এটা ইতোমধ্যে সবাই জেনেছেন যে, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও স্টেট কাউন্সিলর সুচিসহ টোটাল মন্ত্রীসভা এরেস্ট হয়েছেন। সেখানে সেনাবাহিনী ক্যু করেছে। সেনাপ্রধান মিন অং ক্ষমতা দখল করেছেন এবং আগামী একবছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে জানানো হয়েছে নির্বাচনে জালিয়াতী করার জন্যই এদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ৮ নভেম্বরে মিয়ানমারে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) বিপুলভাবে জয় হয়। এনএলডি জাতীয় পরিষদে ৮৩ শতাংশ আসন (মোট ৩৯৬টি) জয় করেছে। ২০১৫ সালে যেটা ছিল ৭৯ শতাংশ। সারা দেশের রাজ্য বা আঞ্চলিক পর্যায়ে ১৪টি পার্লামেন্টের মধ্যে তারা জয়ী হয়েছে ১২টিতে।
অন্যদিকে সেনাসমর্থিত ইউএসডিপি পেয়েছে মাত্র ৩৩টি আসন (নির্বাচনী আসনের ৬.৯ শতাংশ)। ২০১৫ সালের চেয়ে আরো আটটি কম। ইউএসডিপির অনেক সিনিয়র নেতা পরাজিত হয়েছেন। পরাজিতদের মধ্যে দুই ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এক চেয়ারম্যানও রয়েছেন। দক্ষিণ মান্দালয়কে বিবেচনা করা হতো ইউএসডিপির ঘাঁটি। সেখানে তারা এনএলডির কাছে আসন হারিয়েছে।
তবে পরাজয় স্বীকার না করে ইউএসডিপি নেতৃত্ব নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় নতুন নির্বাচন দাবি করেছে। কেবল নির্বাচনকেই কলঙ্কিত নয়, সেইসাথে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার কিছু উদ্বেগজনক খবরও আসছে। উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে এনএলডির নবনির্বাচিত এক এমপিকে তার বাড়ির সামনে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচন নিয়ে বড় প্রশ্ন ছিল রোহিঙ্গাদের গণহারে ভোটাধিকার হরণ ও সঙ্ঘাত-জর্জরিত অনেক এলাকায় ভোট স্থগিত করা। কিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা ভোটের দিন বড় ধরনের অনিয়মের কোনো খবর জানায়নি। রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকারের হরণ করার ব্যাপারে এনএলডি ও ইউএসডিপি একমত। এটা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অনাস্থা দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না ইউএসডিপি'র।
কিন্তু ইউএসডিপি যেভাবে কথা বলেছিল, তাতে মনে হচ্ছে, তারা সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহানুভূতিশীল কাউকে পেয়েছে এবং সেটাই এখন প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনের ঠিক আগে দিয়ে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইঙ নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে কিছু সতর্কতা জানিয়ে সামরিক বাহিনী নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করবে কিনা সে ব্যাপারে সংশয়ের সৃষ্টি করেন। অবশ্য নির্বাচনের পর এনএলডির পরিষ্কার বিজয়ের ফলে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র বলেন, ইউএসডিপির অবস্থান সেনাবাহিনী সমর্থন করে না। কিন্তু এই স্টেটমেন্টের ওপর টিকে থাকতে পারেনি মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
ডিসেম্বরেই নির্বাচনে বড় ধরনের জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ এনেছে সেনাবাহিনী। নির্বাচন কমিশন এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সামরিক শাসনের অবসানের পর এই প্রথমবার বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়। সেনাবাহিনীর সাথে ক্ষমতাসীন দলের সংলাপ চলতে থাকে। তবে সে সংলাপ সমাধানে পৌঁছতে পারে নি।
গত ২৫ জানুয়ারিতে পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরুর আগে বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার আলোচনা ভেস্তে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, সামরিকপন্থী বিক্ষোভকারীরা দুটি শহরে জড়ো হয়েছে ও বিশৃংখলা করছে। আর সেনাবাহিনী জানিয়েছে, নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের মীমাংসা না হলে তারা পদক্ষেপ নেবে। পরদিন ২৬ জানুয়ারি সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্র অভ্যুত্থানের বিষয়ে সরাসরি ইঙ্গিত দিয়েছেন। এরপর থেকেই মূলত আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মিয়ামনারের রাজনীতি।
ফলশ্রুতিতে গতরাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্যু করে সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে। রাজধানী নেপিডো ও প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় রাস্তায় সেনারা টহল দিচ্ছে। প্রধান প্রধান শহরে মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বলছে, কারিগরি জটিলতায় সম্প্রচার কার্যক্রম থেমে গেছে।
মোটাদাগে মনে হচ্ছে সেনাপ্রধানের ক্ষমতার খায়েশই অভ্যুত্থানের বেসিক কারণ। এর সাথে চীনের ইন্ধন থাকতে পারে। সুচির সরকারের প্রতি মার্কিন সমর্থন চীনকে এমনকাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আগামীতে মিয়ানমার ও সে দেশের গণতান্ত্রিক মানুষদের ওপর যে ঝড় যাবে তা সহজেই অনুমিত। একইসাথে রোহিঙ্গা সমস্যাও আরো প্রকট আকারে দেখা দিতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন