১৯৭১ সালে মার্চের শুরু থেকেই ঢাকার চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে চট্টগ্রামে। এর কারণ চট্টগ্রামে ছোট বড় প্রচুর কারখানা। আর এসব কারখানায় কাজ করে হাজার হাজার ভারত থেকে আসা অবাঙালি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য এসব বিহারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ৪ মার্চ থেকে শুরু হয় লীগ কর্তৃক অবাঙালি গণহত্যা এবং সেটা কন্টিনিউ করে।
সেনাবাহিনীকে কোথাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত না হওয়ায় তারা ঘটনার সাথে যুক্ত ছিল না। জিয়া চট্টগ্রামের উপঅধিনায়ক হলেও তার সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা, নিউক্লিয়াসদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয় আমার কাছে। এজন্য তিনি ঢাকার খবর, বিদ্রোহের নির্দেশনার জন্য ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। [১]
চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়ার আগে মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন খলিকুজ্জামানের কাছে পরিস্থিতি ও নির্দেশনা কিছু জানলে তাকে জানাতে বলেছেন। [২]
ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ সকাল থেকে আব্দুর রশিদ জানজুয়ার নির্দেশে মেজর মীর শওকত আলী এক কোম্পানি সেনা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সোয়াত' জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের কাজের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার আনসারিও সেখানে ছিলেন। সন্ধ্যার পর রশিদ জানজুয়া ও শওকত শহরে রেজিমেন্টের ইউনিট লাইনে ফিরে আসেন। এই পুরো ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের বর্ণনায়। সেদিনের বিদ্রোহীদের মধ্যে তিনিও একজন।
//জানজুয়া আমাকে ডাকলেন। বললেন, 'খালেক, ইউ হ্যাভ টু গো টু দ্য পোর্ট টু টেক ওভার কমান্ড অব দ্য এরিয়া।' এমন সময় মেজর জিয়া সেখানে উপস্থিত হন। জিয়াকে দেখেই জানজুয়া বললেন, 'জিয়া, ইউ গো ফার্স্ট, খালেক উইল ফলো ইউ। জিয়া উঠলেন। সঙ্গে দুজন অবাঙালি অফিসার, সে. লে. হুমায়ুন আর সে. লে. আজম। আমি ওপাশে গেলাম। জিয়া বললেন, ‘খালেকুজ্জামান, কিছু শুনলে জানিয়ো।'
গাড়ি চলে গেল । জানজুয়া তার বাসা আলহামরা বিল্ডিংয়ে চলে গেলেন। মীর শওকত চলে গেলেন মেসে। ডিউটি অফিসার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ চলে গেল ওপরে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তখন অলি ওপর থেকে বলল, স্যার, আপনার একটা ফোন আসছে। আমি গেলাম । বাই দ্যাট টাইম অলি হ্যাজ টড। উনি ছিলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অব স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক মি. কাদের (আবদুল কাদের)।
অলির সঙ্গে কী কথা হয়েছে জানি না। বললেন, ‘ঢাকায় তো ইপিআরের ওখানে ফায়ারিং শুরু হয়ে গেছে। আর্মি হ্যাজ রেইডেড ক্যাম্পস। তোমরা কী করছ?’ আরও কিছু বললেন। আমাকে এক্সাইটেড করলেন। আমি অলিকে বললাম, তোমাকে কী বলেছে জানি না । ডিউটি করো ওখানে। কিপ আ ট্র্যাক অন দিস। আই অ্যাম গোয়িং টু গেট ব্যাক আওয়ার বস জিয়া।
পিক আপ এল । আমি কয়েকজন গার্ড নিলাম। জিয়াকে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের সামনে পেলাম। রাস্তায় ব্যারিকেড ছিল। ওখানে আল্লাহর রহমতে ওইটা (ব্যারিকেড) ছিল। জিয়া, লাইক আ ড্যান্ডি ম্যান, স্মার্ট, হাতে ফিল্টার উইলস, দ্যাট ফেমাস উইলস। সিগারেট খাচ্ছেন। বললেন, ইয়েস খালেক, হোয়াট হ্যাপেনড? আই সেইড, ফায়ারিং হজ স্টার্টেড।
ইপিআর ক্যাম্প হ্যাজ বিন অ্যাটাকড... ব্লা ব্লা ব্লা। উনি তখন চিৎকার করে বললেন,
- হোয়াট শ্যাল উই ডু?
- ইউ নো বেটার।
- ইন দ্যাট কেস, উই রিভোল্ট অ্যান্ড শো আওয়ার এলিজিয়েন্স টু দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ।
ইউনিট লাইনে ফিরে আসার পর ল্যান্স নায়েক শফির হাত থেকে রাইফেলটা হাতে নিয়ে বললেন, হুমায়ুন, আজম (জুনিয়র অবাঙালি অফিসার) কাম এলংগ। শফি, তোমার স্যারদের কোয়ার্টার গার্ডের ভেতর নিয়ে যাও।' দে অয়ার স্টান্ট। কোয়ার্টার গার্ডের ভেতরে নিয়ে গেল। জিয়া বললেন, ‘খালেক, লেট মি গো অ্যান্ড গেট দিস বাস্টার্ড (জানজুয়া)।'
জিপে করে আলহামরা বিল্ডিংয়ে গেলেন। জানজুয়া কেইম আউট। জিয়া জানজুয়াকে বললেন :
খালেক অ্যান্ড অলি উড লাইক টু টক টু ইউ। ইউ কাম টু দ্য ইউনিট লাইন। দে আর ওয়েটিং ফর ইউ টু টক।
চলো, চলতা হু।
জানজুয়াকে গাড়িতে বসালেন। জিয়া গাড়ি চালালেন । পেছনে যে সিপাই ছিল, সে বন্দুক ধরে রেখেছিল, সো দ্যাট হি ডাজ নট রান অ্যাওয়ে । (ইউনিট লাইনে) নামার সঙ্গে সঙ্গে জিয়া এক আজব কাণ্ড করলেন। ওখানে শফি ছিল । তার হাত থেকে রাইফেলটা নিলেন, পয়েন্টেড দ্য ব্যারেল অ্যাট হিম। বললেন, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।' জানজুয়া হতভম্ব হয়ে গেছে।
(জিয়া) বললেন, ‘খালেক, টেক হিম। আমি জানজুয়াকে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে গেলাম। বাই দ্যাট টাইম কোয়ার্টার গার্ডের মধ্যে সে, লে. আজম, সে. লে. হুমায়ুন, আহমেদ দ্বীন বলে একজন ক্যাপ্টেন, পাঞ্জাবি অফিসার। আজম, হুমায়ুন, আহমদ দ্বীন অয়ার টেকেন আপ। অ্যান্ড দে অয়ার এলিমিনেটেড ইন দ্য মেলু।
মেজর জিয়া সার্বিক পরিস্থিতি বলে সবার কাছ থেকে আনুগত্য চাইলেন, তোমরা কি আমার সঙ্গে আছ'? সবাই এক আওয়াজে বলেছিল, আমরা আছি।'
জিয়া শওকতকে বলেছিলেন, একটি গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে মাইক দিয়ে বলে দাও যে আমরা, এইট বেঙ্গল হ্যাজ রিভোল্টেড ফর দ্য কজ অব বাংলাদেশ।' বিফিটিং ল্যাঙ্গুয়েজে বলার জন্য। হি ডিড দ্যাট। জিয়া অফিসে বসে...হি ওয়াজ রিংগিং আপ-এমপি, ডেপুটি কমিশনার আর যাদের ফোন করে পায় নাই, অপারেটরকে বলেছেন, সবাইকে বলে দিন এইট বেঙ্গল রিভোল্ট করেছে বাংলাদেশের পক্ষে।'
তারপর আমরা ইউনিট লাইন থেকে বেরিয়ে গেলাম। তখন রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে গেছে। আমরা পটিয়া পর্যন্ত যাই। তখন কিছু কিছু অফিসার ডেপ্লয়েড হয়ে গেছেন। পটিয়া যেহেতু অলির জায়গা, তিনি সবকিছু চিনতেন। এতে আমাদের সুবিধা হয়েছে। বন্দোবস্তটা উনি ভালোভাবেই করে রেখেছিলেন। সেখান থেকে আমাদের বলে দেওয়া হলো, পজিশন, কে কোথায় যাবেন। আমাকে বলা হলো রেডিও স্টেশনটা প্রটেকশন দেওয়ার জন্য, রেডিও স্টেশন থেকে কর্ণফুলীর পূর্বপার পর্যন্ত। [৩]
আমার অনুমান কর্ণেল অলি নিউক্লিয়াস অথবা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। কারণ জিয়াকে তিনিই বিদ্রোহ করতে উস্কে দিয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের আব্দুল কাদেরের বরাত দিয়ে। এরপর আরেকটি কথা বলে জিয়াকে নিয়ে চলে গেলেন কক্সবাজার। অলির কাছে তথ্য ছিল, বিদ্রোহ শুরু হলে কক্সবাজারে অবস্থানরত ৭ম নৌবহরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
মার্কিনীদের সহায়তা পাওয়ার জন্য অলি ও জিয়া একটি জিপ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। এখানেও অলি একজন আওয়ামী নেতা সরোয়ার আলমকে তাদের সাথে যুক্ত করে নেন যাতে জিয়া স্বাধীন সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন। সরোয়ার আলম ছিলেন কক্সবাজারের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য।
এদিকে কর্নেল অলির সাথে যোগাযোগ রাখেন মাহমুদ নামের এক ভারতীয়। সম্ভবত মাহমুদ হোসেন তার ছদ্ম নাম। মাহমুদ পরিচয় দিতেন তিনি ভারতের বিজেপি নেতা মোরারজি দেশাই-এর ভাইজি জামাই। বাংলাদেশে তার আগমন লোকসংগীত কালেকশনে। এই পরিচয়ে তিনি চট্টগ্রামের বহু গণ্যমান্য মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু বাঙালিদের বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেলে তার রাজনৈতিক পরিচয় বের হয়ে আসে। তিনি কর্নেল অলি থেকে কয়েকজন সৈন্য নিয়ে আগেই কক্সবাজার রওনা হন।
মাহমুদ হোসেনই জিয়াকে মার্কিনীদের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মাহমুদ হোসেন ও তার সাথে সৈন্যদের পাক সেনা মনে করে পিটিয়ে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে।[৪]
মেজর জিয়া ও অলি আহমেদ কক্সবাজার গিয়ে যার বাসায় যাওয়ার কথা সেখানে গিয়ে কাউকে পান নি। মাহমুদের করুণ পরিণতি দেখে তারা অত্যন্ত দুঃখিত হন। এদিকে তারা খবর নিয়ে জানতে পারেন আশে পাশে বা কাছাকাছি কোথাও মার্কিন ৭ম নৌ-বহর নেই। ব্যর্থ মনোরথে তারা চট্টগ্রামের পটিয়ায় ফিরে এলেন।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের আওয়ামী নেতাদের সাথে মিটিং হয় তার। অতঃপর ৩০ মার্চ আবার কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে এসে আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এবার শেখ মুজিবের নামে ঘোষণা করেন। এভাবে তিনি চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন। [৫]
মেজর জিয়া বিদ্রোহ করার আগে চট্টগ্রামে ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম আগেই বিদ্রোহ করেন। ঢাকায় রাত ১০টা থেকে ইপিআরের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের দায়িত্বমুক্ত ও নিরস্ত্র করে ব্যারাকে অবস্থান করার জন্য নির্দেশ আসে। ইপিআর কন্ট্রোল রুম থেকে মেজর দেলোয়ার ও কুতুবউদ্দিন ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠাতে থাকে তোমরা যে যেখানে আছো একশনে যাও।
'নিরস্ত্র করার সংবাদ' গুজব সৃষ্টিকারীদের মাধ্যমে হত্যা করার সংবাদে পরিণত হয়। সাড়ে দশটার পর মেজর দেলোয়ার আর কুতুবুদ্দিনের বার্তা পাওয়া যায়নি। অতএব তাদেরকেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে হলো। চট্টগ্রামে ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ঢাকার বার্তা পেয়ে বিদ্রোহ শুরু করেন। এরপর তিনি তার অধীনস্থ অফিসার ও সৈনিকদের কাছে বার্তা পাঠান 'ব্রিং সাম উড ফর মি'। এতে তার অধীনে থাকা সব বাঙালি সেনাসদস্য বিদ্রোহ করে। এরপর তিনি অবাঙালি প্লাটুন কমান্ডার হায়াতকে এরেস্ট করেন। [৬][৭]
সমশের মুবিন চৌধুরি বলেন, রফিকুল ইসলামের বার্তা পেয়ে কাপ্তাইতে দায়িত্বরত ইপিআরের ক্যাপ্টেন হারুন ৬৫ জন সেনা নিয়ে বিদ্রোহ করলেন এবং মেজর জিয়ার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করলেন। জিয়া তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। ২৯ মার্চ সমশের ও হারুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে চকবাজারে এক খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হলেন।
[৮][৯]
গণহত্যা প্রসঙ্গ
চট্টগ্রামে দুই ধাপে গণহত্যা হয়। প্রথমত হয় মার্চে মূলত শহর এলাকায়। দ্বিতীয়ত হয় এপ্রিল ও মে মাসে শহরের বাইরে। শহর এলাকায় হয় মার্চ মাসে। হালিশহর, পাহাড়তলী, আগ্রাবাদ, বায়েজিদ, শেরশাহ কলোনী, ওয়্যারলেস রেলগেইট, কালুরঘাট ইত্যাদি স্থানে গণহত্যা হয়। ২৬ মার্চ থেকে সেনাবাহিনী শহর দখল নিতে থাকলে চটগ্রাম শহরে অবাঙালিদের নিরাপত্তা জোরদার হতে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে সারা মার্চ জুড়ে হাজার হাজার বেসামরিক বিহারি খুন হতে থাকে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় কুতুবউদ্দিন আজিজের লেখা 'ব্লাড এন্ড টিয়ার্স' বইতে। এখানে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সারাদেশের বিহারী হত্যা একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। [১০]
চট্টগ্রামে দ্বিতীয় ধাপের অবাঙালি গণহত্যা শুরু হয় চট্টগ্রাম শহরের বাইরে। এই গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন মেজর জিয়ার কাছে আনুগত্যের শপথ করা বিদ্রোহী বাঙালি সেনাসদস্যেরা। এর মেয়াদকাল প্রায় দুই মাস। যতক্ষণ না পুরো দেশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না আসে। রাঙামাটির কাপ্তাইতে ইপিআর ক্যাপ্টেন হারুন তার সঙ্গীদের সাথে নিয়ে অবাঙালি ইপিআর সদস্য এবং তাদের পরিবারের ওপর গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চের পরের দুই সপ্তাহ ছিল ভয়াবহ। যেখানেই অবাঙালিদের দেখা মিলছিল, সেখানেই তাদের ঘিরে ধরে হত্যা করা হচ্ছিল। ইপিআর ও পুলিশের কিছু লোক এই হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় কিছু লোক। [১১]
ফারুক আজিজ খান আর বলেন, রাঙামাটি থেকে দিনে ও রাতে বাস বোঝাই করে ইপিআরের সদস্যদের সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অবাঙালি ইপিআরের সদস্যরা ও তাদের পরিবার তাদেরই বাঙালি সহকর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হতে থাকে। অনেককে হাত-পা বেঁধে খাদের পানিতে ফেলে দেওয়া হয় বলেও শুনতে পাই। রাতে যখন তারা বাস-ট্রাকে চেপে চট্টগ্রামে রওনা হতো, তখন যে আওয়াজ হতো, তা ছিল রীতিমতো রোমহর্ষক। অবাঙালিদের হত্যা করার পর আমাদের নৈতিক শক্তিও ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেককেই আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। [১২]
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা ও আশপাশের অবাঙালিরা প্রায় সবাই ইপিআরের লোকজন ও তাদের সহযোগীদের কব্জায় চলে আসে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবেই অবাঙালিদের হত্যা করা হতো। সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা ঘটে ২৬-৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১। কর্নফুলী পেপার ও রেয়ন মিলস, চন্দ্রঘোনা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। উদ্ধার করার পর তারা অবর্ণনীয় ধর্ষণ ও বর্বরতার কাহিনী বর্ণনা করে। হতাহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। একইসাথে রাঙামাটি শহরেও মেজর জিয়ার কাছে আনুগত্যের শপথ নেওয়া বাঙালি সৈনিকেরা বেসামরিক অবাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। সেখানে প্রায় ৫০০ অবাঙালি খুন হন। [১৩][১৪]
রাঙামাটির পাশাপাশি মেজর জিয়ার অধিনস্থ সৈনিকেরা এপ্রিল মাসেও শহরের কিছু কিছু স্থানে বেসামরিক নিরীহ মানুষ খুন করে। ১৯৭১ সালের মে মাসে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। তারা ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টারে লিখেন “বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি জুট মিলের বিনোদন ক্লাবে কাপড়ের স্তুপের ভেতর রক্তমাখা একটি পুতুল গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
এ ক্লাবে বাঙালিরা ১৮০ জন মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে। বাঙালিরা দেশপ্রেমের উত্তেজনায় মত্ত হয়ে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানিকে হত্যা করে। বাঙালি বেসামরিক লোক ও মুক্তিফৌজ (জিয়ার সৈনিক) ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আগত (ভারতীয় অভিবাসী) বিহারীদের গণহত্যায় লিপ্ত হয় এবং হাটবাজার ও বসতবাড়ি তছনছ করে, ছুরিকাঘাত, গুলিবর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে। কখনো কখনো ধর্ষণ ও লুটপাটেও লিপ্ত হয় ৷"
১৯৭১ সালের ১২ মে আমেরিকান বার্তা সংস্থা এপি প্রেরিত একটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টারে আরো বলা হয়। “গতকাল গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দর নগরী সফরকারী সাংবাদিকরা জানিয়েছেন যে, তারা ব্যাপক গোলা ও গুলিবর্ষণে ক্ষয়ক্ষতির এবং বিদ্রোহীদের হাতে ব্যাপক বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার প্রমাণ দেখতে পেয়েছেন।
প্রভাবশালী ইস্পাহানি পরিবারের মালিকানাধীন জুট মিলগুলোতে সাংবাদিকরা মিলের ক্লাবে গত মাসে (এপ্রিলে) বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের হাতে নিহত ১৫২ জন অবাঙালি মহিলা ও শিশুর গণকবর দেখতে পেয়েছেন। বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত এ ক্লাবের মেঝেতে এখনো রক্তমাখা জামা-কাপড় ও খেলনা পড়ে রয়েছে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২৫ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানি ও ভারতীয় অভিবাসীদের (১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী মুসলমান) হত্যা করা হয়েছে। অধিবাসীরা একটি ভস্মীভূত ডিপার্টমেন্ট ভবন দেখিয়ে বলেছে, সেখানে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের সাড়ে তিন শ' পাঠানকে হত্যা করেছে।"
এন্থনি মাসকারেনহাস এপ্রিলে সময়গুলোতে চট্টগ্রামে ছিলেন। তিনি লন্ডনের সানডে টাইমসের পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি। ১৯৭১ সালের ২ মে সানডে টাইমসে এন্থনি মাসকারেনহাস প্রেরিত এক রিপোর্টে বলা হয়: "চট্টগ্রামে মিলিটারি একাডেমির কর্নেল কমান্ডিংকে হত্যা করা হয়। এসময় তার আট মাসের অন্তঃসত্তা স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তলপেটে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
চট্টগ্রামের আরেকটি অংশে জীবন্ত অবস্থায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একজন অফিসারের চামড়া ছিলে ফেলা হয়। তার দু'পুত্রের শিরচ্ছেদ করা হয়। তার স্ত্রীর তলপেটে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে তার উন্মুক্ত শরীরের ওপর পুত্রদের মাথা রেখে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো বাঁশ দিয়ে জরায়ু বিদীর্ণ বহু যুবতী মেয়ের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম এবং খুলনা ছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহর। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সমবেত হয়েছিল।" [১৫]
মেজর জিয়া ও তার নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও গণধর্ষণের সবচেয়ে লোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলামের বর্ণনায়। তিনি তার স্মৃতিচারণে বলেন, তিনি এবং তার ছাত্রলীগের বন্ধুরা মেজর জিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রামগড় ক্যাম্পে ছিলেন। একদিন বাঙালি সেনা অফিসাররা জিয়ার নেতৃত্বে সীতাকুন্ডের হাফিজ জুটমিলে অভিযান চালায়। সেখানে নিরীহ সকল অবাঙালি পুরুষ শ্রমিকদের হত্যা করে। এরপর সেখানে থাকা নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিকদের স্ত্রী কন্যাদের রামগড় ক্যাম্পে নিয়ে আসেন এবং দিনের পর দিন তাদের নির্যাতন করেন। এরপর যখন দেশের সেনাবাহিনী রামগড় ক্যাম্প দখলে নিতে আসে তখন জিয়া বুঝতে পারেন তিনি সেনাবাহিনীর সাথে পেরে ওঠবেন না তাই তিনি দলবল নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান। ভারতে যাওয়ার আগে বাঙালি সেনা অফিসাররা রামগড় ক্যাম্পে থাকা সকল অবাঙালি নারীদের হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে যান। ভিডিও দেখুন [১৬]
মেজর জিয়া কি গণহত্যায় জড়িত ছিলেন?
যে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন হয়েছে তাতে নিশ্চিত করা বলা যায় রামগড়, রাঙামাটি, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা ও চট্টগ্রাম শহরে মেজর জিয়ার অনুগত বিদ্রোহী সেনারাই এই অবাঙালি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন মেজর জিয়ার সমর্থকেরা যারা তাকে ভালোবাসেন তারা বলতে পারেন জিয়া কি তাদের গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছেন? এর কী প্রমাণ আছে। আমি তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই জিয়া কী গণহত্যাকারী তার অধীনস্থ সেনাদের শাস্তি দিয়েছেন? যদি না দিয়ে থাকেন তবে এই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ মেজর জিয়ারই প্রত্যক্ষ মদদেই হয়েছে। একজন সেনানায়ক হিসেবে জিয়া তার অধীনস্থদের সকল কৃতিত্ব বহন করতে বাধ্য।
মেজর জিয়া কী খুনি চরিত্র লালন করতেন?
একজন সেনানায়ক যুদ্ধে কঠোর হবেন। তিনি শত্রুদের খুন করবেন এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সহকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা দোষে অস্ত্র উত্তোলন এবং নির্বিচার খুন জিয়ার চরিত্রে আছে। এবং তিনি তা দেখিয়েছেন। খালেকুজ্জামানের বর্ণনা থেকে যা বুঝতে পারি তাতে তার সিনিয়র অফিসার জানজুয়া তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বন্দর নিয়ন্ত্রণে পাঠিয়েছে তা একেবারে মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়। কারণ জানজুয়া প্রথমে খালেককে পাঠিয়েছেন। জিয়া এসে পড়ায় তিনি তাকে যেতে বলেছেন। তার মানে টার্গেট জিয়া ছিল না।
ক্যাপ্টেন খালেকের বর্ণনা অনুসারে অলি ঢাকার ব্যাপারে তথ্য দিয়েছেন। জিয়াকে খুন করার কোনো ব্যাপার সেখানে ছিল না। আর যেহেতু এই সংবাদ খালেক নিজেই জিয়াকে দিয়েছেন তাই এখানে মিসিং ইনফো নেই। খালেক তাকে শুধু ঢাকার ইপিআরের কথাই বলেছেন। তার মানে জিয়ার সাথে জানজুয়ার কোনো খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয় নি। একইসাথে জিয়ার অধীনে থাকা নবীন অবাঙালি অফিসাররা জিয়ার একনিষ্ঠ অনুগত ছিল। কিন্তু জিয়া তার অফিসার জানজুয়া, তার অবাঙালি সহকর্মী ও তার অনুগত অবাঙালি শিষ্যদের একত্র করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করার নির্দেশ দেন। অতঃপর তাদের হত্যা করা হয়। এই ঘটনাই মেজর জিয়ার খুনী চরিত্রকে ফোকাস করে।
মেজর জিয়ার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী ছিল?
মেজর জিয়ার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল না একথা জোর করে বলা যায় না। তিনি ভাসানী দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহচর মশিউর রহমান যাদু মিয়া বলেছেন, পাকিস্তান আমলে মেজর জিয়া মেজর কমল নামধারণ করে ভাসানীর সাথে গোপনে দেখা করতেন ও আলাপ আলোচনা করতেন। [১৭]
এ থেকে বোঝা একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রবল আগ্রহ জিয়ার ছিল নইলে এতো বড় রিস্ক তার মতো ঠাণ্ডা মাথার মানুষ নিতেন না। এরপর জিয়ার ক্ষমতার সময়ে ভাসানী কর্তৃক জিয়াকে একনিষ্ঠ সমর্থন দানও তার রাজনৈতিক আদর্শকে ইঙ্গিত করে। ভাসানীর ইন্তেকালের পর মেজর জিয়া তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে ব্যবহার করেই বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি গঠন করেন। চীনপন্থী বাম ন্যাপের যাদুমিয়াকেই তিনি প্রথমে তার প্রধানমন্ত্রী করে নেন। বিএনপি'র বর্তমান অনেক নেতা প্রকাশ্যেই বলে থাকেন জিয়া ভাসানীর আদর্শ লালন করতেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তেমনাটাই বলেছেন। [১৮]
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু বলেছেন ভাসানীর আদর্শেই বিএনপি গঠিত হয়েছে। [১৯] অতএব এটা অনুমান করা যায় মেজর জিয়াউর রহমান মাওলানা ভাসানীর মতো পিকিংপন্থী বামাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি ভাসানীর দলের প্রতীক নিজের দলের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
তথ্যসূত্র
১. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৮৩
২. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৭৯
৩. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৭৯-৮০
৪. মহিউদ্দিন আহমেদের কাছে কর্নেল অলির সাক্ষাৎকার
৫. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৮২-৮৩
৬. ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন / আমীন আহমেদ চৌধুরী/ পৃষ্ঠা ২১-২৮
৭. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে/ মেজর রফিকুল ইসলাম/ পৃষ্ঠা ১২০
৮. মহিউদ্দিন আহমেদের কাছে সমশের মুবিনের সাক্ষাৎকার
৯. আওয়ামীলীগ : যুদ্ধদিনের কথা/ মহিউদ্দিন আহমদ / পৃষ্ঠা ৮৩
১০. ব্লাড এন্ড টিয়ার্স/ কুতুবুদ্দিন আজিজ/ পৃষ্ঠা ৩৫-৭৮
১১. বসন্ত ১৯৭১/ ফারুক আজিজ খান/ পৃষ্ঠা ৪৭
১২. বসন্ত ১৯৭১/ ফারুক আজিজ খান/ পৃষ্ঠা ৫০
১৩. বসন্ত ১৯৭১/ ফারুক আজিজ খান/ পৃষ্ঠা ৫১
১৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র / বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর/ পৃষ্ঠা ১৪৩
১৫. ব্লাড এন্ড টিয়ার্স/ কুতুবুদ্দিন আজিজ/ পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭
১৬. https://youtu.be/fOfaYa48_4I
১৭. মাওলানা ভাসানী : রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম/ পৃষ্ঠা ২২
১৭. মাওলানা ভাসানী : রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম/ পৃষ্ঠা ২২
১৮. ভাসানী রাজনীতি নির্মাণ করতেন: ফখরুল/ প্রথম আলো/ ২০/১১/২০১৬
১৯. ভাসানীর আদর্শে গড়া দল বিএনপি: বরকতুল্লাহ বুলু/ বাংলা ট্রিবিউন/ ১৭/১১/২০২০
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন