশাগত কাজ করতে পারেন নি। শেষদিকে জামায়াত কর্তৃক নির্ধারিত সামান্য ভাতাই ছিল তার জীবিকার উৎস। কয়েক দশক ধরে তিনি করাচিতে জামায়াত নেতা নেয়ামতুল্লাহ খানের বাড়ির দুটি রুম নিয়ে থাকতেন।
তার স্ত্রী আয়েশা মুনাওয়ারও পুরোদস্তুর জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি মহিলা শাখার সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুনাওয়ার হাসান এতোটাই অনাড়ম্বর ছিলেন যে, তার মেয়ের বিয়েতে পাওয়া সমস্ত উপহার বায়তুল মালে জমা করে দিয়েছিলেন। পরহেজগারীতা ও আমানতদারীতায় তার মতো মানুষ দুনিয়ায় খুবই নগণ্য। তিনি তার সমগ্র জীবনে রাজনীতির চাইতে আদর্শকে বেশি প্রাধান্য দিতেন।
হাসিনার জুলুমের ব্যাপারে তৎপরতা
২০১৩ সালে পাকিস্তানের আমীরে জামায়াত ছিলেন সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান। তিনি সেসময় আমাদের ওপর হাসিনার জুলুমের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের আদেশের তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর উচিত বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। একই সাথে তিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের বিচারের সমালোচনা করে বলেন, এগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তাঁর মতে, যে কোন মুসলিম দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্যান্য মুসলিম দেশের আছে।
তিনি বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের ওপর জুলুমের ব্যাপারে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন। আমাদের দুর্দশার খবর সারা পৃথিবীর মুসলিম নেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান আন্তর্জাতিক মিডিগুলোতে বলেছেন, বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, এবং সে ’কারণে তারা জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করতে চায়। তিনি বলেন, জামায়াতকে সাহায্য করার জন্য অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। তিনি অর্থনৈতিক চাপের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এখানে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে কিছু নেই। বিশেষ করে সৌদি আরব এবং তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
মুসলিম ভাইরা সব কিছুই করতে পারবে। বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম রাষ্ট্র, তাই অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো সব কিছুই করতে পারে। তবে বাংলাদেশে শুধু জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ করে হাইকোর্টের আদেশই নয়, পাকিস্তান জামায়াত প্রধান মনে করেন চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ এবং সেটা শুরু করাই উচিত ছিল না। তিনি দাবি করেন সত্তর দশকের শুরুর দিকে, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার প্রধান, অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিলো। ‘’চুক্তিতে বলা হয়েছিলো, কোন যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে না, বা কোথাও কোন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে না।
কিন্তু পাকিস্তান সরকার এখনো কোন উচ্চ-বাচ্য করছে না, তারা বাংলাদেশ সরকারকে এই চুক্তি সম্পর্কে মনে করিয়ে দিচ্ছে না। পাকিস্তান সরকারের এই ভূমিকা নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসান বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের জন্যই লড়াই করেছিল, কিন্তু এখন ইসলামাবাদ সরকারের নীরব ভূমিকায় জনগণ ক্ষুব্ধ। পাকিস্তানের জনগণ এটা নিয়ে মোটেই খুশি না। যখন যুদ্ধ চলছিল, ঐ দেশ বাংলাদেশ ছিল না, পূর্ব পাকিস্তান ছিল। কাজেই যারা পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করছিল, তারা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সঠিক কাজই করছিল।
সাইয়্যেদ মুনাওয়ার হাসানের মতে, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সমর্থনে পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনীর সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত ছিল। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমির মনে করেন বাংলাদেশে জনমত যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিপক্ষে চলে গেছে। তবে তাঁর মতে, ১৯৭১ সালে সংঘটিত কোন অপরাধের বিচার করার অধিকার বাংলাদেশ সরকারের নেই।
ইন্তেকাল
তিনি দীর্ঘদিন যাবত জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সবশেষে চলমান মহামারী কোভিড-১৯-এ তিনি আক্রান্ত হন। ২৬ জুন শুক্রবার পবিত্র দিলে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন