১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে প্রাদেশিক আইনপরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়। কিন্তু আইনপরিষদে আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা আস্থা ভোটের সম্মুখীন হলে সুনিশ্চিত পরাজিত হবে বুঝতে পেরে মুখমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে গভর্নর শেরে বাংলা ফজলুল হক উক্ত পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এভাবে পুনরায় আবু হোসেন সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে ফজলুল হকের নেতৃত্বে। কিন্তু ফজলুল হক শেষ পর্যন্ত প্রাদেশিক সরকারের পতন ঠেকাতে পারেনি।
ইতোমধ্যে পাকিস্তান কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোয়ালিশন সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। গভর্ণর জেনারেল ইস্কান্দর মির্যা ও আওয়ামী লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের নেতৃত্বে চলে আসেন। কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত বাংলায় ৩০ আগস্ট ১৯৫৬ তারিখে শেরে বাংলার দল কৃষক শ্রমিক লীগের আবু হোসেন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটার পর ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়।
এই কোয়ালিশন সরকার গণতন্ত্রী দল, রফিক হোসাইন-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ অংশ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু দল নিয়ে গঠিত হয়েছিল। কোয়ালিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০৯ জন সদস্যের। মধ্যে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের প্রতি ২০০ জন সদস্যের সমর্থন ছিল। এই ২০০ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ছিল ৯৮ জন, গণতন্ত্রী দলের ১২ জন, সংখ্যালঘু ৭২ জন এবং ১৮ জন আওয়ামী মুসলিম লীগের।
পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ৫ দিন পর কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির (ইস্কান্দর মির্যা) কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এই নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তখন পাকিস্তান গণপরিষদের ৮০ জন সদস্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সদস্য সংখ্যা ছিল ১৩ এবং রিপাবলিকান পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০ জন। তাছাড়া গণপরিষদের ১ জন গণতন্ত্রী দলীয় সদস্য ও ৭ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান কোয়ালিশন সরকারের প্রতি সমর্থন দেন। ফলে গণপরিষদে কোয়ালিশনের পক্ষে সদস্য সংখ্যা হয় ৫১ জন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তিনি পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
একইসঙ্গে কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসীন হওয়ায় আওয়ামী লীগ অল্প সময়ের সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামল শান্তিপূর্ণ হতে পারেনি। কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার গৃহীত বিভিন্ন নীতির প্রশ্নে পার্টির অভ্যন্তরে কোন্দল দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার সময় থেকেই অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী এই পার্টিতে ঢুকে পড়ে। পার্টির এই অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু করে। মাওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে সমালোচনা করে বলেন যে, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে তা পার্টির মেনিফেস্টো বিরোধী। এভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দুটি ভিন্নমতালম্বী গ্রুপের সৃষ্টি হয়।
এই মতবিরোধ শক্তিশালী হয় ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে। কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় ভাসানী বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামুন আলাইকুম জানাতে বাধ্য হবে।
এই কথাটি যখন তিনি বলেন তখন পাকিস্তান কেন্দ্রের সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল। ভাসানী ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাওয়ার্দি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হচ্ছে এটা হচ্ছে ভাসানীর রাজনৈতিক মিথ্যে কথা। সে এর মাধ্যমে সমস্ত বাঙালি বিশেষত আওয়ামীলীগের লোকদেরকে সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে চেয়েছিলো।
মূলত কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। এই চুক্তিতে চীন নাখোশ হয়েছে। চীনের খুশি বা অখুশিই ভাসানীর খুশি বা অখুশি। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তান সংবিধানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাসানী তীব্র প্রতিবাদ করেন। সোহরাওয়ার্দী পৃথক নির্বাচনের পক্ষপাতি ছিলেন। ইসলামিক রিপাবলিকের ব্যাপারেও ভাসানীর আপত্তি ছিলো। এতে সংখ্যালঘুদের অধিকারহরণ হবে বলে তিনি মনে করতেন। ভাসানী তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা বৈদেশিক নীতিরও বিরোধিতা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ভাসানী কাগমারি সম্মেলন করেছে মূলত চীনের চাপে।
কাগমারি সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাসানী বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলতে থাকেন দলের ডানপন্থী ও উদারপন্থীরা। অনেকটা কোণঠাসা ভাসানী মাসখানেক পরে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সোহরাওয়ার্দীর চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। একই বছর ২৫ জুলাই ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকে তার বিরোধীরা উপহাস করে লাল মাওলানা বলতো। ন্যাপ গঠনের পর প্রাদেশিক পরিষদের ২৮ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসে ন্যাপে যোগ দেন।
১৯৫৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য এবং রসরাজ মণ্ডলের নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু সদস্যবৃন্দ আওয়ামী লীগ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। এমতাবস্থায় সরকার আসন্ন আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন কিছুদিন স্থগিত রাখার অনুরোধ করেন। কিন্তু তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। তিনি মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন ও তার দল কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকারকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। ইতোমধ্যে কেন্দ্রে ইস্কান্দর মির্যার সাথে মতবিরোধের জেরে সোহরাওয়ার্দি পদত্যাগ করেন।
সোহরাওয়ার্দি প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করলেও মন্ত্রীসভা ভাঙে নি। কেন্দ্রে ফিরোজ খান নূনের মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় টিকে ছিল। স্বভাবতই পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার গভর্নর শেরে বাংলাকে বরখাস্ত করে। নতুন অস্থায়ী গভর্নর পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনর্বহাল করেন। ১৯৫৮ সালের বাজেটের ব্যাপারে বাংলায় চারটি মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। কিন্তু আগস্ট পর্যন্ত বাজেট পাস সম্ভব হয় না। অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে আইনপরিষদে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয় এবং অক্টোবরে সামরিক আইন জারির মাধ্যমে আইনপরিষদের অবসান ঘটে।
আইন পরিষদের স্পিকার জনাব আবদুল হাকিম ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির এবং ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়। যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পর থেকে কখনো কৃষক-শ্রমিক পার্টির সরকার আবার কখনো আওয়ামী লীগের সরকার দেশ পরিচালনা করে। ১৯৫৮ সালের আওয়ামী লীগ স্পষ্টত অভিযোগ উত্থাপন করে যে, স্পিকার আবদুল হাকিম নিরপেক্ষ নন। এরই প্রেক্ষিতে ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ তারিখে আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে দেওয়ান মাহবুব আলী অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। স্পিকার এক রুলিং দিয়ে তা বাতিল করেন। ফলে পরিষদ ভবনের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। স্পিকার পরিষদ-কক্ষ ত্যাগ করেন।
তখন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় দেওয়ান মাহবুব আলী স্পিকারের বিরুদ্ধে তার অনাস্থা প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করলে ১৭০ জন সদস্য তা সমর্থন করেন। প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা গৃহীত হয়। কিন্তু বিরোধী দলীয় কৃষকশ্রমিক পার্টির সদস্যবৃন্দ এই পরিবর্তন মানেনি। পরবর্তী ২ দিন চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য সৈয়দ আজিজুল হকের সভাপতিত্বে স্বল্প সময়ের জন্য অধিবেশন চলে। কিন্তু তার পরদিন ২৩ সেপ্টেম্বর ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী স্পিকারের চেয়ারে বসামাত্র কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও তার সমর্থক দলের সদস্যবৃন্দ জনাব শাহেদ আলীকে উক্ত চেয়ারে আসন গ্রহণ না করার দাবি করে।
শাহেদ আলী আসন গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে বিভিন্ন বস্তু নিক্ষেপ হতে থাকে। এ বিষয়ে ‘আজাদ পত্রিকা রিপোর্ট করে, ঐ সময় একটি বস্তু ডেপুটি স্পিকারের উপর নিক্ষিপ্ত হওয়ায় তিনি মুখে আঘাত পান এবং আহত স্থান হইতে রক্তপাত হইতে থাকে। নিক্ষিপ্ত বস্তুটি সম্ভবত সদস্যদের ডেস্কের সহিত সংযুক্ত কোনো কাঠের খণ্ড হতে পারে। আহত অবস্থায় শাহেদ আলীকে হাসপাতালে নেয়া হয় সেখানে তিনি ২৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১:২০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। এই ঘটনা পূর্ববাংলা জাতীয় পরিষদের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এরপর ৭ অক্টোবর (১৯৫৮) পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করা হলে পূর্ববাংলা তথা পাকিস্তানে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অবসান ঘটে।
এই ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর নেতা ও ভাসানীর সমর্থক ন্যাপ নেতা অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ বলেন,
//২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৮। এদেশের ইতিহাসের এক চরম কলঙ্কজনক দিন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত কিন্তু জনগণের স্বার্থ বিরোধী এই নেতারা সেদিন দেশের ইতিহাসকে কল্পনাতীতভাবে মসীলিপ্ত করে। বাইরের ঐতিহাসিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের কথা বাদ দিলাম। আমরা ৩০৯ জন পরিষদ সদস্য ছিলাম। তাদের মধ্যে কিছু কলমবাজ লোক তো ছিলেন। বামপন্থীদের মধ্যেও কেউ আজ পর্যন্ত এই দিনের ঘটনাবলীর একটি পূর্ণ বিবরণ লিখেননি। ঐদিনের কার্যবিবরণী, টেপ রেকর্ডার সব কিছু পরবর্তী সরকার বাজেয়াপ্ত করে। তা কোথায় আছে জানি না। জানলেও তা পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।
কাজেই অনেক ক্ষেত্রে আমাকে স্মৃতি নির্ভর হতে হচ্ছে। আর সেদিনকার সেই বিয়োগান্ত নাটকীয় ব্যাপারটির নাটকীয় বর্ণনা আমার অদক্ষ হাতে সম্ভব নয়। তবু চাই যে এর একটা রেকর্ড থাকুক। ভবিষ্যৎ বংশধররা উপলব্ধি করবে তাদের পিতৃপুরুষরা শ্রেণী চেতনার অভাবে কাদের নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করত। আর শ্রেণীগত কারণে, শ্রেণীশোষণের স্বার্থে এই নেতারা কী নির্মম, নির্লজ্জ, পাশবিক বিশ্বাসঘাতকতা করত। জনতা কত মহান। আর এই ‘জননেতা’ নামধারীরা কত নিচ, কত হীন। জনতা কত নি:স্বার্থপর। আর এরা কত স্বার্থান্ধ, কত লোভাতুর, কত নির্লজ্জ।
২৩শে সেপ্টেম্বর (১৯৫৮) সম্পূরক (Supplementary) বাজেট পেশের সাথে সাথে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল।
মোহন মিয়া, নান্না মিয়া, নবী চৌধুরী প্রমুখ আবু হোসেন দলের (কৃষক শ্রমিক পার্টি) নেতারা মাইক স্ট্যান্ড, চেয়ারের হাতল ইত্যাদি যা পেলেন তা ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলেন। এ ব্যাপারে ফরিদপুরের মোহন মিয়া (ইউসুফ আলী চৌধুরী) ওস্তাদ ছিলেন। চরের জমি জবর দখলের সময় তিনি তার লাঠিয়াল বাহিনীর সাথে থাকতেন এবং নিজেই দাঙ্গা পরিচালনা করতেন। ওদিকে আওয়ামী লীগের যারা মাসলম্যান, মারামারিতে ওস্তাদ তারা মোহন মিয়াদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করল। আই.জি. ইসমাইল সাহেব স্বয়ং পরিষদ কক্ষের ভেতরে। এসেম্বলী মার্শালরাও ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে (যা আসির কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে) তারা পরিস্থিতির মোকাবেলা করে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন।
শেখ মুজিব আমার পাশে বসা ছিলেন। অপর পক্ষ স্পিকারের ওপর আক্রমণ করার সাথে সাথে সে তার ব্যাগ থেকে শঙ্কর মাছের হাত দেড়েকের একটা লেজ বের করে। শুনেছি শঙ্কর মাছের মাছের লেজের আঘাতে নাকি ঘা হয় এবং সে ঘা পঁচতে থাকে। স্পীকারের চারদিকে আবু হোসেনের দল হল্লা করছিল। সেদিকে লাফ দেবার আগে আমি শেখ মুজিবের হাত ধরে ফেললাম এবং বললাম – গভর্ণমেন্ট তোমাদের, এসেম্বলি মার্শালরা এমন কি পুলিশের আই.জি উপস্থিত আছেন। কিন্তু মুজিব ঝাড়া মেরে আমার হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেল। মারামারি চলছে। সূর্য পূর্ব দিকে না উঠে পশ্চিম দিকে উঠতে পারে কিন্তু যখন মারামারি চলছে তখন শেখ মুজিব আতাউরের মত চুপচাপ বসে থাকবে তা তো হতে পারে না। তাহলে শেখ মুজিব আর শেখ মুজিব থাকে না।
মারামারি শুরু হলে মহিলা সদস্যরা বিকট কান্নার রোল তুললেন। তাদের পরিষদ কক্ষের পশ্চাদভাগে চলে যেতে বলা হয়। সেদিন প্রেস গ্যালারি খালি ছিল। সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। আমরা ন্যাপ দলীয়রা দাঙ্গাতে জড়িত নয় একথার প্রমাণ রাখার জন্য পরিষদ কক্ষের পেছন ভাগে লাইন ধরে দাঁড়াই। দাঙ্গা হচ্ছিল সামনের দিকে, স্পীকারের চারদিকে। শান্তিবাহিনীর ভূমিকা পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কার বাপের সাধ্য এমন পারস্পরিক বেপরোয়া হিংস্র আক্রমণকে প্রতিরোধ করে। আবু হোসেন দলের একজনের নিক্ষিপ্ত জিনিসের আঘাতে শাহেদ আলীর নাক দিয়ে দরদর রক্ত ঝরতে শুরু করল। ২৫শে সেপ্টেম্বর বেলা ১-২০মিনিটের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। পরদিন গিলোটিন করে বাজেট পাশ করার পর অধিবেশন মূলতবী হয়।”//
স্পিকার শাহেদ আলী হত্যায় মুজিবের ভূমিকা আছে এবং শেখ মুজিবই হত্যা করেছে এমন একটি কথা সমাজে বেশ ভালোভাবেই প্রচলিত আছে। যদিও কথাটির সত্যতা কম। উপস্থিত বেশিরভাগ সাক্ষ্যই জানান দেয় কৃষক শ্রমিক পার্টি শাহেদ আলীর ওপর আক্রমণ করেছে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সদস্যরা তা ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার তখন থেকেই শুরু হয়। কৃষক শ্রমিক পার্টি এই অভিযোগ করে পত্রিকায় বিবৃতি দেয় এবং প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্যার কাছে আবু হোসেন নিচের টেলিগ্রামটি করে।
Mujibur Rahman and other leaders attacked Speaker with spears, rods and microphone stands stop imported armed goondas by Awami Leaguers rushed inside Assembly from outside attacked Speaker and opposition members encircling Speaker to save his life were molested and beaten stop despite frantic appeal police refused help stop some opposition members wrongfully confined in Awami Minister’s house stop others threatened with attack anywhere any time stop. ( Justice Asir Commission Report )
আবার শেরে বাংলা ফজলুল হকও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে টেলিগ্রাম করেন। তিনি বলেন,
Mujibur Rahman over Telephone several times threatened me with violence of the worst sort saying I will not be allowed to enter the Assembly. Will be bodily removed adding that no local police will be of help to me. Relation of mine was assaulted last evening. I seek your advice. ( Justice Asir Commission Report. 9th April 1959 )
১৯৫৪ সালে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালিদের জোট যুক্তফ্রন্ট বাংলার ক্ষমতায় আসে। এবং এর ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রেও যুক্তফ্রন্টের অবস্থান তৈরি হয়। ধারণা করা হয়েছিল এর মাধ্যমে পাকিস্তানে সুন্দর গণতন্ত্রের চর্চা হবে। কিন্তু শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দি এবং ভাসানীর হটকারিতা, নির্লজ্জ লোভের ফল ভোগ করতে হয়েছে পুরো পাকিস্তানকে। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতায় ও তাদের বিষাক্ত আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে পুরো পাকিস্তান। অবসান হয় গণতন্ত্রের। আসে আইয়ুব খানের সেনাশাসন। শুরুতে মানুষ আইয়ুবকে স্বাগত জানালেও কিছুদিন পরেই আইয়ুব তার স্বৈরাচারের বিষদাঁত প্রদর্শন করে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন