১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সাঁড়াশি আক্রমনের চাপে মিত্রশক্তির অন্যতম সদস্য ব্রিটেন নাজেহাল হয়ে পড়ে। একইসাথে একই বছরের শেষদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং তা আমাদের উপমহাদেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জাপানের হাতে বৃটেন ও তার মিত্রশক্তির দুর্গ সিংগাপুরের পতন ঘটে। এর কিছুদিন পর জাপান মিয়ানমার ঘিরে ফেলে। চট্টগ্রাম বন্দর, কোলকাতা বন্দর জাপানির আক্রমনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই বৃটেন ও তার শত্রুকে একই চোখে দেখতেন। গান্ধী বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দুষ্কর্মের শাস্তিস্বরূপ ভগবান হিটলারকে পাঠিয়েছেন। কংগ্রেস মনে করতো যুদ্ধে বৃটেন কোণঠাসা হয়ে পড়লে তার থেকে বেশী বেশী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যাবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জয় করে জাপান বার্মার ভিতর দিয়ে দ্রুত ভারতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারেন যে, এই সংকটের সময় ভারতবাসীর সাহায্য ছাড়া ভারতে জাপানকে বাধা দেওয়া যাবে না । আর ভারতে ব্রিটিশ অধিকার রক্ষা করা যাবে না । জাপানি আক্রমণের ফলে উদ্ভূত এই জটিল পরিস্থিতিতে এশিয়ার বিভিন্ন রণাঙ্গনে জাপানি আক্রমণের মোকাবিলা করতে হলে ভারতের সামরিক শক্তি ও সম্পদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ব্রিটিশ সরকারকে ভারত সম্পর্কে নমনীয় মনোভাব নিতে বাধ্য করে । এই সময়ে চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই শেক ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেন্ট উভয়েই ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নীতি পরিবর্তনের অনুরোধ জানান । এরই সঙ্গে সঙ্গে আটলান্টিক সনদে পরাধীন জাতিগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল । সেই অর্থে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ভারতের পক্ষে অনুকূল ছিল ।
সাতই মার্চ ১৯৪২, জাপান বার্মা দখল করে। তার মাত্র চার দিন পর ১১ই মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল হাউস অব কমন্সে গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দানের পর ওয়ার কেবিনেটে কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। সিদ্ধান্তগুলো একটি খসড়া ঘোষণায় সন্নিবেশিত হয়। সেই খসড়া ঘোষণা নিয়ে স্টাফোর্ড ক্রিপস ২৯ শে মার্চ ভারতে আগমণ করেন। খসড়ার ভুমিকায় বলা হয় যে, একটি নতুন ভারতীয় ডমিনিয়ন গঠন এ ঘোষনার উদ্দেশ্য।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মার্চ স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে একগুচ্ছ প্রস্তাব ঘোষণা করেন। তিনি মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর নিচের প্রস্তাবগুলি পেশ করেন:-
ক. যুদ্ধের অবসানে ভারতকে কানাডার মতো অধিরাজ্যের মর্যাদা (Dominion Status) দেওয়া হবে।
খ. যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে এবং সেই সভাকে ভারতের নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হবে।
গ. নতুন সংবিধান কোনো প্রদেশের পছন্দ না হলে সেই প্রদেশ ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সংবিধান রচনা করতে পারবে। ভারতের যে-কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য ইচ্ছে করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও থাকতে পারবে।
ঘ. সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থা বহাল রাখা।
ঙ. প্রদেশগুলোর প্রাদেশিক আইনসভা সংবিধান সভার সদস্যদের নির্বাচন করবে, অন্যদিকে দেশীয় রাজ্যের রাজারা তাঁদের সদস্যদের মনোনীত করবেন ।
চ. নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার নিজের হাতে রাখবে এবং বড়লাটের কার্যনির্বাহক কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা বাতিল করার অধিকার বড়লাটের থাকবে।
ভারতীয়তের প্রতিক্রিয়া
স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বিশেষত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখেন। তিনিটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই এ আলোচনা চলতে থাকে।
এক. প্রস্তাবিত ভারতীয় ইউনিয়নের প্রদেশের যোগদান না করার স্বাধীনতা।
দুই. শাসনতন্ত্র প্রণয়ন পরিষদের দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব এবং
তিন. সত্বর একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠন।
খসড়া ঘোষণার সময় প্রদেশগুলোকে এ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে যে, ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করা থেকে তারা চাইলে বিরত থাকতে পারে। এ সম্পর্কে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়ানক তীব্র। তার ধারণা, এতে ভারতের অখন্ডতার প্রতি চরম আঘাত হানা হবে। তাই তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে কংগ্রেসের দাবী হলো যে, যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। এতে কংগ্রেসের সুবিধা এই যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেসকে সমর্থন করবে। এ ব্যবস্থা কিন্তু মুসলিম লীগ মেনে নিতে পারেনা। কংগ্রেসের জোর দাবী এই কেন্দ্রে সত্বর একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠন করা হোক। এতে মুসলিম লীগ ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে বলে তারা এ দাবী মেনে নিতে পারেনা।
স্টাফোর্ড ক্রিপসের সাথে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট কিছু দিন যাবত পত্র বিনিময় হয়। কিন্তু কংগ্রেসের দাবী মেনে নেয়া হয়নি বলে ১১ই এপ্রিল কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা করে। মুসলিম লীগ তো আগেই ক্রিপস প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। মুসলিম লীগের কথা এই যে, যতক্ষণ না পাকিস্তান প্রস্তাবের মূলনীতি মেনে নেয়া হয়েছে এবং মুসলিম ভারতে সত্যিকার রায় প্রতিফলিত হয় এমন কোন পদ্ধতিতে মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার মেনে নেয়া না হয়েছে, সে পর্যন্ত ভবিষ্যতের কোন প্রস্তাব মুসলিম লীগ মেনে নিতে পারবে না।
ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণ
ক্রিপসের প্রস্তাবগুলো ভারতের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ-
১. ক্রিপসের প্রস্তাবে ব্রিটিশ সরকারের সদিচ্ছার অভাব প্রকাশ পায়, তাই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগসহ ভারতের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই ক্রিপস-এর প্রস্তাব একযোগে প্রত্যাখ্যান করে।
২. এই প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবিকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় অর্থাৎ ক্রিপস প্রস্তাবে দেশ বিভাগের পরোক্ষ ইঙ্গিত থাকায় কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে।
৩. ভারতের প্রতিরক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে ব্রিটিশ সরকার রাজি ছিল না।
৪. ক্রিপস প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারকে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার মতো সম-মর্যাদা ও ক্ষমতা দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।
৫. মুসলিম লীগ ক্রিপস প্রস্তাবে আপাত খুশি হলেও সরাসরি দেশ বিভাগ মেনে না নেওয়ায় তা বর্জন করে । ফলে ক্রিপস তাঁর প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাহার করে দেশে ফিরে যান ।
ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হওয়ারপর কংগ্রেস চরম ব্যর্থতা ও নৈরাশ্যের শিকার হয়। কংগ্রেস চেয়েছিল একটি জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে উপমহাদেশের উপর তার শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে। এ ছিল ভারতীয় মুসলমানদের পদদলিত করে রাখার এক নির্মম দুরভিসন্ধি। যাহোক ব্রিটিশ সরকার তাঁদের স্বার্থেই কংগ্রেসের এ অন্যায় আবদার মেনে নিতে পারেননি। বৃটেন যুদ্ধে হেরে গেছে এটাকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করে গান্ধী ১৯৪০-এর মে মাসে ভাইসরয়কে লিখিত এক পত্রে বলেন, “এ নরহত্যা বন্ধ করতে হবে। তোমরা ত হেরে যাচ্ছ। এরপরও যদি জিদ ধরে থাক, তাহলে অধিকতর রক্তপাত ঘটবে। হিটলার একজন মন্দ লোক নয়। তোমরা আজ যুদ্ধ বন্ধ করলে, সেও তোমাদের অনুসরণ করবে”।
ভাইসরয় এ জবাবে বলেন, আমরা এখন যুদ্ধরত আছি। আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছার পূর্বে আমরা নড়চড় করব না। আমাদের জন্যে আপনার উৎকণ্ঠা বুঝতে পারছি। তবে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। গান্ধী ভাইসরয়ের জবাবে তুষ্ট না হয়ে ৬ই জুলাই প্রত্যেক ইংলন্ডবাসীর প্রতি এক আবেদনে বলেন, অস্ত্র সংবরণ কর। কারণ এ তোমাদের নিজেদেরকে এবং মানবতাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তোমরা হিটলার ও মুসোলিনিকে ডেকে আনবে এবং তারা তোমাদের সব কিছুই কেড়ে নেবে। ঠিক আছে, তাদেরকে তোমাদের মনোরম অট্টালিকাদিসহ তোমাদের সুন্দর দ্বীপ দখল করতে দাও।
ক্রিপসের বেতার ভাষণ
স্টাফোর্ড ক্রিপস ২৬শে জুলাই, আমেরিকাবাসীদের জন্যে তাঁর প্রদত্ত বেতার ভাষণে, তাঁর ভারত ভ্রমণের সময় থেকে সর্বশেষ ভীতিপ্রদর্শন পর্যন্ত কংগ্রেস রাজনীতির পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কোন দায়িত্বশীল সরকার কংগ্রেসের দাবী বিবেচনা করতে পারেননা। কংগ্রেস আধিপত্যের চরমবিরোধী মুসলমানগণ এবং কয়েক কোটি অনুন্নত সম্প্রদায়ও এ দাবী মানতে পারে না। গান্ধীর দাবী মেনে নেয়ার অর্থ চরম অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করা। তিনি আরও বলেন, আমরা একজন কল্পনাপ্রবণকে প্রাচ্যে জাতিসংঘের বিজয় প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতি দিতে পারি না, তিনি অতীতে যতোবড়োই স্বাধীনতা সংগ্রামী থাকুন না কেন।
জওহরলাল নেহরু উক্ত বেতার ভাষণের প্রতিবাদে স্টাফোর্ড ক্রিপসকে ‘শয়তানের উকিল’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বৃটেনে ভারতের যে অনিষ্ট করেছে এবং এখন ও করছে, তার জন্য তার উচিত ছিল অনুতপ্ত হয়ে অতি বিনীতভাবে আমাদের নিকটে আবেদন পেশ করা। মুসলমানদের কংগ্রেস দাবীর বিরোধিতাকে নেহরু প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমার মুসলমান দেশবাসীকে আমি স্টাফোর্ড ক্রিপস অপেক্ষা ভালোভাবে জানি এবং তাদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা অপবাদ মাত্র।
জওহরলাল নেহেরু ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে ভারতীয়দের সমর্থন সংগঠিত করার জন্য জোরালোভাবে মত প্রকাশ করলেও কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ এবং গান্ধী নিজেও এ ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন। ফলে কংগ্রেস-ব্রিটিশ সম্পর্ক তিক্ত হয় এবং অন্যান্য ঘটনা ভারত ছাড় আন্দোলন এর মতো সম্পূর্ণ সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মিশনের ব্যর্থতার জন্য ক্রিপস কংগ্রেসকে দায়ী করে, অন্যদিকে কংগ্রেস এ দায়ভার চাপায় ব্রিটিশ সরকারের ওপর। এভাবে অবিভক্ত স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার একটি বড় সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন