১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তিনটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ বাধে। এর ১৭ দিন পরে যুদ্ধ বিরতি কার্যকরী হয়। জাতিসংঘ দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ১৯৬৫ সালের ৫ আগস্টের অবস্থানে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়। যুদ্ধবিরতির পরেও সৈন্য অপসারণসহ বেশ কিছু প্রশ্নে দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। এই বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান, সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রধানমন্ত্রী নিকলাই কোসিগিনের উদ্যোগে তাশখন্দ শহরে মিলিত হয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন, যা তাশখন্দ চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির মধ্যস্থতাকারী ছিল ভারতের বন্ধু রাশিয়া। ১৯৬৬ সালের ৯ ও ১০ জানুয়ারি তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরের মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অবসান হয়।
দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন এবং জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্য বৃদ্ধি তাসখন্দ চুক্তির মূলকথা ছিল। যে বিষয় নিয়ে বিরোধ সেই কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছে ও তাদের সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দুই পক্ষ নিজেদের বিরোধ মীমাংসার জন্য পরস্পরের মধ্যে শক্তি প্রয়োগ না করে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ উপায় গ্রহণ করবেন বলে একমত হন। পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, কোনো বিরুদ্ধ প্ররোচনায় উৎসাহ না দেওয়া এবং ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন মেনে চলার ব্যাপারে দুই পক্ষ একমত হন। কাশ্মীরকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইতোপূর্বে সম্পাদিত চুক্তিগুলো কার্যকরী করার ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে বিবেচনা করবেন বলেও একমত হন তারা। যুদ্ধবন্দিদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় এই চুক্তিতে। যুদ্ধের সময় এক দেশ অন্য দেশের যে সম্পদ দখল করেছে তা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারেও সম্মত হন দুই পক্ষ।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পাকিস্তানে আইয়ুব খানের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বেশ জোরেশোরে প্রচার হতে শুরু করে পাকিস্তান যুদ্ধে জিতেছে। ভারতকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে ইত্যাদি। আইয়ুব খান যুদ্ধে যারা ভালো পরদর্শিতা করেছে এমন সৈন্যদের রাষ্ট্রীয় পদক দিতে থাকেন। চারদিকে একেবারে জয় জয়কার। এর মধ্যে পাকিস্তানী জনগণ ভুলে যায় তাদের হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। এখনো কাশ্মীরের দখল ভারতীয়দের কাছে। কাশ্মীরের মুসলিমরা মুশরিকদের কাছে জিম্মী হয়ে আছে। আইয়ুব খানের প্রোপাগান্ডার ফলে পাকিস্তানী জনগণ ভেবেছে পাকিস্তান যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। কাশ্মীর পাকিস্তানের অধিকারে চলে আসবে।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো তাসখন্দ চুক্তির ঘোষণাগুলো যখন প্রকাশ হলো তখন জনগণের মোহভঙ্গ হয়ে পড়ে। তারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কারণ যে ইস্যুতে এত রক্তক্ষয় সেই কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তানের সামান্যতম অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উল্টো কাশ্মির ইস্যুকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সারা পাকিস্তানের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জনগণ তাসখন্দ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। আইয়ুবের মূল শত্রু জামায়াতে ইসলামী সবার আগে বিবৃতি দিয়ে তাসখন্দ চুক্তি ও ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর ১৬ জানুয়ারী আইয়ুববিরোধী দলগুলো মিলিত হয় জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখান থেকে তারা যুক্ত বিবৃতির মাধ্যমে তাসখন্দ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। তারা এই ব্যাপারে আইয়ুবের মিথ্যা প্রচারণা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করে। কাশ্মীরের মুসলিমদের ভাগ্য নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
তাসখন্দ চুক্তির ঘোষণায় যা ছিল
১) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে, উভয়পক্ষই জাতিসংঘের সনদ মেনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। চার্টারের অধীনে তারা বল প্রয়োগের পন্থা অবলম্বন না করা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করার চুক্তি পুনর্নিশ্চিত করে। তারা বিবেচনা করে যে দু'দেশের মধ্যে উত্তেজনার ধারাবাহিকতার কারণে তাদের অঞ্চলে এবং বিশেষত ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের শান্তির স্বার্থ এবং প্রকৃতপক্ষে, ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ বাস্তবায়িত হয় নি। এটা সেই পটভূমির বিরোধী যেখানে জম্মু ও কাশ্মীর আলোচনা হয়েছিল এবং প্রত্যেক পক্ষই নিজ নিজ অবস্থান নির্ধারণ করেছিল।
২) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ এর মধ্যে উভয় দেশের সকল সশস্ত্র সদস্যকে তাদের ৫ আগস্ট, ১৯৬৫ এর পূর্বের অবস্থানে সরিয়ে নেয়া হবে। এবং উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতি সীমায় যুদ্ধবিরতি শর্তাবলী পালন করবে।
৩) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক হবে একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে।
৪) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে উভয় পক্ষই অপর দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত যে কোন প্রচারণাকে নিরুৎসাহিত করবে এবং এমন প্রচারনাকে উত্সাহিত করবে যা দু'দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
৫) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে পাকিস্তানে ভারতের হাই কমিশনার এবং ভারতে পাকিস্তানের হাই কমিশনার তাদের পদে ফিরে আসবেন এবং উভয় দেশের কূটনৈতিক মিশনের স্বাভাবিক কার্যক্রম পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। উভয় সরকারই কূটনীতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের 'ভিয়েনা সমঝোতা চুক্তি' পালন করবে।
৬) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহন এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তিগুলি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় বিবেচনা করার ব্যপারে একমত হয়েছেন।
৭) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে তারা যুদ্ধাবন্দীদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য স্ব স্ব কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিবেন।
৮) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে উভয়পক্ষ শরণার্থীদের সমস্যা এবং উচ্ছেদ / অবৈধ অভিবাসন সম্পর্কিত সমস্যাগুলির আলোচনা চালিয়ে যাবে। তারা আরোও একমত হয়েছেন যে উভয় পক্ষই এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যা জনসাধারণের সীমান্ত অতিক্রম রোধ করবে। সংঘর্ষের জেরে উভয় পক্ষের দখলে নেওয়া সম্পত্তি ও সম্পদের ফেরত নিয়ে আলোচনা করতেও তারা রাজি হয়েছেন।
৯) ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একমত হয়েছেন যে উভয় দেশের প্রত্যক্ষ উদ্বেগের বিষয়ে উভয় পক্ষই সর্বোচ্চ ও অন্যান্য পর্যায়ে বৈঠক চালিয়ে যাবে। উভয় পক্ষই ভারত-পাকিস্তান যৌথ সংস্থাগুলি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে যা সরকারের আরোও কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত এর সিদ্ধান্ত গ্রহনের ব্যাপারে সরকারগুলিকে অবগত করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পারস্পরিক সন্তসজনক ফলাফল আনয়নকারী উক্ত বৈঠিক সংঘটিত করতে গঠনমূলক, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং মহৎ অংশগ্রহনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত সরকার এবং ইউএসএসআর মন্ত্রিপরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে ব্যক্তিগতভাবে গভীর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার অনুভূতি ব্যাক্ত করেছেন। তারা উজবেকিস্তানের সরকার ও বন্ধুপ্রতিম জনগণের প্রতি তাদের বিমুগ্ধকারী সংবর্ধনা ও সহৃদয় আতিথেয়তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করে।
তাসখন্দ চুক্তি ঘোষিত হলে ক্ষেপে উঠে রাজনীতিবিদেরা ও পাকিস্তানী জেনারেলরা। আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো জোট গঠনের চেষ্টা করে। এতে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম লীগ। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী লাহোরে আইয়ুববিরোধী দলগুলোর একটি মিটিং আহ্বান করা হয় কাউন্সিল মুসলিম লীগের উদ্যোগে। মিটিং-এর উদ্দেশ্য ছিল তাসখন্দ চুক্তি পর্যালোচনা ও কাশ্মীরের মুসলিমদের জন্য কোনো প্রস্তাবনা দেওয়া। এই আলোচনায় মুসলিম লীগের সাথে ছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি। এই আলোচনায় আইয়ুবের গোয়েন্দা হিসেবে থাকা ভাসানী ও তার দলকে বাদ দেওয়া হয়।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে জয়েন করার জন্য বলেন। কিন্তু মুজিব আগ্রহ দেখায় নি। কাশ্মীর বিষয়ে সে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের পরামর্শক্রমে শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দলকে প্রস্তুত করেন লাহোরে পাঠানোর জন্য। কিন্তু হঠাৎ করেই বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুস মুজিবের বাসায় এলেন। তিনি মুজিবকে কিছু একটা বুঝিয়েছেন। ব্যাস অমনি মুজিব নিজেই লাহোরে বিরোধী দলগুলোর কাশ্মীর বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিতে প্রস্তুত হন। ৪ ফেব্রুয়ারি তাজউদ্দিনসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে লাহোর রওনা হন।
৫ ফেব্রুয়ারি চৌধুরি মুহাম্মদ আলীর বাসায় মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হয়। সেই মিটিং-এ শেখ মুজিব হঠাৎ করে ৬ দফা ঘোষণা করার আবদার করেন। তিনি সম্মেলনের এজেন্ডায় তার ৬ দফাকে এজেন্ডাভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু অন্যান্য বিরোধী দল তা মেনে নেন নি। তারা বলেন, আমরা আজ একত্রিত হয়েছি কাশ্মীর, তাসখন্দ ও আইয়ুব খানকে নিয়ে। ফলে সম্মেলনের এজেন্ডা থেকে ছয় দফা বাদ পড়ে। মুজিব কিছুক্ষণ হট্টগোল করে সভাস্থল ত্যাগ করে। নিখিল পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এতে বিস্মিত হয়ে পড়েন। কারণ তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা যারা মুজিবের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তারাও আগে থেকে কিছুই জানতেন না ৬ দফার ব্যাপারে।
মুজিব সম্মেলনস্থল ত্যাগ করে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি ঘটা করে ৬ দফা উপস্থাপন করেন। আইয়ুবপন্থী সংবাদ মিডিয়া ৬ দফা ঘোষণাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে। একইসাথে তারা সারাদেশে প্রচার করতে থাকে দেশ ভাঙার এজেন্ডা নিয়েছে বিরোধীদল। তাদের প্রচারণায় অনেকটা চাপা পড়ে যায় কাশ্মির ইস্যুতে করা সম্মেলনের খবর। কাশ্মীর ইস্যু তখনো যে সমাধান হয় নি আজো তা আলোর মুখ দেখেনি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন