সমস্যার সূত্রপাত হুদায়বিয়া সন্ধির সময় থেকে। সন্ধির একটি শর্ত ছিলো মুসলিমদের বিপক্ষে। কুরাইশরা নিজেদের লোকদের মুসলিম হওয়া ঠেকানোর জন্য একটি শর্ত দিয়েছিল। মক্কা থেকে কেউ যদি মদিনায় যায় তবে তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে মদিনা। এর মাধ্যমে তারা চেয়েছিলো তাদের লোকদের মুসলিম হওয়া ঠেকাতে। কারণ এর ফলে কেউ মুসলিম হয়ে মদিনায় আশ্রয় পাওয়ার জন্য যেতে পারবে না। এই শর্তের প্রথম শিকার আবু জান্দাল রা.। তিনি তার পিতার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য রাসূল সা.-এর কাছে এসেছেন। রাসূল সা. বেদনা নিয়ে শর্তানুসারে তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। তখন আবু জান্দাল মক্কায় ফিরে না গিয়ে জেদ্দার পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে ঘাঁটি করে অবস্থান নিয়েছিল। তাঁর সাথে আরো কিছু নতুন মুসলিম মক্কা থেকে পালিয়ে যোগ দেন। তারা একের পর এক কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করে তছনছ করে দেন। পরে বাধ্য হয়ে কুরাইশরা তাদেরকে মদিনায় ফিরিয়ে নিতে রাসূল সা.-কে অনুরোধ করেন।
যাই হোক পুরুষরা তো নিজেদের একটা গতি করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু মক্কা থেকে চলে আসা মহিলাদের ব্যাপারে কী হবে? সর্বপ্রথম উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা হিজরত করে মদীনায় এসে পৌছলেন ৷ কাফেররা চুক্তির কথা বলে তাকেও ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাল। উম্মে কুলসূমের দুই ভাই ওয়ালিদ ইবনে উকবা এবং উমারা ইবনে উকবা তাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মদিনায় হাজির হলো। তখন এ মর্মে প্রশ্ন দেখা দিল যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি নারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে কি না?
চুক্তিতে উল্লেখ ছিলো "আমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কোন পুরুষ যদি আসে আর সে যদি তোমাদের ধর্মের অনুসারীও হয় তাহলেও তোমারা তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে"। কুরাইশদের পক্ষে চুক্তির লেখক সুহাইল ইবনে আমর রা. (পরে মুসলিম হয়েছেন) হয়তো 'রাজুল' শব্দটি ব্যক্তি অর্থে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু যেহেতু চুক্তিপত্রে রাজুল শব্দটিই লেখা হয়েছিল, আরবী ভাষায় যা পুরুষদের বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই উম্মে কুলসুম বিনতে উকবার প্রত্যার্পণের দাবি নিয়ে তার ভাই মদিনায় আসলে আল্লাহর নির্দেশে তাকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন মুহাম্মদ সা.। এই ঘটনার আগ পর্যন্ত কুরাইশরাও এই ভুল ধারণার মধ্যে ছিল যে, নারী -পুরুষ নির্বিশেষে সব ধরনের মুহাজিরদের বেলায় এ চুক্তি প্রযোজ্য। কিন্তু নবী সা. যখন চুক্তির এই শব্দের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তখন তারা হতবাক ও লা-জওয়াব হয়ে গেল এবং বাধ্য হয়েই তারা রাসূল সা. এই সিন্ধান্ত মেনে নিলো।
এই বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সূরা মুমতাহিনার ১০ নং আয়াতে বলেন,
// হে ঈমানদাররা, ঈমানদার নারীরা যখন হিজরত করে তোমাদের কাছে আসবে তখন তাদের ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নাও। তাদের ঈমানের প্রকৃত অবস্থা অবশ্য আল্লাহই ভাল জানেন। অতঃপর যদি তোমরা বুঝতে পারো যে, তারা সত্যিই ঈমানদার তাহলে তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। না তারা কাফেরদের জন্য হালাল, না কাফেররা তাদের জন্য হালাল। তাদের কাফের স্বামীরা তাদেরকে যে মোহরানা দিয়েছে তা তাদের ফিরিয়ে দাও। তাদেরকে মোহরানা দিয়ে বিয়ে করায় তোমাদের কোনো গুনাহ হবে না। আর তোমরা নিজেরাও কাফের নারীদেরকে নিজেদের বিয়ের বন্ধনে আটকে রেখো না। নিজেদের কাফের স্ত্রীদের তোমরা যে মোহরানা দিয়েছ তা ফেরত চেয়ে নাও। আর কাফেররা তাদের মুসলমান স্ত্রীদের যে মোহরানা দিয়েছে তাও যেন তারা ফেরত চেয়ে নেয়। এটি আল্লাহর নির্দেশ। তিনি তোমাদের সবকিছুর ফায়সালা করেন। আল্লাহ জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।//
এই আয়াতে আল্লাহ তা'আলা প্রথম নির্দেশ দিয়েছেন, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করে আসবে এবং তাদের ঈমানদার হওয়ার কথা প্রকাশ করবে তাদেরকে জিজ্ঞেসাবাদ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হও যে, প্রকৃতই তারা ঈমান গ্রহণ করে এখানে চলে এসেছে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আর তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। আল্লাহ তা'আলার এ নির্দেশ কার্যকরী করার জন্য যে নিয়ম চালু করা হয়েছিল তা হলো, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করলে মদীনায় চলে আসত তাদেরকে এ মর্মে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো যে, তারা সত্যিই আল্লাহর একত্ব এবং মুহাম্মাদ সা.এর রিসালাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে কিনা এবং কেবল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্যই হিজরত করেছে কিনা?
ব্যাপারটা এমন নয়তো যে স্বামীর প্রতি বিরূপ ও বিরক্ত হয়ে রাগে বা অভিমানে ঘর ছেড়ে চলে এসেছে? কিংবা আমাদের এখানকার কোন পুরুষের প্রতি তার ভালবাসা ও অনুরাগ তাকে নিয়ে এসেছে? কিংবা অন্য কোন পার্থিব স্বার্থ তার এ কাজের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে? যেসব স্ত্রীলোকেরা এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারত শুধু তাদেরকেই থাকতে দেয়া হতো এবং অবশিষ্ট সবাইকে ফিরিয়ে দেয়া হতো।
দ্বিতীয় যে নির্দেশনাটি এই আয়াত থেকে পাওয়া যায় তা হলো, কাফিরদের সাথে মুমিনের বিবাহ জায়েজ নেই। যে বিবাহিতা নারী মুসলমান হয়ে দারুল কুফর থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামের আসে তার বিবাহ বন্ধন আপনা থেকেই ছিন্ন হয়ে যায়। কোনো পুরুষ লোক মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর তার স্ত্রী যদি কাফেরই থেকে যায় তাহলে ঐ স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে আটকে রাখা তার জন্য জায়েয নয়। আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও কাফেরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম ঘোষণা করেছেন।
একই আয়াত থেকে আমরা তৃতীয় যে নির্দেশনাটি পাই তা হলো, দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের মধ্যে যদি সন্ধি চুক্তি বর্তমান থাকে তাহলে কাফেরদের যেসব বিবাহিত স্ত্রী হিজরত করে দারুল ইসলামে চলে এসেছে মুসলমানদের পক্ষ থেকে তাদের প্রাক্তন স্বামীকে মোহরানা ফিরিয়ে দেয়া এবং মুসলমানদের সাথে বিবাহিত যেসব কাফের স্ত্রী দারুল কুফরে রয়ে গিয়েছে তাদেরকে প্রদত্ত মোহরানা কাফেরদের পক্ষ থেকে ফিরে পাওয়ার জন্য ইসলামী সরকারকে দারুল কুফরের সরকারের সাথে বিষয়টির ফায়সালা করার চেষ্টা করতে হবে।
বিবাহ ছিন্ন হওয়া ও মোহরানা ফিরিয়ে দেওয়া ছিলো আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহর এই নির্দেশ মানতে মুসলিমরা যেমন বাধ্য তেমনিভাবে মোটেই বাধ্য নয় মক্কার মুশরিকরা। তাই কাফির স্ত্রীদের থেকে মোহরানা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না মোটেই। এর সমাধানে আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী আয়াত অর্থাৎ মুমতাহিনার ১১ নং আয়াতে বলেন,
//তোমাদের কাফের স্ত্রীদেরকে দেয়া মোহরানার অংশ যদি তোমরা ফেরত না পাও এবং পরে যদি তোমরা সুযোগ পেয়ে যাও তাহলে যাদের স্ত্রীরা ওদিকে রয়ে গিয়েছে তাদেরকে দেয়া মোহরানার সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দাও। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছো তাকে ভয় করে চলো।//
আল্লাহর নির্দেশে মুসলিমরা মক্কার কুরাইশদের সাথে বিষয়টির ফায়সালা এভাবে করতে চাইছিল যে, যেসব স্ত্রীলোক হিজরত করে মদিনায় চলে এসেছে আমরা তাদের মোহরানা ফিরিয়ে দেব। আর আমাদের লোকদের যেসব কাফের স্ত্রী ওদিকে রয়ে গিয়েছে তোমরা তাদের মোহরানা তোমরা ফিরিয়ে দাও।
কিন্তু তারা এ প্রস্তাব গ্রহণ করলো না। অতএব মুসলিমরা এই আয়াতে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে এই সমস্যার সমাধান করলো। মক্কা থেকে আগত নারীদের মোহরানা মক্কায় ফেরত না পাঠিয়ে রাষ্ট্রের ফান্ডে জমা করা হলো। আর সেখান থেকে যাদের স্ত্রী মক্কায় থেকে গিয়েছে তাদেরকে পাওনা মোহরানা ফেরত দেয়া হলো। এরপরেও যদি মুসলিম পুরুষেরা সবাই মোহরানা ফেরত না পায় তবে যুদ্ধলব্ধ গনিমত থেকে তাদের মোহরানা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে এমন অনেক পুরুষ ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের স্ত্রীরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। আবার এমন অনেক স্ত্রীলোকও ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের স্বামীরা ইসলাম গ্রহণ করেনি। স্বয়ং রসূলুল্লাহ সা.-এর এক মেয়ে হযরত যয়নবের রা.-এর স্বামী আবুল আস ছিলেন অমুসলিম এবং কয়েক বছর পর্যন্ত অমুসলিমই রয়ে গিয়েছিলেন।
মুসলমান নারীদের জন্য তাদের কাফের স্বামী এবং মুসলমান স্বামীদের জন্য তাদের মুশরিক স্ত্রী হালাল নয় এমন কোন নির্দেশও ইসলামের প্রাথমিক যুগে হয়নি। তাই তাদের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক অব্যহত ছিল। হিজরাতের পরেও কয়েক বছর পর্যন্ত এ অবস্থা বিদ্যমান ছিল। এ সময় কিছু সংখ্যক নারী মুসলমান হওয়ার পর হিজরাত করে চলে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাফের স্বামীরা মক্কায় থেকে গিয়েছিল।
আবার বহু সংখ্যক মুসলমান পুরুষ হিজরত করে চলে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাফের স্ত্রীরা দারুল কুফরেই রয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাদের বিবাহ বন্ধন অবশিষ্ট ছিল। এতে বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছিল। কারণ, পুরুষ তো দ্বিতীয় বিয়েও করতে পারে। কিন্তু মহিলাদের জন্য তা সম্ভব ছিল না। পূর্ব স্বামীর সাথে তার বিয়ে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সে অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত না। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর এসব আয়াত নাযিল হলে মুসলমান এবং কাফের ও মুশরিকদের মধ্যকার পূর্বের দাম্পত্য সম্পর্ক বাতিল করে দেয়া হয় এবং মুসলিমদের জন্য একটা অকাট্য ও সুষ্পষ্ট আইন তৈরী করে দেয়া হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন