১২ নভে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৬৪ : ঊনসত্তরের গণভ্যুত্থান ও আইয়ুবের পতন

 


পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের নেতৃত্বে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। ক্রমেই সেই আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। ১৯৬৮ সালে আন্দোলনের মূল ফোকাস তৈরি করে আইয়ুবের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ন্যশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (NSF)। ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন মাওবাদী কম্যুনিজম ও পাকিস্তান জাতীয়তাবাদ লালনকারী ছাত্রদের সংগঠন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন  ঘটনা উপঘটনার মধ্য দিয়ে আন্দোলন ক্রমেই বড় হতে থাকে।  

এদিকে বাংলায় ১৯৬৭ সালে পিডিএমের অনেক জনসভা হলেও আন্দোলন সেভাবে জমে উঠেনি। কারণ আন্দোলনের মূল উৎস ছাত্ররা বেশিরভাগ শেখ মুজিবের ছয় দফা আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ১৯৬৭ এর শেষে ও ১৯৬৮ সালের শুরুতে আগরতলা মামলায় বহু আওয়ামী ও ছাত্রলীগ নেতা এরেস্ট হয়েছে। আর যারা এরেস্ট হন নাই যেমন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অন্যান্যরা শেখ মুজিবের আগরতলা ষড়যন্ত্র নিয়ে বেশ বিব্রত ছিলেন। তাই ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন জমে উঠে নি। 

ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফোরাম ঢাবি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন গভর্ণর মোনায়েম খান (কিশোরগঞ্জ)। ১৯৬৮ সালে ছাত্রলীগ আগরতলা ষড়যন্ত্র ইস্যুতে ব্যাকফুটে গেলে মোনায়েম তার সমর্থকদের দিয়ে NSF কে চাঙ্গা করেন। বলাবাহুল্য ঢাবির এই NSF আর পাঞ্জাবের NSF এক ছিল না। ঢাবির NSF সরকারের গুন্ডাবাহিনী হিসেবেই তৈরি হয়েছে। তারা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন তো করেই নি উল্টো আইয়ুব বিরোধীদের শায়েস্তা করতো। ক্যাম্পাসে শক্তি প্রদর্শন, আইয়ুব বিরোধী শিক্ষকদের হেনস্তা করা ইত্যাদি তাদের নিয়মিত কাজ ছিল। ১৯৬৮ সালে আন্দোলন জমাতে না পারার কারণ হিসেবে নিউক্লিয়াস NSF কে দায়ি করে। 

বাংলার রাজনীতিতে অনেক খারাপ ট্রেডিশন শুরু করে নিউক্লয়াস। এর মধ্যে একটি ছিল ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রহত্যা। NSF এর যে ক'জন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ছিল তাদের মধ্যে সাইদুর রহমান, জমির আলী ও মাহবুবুর রহমান খোকা ছিল অন্যতম। এর মধ্যে সাইদুর রহমানের আরেক ব্যঙ্গ নাম ছিল পাচপাত্তু। যতদূর জানা যায় সে পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সে বার বার ফেল করায় প্রমোশন পায় নি। অন্যদিকে তার ক্লাসমেটরা এমএসসি পার্ট টু এর ছাত্র। সে নাকি নিজেকে এমএসসি পার্ট টু এর ছাত্র দাবী করতো অথচ তার পাস কোর্স শেষ হয় নি। অবশেষে তাকে আড়ালে ব্যঙ্গ করে ডাকা হতো সাইদুর রহমান পাস পার্ট টু। পাসপার্টটু ধীরে ধীরে পাচপাত্তুতে পরিণত হয়। ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে ছাত্রলীগ (নিউক্লিয়াস) NSF কে ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করার উদ্যোগ নেয়। এজন্য তারা তিন নেতা পাচপাত্তু, জমির ও খোকাকে হত্যার ঘোষণা দেয়। এর কিছুদিন পর অক্টোবর মাসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিউক্লিয়াস পাচপাত্তুকে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে খুন করে। জমির ও খোকা পালিয়ে যায়। শুরুতে ছাত্রলীগ আনন্দ মিছিল করলে। খুনের আসামী ধরতে প্রশাসন তৎপরতা চালালে ছাত্রলীগও ক্যাম্পাস ছাড়া হয়। 

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন আইয়ুবের ভিত নড়ে উঠেছে। আইয়ুবের পতন এখন পিডিএম, NSF এবং ভুট্টোর একক দাবিতে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় আইয়ুব মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বন্ধু ভাসানীর দারস্থ হয়েছে। সে চেয়েছিলো ভাসানীর মাধ্যমে ছয় দফার পক্ষে, আগরতলার দেশবিরোধী আসামীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করিয়ে নিতে। কারণ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাচ্ছে বা ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখলে নিচ্ছে এমন ভয় দেখিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের আন্দোলন কন্ট্রোল করতে চেয়েছিলেন। পুর্ব পাকিস্তানে কোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাইরে কোনো হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন সফল করতে দিচ্ছেন না চৌকস মোনায়েন খান। তিনি শক্ত হাতে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন। পুলিশকে দিয়ে গুলি না করিয়ে তিনি আন্দোলন তৈরি করতে পারে এমন নেতাদের চাপে রেখেছিলেন। ফলে ঢাকা ছিল নিরুত্তাপ। তিনি পাচপাত্তু খুনের ঘটনায়ও মাথা গরম করেন নি।  

আইয়ুবের ইশারায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ২৮ নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের এক যৌথসভায় ৬ ডিসেম্বরকে জুলুম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় মাওলানা ভাসানী বলেন “পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি মানিয়া না লইলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বাধীন পূর্ব বাংলা গঠন করিবে। পল্টনের ওই জনসভায় পরদিন ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় হরতাল আহবান করা হয়। ওই দিনে পুলিশ মিছিলে গুলি চালিয়ে তিন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়। ব্যাস! আন্দোলন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে শহর-বন্দরগঞ্জে। চারদিকে নিউক্লিয়াস সক্রিয় হয়ে ওঠে। মোনায়েম খান ভাসানীকে এরেস্ট করেননি। ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ভাসানী একাই আন্দোলনে গতি এনে দেন। পুলিশ নিষ্ক্রিয় প্রায়। 

ভাসানী তার সভা সমাবেশে আইয়ুব বিরোধী কথা না বলে একের পর স্বাধীনতার প্রস্তাব ও শেখ মুজিবের মুক্তির কথা বলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে নিউক্লিয়াস দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। তারা কি ভাসানী সামনে রেখে বিপ্লব করে ফেলবে! নাকি আওয়ামী লীগ অথবা শেখ মুজিবের জন্য অপেক্ষা করবে! তবে তারা ভাসানীর দিকেই ঝুঁকেছে বেশি। অন্যদিকে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ পরিচালনা করছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। যতদূর জানা যায় তিনি নিউক্লিয়াসের ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তাই নিউক্লিয়াসের প্রভাবও তার ওপর বিদ্যমান ছিল না। তাই তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণভিত্তি তৈরির বাইরে যে কোনো কর্মসূচীকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হলো মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি। আওয়ামী লীগের চাইতে ন্যাপ বেশি ভূমিকা রাখছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উইথড্রো করতে, শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। 

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ :

১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ডাকসু, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ, মাওবাদী) ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ, মার্ক্সবাদী)-এর নেতৃবৃন্দ ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে এবং তাদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ দফার মধ্যে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ৬ দফার সাথে ছাত্র সমস্যাকেন্দ্রিক দাবি দাওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংক্রান্ত দাবিসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১১ দফা কর্মসূচি আন্দোলনে ব্যাপক গতি এনে দেয়। 

১১ দফা নিম্নরূপ~

১. হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত আইন বাতিল করা এবং ছাত্রদের সকল মাসিক ফি কমিয়ে আনা।

২. প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দেওয়া এবং দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া।

৩. ছয় দফা দাবির শর্তানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা।

৪. পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশগুলোকে (অর্থাৎ, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু) স্বায়ত্তশাসন দিয়ে একটি ফেডারেল সরকার গঠন করা।

৫. ব্যাংক, বীমা, পাটকলসহ সকল বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ।

৬. কৃষকদের উপর থেকে কর ও খাজনা হ্রাস এবং পাটের সর্বনিম্নমূল্য ৪০ টাকা ধার্য করা।

৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং শ্রমিক আন্দোলনে অধিকার দান।

৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ।

৯.জরুরি আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার।

১০. সিয়াটো (SEATO), সেন্ট্রো (CENTRO)-সহ সকল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং জোট বহির্ভূত নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ।

১১. আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি ও অন্যান্যদের উপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেয়া।

ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি :

৮ জানুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তানে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি সংক্ষেপে ডাক (DAC) গঠনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির (ডাক) শরীকদল ছিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (মুজিব), পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (তর্কবাগীশ), জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (তোয়াহা, মার্ক্সবাদী), পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ, পাকিস্তান জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। ভাসানীর সাথে আইয়ুবের যোগাযোগ ও ভাসানীর প্রতারণামূলক কর্মপদ্ধতি সবার জানা। তাই কোনো বিরোধী দল ভাসানীর সাথে যুগপৎ আন্দোলনে রাজি হয় নি। তাই ভাসানী আন্দোলন শুরু করলেও কেউ তার সাথে যুক্ত হয় নি।  

ডেমোক্রেটিক একশন কমিটির আট দফা দাবি 

১- ফেডারেল পার্লামেন্ট সরকার প্রবর্তন 

২- প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচন 

৩- আবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার 

৪- নাগরিক অধিকার বহাল ও সকল কালাকানুন বাতিল 

৫- শেখ মুজিবুর রহমান, খান আব্দুল ওয়ালী, জুলফিকার আলী ভুট্টোর মুক্তিদান 

৬- ১৪৪ ধারার আওতায় সকল প্রকার আদেশ প্রত্যাহার 

৭- শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার বহালকরণ 

সংবাদ পত্রের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং বাজেয়াপ্তকৃত সকল প্রেস ও পত্রিকা পুনর্বহালকরণ

ডাক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ও সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভা ও প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি হাতে নেয় তারা। এ মিছিলে পুলিশের গুলিতে মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম নেতা আসাদউজ্জামান নিহত হলে গণজাগরণ রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানের। এরপর ২৪ জানুয়ারি গুলিতে নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে রুস্তম নিহত হলে ঢাকার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শহরের নিয়ন্ত্রণভার সেনাবাহিনীর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়। পরদিন সেনাবাহিনী ও ই.পি.আর-এর বেপরোয়া গুলিতে ঢাকার নাখালপাড়ায় গৃহবধূ আনোয়ারা বেগম গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে তার প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র। 

এদিকে বাইরের পরিস্থিতি অনেক উত্তপ্ত দেখে ক্যান্টনমেন্টে আটকে থাকা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হক বিদ্রোহ করে বসে। তারা ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে এক সৈনিকের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে জিম্মি করে। তাদের প্রচেষ্টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জহুরুল হক ও ফজলুল হক দু'জনই গুলিবিদ্ধ হন। তাদের সিএমএইচ-এ চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু সংবাদে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যায়। আন্দোলন আরো ভয়ানক হয়ে ওঠে। এমন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে যে, ঐদিন বিকেলে মওলানা ভাসানী তার জনসভায় দু’মাসের মধ্যে ১১ দফার বাস্তবায়ন এবং সকল রাজবন্দির মুক্তি দেওয়া না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি আরও বলেন যে, প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মতো জেলখানা ভেঙ্গে শেখ মুজিবকে ছিনিয়ে আনা হবে। সভাশেষে ছাত্রলীগ (নিউক্লিয়াস) মন্ত্রী ও বিচারকদের ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করে। 

 এভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে চলা যুগপৎ আন্দোলনে ও গণঅভ্যুত্থানের প্রবল চাপে আইয়ুব পিছু হটেন। তিনি শেখ মুজিবের সাথে সমঝোতা করে ফেলেন। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনা করার জন্য তিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। তিনি চেয়েছেন যেন আন্দোলনকারী সব দল তার সাথে আলোচনায় বসে। 

২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে আইয়ুব খান। শেখ মুজিবসহ ৩৪ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ তারিখ গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে। সেখানে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। সারা ঢাকা শহরে আনন্দ মিছিল করে ছাত্রলীগ। রণক্ষেত্র ঢাকা থেকে উৎসবের ঢাকায় পরিণত হয়। মুজিব তার জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান। বক্তৃতায় শেখ মুজিব সব বিরোধী দলকে শান্ত থাকার জন্য আহবান করেন এবং প্রেসিডেন্টের সাথে গোল টেবিল আলোচনায় যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি আইয়ুবের প্রতি আস্থা রাখার জন্য আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দলকে আহ্বান জানান। 

মুজিবের মুক্তির পর রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড়ে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি ভাসানী ও মুজিবের সাথে বৈঠক করেন। ধারণা করা হয় তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মুজিবের মুক্তির পর থেকে ঢাকায় আন্দোলন সংগ্রাম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শেখ মুজিবের অনুরোধে ডেমোক্রেটিক একশন কমিটি আইয়ুবের সাথে আলোচনায় যোগ দিতে রাজি হয়। অবশেষে ২৬ তারিখ গোলটেবিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। নানান বিষয়ে ও দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ঈদুল আযহা উপলক্ষে বিরতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আবারো ১৯৬৯ সালের ১০ মার্চ থেকে গোলটেবিল আলোচনা শুরু হয়। গোলটেবিল আলোচনায় ভাসানী ও ভুট্টো অংশগ্রহণ করেনি। 

এদিকে ভুট্টো ও পশ্চিম পাকিস্তানের NSF আন্দোলন থেকে একচুলও সরে আসে নি। বরং আরো বেশি জ্বালাও, পোড়াও, অবরোধ শুরু করে দিয়েছে। তাদের একটাই দাবি, আইয়ুবের পতন হতে হবে। ১৩ মার্চ গোলটেবিল আলোচনার সমাপ্তি হয়। সমাপ্তিকালে আইয়ুব খান প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন এবং ফেডারেল পার্লামেন্টারি প্রবর্তনের দাবি মেনে নিয়েছেন বলে ঘোষণা দেন।  তার এই ঘোষণা ভুট্টোকে থামাতে পারে নি। পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় আইয়ুব খানের ওপর সেনাবাহিনীর চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। 

আমাদের অনেক ভুল ইতিহাস শেখানো হয় তার মধ্যে একটি হলো, ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকায় সৃষ্টি হওয়া গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন হয়। মূলত আইয়ুবের বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (PDM)-এর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ১৯৬৭ সালে। তারই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি ও NSF এর আন্দোলন শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবকে মুক্ত করার আন্দোলন শুরু হয় ৮ ডিসেম্বর এবং এই আন্দোলনের শেষ হয় ২২ ফেব্রুয়ারি। PDM ও DAC এক পর্যায়ে আইয়ুব খানকে রেখেই শান্তিপূর্ণ সমাধানে রাজি হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো ও NSF আন্দোলন চালিয়ে গেলে আইয়ুব খানের পতন হয় ২৫ মার্চ।    

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন