আমাদের মহানবী সা. যাদের খুব ভালোবাসতেন তাদের মধ্যে একজন হলেন তাঁর চাচা আবু তালিব। যদিও তাঁর এই চাচা ইসলামে প্রবেশ করেনি তবুও আবু তালিব যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন মুহাম্মদ সা. তাঁর আশ্রয়েই ছিলেন। আবু তালিব তার দুই হাত প্রসারিত করে ভাতিজা মুহাম্মদ সা. কে আগলে রেখেছেন। এজন্য তিনি অনেক কষ্ট স্বীকারও করেছেন।
যখন হযরত উমার রা. ঈমান আনলেন তখন কুরাইশ নেতারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিল। মুশরিক কুরাইশরা প্রথমেই এ দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে পড়েছিল যে, ইসলামের দাওয়াতের নিয়ে তাদের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি উঠেছেন যিনি নিজের পারিবারিক আভিজাত্য, নিষ্কলংক চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও বিচার বিবেচনার দিক দিয়ে সমস্ত জাতির মধ্যে অদ্বিতীয়। তারপর আবু বকরের মতো লোক তাঁর ডানহাত, যাকে মক্কা ও তার আশপাশের এলাকার প্রত্যেকটি শিশুও একজন অত্যন্ত ভদ্র, বিবেচক, সত্যবাদী ও পবিত্র পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে জানে। এখন যখন তারা দেখলো, উমর ইবনে খাত্তাবের মতো অসম সাহসী ও দৃঢ় সংকল্প ব্যক্তিও এ দু’জনের সাথে মিলিত হয়েছেন তখন নিশ্চিতভাবেই তারা অনুধাবন করতে সক্ষম হলো যে, বিপদ সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। তারা মুহাম্মদ সা.-এর দাওয়াত বন্ধ করার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকলো।
এদিকে চাচা আবু তালিব ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মুশরিক কুরাইশ সরদাররা মনে করলো, এবার বুঝি আবু তালিবের শেষ সময় এসে গেছে। তখন তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো, হয় মুহাম্মদ সা.-এর সাথে তাদের বিবাদ মিটানো হবে নতুবা তাকে শেষ করে দেওয়া হবে। তারা মনে করলো এই বিষয়ে আবু তালিবের কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বলা উচিত। তিনি আমাদের ও তাঁর ভাতিজার বিবাদ মিটিয়ে দিয়ে গেলে ভালো। নয়তো এমন ও হতে পারে, তার মৃত্যু হয়ে যাবে এবং আমরা পরে মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে কোনো কঠোর ব্যবহার করবো। আর আরবের লোকেরা এ বলে আমাদের খোঁটা দেবে যে, যতদিন আবু তালিব জীবিত ছিলেন ততদিন এরা তাকে সমীহ করে চলেছে, এখন তার মৃত্যুর পর তার ভাতিজার গায়ে হাত তুলেছে।
তারা সবাই একমত হলো। আপোষ প্রস্তাব নিয়ে প্রায় ২৫ জন কুরাইশ নেতা আবু তালিবের কাছে গেল। এদের অন্যতম ছিলো আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, উমাইয়াহ ইবনে খালফ, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওযাদ ইবনুল মুত্তালিব, উকাবাহ ইবনে আবী মু’আইত, উতবাহ ও শাইবাহ। তারা যথারীতি প্রথমে আবু তালিবের কাছে মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে নিজেদের অভিযোগ পেশ করলো। তারপর বললো, আমরা আপনার কাছে একটি ইনসাফপূর্ণ আপোষের কথা পেশ করতে এসেছি। আর তা হলো আপনার ভাতিজা আমাদেরকে আমাদের ধর্মের ওপর ছেড়ে দিক আমরাও তাকে তার ধর্মের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। সে যে মাবুদের ইবাদত করতে চায় করুক, তার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্ত সে আমাদের মাবুদদের নিন্দা করবে না এবং আমরা যাতে আমাদের মাবুদদেরকে ত্যাগ করি সে প্রচেষ্টা চালাবে না। এ শর্তের ভিত্তিতে আপনি তার সাথে আমাদের আপোষ করিয়ে দিন।
চাচা আবু তালিব নবী সা.-কে ডাকলেন। তাঁকে বললেন, ভাতিজা! এই যে তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার কাছে এসেছে। তাদের ইচ্ছে, তুমি একটি ইনসাফপূর্ণ আপোষের ভিত্তিতে তাদের সাথে একমত হয়ে যাবে। এভাবে তোমার সাথে তাদের বিবাদ শেষ হয়ে যাবে। তারপর কুরাইশ সরদাররা তাঁকে যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো তিনি মুহাম্মদ সা.-কে বললেন। মুহাম্মদ সা. জবাবে বেশ কৌশলী হয়ে হিকমত সহকারে বললেন, “চাচাজান! আমি তো তাদের সামনে এমন একটি কথা পেশ করছি তা যদি তারা মেনে নেয় তাহলে সমগ্র আরব জাতি তাদের হুকুমের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারবরা তাদেরকে কর দিতে থাকবে।” একথা শুনে প্রথমে তো তারা হতভম্ব হয়ে গেল।
এবার আবু তালিব কুরাইশ নেতাদের বললেন, তোমরা আমার ভাতিজার কথা শুনলে তো আরব ও পৃথিবীর মালিক হয়ে যাবে। তাহলে বলো, মুহাম্মদের প্রস্তাব বেশি ভালো, না তোমরা ইনসাফের নামে যে কথাটি আমার সামনে পেশ করছো সেটি বেশি ভালো? রাসূল সা. আরো বললেন, তোমরা আমার কথাটি মেনে নেবে অথবা যে অবস্থার মধ্যে তোমরা এখন পড়ে রয়েছো তার মধ্যেই তোমাদের পড়ে থাকতে দেবো এবং নিজের জায়গায় বসে আমি নিজের আল্লাহর ইবাদত করতে থাকবো কোনটির মধ্যে তোমাদের কল্যাণ রয়েছে? আমি তো তোমাদের কল্যাণের জন্যই কাজ করছি।
তারা বুঝতে পারছিল না এমন একটি লাভজনক কথার প্রতিবাদ কীভাবে করবে? কাজেই তারা নিজেদের বক্তব্য থেকে সরে এসে বললো, তুমি একটি কথা বলছো কেন, আমরা তো এমন দশটি কথা মানতে রাজি কিন্তু সেই কথাটি কি তাতো একবার বলো। মুহাম্মদ সা. বললেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। একথা শুনেই তারা সবাই একসাথে উঠে দাঁড়ালো এবং সে কথাগুলো বলতে বলতে চলে গেলো যা আল্লাহ সূরা সোয়াদের শুরুতে উদ্ধৃত করেছেন।
সূরা সোয়াদের ৪ থেকে ৮ নং আয়াতে রয়েছে, মুশরিকরা আল্লাহর রাসূল সা. সম্পর্কে বলেছিলো, “এ হচ্ছে যাদুকর, বড়ই মিথ্যুক। সকল প্রভুর বদলে সেকি মাত্র একজনকেই প্রভু বানিয়ে নিয়েছে? এতো বড় বিস্ময়কর কথা! নেতারা একথা বলতে বলতে বের হয়ে গেলো, “চলো, অবিচল থাকো নিজেদের প্রভুদের উপাসনায়। একথা তো (রাসূল সা.-এর প্রস্তাব) বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে। আমরা অতীতের জাতিগুলোর মধ্য থেকে কারো কাছ থেকে তো এ ধরনের কথা শুনিনি। এটি একটি মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মধ্য থেকে কেবল এ ব্যক্তির ওপরই কি আল্লাহর কুরআন নাযিল করা হল?
তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা একই সূরার ৮ থেকে ১১ নং আয়াতে বলেন, আসলে তারা তো আমার কুরআন সম্বন্ধে সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। বরং তারা এখন পর্যন্ত আমার ‘আযাবের স্বাদ গ্রহণ করেনি। তাদের নিকট কি তোমার মহাপ্রতাপশালী, মহান দানশীল প্রতিপালকের অনুগ্রহের ভান্ডারসমূহ আছে? অথবা তাদের কি আধিপত্ত আছে আসমান ও জমিন এবং উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর ওপর? তাহলে তারা সিঁড়ি বেয়ে আকাশে আরোহণ করুক। বহুদলের মধ্য থেকে এতো ছোট্ট একটি দল, এখানেই এটি পরাজিত হবে।
১১ নং আয়াত দিয়ে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন যে, অবশ্যই মক্কার এই কুরাইশদের এখানেই পতন হবে। কাফেরদেরকে সুস্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আজ তোমরা যে ব্যক্তিকে বিদ্রূপ করছো এবং যার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে জোরালো অস্বীকৃতি জানাচ্ছো, খুব দ্রুতই সে বিজয়ী হবে।
এরপর আল্লাহ তায়ালা একের পর এক ৯ জন নবীর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন যাদের জাতির লোকেরা তাদের কথা শোনেনি। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের একথা হৃদয়ংগম করিয়েছেন যে, যারাই অস্বীকার করেছে, জুলুম করেছে তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন আল্লাহর পাকড়াও থেকে তারা রেহাই পাবে না। মানুষের সঠিক মনোভাব ও কর্মনীতিই তার কাছে গ্রহণীয়। অন্যায় কথা, যেই বলুক না কেন, তিনি তাকে পাকড়াও করেন। ভুলের ওপর যারা অবিচল থাকার চেষ্টা করে না বরং জানার সাথে সাথেই তাওবা করে এবং দুনিয়ায় আখেরাতের জবাবদিহির কথা মনে রেখে জীবন যাপন করে তারাই তার কাছে পছন্দনীয়।
এরপর অনুগত ও বিদ্রোহী বান্দারা আখেরাতের জীবনে যে পরিণামের সম্মুখীন হবে তার বর্ণনা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন এবং এ প্রসঙ্গে কাফেরদেরকে বিশেষ করে দু’টি কথা বলা হয়েছে। এক, আজ যেসব সরদার ও ধর্মীয় নেতাদের পেছনে মূর্খ লোকেরা অন্ধের মতো ভ্রষ্টতার দিকে ছুটে চলছে আগামীতে তারাই জাহান্নামে পৌঁছে যাবে তাদের অনুসারীদের আগে এবং তারা উভয়দল পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকবে। দুই, আজ যেসব মু’মিনকে এরা লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত মনে করছে আগামীতে এরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখবে জাহান্নামে কোথাও সেসব মুমিনদের নাম নিশানাও নেই এবং এরা নিজেরাই জাহান্নামের আযাবে পাকড়াও হয়েছে।
সবশেষে সূরা সোয়াদে আদম আ. ও ইবলিসের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কাফের কুরাইশদেরকে একথা বলা যে, মুহাম্মাদ সা.-এর সামনে নত হবার পথে যে অহংকার তোমাদের বাধা দিচ্ছে, সে একই অহংকার আদমের সামনে নত হতে ইবলিসকে বাধা দিয়েছিল। আল্লাহ আদমকে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন ইবলিস তাতে ঈর্ষান্বিত হয়েছিল এবং আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অভিশপ্ত হয়েছিল।
অনুরূপভাবে আল্লাহ মুহাম্মাদ সা.-কে যে মর্যাদা দিয়েছেন তাতে তোমাদের হিংসা হচ্ছে। তাই তোমরা তাঁর আনুগত্য করছো না। ইবলিসের যে পরিণতি হবে সে একই পরিণতি হবে তোমাদেরও।
আজকাল ইন্টারফেইথ ডায়ালগের নামে ইসলামের সাথে একধরনের আপোষকামীতা শুরু হয়েছে। এই ইন্টারফেইথের বেসিক হলো, সব ধর্মই সঠিক এবং ভালো কথা বলে। অতএব সব ধর্মকেই আমরা মেনে নিবো। অন্য ধর্মের মানুষদের আহ্বান করবো না। সবাই যার যার ধর্ম নিয়ে থাকবো। প্রয়োজনে একে অন্যের ধর্মীয় প্রার্থনা ও উৎসবে যোগদান করবো। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কয়েকটি ইন্টারফেইথ ডায়ালগের আয়োজন হয়েছে এমনকি খ্রিস্টানদের পোপ বাংলাদেশে আসলে সর্বধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছিলো।
বাংলাদেশে এই আপোষকামীতা ও ইন্টারফেইথের বড় বার্তাবাহক হলো ফরিদ উদ্দিন মাসুদ। এর সাথে আর কিছু ব্যক্তিবর্গ বুঝে বা না বুঝে আপষকামীতার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। কোন লোভ, সুবিধা, ভয়-ভীতি ইত্যাদির কারণে ইসলামের দাওয়াত, ইকামাতে দ্বীন ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজ থেকে দূরে থাকা বা আপোষ করা বৈধ নয়। আল্লাহর রাসূলের জীবনে এরকম আপোষের প্রস্তাব বহু এসেছে। মুহাম্মদ সা. কাফেরদের সব প্রস্তাবকে উপেক্ষা করেছেন। মুশরিক ও কাফিরদের ভুল পথ সম্পর্কে সচেতন করেছেন। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর পথে সক্রিয় থেকেছেন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। ইকামাতে দ্বীনের পথে অবিচল রাখুন। মুশরিক ও তাদের দালালরা যেন আমাদের লোভ ও ভয় দেখিয়ে প্রভাবিত করতে না পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন