উহুদ যুদ্ধের পরের ঘটনা। একদিন নজদের নেতা আবু বারা আমির বিন মালিক মদিনায় মুহাম্মদ সা.-এর কাছে উপস্থিত হলেন। মুহাম্মদ সা. তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন না আবার প্রত্যাক্ষানও করলেন না। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য একদল সাহাবীগণকে নাজদবাসীদের নিকট প্রেরণ করেন তাহলে তারা আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবে বলে আশা করি।
মুহাম্মদ সা. বললেন, নাজদবাসীদের সম্পর্কে আমি ভয় করছি। তারা যদি সাহাবীদের খুন করে!
আবু বারা তখন বললেন, ‘তারা আমার আশ্রয়ে থাকবেন।’
এরপর রাসূল সা. মুনযির বিন আমিরকে নেতা নিযুক্ত করে ৭০ জনের একটি দল নজদে প্রেরণ করেন। এ সাহাবারা ছিলেন বিজ্ঞ, তিলওয়াতকারী এবং শীর্ষ স্থানীয় আবেদ। তারা দিনের বেলা জঙ্গল থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করে তার বিনিময়ে আহলে সুফফাদের জন্য খাদ্য ক্রয় করতেন ও কুরআন শিক্ষা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। আর রাতের বেলা আল্লাহর সমীপে মুনাজাত ও সালাতের জন্য দণ্ডায়মান থাকতেন। ৭০ জনের সেই কাফেলাটি নজদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে বীর-এ মাউনা নামক কুয়ার নিকট পৌঁছেন। এই কুয়াটি বনু আমির এবং বনু সুলাইমের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল।
সাহাবীগণ উম্মু সুলাইমের ভাই হারাম বিন মিলহানকে রাসূলুল্লাহ সা.-এর পত্রসহ নজদের মুশরিক নেতা আমির বিন তোফাইলের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু পত্রটি পাঠ করা তো দূরের কথা তার ইঙ্গিতে এক ব্যক্তি হারামকে পিছন দিক থেকে এত জোরে বর্শা দ্বারা আঘাত করল যে, দেহের অপর দিক দিয়ে ফুটো হয়ে বের হয়ে গেল। বর্শা-বিদ্ধ রক্তাক্তদেহী হারাম বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর মহান! কাবার প্রভূর কসম! আমি কৃতকার্য হয়েছি।’
এর পরপরই আমির অবশিষ্ট সাহাবাদের আক্রমণ করার জন্য তার গোত্র বনু আমিরকে আহবান জানাল। কিন্তু যেহেতু তারা আবু বারা’র আশ্রয়ে ছিলেন সেহেতু তারা সেই আহবানে সাড়া দিল না। এদিক থেকে সাড়া না পেয়ে সে বনু সুলাইমকে আহবান জানাল। বুন সুলাইমের তিনটি গোত্র এ আহবানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ সাহাবীদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। প্রত্যুত্তরে সাহাবারা যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং একজন বাদে সকলেই শাহাদত বরণ করলেন। কেবলমাত্র কা‘ব বিন যায়দ রা. জীবিত ছিলেন।
এছাড়াও আরও দু’জন সাহাবী একটু দূরে আমর বিন উমাইয়া যামরী রা. এবং মুনযির বিন উক্ববা রা. কাফেলার উট চরাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে তাঁরা পাখি উড়তে দেখে সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। অতঃপর তারা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। মুনযির যুদ্ধ করতে করতে শাহাদতবরণ করেন। আর ‘আমর বিন উমাইয়া রা.-কে বন্দী করা হয়। কিন্তু যখন আমির বিন তোফায়েল অবগত হয় যে, আমর বিন উমাইয়া মুদার গোত্রের তখন তাকে হত্যা না করে ছেড়ে দেয়। কারণ তার মা মুদার গোত্রের একটি দাসকে মুক্ত করার মানত করেছিলেন।
আমর বিন উমাইয়া মদিনায় ফিরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক স্থানে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় তার পাশে আরো দুজন লোক বিশ্রামের জন্য বসলো। তিনি তাদের পরিচয় জেনে নিলেন তারা বনু আমিরের লোক। তিনি প্রতিশোধ নেয়ার নিমিত্তে ঐ দুজনকে হত্যা করেন। যদিও বনু আমিরের নেতা আমির বিন তুফায়েলের নেতৃত্বে সাহাবাদের হত্যা করা হয় কিন্তু বনু আমিরের লোকেরা সেই হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেনি এবং নিরাপত্তাও দেয়নি।
যাই হোক আমর বিন উমাইয়া রাসূলের সা.-এর কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূল সা. যখন শুনলেন বনু আমিরের দুজন লোককে হত্যা করেছে আমর তখন তিনি বললেন তাদের সাথে তো আমাদের নিরাপত্তা চুক্তি আছে। আমর জানালেন তিনি তা জানেন না। তখন রাসূল সা. বনু আমিরের সাথে সম্পর্ক নষ্ট না করার জন্য ঐ দুজনের ব্যাপারে বললেন, তাদের রক্তপণ আমাকে দিতে হবে।
আল্লাহর রাসূল সা. বনু আমিরের সাথে মধ্যস্থতা করার জন্য বনু নাযিরের সহায়তা চাইলেন। কারণ বনু নাযির আর বনু আমিরের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বনু নাযির হলো মদিনার সবচেয়ে শক্তিশালী ইহুদী গোত্র। বনু নাযির মদিনা সনদে সাক্ষর করার মাধ্যমে আল্লাহর রাসূলের রাজনৈতিক মিত্র ছিল। যদিও তারা মিত্র চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল কিন্তু তারা মদিনা রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। একই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল মক্কার কুরাইশরা ও মদিনার মুনাফিকরা। এটা ছিল ত্রিপক্ষীয় ষড়যন্ত্র। এর দায়ে ২য় হিজরিতে বনু নাযিরের নেতা কা'ব বিন আশরাফকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
যাই হোক বনু নাযিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাব বনু আমিরের সাথে আল্লাহর রাসূল সা.-এর মধ্যস্থতা করতে রাজি হয় এবং আল্লাহর রাসূল সা.-কে অপেক্ষা করতে বলেন। রাসূল সা. আবু বকর রা. ও ঊমার রা.সহ আরো কিছু সাহাবী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এদিকে ইহুদী বনু নাযির গোত্র আল্লাহর রাসূল সা.-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু করলো। তারা রাসূল সা.-এর নিকট হতে সরে গিয়ে পরস্পর পরামর্শ করলো, “এর চেয়ে বড় সুযোগে কি আর পাওয়া যাবে? এখন মুহাম্মদ আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে রয়েছেন। এসো তাকে আমরা শেষ করে (হত্যা করে) ফেলি।” তারা পরামর্শক্রমে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, যে দেয়াল ঘেঁষে তিনি বসে আছেন ঐ ঘরের উপর কেউ উঠবে এবং সেখান হতে সে তার উপর একটি বড় পাথর নিক্ষেপ করবে। এতেই তাঁর জীবনলীলা শেষ হয়ে যাবে।
আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কা'ব এই কাজে নিযুক্ত হলো। অতঃপর কার্য সাধনের উদ্দেশ্যে সে ছাদের উপর আরোহণ করলো। ইতিমধ্যে আল্লাহ তা'আলা হযরত জিবরাঈল আ.-কে স্বীয় নবী সা.-এর নিকট পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন সেখান হতে চলে যান। সুতরাং তিনি তৎক্ষণাৎ সেখান হতে উঠে চলে গেলেন, ফলে ঐ ইহুদীরা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলো। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর সাথে তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী ছিলেন। যেমন হযরত আবু বকর রা., হযরত উমার রা., হযরত আলী রা. প্রমুখ। তিনি সেখান হতে সরাসরি মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হন।
রাসূল সা.-এর চলে যাওয়া দেখে সাহাবারা ভেবেছিলেন তিনি হয়তো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে যাচ্ছেন। এদিকে ইহুদিরাও পাথর ফেলে হত্যা করতে এসে দেখে মুহাম্মদ সা. নেই। তারাও মুহাম্মদ সা.-এর ফিরে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সাহাবার মদিনায় ফিরে দেখেন রাসূল সা. মসজিদে নববীতে। তখন মুহাম্মদ সা. ওহীর কথা সাহাবাদের জানান এবং বনু নাযিরের বিশ্বাসভঙ্গ ও মুনাফিকির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন।
তিনি মুহাম্মদ বিন মাসলামাকে ইহুদীদের কাছে পাঠিয়ে বার্তা পাঠান তিনদিনের মধ্যে মদিনা ছেড়ে চলে যেতে নতুবা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। যুদ্ধের ঘোষণা শুনে ইহুদীরা একটুও বিচলিত হয়নি। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল তাদের শক্তিশালী দুর্গগুলো তাদের রক্ষা করবে। আল্লাহর রাসূল সা. তাদের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ এনেছেন তা তারা অস্বীকার করেনি উপরন্তু তারা আল্লাহর রাসূলের সাথে করা চুক্তি ভঙ্গের ঘোষণা করলো।
এদিকে আরেক ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার গোপন আশ্বাস দিলে আল্লাহর রাসূল সা. বনু নাযিরের ওপর অবরোধ বহাল রেখেই বনু কুরাইজার দুর্গগুলোর উদ্দেশ্যে মহড়া দিয়ে আসলেন। মুহাম্মদ সা.-এর এই রূপ দেখে বনু কুরাইজা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নি। আবার মুনাফিকদের মধ্য থেকে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার কথা জানালেও সেও এগিয়ে আসেনি। অবশেষে বনু নাযির আত্মসমর্পন করে।
এই ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে মহান রাব্বুল আলামীন সূরা হাশর নাজিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ২ - ৪ নং আয়াতে বলেন,
//তিনিই আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে প্রথমবার একত্রিত করে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে বহিস্কার করেছেন। তোমরা ধারণাও করতে পারনি যে, তারা বের হবে এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদের দূর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষা করবে। অতঃপর আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর এমনদিক থেকে আসল, যার কল্পনাও তারা করেনি। আল্লাহ তাদের অন্তরে ত্রাস সঞ্চার করে দিলেন। তারা তাদের বাড়ী-ঘর নিজেদের হাতে এবং মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করছিল। অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।
আল্লাহ যদি তাদের জন্যে নির্বাসন অবধারিত না করতেন, তবে তাদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিতেন। আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আযাব। এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।//
এখানে এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি হবে তা ইহুদীরাতো কল্পনা করেনি, মুসলিমরাও ভাবতে পারে নি এত সহজে বনু নাযির আত্মসমর্পন করবে। এখানে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন তারা যদি আত্মসমর্পন না করে, দেশান্তরী না হয়ে যুদ্ধ করতো তবে তাদের জন্য আরো ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করতো। যেমন শাস্তি পেয়েছে খন্দক যুদ্ধের পরে বনু কুরাইজা।
সূরা হাশরের ৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরেকটি প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন যাতে করে মুসলিমরা হীনমন্যতায় না ভুগে। বনু নাযির যাতে দ্রুতই আত্মসমর্পন করে সেজন্য রাসূল সা.-এর নির্দেশে মুসলিম সেনাবাহিনী বনু নাযিরের কিছু খেজুর গাছ কেটে ফেলে। আল্লাহ বলেন,
//তোমরা যে কিছু কিছু খেজুর গাছ কেটে দিয়েছ এবং কিছু না কেটে ছেড়ে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই আদেশ এবং যাতে তিনি অবাধ্যদেরকে লাঞ্ছিত করেন।//
বনু নাযিরের ইহুদীরা সম্পদশালী ছিল। তাদের গর্বের একটি বড় কারণ ছিল তারা অনেক খেজুর বাগানের মালিক। অর্থাৎ তাদের খাদ্যের অভাব হবে না। কিন্তু তারা যখন দেখলো মুহাম্মদ সা. তাদের গাছগুলোর কিছু কিছু কেটে ফেলতে শুরু করেছে তখন তারা বিচলিত হয়ে পড়লো। কারণ তারা জানতো মুসলিমদের যুদ্ধনীতিতে ফসলের গাছ কাটা নিষেধ।
যখন মুসলিম বাহিনী কিছু কিছু খেজুর গাছ নষ্ট করে দিচ্ছিলেন তখন মদিনার মুনাফিকরা ও বনু কুরাইজা এমনকি বনু নাযির গোত্রের লোকও হৈ চৈ করতে শুরু করলো যে, মুহাম্মাদ সা. "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেন; কিন্তু দেখো, তরুতাজা শ্যামল ফলবান গাছ কাটা হচ্ছে ৷ এটি কি "ফাসাদ ফিল আরদ" নয়? এই সময় আল্লাহ তা'আলা এই নির্দেশ নাযিল করেলেন, "তোমরা যেসব গাছ কেটেছো এবং যা না কেটে অক্ষত রেখেছো এর কোন একটি কাজও নাজায়েয নয় ৷ বরং এ উভয় কাজেই আল্লাহর সম্মতি রয়েছে।"
এ থেকে শরীয়াতের এ বিধানটি পাওয়া যায় যে, সামরিক প্রয়োজনে যেসব ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর তৎপরতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা "ফাসাদ ফিল আরদ" বা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টির সংজ্ঞায় পড়ে না ৷ "ফাসাদ ফিল আরদ" হলো কোন সেনাবাহিনীর মাথায় যদি যুদ্ধের ভূত চেপে বসে এবং তারা শত্রুর দেশে প্রবেশ করে শস্যক্ষেত, গবাদি পশু, বাগান, দালানকোঠা, প্রতিটি জিনিসই নির্বিচারে ধ্বংস ও বরবাদ করতে থাকে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে সেটিই সাধারণ বিধান। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, ফসল ধ্বংস করবে না এবং তিনি জনবসতি বিরাণ করবে না।
কুরআনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মানুষদের নিন্দা ও সমালোচনা করতে গিয়ে এ কাজের জন্য তাদের তিরষ্কার ও ভীতি প্রদর্শন করে বলা হয়েছেঃ "যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করে চলে।" (বাকারাহ, ২০৫) হযরত আবু বকরের রা. এর নীতি ছিল কুরআনের এ শিক্ষারই হুবহু অনুসরণ। তবে সামরিক প্রয়োজন দেখা দিলে বিশেষ নির্দেশ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়লে তা করা যেতে পারে।
এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা হাশরের ৬ থেকে ১০ নং আয়াতে বনু নাযির থেকে প্রাপ্ত সম্পদ কীভাবে বন্টিত হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অবরোধের একটা পর্যায়ে যখন বনু নাযির বুঝতে পারলো কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না তখন তারা ভীত হয়ে পড়লো। তারা মুহাম্মদ সা.-এর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো। মুহাম্মদ সা. তাদের প্রাণের নিরাপত্তা দিতে রাজি হলেন এবং মদিনা থেকে তাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে তাদের জানালেন তারা শুধু ততটুকু সম্পদ নিতে পারবে যতটুকু উটের পিঠে বোঝাই করা সম্ভব। তবে কোনো অস্ত্র নেওয়া যাবে না। সব অস্ত্র রেখে যেতে হবে।
বনু নাযির যখন চলে যায় তখন মুসলিমরা অনেক সম্পদ পায়। এই সম্পদ পাওয়ার জন্য মুসলিমদের যুদ্ধ করতে হয় নি। তাই এই সম্পদকে গণিমত না বলে ফাই বলা হয়। গণিমতের বিধান আর ফাইয়ের বিধান একই রকম নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
// আল্লাহ তাদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তজ্জন্যে তোমরা ঘোড়ায় কিংবা উটে চড়ে যুদ্ধ করনি, কিন্তু আল্লাহ যার উপর ইচ্ছা, তাঁর রসূলগণকে প্রাধান্য দান করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান। আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্যে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টিলাভের অন্বেষণে এবং আল্লাহ তাঁর রসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। তারাই সত্যবাদী //
মহান রাব্বুল আলামীন এখানে বিস্তারিত বলে দিয়েছেন ফাইয়ের সম্পদ কীভাবে বন্টিত হবে। রাসূল সা. এই সম্পদ থেকে যৎসামান্য নিজের ও তার পরিবারের জন্য গ্রহণ করেন। এই সম্পদ দেওয়া হয়েছে মূলত মুহাজিরদেরকে যারা তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে মদিনায় এসেছেন। একইসাথে মুহাজিররা এতোদিন আনসারদের যেসব সম্পদ ব্যবহার করতো সেগুলোও আনসার ফেরত দিয়ে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে থাকেন।
এরপর মহান রাব্বুল আলামীন মুনাফিকদের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের জানান। রসূলুল্লাহ সা. যে সময় বনু নযিরকে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সময় দিয়ে নোটিশ দিয়েছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু হতে এখনো কয়েকদিন দেরী ছিল সেই সময় এই আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিলো। রসূলুল্লাহ সা. বনু নাযিরকে এই নোটিশ দিলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং মদীনার অন্যান্য মুনাফিক নেতারা তাদের বলে পাঠালো যে, আমরা দুই হাজার লোক নিয়ে তোমাদের সাহায্য করার জন্য আসবো। আর বনু কুরাইযা এবং বনু গাতফানও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। অতএব তোমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও এবং কোন অবস্থায়ই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো না। তারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো। আর তোমরা এখান থেকে বহিষ্কৃত হলে আমরাও চলে যাব। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতগুলো নাযিল করেছেন।
তিনি হাশরের ১১ থেকে ১৭ নং আয়াতে আব্দুল্লাহ বিন উবাইদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন,
//আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেন নি? তারা তাদের কিতাবধারী কাফের ভাইদেরকে বলে, তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেশ থেকে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা কখনও কারও কথা মানব না। আর যদি তোমরা আক্রান্ত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব। আল্লাহ তা’আলা সাক্ষ্য দেন যে, ওরা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী।
যদি তারা (বনু নযির) বহিস্কৃত হয়, তবে মুনাফিকরা তাদের সাথে দেশত্যাগ করবে না আর যদি তারা আক্রান্ত হয়, তবে তারা তাদেরকে সাহায্য করবে না। যদি তাদেরকে সাহায্য করে, তবে অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করবে। এরপর কাফেররা কোন সাহায্য পাবে না। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর চাইতে তোমাদের বেশি ভয় করে। এটা এ কারণে যে, তারা এক নির্বোধ সম্প্রদায়।
তারা সংঘবদ্ধভাবেও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না। তারা যুদ্ধ করবে কেবল সুরক্ষিত জনপদে অথবা দুর্গ প্রাচীরের আড়াল থেকে। তাদের পারস্পরিক কোন্দল প্রচন্ড হয়ে থাকে। আপনি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ মনে করবেন; কিন্তু তাদের অন্তর শতধাবিচ্ছিন্ন। এটা এ কারণে যে, তারা এক কান্ডজ্ঞানহীণ সম্প্রদায়।
তারা সেই লোকদের মত, যারা তাদের নিকট অতীতে নিজেদের কর্মের শাস্তিভোগ করেছে। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা শয়তানের মত, যে মানুষকে কাফের হতে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলেঃ তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি বিশ্বপালনকর্তা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করি। অতঃপর উভয়ের পরিণতি হবে এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং চিরকাল তথায় বসবাস করবে। এটাই জালেমদের শাস্তি।//
মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করার তাওফিক দান করুন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন