২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস। সেদিন সকল সরকারি অফিস আদালতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কথা। সেদিন ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের পতাকার স্থলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে আওয়ামীলীগ। এই পতাকার নকশা তৈরি করে ১৯৬৮ সালে নিউক্লিয়াস। বাংলাদেশের এই পতাকা সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে উত্তোলন করা হয় ২ মার্চ শেখ মুজিবের বাসার সামনে। শেখ মুজিব সেটা তৎক্ষণাৎ নামিয়ে ফেলে। এরপর বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলাকারী লোকদের হাতে এই পতাকা দেখা যায়। ৭ মার্চ ভাষণের সময় অনেকে হাতে এই পতাকা দেখা যায়।
২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের অফিসসহ ঢাকার অনেক স্থানে পাকিস্তানের পতাকার বদলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর মাধ্যমে স্পষ্ট মেসেজ দিতে থাকে আওয়ামীলীগ যে, তারা দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায়। তারা পাকিস্তানের নেতৃত্ব চায় না। বরং পাকিস্তানকে ভাগ করে দিতে চায়। অথচ ২২ মার্চ মুজিব ও ভুট্টো সমঝোতা হয়েছে এবং মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে রাজি হয়। একটি রহস্যজনক বিষয় হলো সেদিন ঢাকায় দু'টি দূতাবাসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হয়। সেই দুটি রাষ্ট্র হলো রাশিয়া এবং ব্রিটেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা আক্ষরিক অর্থে না হলেও পয়লা মার্চ থেকেই স্বাধীনতার প্রচারণা চলতে থাকে। নিউক্লিয়াসের প্ররোচনায় বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো এই শ্লোগান চলতে থাকে পুরো মার্চ জুড়ে। শেখ মুজিব দ্বিধায় ছিলো আলাদা দেশ করবে না কি পাকিস্তানেই থাকবে। মুজিব কখনো আশা করে নি সে পুরো পাকিস্তানের নেতা হতে পারবে। তাই সে ১৯৬৩ সাল থেকেই ভারতের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু যখন পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসলো তখন সে দ্বিধায় পড়ে যায়। তাই স্বাধীনতার কথা বলেও আবার সেটা ক্লিয়ার করতে পারে নি। অন্যদিকে বামপন্থী নিউক্লিয়াসের সদস্যরা তার দ্বিধাকে আশংকার নজরে রেখেছে। যখন শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে, আপাতত পাকিস্তান ভাঙ্গা বাদ তখনই নিউক্লিয়াস ও ভারত মুজিবকে দেশবিরোধী হিসেবে প্রমাণ করে।
মুজিব তার ওপর সকল অভিযোগ থেকে বাঁচতে না পালিয়ে আইনের কাছে আত্মসমর্পন করে। একমাত্র কামাল হোসেন ছাড়া বাকীসব আওয়ামী শীর্ষ নেতা পালিয়ে যায়। বেশিরভাগ যায় ভারত সীমান্তে। মুজিব দুইদিনের হরতাল ডেকে নিজ বাসায় অবস্থান করেছেন। সেনাবাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। ঢাকায় রাত ১০টা থেকে পিলখানায় ২২ এফএফের সদস্যরা ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করতে শুরু করে। ইপিআর কন্ট্রোল রুম থেকে মেজর দেলওয়ার ও কুতুবুদ্দীন ওয়্যারলেসে অনবরত অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের বার্তা পাঠাতে থাকেন, যে যেখানে আছ, তোমরা ইমিডিয়েটলি অ্যাকশনে যাও।' তারা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বার্তা পাঠান । তারপর তাঁদেরও নিরস্ত্র করা হয়।
রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রামে ইপিআরের অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বার্তাটি পান। তখনই তিনি অ্যাকশনে চলে যান। তিনি ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠান ‘ব্রিং সাম উড ফর মি'। এই বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অধীনে সবাই বিদ্রোহ করেন। ক্যাপ্টেন রফিকের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ২৫ মার্চ রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে ইপিআরের ওয়্যারলেস স্টেশনের দায়িত্বে থাকা অবাঙালি প্লাটুন কমান্ডার ক্যাপ্টেন হায়াতকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন। ২৬ মার্চ সকালে তিনি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
সেসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশভাগের বিষয়টি সমগ্র বাঙালি সেনাসদস্যের জানা ছিল। যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিউক্লিয়াসের সাথে যুক্ত ছিল তারা নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। আর যারা যুক্ত ছিল না তারা অবগত ছিল। কারণ প্রত্যেক বাঙালি অফিসার ও সৈনিকই বাংলাকে আলাদা করার গোপন প্রস্তাব ১৯৬৭ সাল থেকে পেয়ে আসছিল। অফিসারের চাইতে সৈনিকদের মধ্যেই নিউক্লিয়াস সদস্য বেশি ছিল।
ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তার প্রতিরোধের বিষয়টি বেতারের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য আওয়ামী নেতাদের অনুরোধ করেন। ইতোমধ্যে রফিকুল ইসলামের বার্তা মেজর জিয়ার কাছেও পৌঁছে কর্নেল অলির মাধ্যমে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেন তার সিনিয়র জানজুয়াকে এরেস্ট করার মাধ্যমে। জিয়ার সম্বল ছিল ৩০০ সৈন্য। জিয়া বুঝতে পেরেছেন তিনি শহরে থাকতে পারবেন না তাই তিনি কর্ণফুলি নদী পার পটিয়ায় চলে গেলেন। সেখান থেকে অলি ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে এসে কালুরঘাটে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন ২৬ মার্চ। এই ঘোষণায় তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র জিয়া তার নিজের দখলে রাখার প্ল্যান করে লে. সমশের মবিন চৌধুরীকে দিয়ে একদল সৈন্যকে পাহারায় রেখে যান।
আমার অনুমান কর্ণেল অলি নিউক্লিয়াসের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। কারণ জিয়াকে তিনিই বিদ্রোহ করতে উস্কে দিয়েছেন। ঢাকার ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে জিয়ার সামনে উপস্থাপন করেছেন। এরপর আরেকটি কথা বলে জিয়াকে নিয়ে চলে গেলেন কক্সবাজার। অলির কাছে তথ্য ছিল, বিদ্রোহ শুরু হলে কক্সবাজারে অবস্থানরত ৭ম নৌবহরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। মার্কিনীদের সহায়তা পাওয়ার জন্য অলি ও জিয়া একটি জিপ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। এখানেও অলি একজন আওয়ামী নেতা সরোয়ার আলমকে তাদের সাথে যুক্ত করে নেন যাতে জিয়া স্বাধীন সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন। সরোয়ার আলম ছিলেন কক্সবাজারের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য।
এদিকে কর্নেল অলির সাথে যোগাযোগ রাখেন মাহমুদ নামের এক ভারতীয়। সম্ভবত মাহমুদ হোসেন তার ছদ্ম নাম। মাহমুদ পরিচয় দিতেন তিনি ভারতের বিজেপি নেতা মোরারজি দেশাই-এর ভাইজি জামাই। বাংলাদেশে তার আগমন লোকসংগীত কালেকশনে। এই পরিচয়ে তিনি চট্টগ্রামের বহু গণ্যমান্য মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু বাঙালিদের বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেলে তার রাজনৈতিক পরিচয় বের হয়ে আসে। তিনি কর্নেল অলি থেকে কয়েকজন সৈন্য নিয়ে আগেই কক্সবাজার রওনা হন। মাহমুদ হোসেনই জিয়াকে মার্কিনীদের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মাহমুদ হোসেন ও তার সাথে সৈন্যদের পাক সেনা মনে করে পিটিয়ে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে।
মেজর জিয়া ও অলি আহমেদ কক্সবাজার গিয়ে যার বাসায় যাওয়ার কথা সেখানে গিয়ে কাউকে পান নি। মাহমুদের করুণ পরিণতি দেখে তারা অত্যন্ত দুঃখিত হন। এদিকে তারা খবর নিয়ে জানতে পারেন আশে পাশে বা কাছাকাছি কোথাও মার্কিন ৭ম নৌ-বহর নেই। ব্যর্থ মনোরথে তারা চট্টগ্রামের পটিয়ায় ফিরে এলেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের আওয়ামী নেতাদের সাথে মিটিং হয় তার। অতঃপর ৩০ মার্চ আবার কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে এসে আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এবার শেখ মুজিবের নামে ঘোষণা করেন।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়, //এই বিরাট শক্তির (পাকিস্তানি বাহিনী) মোকাবিলায় বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হবে না এ কথা বাঙালি সেনারা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববাসীর কাছে কথা জানিয়ে যাওয়ার জন্য মেজর জিয়া ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়াকে পেয়ে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠেন।
কিন্তু কী বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিড়ে ফেলেন। কী জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী ও দেশবাসীকে বেতার মারফত? এদিকে বেতারকর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন আর পনেরো মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ঘোষণা দেবেন। কিন্তু পনেরো মিনিট পার হয়ে গেল। মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন, তখন তাঁর মানসিক অবস্থা বোঝবার নয়। বিবৃতি লেখায় ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিল শব্দচয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে। প্রায় দেড় ঘন্টা মুসাবিদার পর তিনি তৈরি করেন তার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। নিজেই সেটা বাংলা ও ইংরেজিতে পাঠ করেন।//
৩০ মার্চ সকালে মেজর জিয়া চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আরেক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনই দুটি পাকিস্তানি বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে বেতার কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
ঘটনার পরম্পরায় বোঝা যায় যে, জিয়াউর রহমান নিউক্লিয়াসের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তবে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল না একথা জোর করে বলা যায় না। তিনি ভাসানী দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মাওবাদের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহচর মশিউর রহমান যাদু মিয়া বলেছেন, পাকিস্তান আমলে মেজর জিয়া মেজর কমল নামধারণ করে ভাসানীর সাথে গোপনে দেখা করতেন ও আলাপ আলোচনা করতেন। এথেকে বোঝা একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রবল আগ্রহ জিয়ার ছিল নইলে এতো বড় রিস্ক তার মতো ঠাণ্ডা মাথার মানুষ নিতেন না। এপ্রিলের শুরুতেই মেজর জিয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অলি ও আওয়ামী নেতাদের সহায়তায় তিনি রামগড় হয়ে ভারতে চলে যান।
এদিকে চিত্তরঞ্জন ও কালিদাসের সহায়তায় নিউক্লিয়াসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তাজউদ্দিন আহমেদ কোলকাতায় পৌঁছে যান। একে একে অনেক নেতাই কোলকাতায় চলে যান। সেখানে তাদের সকল ব্যবস্থা করে রাখে চিত্তরঞ্জন। আওয়ামী নেতাদের ভারত পাড়ি দিতে বেশ সহায়তা করেন এম এ জি ওসমানী। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন তাজউদ্দিন। সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়ে মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা করেন। নিউক্লিয়াস সদস্যরা ঢাকার বাইরের ব্যাংকগুলো লুট করতে থাকে। লুটকৃত অর্থ ছিল অনেক যার সঠিক হিসেব তাজউদ্দিনরা দেয়নি। তবে স্বাধীনতার পর চাপে পড়ে বলেছে সেখানে ১০০ কোটি টাকা ছিল।
চিত্তরঞ্জনদের চেষ্টায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে। সেখানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে বৈঠক করাই ছিল উদ্দেশ্য। দিল্লিতে পৌঁছানোর পর ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দীন জানান যে পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রিসভার সদস্য। ইন্দিরার কাছে তাজউদ্দিন নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন। ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে যুদ্ধে সহায়তা ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। তার আগে তাজউদ্দিনকে চুক্তি করার জন্য বলেন। তাজউদ্দিন সাতটি বিষয়ে চুক্তি করেন,
১- মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা যুদ্ধ করেছে তারাই দেশ স্বাধীন হলে প্রশাসনে নিয়োগ পাবে। বাকীরা চাকরীচ্যুত হবে। যে শূন্যপদ সৃষ্টি হবে তা ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা দ্বারা পূরণ করা হবে।
২- বাংলাদেশ ও ভারতের সশস্ত্র বাহিনী মিলে যৌথ কমান্ড গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। ভারতের সেনাপ্রধান উক্ত যৌথ কমান্ডের প্রধান হবেন। তার কমান্ড অনুসারেই যুদ্ধে শামিল হওয়া বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
৩- স্বাধীন বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী থাকবেনা।
৪- আভ্যন্তরীন আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে প্যারামিলিটারি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হবে।
৫- দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। কিন্তু সময়ে সময়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বানিজ্য নীতি নির্ধারণ করা হবে।
৬- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী অনির্ধারিত সময়ের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করা হবে।
৭- বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ আলোচনা করে একই ধরণের পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করবে।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠক ও চুক্তি শেষে তিনি বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ (MNA) এবং এমপিএদের (MPA) কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। উক্ত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিপরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিএগণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপ্রধান এবং মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী (অর্থ মন্ত্রণালয়), খন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়) ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান(স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রণালয়) কে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ প্রদান করেন।
এরপর ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে মন্ত্রিপরিষদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। নতুন রাষ্ট্রের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রব এবং মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ উইং কমান্ডার আবদুল করিম খন্দকার এর নাম ঘোষণা করেন। এরপর সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এই ঘোষণাপত্র এর আগেও ১০ এপ্রিল প্রচার করা হয় এবং এর কার্যকারিতা ঘোষণা করা হয় ২৬ই মার্চ ১৯৭১ থেকে। ঐদিন থেকে ঐ স্থানের নাম দেয়া হয় মুজিবনগর।
এখানে লক্ষ্যনীয় ঘোষণাপত্র ১ম ১১ এপ্রিল প্রকাশ করা হলেও কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয় ২৬ মার্চ থেকে। এর মূল কারণ তারা চেয়েছিলো জিয়ার ঘোষণা যাতে আর কার্যকারিতা না পায়। যদিও মেজর জিয়ার ঘোষণা তাদের অনেক উপকার করেছে। পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহীদের আবার ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। সারাদেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ২৫ মার্চের পর দেশের সেনাবাহিনী শুধুমাত্র ঢাকা আর বিভাগীয় শহরের নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বাকী জেলাশহর ও গ্রামে একচ্ছত্রভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দখল করে রেখেছিল। সেখানে অবাঙ্গালিদের ওপর চালাচ্ছিল নির্মম গণহত্যা। এই সন্ত্রাসীরা সাহস পেয়েছে জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমেই।
যদিও তাজউদ্দিনদের উপকার হয়েছে তবুও তারা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে মেজর জিয়ার ঘোষণাকে পজেটিভলি দেখেনি। এ কারনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা করেছে।
বেসিক্যলি তাজউদ্দিন সাহেব রুশপন্থী বাম ছিলেন। এই ব্যাপারে কমরেড তোয়াহা বলেন, //তাজউদ্দীন পূর্বাপর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যদিও তাজউদ্দীন বাহ্যত: আওয়ামী লীগ করতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের সাথেই জড়িত ছিলেন। পার্টির সিদ্ধান্তেই তাকে আওয়ামী লীগে রাখা হয়। একবার সম্ভবত: '৬২ সালের দিকে তিনি জেল থেকে বের হয়ে আমাদের বললেন 'আর ছদ্মনামে (অর্থাৎ আওয়ামী লীগে) কাজ করতে আমার ভালো লাগছে না। আমি নিজ পার্টিতেই কাজ করবো।' তখন কেউ কেউ মনে করলো, 'থাক না আমাদের একজন আওয়ামী লীগে আছে, সেখানেই কাজ করুক না।' পরে অবশ্য পার্টিতে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল কিন্তু তাজউদ্দীনকে প্রত্যক্ষভাবে পার্টিতে নেয়া হয়নি।
আমার মতে সেটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তবে তাজউদ্দিন আওয়ামী লীগে থেকেও আমাদের জন্য কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের সব তথ্য আমাদের সরবরাহ করেছেন। ইন্ডিয়াতে গিয়ে অসম-চুক্তি করার পরই তার মাঝে একটা বিক্ষিপ্তভাব এসে যায়। এরপর তিনি কিছুটা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন আমরা তাকে তাঁবেদার সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনে করতাম, তখনও তিনি আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। (বারান্দার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে) প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একবার এ বারান্দায় বসে আমার সাথে আলাপ করে গেছেন। ভুল-শুদ্ধ যখন যা করেছেন সবই এসে আমাদের কাছে অকপটে বলেছেন।//
বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস #বঙ্গকথা'র ৭০ নং পর্ব
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন