আগরতলা হলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী। এখানে নিউক্লিয়াসের মধ্যস্থতায় ১৯৬৭ সালে এক গভীর ষড়যন্ত্র অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসার ও সিপাহি অতি গোপনে সংগঠিত হতে থাকেন। এর নেপথ্যে কাজ করে নিউক্লিয়াস। তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ লক্ষ্যে অতি গোপনে কাজ করে যেতে থাকেন। তাদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল ভারতীয় মুশরিকদের সহায়তা। চিত্তরঞ্জন সুতার ও কালিদাস বৈদ্যের মধ্যস্থতায় নিউক্লিয়াস বাঙালি অফিসারদের সাথে ভারতীয় অফিসারদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়।
ভারতীয় অফিসাররা এই নিউক্লিয়াস ও কয়েকজন সেনা অফিসারদের ওপর আস্থা রাখতে পারে নি। তাই তারা নিউক্লিয়াসকে শর্ত দেয় জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ছাড়া নিউক্লিয়াসকে সহায়তা করা যাবে না। আর গণভিত্তি না থাকলে ভারতের পক্ষে সহায়তা করা উচিত হবে না এবং এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না। ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিবকে বুঝিয়ে রাজি করে সিরাজুল আলম খান। শেখ মুজিব ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করে নিউক্লিয়াসের কথার সত্যতা যাচাই করেন। এরপর তিনি ভারতীয় গোয়েন্দাদের সাথে আলোচনা করার জন্য ১৯৬৭ সালের শেষদিকে আগরতলায় যান। আগরতলা গিয়ে শেখ মুজিব লে. কর্নেল মিশ্র ও মেজর মেননের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেন। যতদূর জানা যায় আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। শেখ মুজিব ও মুশরিকদের মধ্যে বনিবনা হয় নি। শেখ মুজিব আবার পাকিস্তানে চলে আসেন।
অত্যন্ত গোপনে এই মিটিং করার চেষ্টা করলেও পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার কারণে এ ষড়যন্ত্র প্রকাশ পায়। যারা মুজিবের সাথে মুশরিকদের এই মিটিং-এর কারিগর তারা প্রত্যেকে আলাদাভাবে ভারত গিয়েছে ও ভারত থেকে এসেছে। পাকিস্তানী গোয়েন্দারা কাউকে এরেস্ট না করে নজরদারীতে রেখেছিল। কারণ তখন একজনকে এরেস্ট করলে বাকীরা সতর্ক হয়ে যাবে এবং হয়তো ভারত থেকে আর ফিরবে না। তাই পাকিস্তানী গোয়েন্দারা গাদ্দারদের ধরার জন্য অপেক্ষা করলো। যখন সবাই ভারত থেকে ফিরে এসে কাজে যোগ দিলো তখন একযোগে সবাইকে গ্রেপ্তার করলো।
গোয়েন্দাবাহিনী সারা পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার আওয়ামী কর্মীকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে কালিদাস বৈদ্যও ছিল। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি এক প্রেসনোটে ঘোষণা করে যে, সরকার ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। এ ঘোষণায় ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ৮ জনের গ্রেফতারের খবর প্রকাশ পায়। এতে অভিযোগ করা হয় যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল। স্বরাষ্ট্র দফতর ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি অপর এক ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করে।
সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা ঘোষণা দেয়। এই মামলায় আসামি করা হয়েছিল তাদের নাম
১। শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর)
২। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (বরিশাল)
৩। স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান (মাদারীপুর)
৪। প্রাক্তন লিডিং সি ম্যান সুলতান উদ্দিন (নোয়াখালি)
৫। প্রাক্তন এবল সি ম্যান নুর মোহাম্মদ (ঢাকা)
৬। আহমদ ফজলুর রহমান সিএসপি (ঢাকা)
৭। ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ (নোয়াখালি)
৮। প্রাক্তন কর্পোরেল এবি সামাদ (বরিশাল)
৯। দলিল উদ্দিন (বরিশাল)
১০। রুহুল কুদুস সিএসপি (খুলনা)
১১। ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (বরিশাল)
১২। ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী (চট্টগ্রাম)
১৩। বিধানকৃষ্ণ সেন (চট্টগ্রাম)
১৪। সুবেদার আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা)
১৫। ইপিআর টিএস ক্লার্ক মুজিবর রহমান (কুমিল্লা)
১৬। সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা)
১৭। সার্জেন্ট জহুরুল হক (নোয়াখালি)।
১৮। মোহাম্মদ খুরশিদ (ফরিদপুর)
১৯। খান মোহাম্মদ শামছুর রহমান সিএসপি (ঢাকা)।
২০। রিসালদার শামসুল হক (ঢাকা)
২১। হাবিলদার আজিজুল হক (বরিশাল)
২২। এসএসি মাহফজুল বারি (নোয়াখালি)
২৩। মেজর শামসুল আলম (ঢাকা)
২৪। সার্জেন্ট শামসুল হক (নোয়াখালি)
২৫। ক্যাপ্টেন মোতালিব (ময়মনসিংহ)
২৬। ক্যাপ্টেন শওকত আলী (ফরিদপুর)
২৭। ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হুদা (বরিশাল)
২৮। ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান (ঢাকা)
২৯। সার্জেন্ট আবদুল জলিল (ঢাকা)
৩০। মাহবুবুদ্দিন চৌধুরী (সিলেট)
৩১। লে. এস এম রহমান (যশোর)
৩২। সাবেক সুবেদার তাজুল ইসলাম (বরিশাল)
৩৩। মোহাম্মদ আলী রেজা (কুষ্টিয়া)
৩৪। ক্যাপ্টেন খুরশিদ (ময়মনসিংহ)
৩৫। লে. আবদুর রউফ (ময়মনসিংহ)
আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলায় ৩৫ জনের মধ্যে মাত্র একজন রাজনীতিবিদ। বাকীরা সবাই সরকারের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। নিউক্লিয়াস সদস্যদের মধ্যে এগারো জন রাজস্বাক্ষী হয়। ফলে শেখ মুজিব ও আওয়ামী কতিপয় নেতার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। সাক্ষ্যদের সাক্ষ্যে ও বাকীদের রিমান্ড থেকে পাওয়া তথ্যের মাধ্যমে প্রতিদিনই পত্রিকায় তাদের কুকীর্তি ফলাও করে প্রকাশ করছে সরকার। যতই কুকীর্তি প্রকাশ করছে জনতা ততই উত্তপ্ত হচ্ছিল মুজিবের বিরুদ্ধে। অবস্থা বেগতিক দেখে আওয়ামী নেতারা ও শেখ মুজিব পুরো ঘটনা অস্বীকার করে। একে আইয়ুবের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করতে থাকে। বাঙালিরা অবশ্য স্বৈরাচারী আইয়ুবকে নয় ষড়যন্ত্রকারী শেখ মুজিবের ওপর আস্থা রেখেছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই মামলাকে বানোয়াট মামলা হিসেবে সাব্যস্থ করেছিলো। এই মামলাকে তাই বলা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা মামলা।
যে এগারো জন নিউক্লিয়াস কর্মী রাজসাক্ষি হলেন, তারা হলো,
১। লে. মোয়াজ্জেম হোসেন (ময়মনসিংহ)
২। প্রাক্তন কর্পোরেল আমির হোসেন মিয়া (মাদারীপুর)
৩। সার্জেন্ট শামসুদ্দিন আহমদ (ময়মনসিংহ)
৪। ডা. সৈয়দুর রহমান (চট্টগ্রাম)
৫। মির্জা রমিজ (চট্টগ্রাম)
৬। ক্যাপ্টেন আবদুল জলিল ভূইয়া (কুমিল্লা)
৭। কর্পোরেল জামালউদ্দিন (পাবনা)
৮। কর্পোরেল সিরাজুল ইসলাম (কুমিল্লা)
৯। মোহাম্মদ গোলাম আহমদ (মাদারীপুর)
১০। মোহাম্মদ ইউসুফ (বরিশাল)
১১। সার্জেন্ট আবদুল হালিম (কুমিল্লা)
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ব্রিটিশ আইনজীবী ও পার্লামেন্ট সদস্য টমাস উইলিয়াম। তাকে সহায়তা করেন এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ। এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান ও আতাউর রহমান খান উভয়েই ছয় দফা ইস্যুতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। শেখ মুজিব তাদের আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু এই দুই নেতা যখন দেখলেন মুজিব যেভাবে ফেঁসে গিয়েছে নিশ্চয়ই তার ফাঁসী হওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। তাই তারা মুজিবকে রক্ষায় আইনী সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলেন। অন্যদিকে মুজিব যাদের পরামর্শে এই গাদ্দারির সাথে যুক্ত হলেন তারা সটকে পড়েছিলো। এই ঐতিহাসিক মামলায় মুজিব আত্মপক্ষ সমর্থনে যে জবানবন্দী দেন তার রাজনৈতিক তাৎপর্য অপরিসীম।
শেখ মুজিবুর রহমান তার জবানবন্দীতে বলেন,
//স্বাধীনতাপূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হইতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে আমাকে আমার লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে। স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলে, ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও ছিল এবং এখনও সেইরূপ একটি নিয়মতান্ত্রিকতার পথানুসারী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিদ্যমান। ১৯৫৪ সালে আমি প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদে এবং পরে জাতীয় বিধানসভায় সদস্য নির্বাচিত হই। আমি দুইবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিত্ব লাভ করি। অধিকন্তু আমি গণচীনে প্রেরিত বিধান পরিষদের এক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করি। জনসাধারণের কল্যাণার্থে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীদল গঠন করার জন্য আমাকে ইতিমধ্যে কয়েক বৎসর কারা-নির্যাতন ভোগ করিতে হইয়াছিল।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর হইতেই বর্তমান সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে। ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় দেড় বৎসরকাল বিনা বিচারে আটকে রাখে। আমাকে এইভাবে আটক রাখাকালে তাহারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। কিন্তু আমি ঐ সকল অভিযোগ হইতে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করি। ১৯৫৯-এর ডিসেম্বর কিংবা ১৯৬০-এর জানুয়ারিতে আমার উক্ত আটকাবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিলাভকালে আমার উপর কিছু কিছু বিধি-নিষেধ জারি করা হয়, যেমন : ঢাকা ত্যাগ করলে আমাকে গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে এবং প্রত্যাবর্তনের পরেও একইভাবে সে বিষয় তাহাদিগকে অবগত করাইতে হইবে। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা এই সময় সর্বদা ছায়ার মতো আমার পিছু লাগিয়া থাকিত।
অতঃপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারির প্রাক্কালে যখন আমার নেতা মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয় তখন আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সবলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয় এবং প্রায় ছয় মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং আমরা সম্মিলিত বিরোধী দলের অঙ্গদল হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সম্মিলিত বিরোধী দল এই সময় প্রেসিডেন্ট পদে জনাব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মোহ্তারেমা ফাতেমা জিন্নাহকে মনোনয়ন দান করে। আমরা নির্বাচনী অভিযান শুরু করি। সরকারি কর্তৃপক্ষও পুনরায় আমার বক্তৃতা সম্পর্কে কয়েকটি মিথ্যা মামলা দায়ের করিয়া আমাকে বিরক্ত ও লাঞ্ছিত করিতে থাকে।
১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। যুদ্ধ প্রচেষ্টার সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্যও আমার দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করে। যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করি।
সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশসহ বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। আমি তাসখন্দ ঘোষণাকেও সমর্থন করিয়াছিলাম। কারণ আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে আস্থাবান আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হওয়া উচিত। ১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনীর বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান ৬-দফা কর্মসূচী উপস্থিত করি। ৬-দফা কর্মসূচীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের জন্যেই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হইয়াছে। অতঃপর আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৬-দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুকূলে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্যে ৬-দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়।
ইহাতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারি নেতৃবৃন্দ ও সরকারি প্রশাসনযন্ত্র আমাকে ‘অস্ত্রের ভাষায়’ ‘গৃহযুদ্ধ’ ইত্যাদি হুমকি প্রদান করে এবং একযোগে এক ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে আমি যখন খুলনায় একটি জনসভা করিয়া যশোর হইয়া ঢাকা ফিরিতেছিলাম তখন তাহারা যশোরে আমার পথরোধ করে এবং আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে ঢাকা হইতে প্রেরিত এক গ্রেফতারী পরোয়ানাবলে এইবারের মতো প্রথম গ্রেফতার করে। আমাকে যশোরের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে উপস্থিত করা হইলে তিনি আমাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন প্রদান করেন। আমি ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা প্রশাসকের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি আমার জামিনে অসম্মত হন, কিন্তু মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিনবলে আমি সেই দিনই মুক্তি পাই এবং সন্ধ্যা ৭টায় নিজগৃহে গমন করি। সেই সন্ধ্যা, ৮টায়, পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতার উপর সিলেট হইতে প্রেরিত এক গ্রেফতারী পরোয়ানাবলে আমার বাসগৃহ হইতে আমাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সেই রাত্রেই আমাকে সিলেট লইয়া যায়।
পরদিন প্রাতে আমাকে আদালতে উপস্থিত করা হইলে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিনের আবেদন বাতিল করিয়া আমাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। পরদিবস সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন প্রদান করেন, কিন্তু মুক্ত হইবার পূর্বেই পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে আমাকে কারা দরজায়ই গ্রেফতার করে। এবারের গ্রেফতারী পরোয়ানা মোমেনশাহী হইতে প্রেরিত হইয়াছিল। সেই রাত্রে আমাকে পুলিশ পাহারাধীন মোমেনশাহী লইয়া যাওয়া হয় এবং একইভাবে মোমেনশাহীর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিন প্রদানে অস্বীকৃতি হন এবং পরে মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিনে মুক্তিলাভ করিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি। উপরিউক্ত সকল ধারাবাহিক গ্রেফতারী প্রহসন ও হয়রানি ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হয়।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, সম্ভবত ৮ মে, আমি নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করি এবং রাত্রে ঢাকায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করি। রাত ১টার সময় পুলিশ ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুল’ এর ৩২ ধারায় আমাকে গ্রেফতার করে। একই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। আমার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহীদুল ইসলামকেও কারারুদ্ধ করা হয়।
অধিকন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাককেও বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইহার একমাত্র কারণ হইল যে, ইত্তেফাক মাঝে মাঝে আমার প্রতিষ্ঠানের নীতিসমূহ সমর্থন করিত। সরকার ইহার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং ইহার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়াকে দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ রাখিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারী মামলা দায়ে করে। যুগপৎ চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার্স অব কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন সহ-সভাপতি ও অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষা বিধিবলে অন্ধ কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়।
আমাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আমার প্রতিষ্ঠান ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। প্রদেশব্যাপী এই হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১১ ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশ প্রায় ৮০০ লোক গ্রেফতার করে এবং অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব মোনেম খান প্রায়শই তাঁহার লোকজন এবং সরকারি কর্মচারী সমক্ষে উন্মুক্তভাবে বলিয়া থাকেন যে, যতদিন তিনি গদিতে আসীন থাকিবেন ততদিন শেখ মুজিবকে শৃঙ্খলিত থাকিতে হইবে। ইহা অনেকেই অবগত আছেন। আটকাবস্থায় কারাকক্ষেই আমাকে বেশ কয়েকবার বিচারের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে।
প্রায় ২১ মাস আটক রাখিবার পর ১৯৬৮ সালের ১৭/১৮ তারিখে রাত ১টার সময় আমাকে তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হইতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বল প্রয়োগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখে। আমাকে বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয় এবং কাহারো সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকে খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না, বিশ্ব হইতে সকল যোগাযোগবিহীন অবস্থায় এইভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচ মাসকাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযোগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। এই মানসিক অত্যাচার সম্বন্ধে যত অল্প প্রচার করিতে হয় ততই উত্তম।
এই বিচারকার্য শুরু হওয়ার মাত্র একদিন পূর্বে, ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন, আমি প্রথম এ্যাডভোকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষাৎ করি এবং তাঁহাকে আমার অন্যতম কৌশলী নিয়োগ করি। কেবলমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালাইবার জন্য এবং আমার দলকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনোবৃত্তি লইয়া আমাকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে। ৬-দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চাকরির সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমতার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা এবং নিষ্পেষণ করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য।
এই আদালতে আসিবার পূর্বে আমি লে. কঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, লে. মোজাম্মেল হোসেন, এক্স-কর্পোরাল আমির হোসেন, এল এস সুলতান উদ্দিন আহম্মদ, কামাল উদ্দিন আহাম্মদ, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজ উল্লাহ্ ও এই মামলায় জড়িত অন্যান্য স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মচারীদের কখনো দেখি নাই। জনাব আহমদ ফজলুর রহমান, জনাব রুহুল কুদ্দুস ও জনাব খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান এই তিনজন সিএসপি অফিসারকে আমি জানি। আমি মন্ত্রী হিসাবে সরকারি কার্য সম্পাদনকালে তাঁহাদিগকে জানিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম এবং তাঁহারাও তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাদের সঙ্গে কখনো রাজনীতি বিষয়ক আলোচনা করি নাই কিংবা কোনো ষড়যন্ত্রেও ব্যাপৃত হই নাই। আমি কোনদিন লে. কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসগৃহে অথবা করাচীতে জনাব কামালউদ্দিনের বাসগৃহে গমন করি নাই কিংবা আমার অথবা লে. কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেনের অথবা করাচীতে জনাব কামাল উদ্দিনের বাসগৃহে কোন সভাও অনুষ্ঠিত হয় নাই কিংবা তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোন ব্যক্তির সহিত কোন আলোচনা আমার অথবা জনাব তাজউদ্দীনের বাসায় সংঘটিত হয় নাই।
ঐ সকল ব্যক্তি কোনদিন আমার গৃহে গমন করে নাই এবং আমিও এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত কাহাকেও টাকা দিই নাই। আমি কখনো ডা. সাঈদুর রহমান কিংবা মানিক চৌধুরীকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করিতে বলি নাই। তাঁহারা চট্টগ্রামে আমার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শত শত সাধারণ কর্মীদের ন্যায় মাত্র। আমার প্রতিষ্ঠানে তিনজন সহ-সভাপতি, ৪৪ জন নির্দেশনা পরিষদ সদস্য, একজন সাধারণ সম্পাদক এবং আটজন মন্ত্রী, এম.এন.এ ও এম.পি.এ.। বর্তমানে কেন্দ্রীয় পরিষদের পাঁচজন ও প্রাদেশিক পরিষদের ১০ জন সদস্য আমার প্রতিষ্ঠানভুক্ত। চট্টগ্রামেও আমার প্রতিষ্ঠানের জেলা ও শহর সভাপতি ও সম্পাদকগণ; প্রাক্তন এম.এন.এ., এম.পি.এ. ও অনেক বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ বিদ্যমান। আমি তাঁহাদের কাহারও নিকট কোন প্রকার সাহায্যের কথা উল্লেখ করি নাই। ইহা অসম্ভব যে, আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী মানিক চৌধুরী ও একজন সাধারণ এল.এম.এফ. ডাক্তার সাঈদুর রহমানকে কোনো সাহায্যের জন্যে অনুরোধ করিতে পারি।
১৯৬৫ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব জহুর আহাম্মদ চৌধুরীর বিরোধিতা করিবার জন্যে ডা. সাঈদুর রহমানের গৃহে আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছিল। আমি ডা. সাঈদুর রহমানের গৃহে কদাপি গমন করি নাই। আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইহা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচী রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নই। আমি দেশের উভয় অংশের জন্যে ন্যায় বিচার চাহিয়াছিলাম। ৬-দফা কর্মসূচীতে ইহাই বিধৃত হইয়াছে। দেশের জন্যে আমি যাহাই করিয়াছি ভাবিয়াছি আমি সর্বদাই তাহা নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডির ভিতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি এবং এই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসকগোষ্ঠী এবং স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহীত হইতে হইয়াছে। তাহারা আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে দমন করিয়া পাকিস্তানের জনগণের, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ ও নিষ্পেষণ অব্যাহত রাখিতে চায়।
আমার উক্তির সমর্থনে আমি মহামান্য আদালত আরো নিবেদন করতে চাই যে, আমাকে প্রতিহিংসাবশত মিথ্যা এই মামলায় জড়িত করা হইয়াছে। পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে অভিযুক্ত বলিয়া কথিত ২৮ ব্যক্তির নাম লিপিবদ্ধ ছিল এবং উহার মধ্যে আমার নাম ছিল না। উক্ত প্রচারপত্রে ইহাও উল্লেখ করা হইয়াছিল যে, সকল অভিযুক্তই অভিযোগ স্বীকার করিয়াছে তদন্ত প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে এবং শীঘ্রই বিষয়টি বিচারার্থে আদালতে প্রেরণ করা হইবে।
একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসেবে অর্জিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্বরাষ্ট্র বিভাগের উক্ত প্রচারপত্র সম্বন্ধে এ কথা জানাইতে চাই যে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সেক্রেটারি কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে দলিলপত্র পরীক্ষিত ও অনুমোদিত হওয়া ব্যতিরেকে কোন বিভাগ হইতে কোন প্রকার প্রচারপত্র প্রকাশ করা যায় না এবং এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে কোন প্রচারপত্র প্রকাশ করিতে হইলে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাভ আবশ্যক। বর্তমান মামলা উল্লিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নহে। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্র জাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া। আমি কখনো পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার জন্যে কোন কিছু করি নাই কিংবা কোনদিনও এই উদ্দেশ্যে কোন স্থল, নৌ বা বিমানবাহিনীর কোন কর্মচারীর সংস্পর্শে কোন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই।
আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।//
আগরতলা ষড়যন্ত্র বিষয়ে শেখ মুজিবের এই জবানবন্দী মিথ্যা তা পরবর্তীতে অনেকের কথায় প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন, এই মামলার ২৬ নং আসামী ক্যাপ্টেন শওকত আলীর কথায়। তিনি সত্য মামলা আগরতলা নামে একটি বই লিখে মুশরিকদের সাথে করা পুরো ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। বইটির ভূমিকায় তিনি বলেন, //জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যাঁরা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম, “ষড়যন্ত্র” শব্দটি তাঁদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেব, তাদের বন্দী করব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবো।//
এছাড়া ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী বলেন, //আগরতলা মামলা ষড়যন্ত্র ছিল না, এটা ছিল সত্য। মামলাটি ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য। এই অন্যান্যদের মধ্যে আমরা ৩৪ জন ছিলাম। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন আমাদের ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির করা হয়। সে সময় পাকিস্তানের ওই বিশেষ আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। অভিযোগে বলা হয়, আপনারা পাকিস্তানের পূর্বভাগ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথক করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই অভিযোগটি সত্য ছিল।//
কর্নেল শওকতের এই কথায় প্রমাণ হয় সেসময় মিথ্যে কথা বলে শেখ মুজিব ও তৎকালীন আওয়ামী নেতারা এদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিলো। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ অভিযোগ এনেছিলে। তারা সেসময় জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য ও সম্ভাব্য শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তারা জনগণ ও আদালতকে মিথ্যা বলেছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন