৯ বছর আগের কথা। ৪ ফেব্রুয়ারি। গভীর রাত। দিনে শীতের দেখা না পাওয়া গেলেও রাতে বেশ শীত জেঁকে বসে। ঢাকা থেকে ছাড়লো হানিফ পরিবহনের একটি বাস। বাসের নাম্বার ‘ঝিনাইদহ-৩৭৫০’। বাসের গন্তব্য কুষ্টিয়া। সেই বাসে উঠে বসে দুই বন্ধু। তাদের গন্তব্য কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। তারা সেখানেরই ছাত্র।
রাতের বাসের যাত্রীরা সাধারণত ঘুমিয়ে পড়ে। তবে ঘুমিয়ে পড়ার সময়টুকু তারা তখনো পায়নি। বাস ছেড়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। বাসে যাত্রীরা কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে। হালকা শব্দে গান ছেড়েছেন চালক। গাড়ির বাইরে মধ্যরাতে আশপাশের জনপদে নীরবতা নেমে এসেছে ততক্ষণে। হানিফ পরিবহনের বাসটিও ছুটে চলেছে কুষ্টিয়ার পথে।
ততক্ষণে সাভার পেরিয়ে বাসটি পৌঁছাল নবীনগর এলাকায়। চালক দেখলেন বাসটি থামানোর সংকেত দিচ্ছে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর একটি গাড়ি। গতি কমালেন চালক। বাসের গতিরোধ করে দাঁড়াল র্যাব-৪ এর একটি গাড়ি। র্যাবের পোশাকে ৮-১০ জন উঠলেন বাসটিতে। সবার হাতে অস্ত্র। ইউনিফর্ম ছাড়াও রয়েছেন ভিন্ন পোশাকের কয়েকজন। উপস্থিত যাত্রীদের ধারনা তারা গোয়েন্দা শাখার লোকজন এবং তাদের সোর্স। র্যাবের সদস্যদের দেখে যাত্রীদের সকলেই মনে করেন তল্লাশি চলবে হয়তো।
যাত্রীরা যখন তল্লাশির অপেক্ষায় তখন দেখা গেল নির্ধারিত দুটি সীটের পাশে গেলো র্যাবের সদস্যরা। বাসটির সিট নম্বর C1 ও C2 তে বসেছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধু। এই দুই সীট ঘিরেই র্যাবের যত তৎপরতা। এমন পরিস্থিতিতে বাসের ভেতর তখন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বসে থাকলেন অন্য যাত্রীরা। কেউই ভয়ে কথা বলছেন না। যাত্রীদের চোখের সামনে থেকেই সেই দুই ছাত্রকে তুলে নিলেন র্যাব-৪ এর সদস্যরা।
তাদের নিয়ে যাওয়ার সময় বলা হল-‘আমরা আইনের লোক। আমাদের সঙ্গে আসুন’। দ্রুতই এই অপারেশনের সমাপ্তি ঘটে বাসটিতে। এরপর থেকে আজ অবধি খোঁজ মেলেনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী সেই দুই শিক্ষার্থী ওয়ালিউল্লাহ ও আল-মুকাদ্দাসের। গল্প এখানেই শেষ। হারিয়ে গেল তারা। গুম করে ফেললো র্যাব তাদেরকে।
ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন দাওয়া অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের মাস্টার্সের ছাত্র। পিরোজপুরের কমদতলী ইউনিয়নে খানাকুনিয়ারী গ্রামে তার জন্ম। তার বাবা মাওলানা আবদুল হালিম। র্যাবের হাতে গুম হওয়া মুকাদ্দেস আল ফিকহ্ বিভাগের ছাত্র। ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার সোজালিয়া গ্রামে তার বাড়ি। তার বাবার নাম মাওলানা ফজলুর রহমান। লেখাপড়ার পাশাপাশি শতাধিক গান, গল্প আর নাটক লিখেছিলেন মুকাদ্দেস।
এই খবরটি যখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে তখন ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের পরিবারেও দ্রুত পৌঁছে যায় খারাপ খবরটি। সন্তানের খোঁজে র্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা দফতরে চষে বেড়িয়েছেন স্বজনরা। কিন্তু, নিজেদের অপকর্ম স্বীকার করেনি কোনো বাহিনী। হানিফ পরিবহনের যে বাসটি থেকে দুই ছাত্রকে তুলে নেয়া হয়েছিল তার চালক ও সুপারভাইজারও ঘটনার পর স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদেরকে বলেছিলেন যে, র্যাব-৪ এর সদস্যরাই তুলে নিয়েছে শিক্ষার্থীদেরকে। এমনকি বাসের কয়েকজন যাত্রীও সেই সময় একই তথ্য দিয়েছিলেন।
নিখোঁজ আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে কেন আদালতে সশরীরে হাজির করা হবে না, জানতে চেয়ে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বিষয়টি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। বিচারপতি আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি আকরাম হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ রুল জারি করেছিল। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল র্যাবের হাতে আটক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দাস ও মো. ওয়ালিউল্লাহকে সশরীরে আদালতে হাজির করার জন্য। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক তাদের আটকের বিষয়টি কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয়। ওই দুই ছাত্রের আত্মীয়দের করা পৃথক দু’টি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে এই আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
রুল জারির তিন সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের আইজি, র্যাবের ডিজিসহ ৯ জনকে জবাব দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু, এতটুকুতেই থেমে গেছে আওয়ামী হাইকোর্ট । শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকারও আওয়ামী হাইকোর্টের এই নির্দেশনার কোন পাত্তাই দেয়নি। সে সময় বাদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম আদালতে বলেছিলেন, সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের রক্ষক। এভাবে একের পর এক মানুষ আটক করার পর নিখোঁজ হয়ে গেলে দেশে সাংবিধানিক ও আইনের শাসন ভেঙে পড়বে। মানুষ সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহর গুমের ঘটনায় দেশে-বিদেশে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। ক্লাস বর্জন, আন্দোলন, বিক্ষোভও করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট মাফিয়া সরকার ফেরত দেয়নি এই দুই ছাত্রকে। শেখ হাসিনা তার বাবা শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনীর মতো র্যাবকে একটি গুণ্ডা মাফিয়া বাহিনীতে পরিণত করেছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘ছাত্রনেতারা নির্যাতনের ঝুঁকিতে’ শীর্ষক শিরোনামে বিবৃতিও দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই ছাত্রকে উঠিয়ে নেওয়ার সময় র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মোখলেসুর রহমান। র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমানের মেয়াদকালে এরকম অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। এমনসব গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের জন্য র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে ২০১২ সালে তাকে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক "পুলিশ পদক (বিপিএম)" দেওয়া হয়েছিল হাসিনা মাফিয়া সরকারের পক্ষ থেকে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে এই সময় দায়িত্ব পালন করেন কর্নেল জিয়াউল আহসান। শেখ হাসিনার খুনি বাহিনীর অন্যতম সদস্য হিসাবে জিয়াউল আহসানই এই বাহিনীতে সবচেয়ে বেশি সময়কাল দায়িত্ব পালন করেন। তার নির্দেশ ও দিক নির্দেশনায় বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মীকে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা ও গুম করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রের গুমেও তার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা গেছে।
৯ বছর হয়ে গেল। প্রিয় সন্তান আর ফেরেনি ঘরে। মায়ের কান্না আর বাবার আহাজারিও থামেনি। আর প্রিয় ভাইকে কাছ পেতে অপেক্ষায় আছে ছোট ভাই-বোনেরা। ক্যাম্পাসের বন্ধুরাও ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছে বহুদিন আগে। হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে আছে তারা।
সরকারি গুণ্ডা র্যাব তো বিনা কারণে তাদের গুম করবে না। অবশ্যই তাদের অপরাধ আছে। অবশ্য এই অপরাধ আইনের দৃষ্টিতে নয়। তাই আইনের কাছে সোপর্দ করার হিম্মত হাসিনা ও তার গুণ্ডাদের হয়নি। তারা দুই বন্ধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। এটাই তাদের জন্য কাল হয়েছে। ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের তালিকা অনুযায়ী ছাত্রশিবিরের মেধাবী ও যোগ্য সংগঠকদের র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাদের দিয়ে ধরে ধরে গুম, গ্রেফতার বা নির্যাতন করা হয়েছে তখন। এখনো এই ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান অনেকে।
আজ ৪ ফেব্রুয়ারি। ওয়ালি-মুকাদ্দাস ভাইকে হারানোর ৯ বছর। অথর্ব আমরা! বসে বসে দিন গুণি। আমাদের কেউ ক্ষমা করবে না। কেউ না।
#DhakaMafia
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন