১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের মুসলিমদের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের সাফল্য আসে। যদিও পাকিস্তান গঠিত হওয়ার আনন্দ অনেকখানি ম্লান হয়ে যায় পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ হওয়ার মাধ্যমে। ভারতের হিন্দু প্রধান প্রদেশ একটিও ভাগ হয়নি অথচ মুসলিম প্রধান দুইটি প্রদেশ ভাগ করতে বাধ্য করে কংগ্রেস। ব্রিটিশ আইনজীবী র্যাডক্লিপকে মাউন্টব্যাটেন দায়িত্ব দেন সীমারেখা টেনে দেওয়ার জন্য। পাঞ্জাব ও বাংলায় সেই ভাগ করতে গিয়ে ইংরেজ সরকার কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে। সেই সূত্রে সীমান্ত অঞ্চলে নতুন করে আবার দাঙ্গা শুরু হয়। ফলে মুসলিমরা স্বাভাবিকভাবেই মনঃক্ষুণ্ণ হয়। যাই হোক তারপরও প্রায় দুইশ বছরের পরাধীনতার অবসান হওয়ায় মুসলিমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
পাকিস্তানেও তুর্কির মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। মোস্তফা কামাল পাশা ব্রিটিশদের থেকে তুর্কি জাতিকে উদ্ধার করে। স্বভাবতই মুসলিমরা ভেবেছিল তিনি আবার প্রচলিত খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু খিলাফতের কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন তিনি। খিলাফত ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে সেক্যুলার তুরস্ক গঠন করেন। একই ব্যাপার ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ আমলে জিন্নাহ যখন বিভিন্ন জনসভায় যেতেন তখন তিনি বুক পকেটে থাকা ছোট্ট একটি কুরআনের কপি বের দেখিয়ে বলতেন, এটিই হবে পাকিস্তানের সংবিধান। কুরআনের ভিত্তিতেই চলবে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র।
যখন থেকে পাকিস্তান প্রস্তাব হয়েছে তখন থেকেই মুসলিম লীগের নেতারা বলতেন পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তানের পক্ষে থেকে মুসলিম লীগের এই দাবিকে সঠিক মনে করতেন না গত শতাব্দির পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। তিনি ১৯৪০ সালে এই বিষয়ে একটি লেকচার দেন যা পরে বই আকারে ছাপা হয়েছে। বইটির নাম ইসলামী হুকুমাত কিস্তারা কায়েম হতি হ্যায়। সেখানে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরের বছর তিনি প্রস্তাবিত পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি সংগঠন কায়েম করেন, যার নাম জামায়াতে ইসলামী।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সংবিধান একটি সেক্যুলার সংবিধান হবে বলে ধারণা দেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা।
১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করে ১৯৪৮ সাল থেকে। আর সেটি ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি নিয়ে। ১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।
দফাগুলো হচ্ছে
১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।
এই দাবীগুলো নিয়েই জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে।
১৯৪৮ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। গভর্ণর জেনারেল হন ঢাকার নওয়াব পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন লিয়াকত আলী খান। এই সময় থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ শাসকের ভূমিকায় থাকেন। লিয়াকত আলী খান সরকার ১৯৪৮ সনের ৪ অক্টোবর ইসলামী শাসনতন্ত্রের অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। প্রায় ২০ মাস জেলে রাখার পর ১৯৫০ সনের ২৮ মে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৫০ সনের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে দেশের আলিম সমাজ যদি সর্বসম্মতভাবে কোন শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে, গণপরিষদ তা বিবেচনা করে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী আস্থাশীল ছিলেন যে বহুধাবিভক্ত আলিম সমাজ এই জটিল বিষয়ে কখনো একমত হতে পারবে না এবং কোন সর্বসম্মত প্রস্তাবও পেশ করতে পারবে না।
১৯৫১ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে করাচিতে সারা দেশের সকল মত ও পথের ৩১ জন শীর্ষ আলিম একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে একত্রিত হন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী একটি খসড়া পেশ করেন। আলাপ-আলোচনার পর চূড়ান্ত হয় একটি মূল্যবান দলিল “ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি।”
দফাগুলো ছিলো নিন্মরুপ:
১. দেশের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ।
২. দেশের আইন আল-কুরআন ও আসসুন্নাহ ভিত্তিতে রচিত হবে।
৩. রাষ্ট্র ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার উপর সংস্থাপিত হবে।
৪. রাষ্ট্র মা‘রুফ প্রতিষ্ঠা করবে এবং মুনকার উচ্ছেদ করবে।
৫. রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য সম্পর্ক মজবুত করবে।
৬. রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি দেবে।
৭. রাষ্ট্র শারীয়াহর নিরিখে নাগরিকদের সকল অধিকার নিশ্চিত করবে।
৮. আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
৯. স্বীকৃত মাযহাবগুলো আইনের আওতায় পরিপূর্ণ দ্বীনি স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১০. অমুসলিম নাগরিকগণ আইনের আওতায় পার্সোনাল ল’ সংরক্ষণ ও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১১. রাষ্ট্র শারীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত অমুসলিমদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।
১২. রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম পুরুষ।
১৩. রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে।
১৪. রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি মাজলিসে শূরা থাকবে।
১৫. রাষ্ট্রপ্রধান দেশের শাসনতন্ত্র সাসপেন্ড করতে পারবেন না।
১৬. সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপ্রধানকে পদচ্যুত করা যাবে।
১৭. রাষ্ট্রপ্রধান তার কাজের জন্য মজলিসে শূরার নিকট দায়ী থাকবেন এবং তিনি আইনের ঊর্ধ্বে হবেন না।
১৮. বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন হবে।
১৯. সরকারী ও প্রাইভেট সকল নাগরিক একই আইনের অধীন হবে।
২০. ইসলামবিরোধী মতবাদের প্রচারণা নিষিদ্ধ হবে।
২১. দেশের বিভিন্ন অঞ্চল একই দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট বলে গণ্য হবে।
২২. আলকুরআন ও আসসুন্নাহর পরিপন্থী শাসনতন্ত্রের যেই কোন ব্যাখ্যা বাতিল বলে গণ্য হবে।
এই নীতিমালা বিপুল সংখ্যায় লিফলেট আকারে ছাপিয়ে সারা দেশে ছড়ানো হয়। এর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা দেশে বহুসংখ্যক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। আবার জামায়াতের দাবির বিরুদ্ধেও কেউ কেউ অবস্থান নেন। মুসলিম লীগ নেতারা কৌশলী অবস্থান নেন। তারা ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে দেখতে চান না। তবে তারা তা স্পষ্ট করেননি।
প্রকাশ্যে ইসলামী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতারা। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মাওলানা(!) আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও ছিল অন্যতম। তিনি তো পাকিস্তানকে সেক্যুলার হিসেবেও দেখতে চাইতেন না। তিনি মাওবাদী কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র বাস্তবায়ন হলে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করতেন।
কাদিয়ানী সমস্যা :
পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন বাঙ্গালী খাজা নাজিম উদ্দিন। তিনি ১৯৫৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। সে সময় পাকিস্তানে আহমদিয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ব্যাপক বিস্তার হয় এবং একইসাথে তারা পাকিস্তানের সংবিধানে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। পাকিস্তানের কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা এই মতবাদের অনুসারী ছিলেন। কাদিয়ানীদের বিভ্রান্ত মতবাদ পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে প্রভাব রাখার আশংকা শুরু হয় মুসলিমদের মধ্যে। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মূল নেতা মওদূদী সাহেব বিষয়টাকে গুরুত্বের সাথে দেখেন। তিনি সংবিধান কমিটি থেকে চিহ্নিত কাদিয়ানীদের বাদ দেওয়া, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কাদিয়ানী ও অমুসলিমদের অংশগ্রহণ না করানোর দাবি তুলেন।
রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাইয়্যেদ মওদুদী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনও চালিয়ে যান। তিনি 'কাদিয়ানী মাসয়ালা' নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম প্রমাণ করেন এবং তাদের ভ্রান্ত আকিদার স্বরূপ উন্মোচন করেন। এই বইটি কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনে গতি এনে দেয়। এই আন্দোলন বড় ধরনের নাড়া দেয় পাকিস্তানকে। অধিকাংশ মুসলিম এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। এ সময় অনেকগুলো সংগঠন একযোগে কাদিয়ানীদেরকে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তারা সর্বদলীয় কনভেনশনে ১৯৫৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন কমিটি' গঠন করে। জামায়াত এই কমিটির বিরোধিতা করে অহিংস আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়।
এদিকে পাঞ্জাবে কাদিয়ানী সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকার ও জনগণের মধ্যকার দাঙ্গা ভয়াবহরূপ ধারণ করে। এরূপ পরিস্থিতিতে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ১৯৫৩ সালের আটাশে মার্চ মাওলানা মওদূদীসহ জামায়াতের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। এটা ছিল মূলত সামরিক কর্তৃপক্ষের ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার নগ্ন বহিপ্রকাশ। তারা দাঙ্গা সৃষ্টির অভিযোগে গ্রেপ্তার করলেও মূলত মওদূদী ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাওলানাকে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে “কাদিয়ানী মাসয়ালা” বইয়ের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এ অভিযোগেই ৮ই মে তারিখে সামরিক আদালত মাওলানাকে ফাঁসীর আদেশ প্রদান করে। অথচ মাওলানা সামরিক মানুষ ছিলেন না। মূলত এটা ছিল একটা অজুহাত। মওদূদীকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে দূরে রাখাই ছিলো এর বেসিক উদ্দেশ্য। এর পেছনে মুসলিম লীগের ইন্ধন ছিল। মাওলানার ফাঁসীর ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আরেক বাঙালি নেতা মোহাম্মদ আলী বগুড়া। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর তীব্র বিরোধিতা ও ক্ষোভের মুখে মুসলিম লীগ ও সেনাবাহিনী তাঁর মৃত্যু দণ্ডাদেশ মওকুফ করে তারা মাওলানাকে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করে। আবার এর বিশ মাস কারাবাসের পর মাওলানা বিনা শর্তে মুক্তি দেয় সরকার।
যাই হোক, সামরিক কর্তৃপক্ষ যে “কাদিয়ানী মাসয়ালা” পুস্তিকা প্রণয়নের অজুহাতে মাওলানাকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করে সে পুস্তিকাটির কিন্তু তারা বাজেয়াপ্ত করেনি। লাহোরের সামরিক আদালতে তার বিচার চলাকালেই লাহোর শহরেই বইটির বেস্ট সেল চলছিল। শুধু লাহোর নয় সারা পাকিস্তানেই বইটির বিক্রি চলছিল দেদারছে। মূলত বইটির কোথাও কোন উস্কানিমূলক কথা ছিল না। বরং তাতে তিনি 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন কমিটি'র বিরোধিতা করেছেন। তাই সরকারও চেয়েছিলো বইটি মানুষ পড়ুক।
কাদিয়ানীরা যে মুসলমান নয়, অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে এ বইটিতে তা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কাদিয়ানীদেরকে আইনগতভাবে অমুসলিম ঘোষণা করাই ছিল মওদূদীর দাবি। এ দাবির স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য এ বইটিতে সরবরাহ করা হয়েছে। এ দাবী আদায়ের লক্ষ্যে মাওলানা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবার আহ্বান জানান। অবশেষে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। কাদিয়ানীরা যে অমুসলিম এ ব্যাপারে উম্মতের গোটা আলেম সমাজ একমত।
গণদাবির মুখে গণপরিষদ ১৯৫৬ সনের ২৯ ফেব্রুয়ারি একটি শাসনতন্ত্র পাস করে। কিন্তু সেখানে ইসলামপন্থীদের বেশিরভাগ দাবিই উপেক্ষা করা হয়। এসময় পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামীলীগ। আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। সংবিধানে পাকিস্তানকে 'ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান' হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। মুসলিম লীগ মনে করেছে এই দাবি দিয়ে মওদূদী ও জামায়াতকে বোকা বানিয়ে আন্দোলন থেকে দূরে রাখবে। মওদূদী তাদের এই চালাকি বুঝতে পেরেও 'ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান' এই ঘোষণাকে পজেটিভ হিসেবে গ্রহণ করে সংবিধানকে স্বাগত জানান এবং বাকী দাবিগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। মাওলানার যুক্তি ছিল এর মাধ্যমে রাষ্ট্র তার পরিচয় পেয়েছে। ধীরে ধীরে সকল নিয়ম কানুন, আইন আদালত ইসলামী শরিয়াহর ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
মাওলানার এই চিন্তা বাস্তব হচ্ছে। পাকিস্তানের ইসলামী রিপাবলিক পরিচয়ে একে একে পাকিস্তান থেকে সুদ, মদসহ অনেক অনৈসলামিক নিয়ম ও আচার বন্ধ হয়েছে। কাদিয়ানীরাও অমুসলিম ঘোষিত হয়ে একটি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে শাসনতন্ত্র নিয়ে পাকিস্তানে ব্যাপক গোলযোগ তৈরি হয়। প্রথমত ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের মধ্যে ভাঙন তৈরি হয়। আগেই বলেছিলাম মাওলানা(!) ভাসানী ইসলামী রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছেন। এর পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দি সরকার আমেরিকা ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। এতে চীনপন্থী ভাসানী সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং কাগমারিতে সম্মেলন করেন। কাগমারিতে তিনি ইসলামী রিপাবলিক ও আমেরিকাপন্থী অবস্থান থেকে সরে না এলে সালামুন আলাইকুম জানাতে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দি ও আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতারা তার এই অবস্থানকে গুরুত্ব দেন নি। কোণঠাসা হয়ে পড়েন ভাসানী। অবশেষে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে মাওবাদী দল গঠন করেন।
এদিকে নতুন সংবিধানে গভর্নর জেনারেল সিস্টেম বাদ পড়ে। গভর্নর জেনারেল ছিলেন ইংল্যান্ড কর্তৃক নিয়োগকৃত। স্বাধীনতার সময় এই নিয়ম যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান নিজেদের জন্য শাসনতন্ত্র তৈরি না করবে ততদিন ইংল্যান্ডের রাজা/রাণী কতৃক গভর্নর জেনারেল থাকবেন। তিনি মুর্শিদাবাদের নওয়াব পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন মীর জাফরের বংশধর। আগে মূলত রাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হতো। নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বেড়ে যায়। ইস্কান্দর মির্যার সাথে সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ বাড়তে থাকে। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সংসদ অধিবেশনে সংঘর্ষ চলাকালে স্পিকার শাহেদ আলী ইন্তেকাল করেন। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে অস্থিরতা শুরু হয়। ইস্কান্দর মির্যাকে চাপে ফেলতে ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করেন।
সোহরাওয়ার্দির পদত্যাগে পুরো পাকিস্তানে গোলযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। প্রদেশগুলোতেও নানান ইস্যুতে অস্থিরতা তৈরি হয়। যেমন পূর্ব পাকিস্তানে অস্থিরতার মূল বিষয় ছিলো আওয়ামীলীগ ও ন্যাপের মধ্যেকার বিরোধ। সোহরাওয়ার্দির পদত্যাগের পর গুজরাট থেকে আসা মুসলিম লীগ নেতা ইবরাহীম ইসমাঈলকে প্রধানমন্ত্রী করে ইস্কান্দর মির্যা। আওয়ামীলীগ ও রিপাবলিকান পার্টির ভেটোতে মাত্র ৫৫ দিন পরই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ইসকান্দর মির্যা নিজ দলের ফিরোজ খান নুনকে প্রধানমন্ত্রী করেন। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেকার সমস্যার সমাধান হয় না। সারাদেশেই গোলযোগ তৈরি হয়। বিভিন্নস্থানে বিশেষত লাহোরে ও পাঞ্জাবে সেনাবাহিনীকে মানুষ আহ্বান করতে থাকে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ইস্কান্দর মির্যা সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন জারি করেন। সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। সামরিক আইন জারির পর সারাদেশে সেনা নিশ্চিত করা হয়। গোলযোগ ও হট্টগোল বন্ধ হয়। সামরিক আইন জারির বিশ দিন পর আইয়ুব খান ইস্কান্দর মির্যাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেন। ইস্কান্দার মির্জা লন্ডনে নির্বাসিত হন।
পাকিস্তানে শুরু হয় সেনাশাসন। আইয়ুব খানের অধ্যায়। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হয় আইয়ুব খানকে স্বাগত জানিয়ে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন