বাবা-মা আমার বুঝজ্ঞান হওয়ার আগে থেকে জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলেন। ঘরভর্তি ছিল ইসলামী সাহিত্য ও তাফসীর। আর আব্বু আম্মুর নসীহত তো আছেই। বাসার পাশেই ছিল শিবির মেস। শিবিরের আঙ্কেলরা আদর করতেন, চকোলেট খাওয়াতেন। স্টিকার ও ভিউকার্ড দিতেন। এভাবে এতো মানুষের প্রভাবে কখন যে ছাত্রশিবিরে যুক্ত হয়ে গেছি বুঝতে পারি নাই। শৈশব থেকেই আমি শিবির করি বলা চলে। আব্বুর সাথে, শিবিরের আঙ্কেলদের সাথে প্রাইমারি থেকেই শিবিরের প্রোগ্রামগুলোতে যাতায়াত হতো।
তবে যখন সেভেন এইটে উঠেছি তখন শিবিরের ভাইদের থেকে দূরে থাকতে চাইতাম। তখন শিবির দায়িত্বশীলদের আঙ্কেল বলা ছেড়ে দিয়েছি। শুধু মাসের শুরুর দিকে যখন তারা কিশোর কন্ঠ নিয়ে আসতেন তখন তাদের থেকে সেটা কালেকশন করতাম। এছাড়া ওদের মিটিং-এ এটেইন করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ তারা যেসময় মিটিং করে ওটা আমার খেলার টাইম। আর শুধু ১৫ মিনিটের মিটিং হলে না হয় হতো, কিন্তু তারা আমাকে 'সাথী' হতে বলে। 'সাথী' হলে আমার খেলাধূলা চাঙে উঠবে। তাই মিটিং-এ যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
কিন্তু সেসময়ের কিছু দায়িত্বশীল আমাকে এমনভাবে চেপে ধরলেন যে, ক্লাস নাইনে আমাকে 'সাথী' হতেই হলো। সাথী হওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করামাত্র আমার বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি, বিকেলের খেলা সব লিমিটেড হয়ে গেল। প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়া মুখস্ত করা লাগতো। প্রতিদিন কোন না কোন বই পড়া লাগতো। দায়িত্বশীল এসে আবার সে বই থেকে পড়া ধরতেন। এভাবে লাইফটা একেবারে টাইট হয়ে গেল। এরপর সাথী হলাম। সাথী শপথ নেওয়ার পর দায়িত্বের বোঝা বাড়তে লাগলো। তখন অবশ্য সাংগঠনিক পড়ালেখার চাপ কিছুটা কমেছে। দায়িত্বের চাপে আমার খেলাধূলা সত্যিই চাঙে উঠে গেল।
যাই হোক এভাবে আমি শিবির হয়ে গেলাম। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার থেকে শুরু হলো সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া আরো কঠিন, আর পেইনফুল। প্রতিটি ঘন্টার হিসাব দিতে হতো উর্ধ্বতনকে। কুরআন যা একটু মুখস্ত হয়, হাদিস তো মোটেই মুখস্ত হয় না। আমি আমার একাডেমিক পড়াশোনাও মুখস্ত রাখতে পারতাম। সারাজীবন পরীক্ষায় যা বুঝতাম তা বানিয়ে লিখে আসতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে তো আর সেটা সম্ভব না, কারণ আমি আরবি ব্যাকরণ বাক্যগঠন কিছু বুঝি না। সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়ায় হাদিস মুখস্ত করা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের। যেদিন সদস্য হয়েছি সেদিন ফাইনাল ভাইবাতে তৎকালীন অফিস সম্পাদক রেজাউল ভাই ধরছিলেন ইতিহাস ও সাধারণ জ্ঞান থেকে। আল্লাহ রক্ষা করেছে। এটা আমার ছিল ফেবারিট। উনি আমার থেকে বঙ্গভঙ্গ, ঢাবি প্রতিষ্ঠা ও দ্বিজাতিতত্ত্ব জানতে চেয়েছেন। সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলাম। কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ ভাই শুধু আমার নামের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। আর বলেছেন ছোট মানুষ আপনি! কেন সদস্য হবেন?
এরপর একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। ভার্সিটিতে তখন নতুন। হলে রুমমেট দুজনই ছিল সিনিয়ার। আমি পুরোদস্তুর ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হওয়ায় আমাদের রুমে বেশীরভাগ আড্ডা রাজনৈতিক আড্ডায় পরিণত হতো। রুমমেটদের একজন ছিল বিএনপি ঘেঁষা অন্যজন কট্টর লীগ সমর্থক। একদিন লীগ সমর্থক সিনিয়র ভাইটি কথায় কথায় বললেন “তুমি বেশি ফাল পাইড়ো না, তোমার আর কীসের ইসলামী আন্দোলন, তুমি বাপ-দাদার গোলামিই করতাছো। তোমার বাপ-মাও জমাতি তুমিও জমাতি।”
ঐ কথা শুনে আমি থমকে গিয়েছিলাম। চিন্তা করে দেখলাম, কথাটা ভুল বলেননি। আমি তো অন্য ইসলামী সংগঠনগুলো নিয়ে চিন্তা করিনি। আমার সামনে নতুন ভাবনার দুয়ার খুলে গেলো। অন্যকোন সংগঠন শিবিরের চাইতেও সহীহ হতে পারে। প্রথমে দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা করলাম। তারা কিছু ইনফরমেশন দিলেন অন্য ইসলামী দল সম্পর্কে। সব নেগেটিভ ইনফরমেশন।
সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম ইনফরমেশনগুলোতো ভুলও হতে পারে। অতঃএব ঐ দলগুলোর সাথে মিশতে হবে। তাদের বই পড়তে হবে তাদের জানতে হবে। একটি নোটবুক ক্রয় করলাম। একে একে সব দলগুলোর নাম লিখলাম। টার্গেট সত্যানুসন্ধান। প্রতিটি দল সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। প্রতিটি দলের বৈশিষ্ট্য লিখি। সর্বশেষ মন্তব্য করি কেন আমি এই দলের সাথে যুক্ত হতে পারছি না।
মোটামুটি সব দল সম্পর্কে নোট করা শেষ। ২০১১ সালে অনুসন্ধান মোটামুটি শেষ বলে ঘোষনা করি। আলহামদুলিল্লাহ সারা বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের চাইতে অধিকতর ভালো কোনো সংগঠন পাই নি। সেই সাথে প্রশান্তি অনুভব করি। ইনশাআল্লাহ, অন্তত আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা আমাকে এই মর্মে পাকড়াও করবেন না যে, আমি বাপ-দাদার গোলামি করেছি। প্রত্যেকটি সংগঠনের ব্যাপারে উত্তর তৈরী করেছি কেন আমি তাদের সাথে নেই।
এই কাজটি করতে গিয়ে শিবির সম্পর্কে আস্থা আরো বেড়েছে। দারুণ একটি ব্যাপার আবিষ্কৃত হয়েছে। শিবির আসলে একটি মধ্যমপন্থী দল। তাই বলে আমি এই দাবী করছি না শিবিরই একমাত্র সহীহ দল কিংবা শিবিরের কোন ভুল নাই। আমার বিবেচনায় দ্বীন প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে এর চাইতে ভালো অথবা এর কাছাকাছি কোনো সংগঠনকে আমি পাইনি।
আমি আমার অনুসন্ধানে তিনটি বিষয়কে সামনে রেখেছি।
১. আকীদা।
২. বিপ্লবের পদ্ধতি।
৩. নেতৃত্ব কাঠামো।
আকীদার ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় পাশ করেছে অনেকগুলো সংগঠন। যাদের আকীদা আমার কাছে সহীহ মনে হয় নি, তাদের পরবর্তী দুটো বিষয় নিয়ে আমি আর জানার চেষ্টা করি নি।
বিপ্লবের পদ্ধতি মানে ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে নির্মিত হবে এই প্রশ্নে আমি আদর্শ হিসেবে গ্রহন করেছি রাসূল সা.-এর সীরাতকে। রাসূল সা. তিনটি কাজ করেছেন।
১. অগ্নি পরীক্ষার মাধ্যমে ১৩ বছর ধরে যোগ্য লোক তৈরি করেছেন যারা ইসলামী রাষ্ট্রকে ইসলামী আদর্শ মোতাবেক চালাতে পারবেন।
২. দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে গনমানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন, যাতে তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়। ইসলামের সুমহান আদর্শ মেনে নেয়।
৩. নেতা হিসেবে নিজেকে আদর্শের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে ইসলামের জীবন্ত রূপ দিয়েছেন।
এই বিপ্লবের পদ্ধতির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে অন্যান্য দলগুলো কোন না কোন অংশে চরমপন্থা অবলম্বন করেছে। যেমন কেউ শুধু দাওয়াত নিয়ে চরমপন্থি হয়ে আছে, কেউ সেক্টরগুলোর মধ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে চরমপন্থা করছে, কেউ সামাজিক কাজ নিয়ে চরমপন্থা করছে। কেউ আবার নেতা নিয়ে চরমপন্থা করছে। একমাত্র ভারসাম্য দল পেলাম শিবির, যে সব সেক্টর নিয়ে কাজ করছে। ইসলামকে আংশিকভাবে গ্রহণ না করে সামগ্রিক জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছে।
নেতা আদর্শের মডেল হবেন, এই ব্যাপারে সব দলেই ঘাটতি আছে, এমনকি শিবিরেও এই ঘাটতি আমার চোখে পড়েছে।
তৃতীয় যে বিষয় নেতৃত্ব কাঠামো। অসাধারণ একটা সিস্টেম ডেবেলপ করেছে শিবির। যাতে নেতৃত্বের প্রতি লোভীদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে একেবারেই হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সর্বস্তরের নেতৃত্ব নিয়ে আস্থাহীনতা জামায়াত-শিবির ছাড়া প্রায় সব দলেরই প্রধান সমস্যা। আর প্রায় সব দলেই নেতৃত্বলোভীরাই নেতা হওয়ার সুযোগ পায়। আর্থিক সচ্ছতা মেইন্টেইন করতে পেরেছে এমন সংগঠন খুব কম।
তাছাড়া শিবিরের আছে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য যা শিবিরকে তার লক্ষ্য অর্জন সহজ করে দিচ্ছে।
১. শিবিরের বিপ্লবী দাওয়াত।
শিবির দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মানুষকে আহ্বান করে না। দুনিয়ার কোন সফলতার লোভ দেখায় না। একান্ত পরকালীন সাফল্যের কথা সামনে নিয়ে আসে, যেভাবে আল্লাহর রাসূল দাওয়াত দিয়েছেন।
২. ইসলামী সমাজ গঠনের উপযোগী ব্যক্তিগঠন পদ্ধতি।
শিবির মনে করে ব্যক্তিগঠনের জন্য তিন ধরণের যোগ্যতা লাগবে। এক, ঈমানী যোগ্যতা। দুই, ইলমী যোগ্যতা। তিন, আমলী যোগ্যতা। যোগ্যতা হাসিলে কঠোর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটি।
৩. ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি তাকওয়া ভিত্তিক সংগঠন। শিবির কোন লোককে দায়িত্ব প্রদানকালে তাকওয়ার বিষয়টি সামনে রাখে।
৪. শিবিরের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে “নেতৃত্ব সৃষ্টির পদ্ধতি”। অসাধারণ এই পদ্ধতিতে নেতৃত্ব বা পদলোভীদের কোন স্থান নেই।
৫. শিবিরের অর্থের উৎস শিবিরের দায়িত্বশীল, কর্মী এবং শুভাকাংখীরা। শিবির বাইরের অন্য কারো অর্থে চলে না। তাই কারো ক্রীয়ানক হিসেবে কাজ করে না।
৬. বিরোধীদের প্রতি শিবিরের আচরণ।
শিবির তার বিরোধীদের মধ্যে যারা অশালীন ও অভদ্র ভাষা প্রয়োগ করে তাদের করুণার পাত্র মনে করে। শিবিরের দাওয়াত আদর্শ ও কর্মসুচীর বিরুদ্ধে বেচারাদের কিছু বলার সাধ্য নেই বলে বেসামাল হয়ে গালাগালি করে মনের ঝাল মেটানোর চেষ্টা করে। শিবির তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করে।
আর যারা মিথ্যা সমালোচনা করে অপবাদ দেয়, শিবির প্রয়োজন মনে করলে সেই সমালোচনা সত্য উপস্থাপন করে খন্ডন করে। আর তাছাড়া শিবির এও বিশ্বাস করে, মুমিনের দুনিয়ার জীবনে ব্যর্থতা হলো আল্লাহর আনুগত্য করতে না পারা। দুনিয়ার জীবনের কষ্ট, নির্যাতন, অত্যাচার অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিকূলে থাকা সবগুলোকেই শিবির পরীক্ষা বলেই গণ্য করে।
গতকাল শিবিরের ৪৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী গেল। বাংলার হাজার হাজার মানুষের চরিত্র গঠনে ছাত্রশিবিরের অবদান অপরিসীম। ইসলাম কায়েমকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নেয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো সংগঠন এমন বিশাল ভূমিকা রেখেছে তা আমার জানা নেই। শিবির থেকে বিদায় নিয়েছি প্রায় তিন বছর হলো। এখনো প্রাণভরে রোমান্থন করি সেই প্রেরণাদায়ক স্মৃতিগুলো।
আমার এই লেখা যেসব ছাত্রভাইরা পড়বেন, আপনাদের প্রতি আমার আহবান থাকবে ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পর্ক তৈরি করুন। ইনশাআল্লাহ আপনার সময়গুলো বৃথা যাবে না। কিয়ামতের কঠিন দিনে এগুলো আপনার নাজাতের উসিলা হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে রাখুন। আমিন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন