৮ অক্টো, ২০২০

আল্লাহর রাসূল সা. কি গণহত্যা করেছেন?


আল্লাহর রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে কিছু নালায়েক। ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজাকে দেওয়া শাস্তিকে কেউ কেউ রাসূল সা. গণহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ আনে। আসলে কী ছিলো সেই ঘটনা তা জেনে নেয়া যাক।


খন্দকের যুদ্ধের সময় বহুদিন আবু সুফিয়ানের বাহিনী মদিনা অবরোধ করে রাখে। কিন্তু খন্দক থাকায় তা পেরিয়ে মদিনায় প্রবেশ করতে পারছিলো না। এমতাবস্থায় এক রাতে আল্লাহ তায়ালা তার সেনাবাহিনী পাঠালেন। ভীষণ ধুলি ঝড়ে উড়ে গেল মুশরিকদের সম্মিলিত বাহিনীর তাঁবু ও পশু। তারা হাল ছেড়ে দিল। এর আগের কিছু ঘটনা ও ধূলিঝড় তাদের মনোবল পুরো ভেঙে দিয়েছে। খন্দকের যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময় মুসলিমদের ওপর ভয়াবহ বিপদ আপতিত হয়। একের পর এক বিপদে অনেক মুসলিম উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারা আল্লাহর রাসূল সা. ও নিষ্ঠাবান মুসলিমদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। এই ব্যাপারে সূরা আহযাবের ১২- ২০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিস্তারিত বলেছেন।


বিপদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বিপদ হলো ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজার চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা। তারা মদিনা সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মিত্র শক্তি ছিল। যখন মুসলিমদের ওপর কুরাইশদের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলো তখন তারা মুসলিমদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল সা. তাদের দিক থেকে আক্রমণের আশংকা করেন নাই বিধায় পূর্ণ শক্তি কুরাইশের বিরুদ্ধে মজুদ রেখেছিলেন। এমনিতেই মুসলিমদের শক্তি ছিল অপ্রতুল এর মধ্যে বনু কুরাইজাকে ঠেকানোর জন্য তিনশত সাহাবীর একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। এরপর আল্লাহর রাসূল কূটনৈতিক চাল চাললেন। এতে মুশরিকদের ঐক্য নষ্ট হয়ে পড়ে। একইসাথে বনু কুরাইজার সাথেও তাদের চুক্তি নষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে শেষ পর্যন্ত বনু কুরাইজা আক্রমণের সাহস পায়নি। আর আল্লাহ তায়ালা ধূলিঝড় দিয়ে আবু সুফিয়ানের বাহিনীকে লণ্ডভণ্ড করে দেন।   


পরদিন যোহরের সময় আল্লাহর রাসূল সা. বিজয়ীর বেশে মদিনায় প্রবেশ করলেন। তার শরীর ছিল ধূলোমলিন এবং এবং তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তিনি অস্ত্র রেখে দিলেন ও পাক সাফ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমন সময় জিবরীল আ. রাসূল সা. কাছে মানুষের বেশে আসলেন। তার মাথায় ছিল রেশমের পাগড়ী। তিনি রেশমী কাপড়ে আবৃত একটি খচ্চরে আরোহণ করে ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বললেন, 

- হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন? 

- হ্যাঁ

- কিন্তু ফেরেশতারা এখনও অস্ত্র ত্যাগ করেনি। আর আপনিও রণাঙ্গন থেকে মুসলমানদের দাবীতেই ফিরছেন! হে মুহাম্মাদ আল্লাহ আপনাকে বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযান যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমিও সেখানে যাবো এবং তাদের তছনছ করে ছাড়বো।”


এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে এই মর্মে ঘোষণা করতে বললেন, “যেসব লোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা মানবে, তারা যেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়ে।”


মুহাম্মদ সা. আলীকে রা.-কে পতাকা নিয়ে বনু কুরাইযার এলাকা অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণও তাঁর অনুসরণ করলেন। আলী রা. রওনা হয়ে তাদের দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছতেই রাসূলুল্লাহ সা.-এর বিরুদ্ধে একটা জঘন্য উক্তি শুনতে পেলেন। কিছুক্ষণ পর রাসূল সা. উপস্থিত হলে তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এসব জঘন্য লোকদের কাছে আপনার যাওয়া উচিত নয়।” রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “কেন? মনে হয়, তুমি তাদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে কোনো কটু ও অশ্রাব্য কথা শুনেছো।” আলী রা. বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সত্যই তাই।” 


রাসূলুল্লাহ সা. বনু কুরাইযার ‘আত্তা’ নামক কূপের কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। মুসলমানরা দলে দলে এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে লাগলো। কেউ কেউ ইশার শেষ জামাতের পরেও এলেন। তারা তখনও আছর পড়েননি। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. বলেছিলেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়তে। অনন্যোপায় হয়েই তাঁরা যুদ্ধের খাতিরে নামায বিলম্বিত করেছিলেন। তাই তাঁরা এশার পরে আছর পড়েন। এ জন্য তাঁদেরকে তিরস্কার করা হয়নি। রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখলেন। ফলে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন।


এদিকে কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের লোকজন স্বদেশ অভিমুখে রওনা হয়ে যাওয়ার পর বনু নাদিরের হুয়াই ইবনে আখাতাব বনু কুরাইযার সাথে তাদের দুর্গে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের উদ্দেশ্যেই সে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা সুনিশ্চিতভাবে যখন বুঝতে পারলো যে, রাসূলুল্লাহ সা. তাদের সাথে যুদ্ধ না করে কিছুতেই ফিরে যাবেন না, তখন গোত্রপ্রধান কা’ব ইবনে আসাদ গোত্রের লোকদের ডেকে বললো, 

“হে ইহুদীগণ শোনো! তোমাদের ওপর কি মুসিবত এসেছে দেখতে পাচ্ছো, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখছি। এর যেকোনো একটা গ্রহণ করতে পার।” তারা বললো, “সে প্রস্তাবগুলো কি?” সে বললো, 


প্রথমত; মুহাম্মাদকে আমরা সবাই অনুসরণ করি ও মেনে নেই। আল্লাহর কসম, তিনি যে নবী তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। আমাদের ধর্মগন্থেও তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তানদের জান ও মালের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হতে পারবো।” 

তারা বললো, “আমরা কখনো তাওরাতের কর্তৃত্ব অস্বীকার করবো না এবং তার বিকল্পও গ্রহণ করবো না।” 


দ্বিতীয়ত; এটা যদি না মানো তাহলে এসো আমরা আমাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সবাইকে হত্যা করি। তারপর তরবারি নিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। তখন আমাদের পেছনে কোন ঝামেলা ও দায়দায়িত্ব থাকবে না। তারপর আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবো। যদি আমরা নিহত হই তাহলে আমাদের বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই মরতে পারবো। আর যদি জয়লাভ করি তাহলে নতুন করে স্ত্রী এবং সন্তানাদিও লাভ করতে পারবো।” 

সবাই বললো, “এই নিরীহ প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলবো এও কি সম্ভব? ওরাই যদি না থাকলো তাহলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি?” 


তৃতীয়ত “এটাও যদি অস্বীকার করো তাহলে আর একটা উপায় অবশিষ্ট থাকে। আজ শনিবারের রাত। সম্ভবত, মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীরা আজকে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবে। তাই, এসো, আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করি।” 

তারা বললো, “আমরা কি এভাবে শনিবারটার অমর্যাদা করবো? এ দিনে আমাদের পূর্ববর্তীরা যা করেনি, তাই করবো? অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক করেছিলো। তার ফলে তাদের চেহারাও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নেই।” 


সর্বশেষ কা’ব বললো, “আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে একটি লোকও এমন জন্মেনি, যে সারাজীবনে একটি রাতের জন্যও স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।”


তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দূত পাঠিয়ে অনুরোধ করলো যে, আপনি আমাদের মিত্র আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। তার সাথে আমরা কিছু পরামর্শ করবো।” রাসূলুল্লাহ সা. তাকে পাঠিয়ে দিলেন। আবু লাবাবা গেলে সমগ্র গোত্রের লোক তার পাশে জমায়েত হলো এবং নারী ও শিশুরা তার কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে আবু লুবাবার হৃদয় বিগলিত হলো। তারা বললো, “হে আবু লুবাবা তুমি কি মনে করো, মুহাম্মাদের ফায়সালাই আমাদের মেনে নেয়া উচিত?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সেই সাথে নিজের গলায় হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালেন যে, সে ফায়সালা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এটা ছিল ওনার ধারণাপ্রসূত। তাই তিনি বলেন, “আমি তৎক্ষনাৎ উপলব্ধি করলাম যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকরা করে বসেছি।”


ভুল বুঝতে পেরে আবু লুবাবা পরক্ষণেই কুরাইজার দূর্গ থেকে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে না গিয়ে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে প্রতিজ্ঞা করলেন, “আমি যে ভুল করেছি তা আল্লাহ মাফ করে না দেওয়া পর্যন্ত আমি এই স্থান থেকে নড়বো না, যে মাটিতে আমি আল্লাহ ও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেখানে আমি আর কখনো কাউকে মুখ দেখাবো না।” রাসূলুল্লাহ সা. অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন আবু লুবাবার জন্য। পরে সমস্ত ব্যাপার শুনে বললেন, “সে যদি আমার কাছে আসতো তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু সে যখন এরূপ প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তাকে মুক্ত করতে পারি না।”


প্রায় ছয় রাত আবু লুবাবা রা. নিজেকে বন্দি রাখলেন। কেবল নামাজের সময় হলে তার স্ত্রী বাঁধন খুলে দিতেন। এসময় তিনি ওজু করে নামাজ পড়তেন। সাত দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা আবু লুবাবা রা.-এর তওবা কবুল করলেন। এই প্রসঙ্গে সূরা তাওবার ১০২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, //আর অপর কতক লোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তারা এক সৎকর্মের সাথে অসৎকর্ম মিশ্রিত করেছে। আল্লাহ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাক্ষমাশীল পরম দয়ালু।// 


এই আয়াত নাজিলের পর আম্মাজান উম্মে সালামা রা. বলেন, আবু লুবাবাকে ক্ষমা করা হলে আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাকে এ সুসংবাদ জানাবো?” রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “জানাতে পার।” অতঃপর উম্মে সালামা তাঁর ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আবু লুবাবা, সুসংবাদ! তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।” এরপর তাকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানগণ তার কাছে ছুটে গেল। কিন্তু আবু লুবাবা রা. বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সা. নিজ হাতে মুক্ত করে না দিলে আমি নিজেকে মুক্ত করবো না।” একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযরের নামাযে যাওয়ার সময় তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন।


এখনো বনু কুরাইজা নিজেদেরকে সমর্পন করতে রাজি হয়নি। আবু লুবাবা রা.-এর ক্ষমা ঘোষণা হওয়ার পরদিন তারা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিল। কারণ ততদিনে তাদের রসদ ফুরিয়ে গেছে। তাছাড়া মদিনায় আল্লাহর রাসূল সা. আসার আগে মিত্র গোত্র আউস থেকে তারা এই নিশ্চয়তা পেয়েছে যে, আউসের নেতারা তাদের লঘু শাস্তির জন্য চেষ্টা করবে। বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সা.-এর ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত হলো। খবর শুনে আউস গোত্রের লোকরা যারা এই ইহুদী গোত্রের প্রতি দরদী ছিল তারা মুহাম্মদ সা.-এর নিকট ছুটে এলো। বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, বনু কুরাইযা আমাদের মিত্র। খাযরাজ গোত্রের মুকাবিলায় তারা আমাদের সহায়তা করতো। খাযরাজের মিত্রের (বনু কাইনুকার) ক্ষেত্রে আপনি কি আচরণ করেছেন তাতো আপনার জানাই আছে।” 


২য় হিজরিতে বদর যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ সা. বনু কাইনুকা গোত্রকে অবরোধ করেছিলেন। তারা খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। তারাও মুহাম্মদ সা.-এর ফায়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তাদের প্রাণভিক্ষা চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রাণভিক্ষা মঞ্জুর করেছিলেন। আওস গোত্র রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট বনু কুরাইযার প্রাণরক্ষার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, “হে আউস গোত্রের লোকজন, আমি তোমাদের একজনকে সালিশ নিয়োগ করি তবে তাতে তোমরা রাজী আছ তো?” তারা বললো, ‘হ্যাঁ।’ 


অতঃপর বনু আউসের অনুরোধে হযরত মুহাম্মদ সা. তাদের গোত্রের পণ্ডিত ব্যক্তি সাদ ইবনে মুয়াজ রা.-কে বনু কুরাইজার বিচারের জন্য নিযুক্ত করেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় সাদ রা. আহত হয়েছিলেন। এসময় তীরের আঘাতে তার হাতের শিরা কেটে যায়। যুদ্ধাহত অবস্থায় তাকে বিচারের জন্য নিয়ে আসা হয়। সা’দ রা. রাসূলুল্লাহ সা. ও মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “তোমাদের নেতাকে স্বাগত জানাও।” এরপর সবাই তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “হে সা’দ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে আপনার মিত্রদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব দিয়েছেন।” 


সা’দ বললেন, “আমি যে ফায়সালা ঘোষণা করবো সেটাই ফায়সালা বলে স্বীকৃতি হবে। তোমরা সবাই আল্লাহর নামে তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ?” তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর যে পার্শ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সে দিকে ইশারা করে বললেন, “এখানে যারা আছেন তাঁরাও কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?” সা’দ অবশ্য শ্রদ্ধাবশতঃ রাসূলুল্লাহ সা.-এর কথা উল্লেখ করলেন না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বনু কুরাইজাকে জিজ্ঞাসা করেন তারা তার ব্যাপারে ও তাওরাতের ব্যাপারে আস্থাশীল কিনা। তারা তাতে সায় দিলো। সা'দ রা. সেসময় ঘোষণা দেন বনু কুরাইজার বিচার তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত অনুসারে হবে। সা'দ তাওরাত থেকে পাঠ করতে থাকেন। 


//যখন তোমরা কোনো শহর আক্রমণ করতে যাবে, তখন প্রথমে সেখানকার লোকদের শান্তির আবেদন জানাবে। যদি তারা তোমাদের প্রস্তাব স্বীকার করে এবং দরজা খুলে দেয়, তাহলে সেই শহরের সমস্ত লোকেরা তোমাদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে এবং তোমাদের জন্য কাজ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু যদি শহরের লোকেরা তোমাদের শান্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসে তাহলে তোমরা অবশ্যই শহরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে। এবং যখন শহরটিকে অধিগ্রহণ করতে প্রভু তোমাদের ঈশ্বর তোমাদের সাহায্য করবেন, তখন তোমরা অবশ্যই সেখানকার সমস্ত পুরুষদের হত্যা করবে। কিন্তু তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য স্ত্রীলকদের, শিশুদের, গবাদিপশু ও শহরের যাবতীয় জিনিস নিতে পার। তোমরা এই সমস্ত জিনিসগুলি ব্যবহার করতে পার। প্রভু তোমাদের ঈশ্বর, তোমাদের এই জিনিসগুলি দিয়েছেন।//


এরপর সা’দ ঘোষণা করলেন, “আমার ফায়সালা এই যে, বনু কুরাইজার সব পুরুষকে হত্যা করা হোক, সমস্ত ধনসম্পদ বণ্টন করে দেয়া হোক এবং স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হোক।”

মুহাম্মদ সা. সা’দ রা.-কে বললেন, “তোমার ফায়সালা সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহর যে ফায়সালা এসেছে তারই অনুরূপ।”


এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ২৬ ও ২৭ নং আয়াতে বলেন, //কিতাবীদের মধ্যে যারা কাফেরদের পৃষ্টপোষকতা করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ থেকে নামিয়ে দিলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা একদলকে হত্যা করেছো এবং একদলকে বন্দী করেছো। তিনি তোমাদেরকে তাদের ভূমির, ঘর-বাড়ীর, ধন-সম্পদের এবং এমন এক ভূ-খন্ডের মালিক করে দিয়েছেন, যেখানে তোমরা যুদ্ধ করোনি। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।//


সা'দের সিদ্ধান্ত সকলে মেনে নিতে বাধ্য হলো। বন্দীদেরকে বনু নাজ্জার গোত্রের নারী কাইস বিনতে হারিসার বাড়িতে রাখা হয়। এরপর মদিনার বাজারে গর্ত খুড়ে ৬০০ মতান্তরে ৭০০ বন্দীর শিরচ্ছেদ করা হয়। বনু কুরাইজাকে প্ররোচনাদানকারী হুয়াই বিন আখতাবকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ইতিপূর্বে বনু কুরাইজাকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বনু কুরাইজার ভাগ্য বরণের জন্য হুয়াই তাদের সাথে অবস্থান করছিলেন। তার পোষাক যাতে কেউ নিতে না পারে সেজন্য তিনি তার বিভিন্ন জায়গায় ছিদ্র করে রেখেছিলেন। তাকে নিয়ে আসার পর তিনি হযরত মুহাম্মদ সা. কে উদ্দেশ করে বলেন, "আপনার সাথে শত্রুতার জন্য আমি নিজেকে নিন্দা করি না। কিন্তু যে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ সে পরাজিত হয়।" এরপর ইহুদী লোকেদের সম্বোধন করে বলেন, "লোকেরা, আল্লাহর ফয়সালায় কোনো অসুবিধা নেই। এটা ভাগ্যের লিখিত ব্যাপার। এটি এমন হত্যাকাণ্ড যা বনী ইসরাইলের জন্য আল্লাহ লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন।" এরপর হুয়াই বসে পড়েন ও তার শিরচ্ছেদ করা হয়।


পুরুষদের সাথে এক নারীকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। এই নারী কাল্লাদ বিন সুয়াইদের উপর যাতা ছুড়ে মেরে তাকে হত্যা করেছিল। তাকে হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বন্দী নারী ও শিশুসহ যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয়। তবে মুসলিমদের অনুরোধে বেশ কয়েকজন ইহুদিকে ক্ষমা করা হয়। এছাড়াও বনু কুরাইজার কিছু লোক আত্মসমর্পনের পূর্বে দুর্গ ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে। তাদেরকেও পরিবারসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ধন-সম্পদ, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেন। 


এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইহুদীরা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য প্রায় ২৫ দিন পেয়েছিলো। কিন্তু তারা তা করেনি। এর মধ্যে যারা তাদের নেতার অনুসরণ করেছে তারাই সা'দের বিচারের মুখোমুখি হয়েছে। অন্যদিকে যারা তার আগে নিজ ইচ্ছায় দুর্গ ত্যাগ করে আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে ক্ষমা চেয়েছে তারা ক্ষমা পেয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন