সবচেয়ে বড় গুনাহ বা পাপ হলো শিরক। মক্কার মুশরিকরা আল্লাহকে মানতো। সাথে লাত, মানাত, উজ্জাসহ অন্যান্য দেব দেবীকেও সম্মান করতো। লাত, মানাত ও উজ্জাকে আল্লাহর তিন কন্যা হিসেবে জ্ঞান করতো। কুরাইশরা ইবরাহীম আ., ইসমাঈল আ.-কে পূর্বপুরুষ ও পীর হিসেবে মানতো। তাদের ভালো মন্দ করার ক্ষমতা আছে বলে মনে করতো। আবার তাদের কাছে সুপারিশকারী হিসেবে হুবালকেও সম্মান করতো। হুবাল ছিল কা'বা ঘরে সংরক্ষিত প্রধান মুর্তি।
মহানবী সা.-কে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাই তাঁকে নিজ তত্ত্বাবধানে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। তৎকালীন সমাজ থেকে নবী সা. শিক্ষা নেননি। ফলশ্রুতিতে নবী সা. মুশরিকদের শিরকি কর্মকান্ড একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি এর থেকে কীভাবে জাতির লোকদের বাঁচানো যায় সেই চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। কিন্তু সমাধান পান নি। সমাধান লাভ করার উদ্দেশ্যে তিনি নির্জন স্থানে গবেষণা করা শুরু করলেন।
মহাম্মদ সা.-এর বড় দায়িত্ব ছিল দুনিয়া থেকে এসব শিরকি কাজ তুলে দিয়ে সেখানে দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করা। সর্বত্র আল্লাহর নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠা করা। এটাকে আল্লাহ তায়ালা দ্বীন প্রতিষ্ঠা হিসেবে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। অনেক একে তাওহীদ প্রতিষ্ঠাও বলে থাকেন।
আল্লাহ তায়ালা সূরা আত তাওবার ৩৩ নং আয়াতে বলেন, তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে। এই একই কথা রিপিট করেন সূরা ফাতহ'র ২৮ নং আয়াতে ও সূরা সফের ৯ নং আয়াতে।
এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা ইকামতে দ্বীনের বিষয়ে সূরা আশ শুরার ১৩ নং আয়াতে বলেন, তিনি তোমাদের জন্য দ্বীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহি পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো, তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন।
এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করেছেন তিনি কী দায়িত্ব দিয়ে মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি ওহি নাজিল করেছেন।
যাই হোক আল্লাহর রাসূল সা. গবেষণার মাস হিসেবে বাছাই করেছেন রমাদান মাসকে। তিন বছর তিনি রমাদানে এতেকাফ বা নির্জনে থেকে গবেষণা করেছেন। এর মধ্যে ৩য় বছরের রমাদানে তাঁর ওপর ওহি নাজিল হয় এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী হিসেবে স্বীকৃতি ও ঘোষণা লাভ করেন। তিনি যে বছর নবুয়্যত পান সেই বছর রমাদানের আগে প্রায় ছয় মাস ধরে সত্য স্বপ্ন দেখতেন। অর্থাৎ তিনি রাতে যা স্বপ্নে দেখতেন দিনে তা সত্যিই ঘটতো। এভাবে অলৌকিক ঘটনাগুলো নবী সা.-কে বিচলিত করে। তিনি আরো বেশি নির্জনতাকে ধারণ করেন।
মুহাম্মদ সা. এর বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি হলো। নবুয়্যত পাওয়ার আগে নবী সা.-এর সাথে তাঁর স্বজাতীয়দের সাতে মানসিক ও চিন্তার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেল। এ অবস্থায় রসুল নিঃসঙ্গতা প্রিয় হয়ে উঠলেন। ছাতু এবং পানি নিয়ে তিনি মক্কা থেকে দুই মাইল দুরে অবস্থিত হেরা পাহাড়ের গুহা গিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। রাসূল সা. এই গুহায় যাওয়ার পর খাদিজা রা.-ও তাঁর সঙ্গে যেতেন এবং নিকটবর্তী কোন জায়গায় অবস্থান করতেন। মুহাম্মদ সা. পুরো রমযান মাস এই গুহায় কাটাতেন। জগতের দৃশ্যমান এবং এর পেছনে কাজকর্ম, কুদরতের কারিশমা সম্পর্কে চিন্তা করতেন।
স্বজাতির লোকদের মূর্তি পূজা এবং নোংরা জীবন যাপন দেখে তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁর সামনে সুস্পষ্ট কোন পথ সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি, প্রচলিত অবস্থার বিপরীত কোন কর্মসূচী ছিল না যার ওপর জীবন কাটিয়ে তিনি মানসিক স্বস্তি ও শান্তি লাভ করতে পারেন। রসুলের এ নিঃসঙ্গপ্রিয়তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞার একটি অংশ। এমনি করে আল্লাহ পাক তাঁকে ভবিষ্যতের গুরুদায়িত্বের জন্য তৈরি করছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের বাস্তব সমস্যার সমাধান দিয়ে যিনি জীবন ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হবেন, তিনি পারিপার্শ্বিক হৈ চৈ হট্টগোল থেকে দূরে নির্জনতায় কোলাহলমুক্ত পরিবেশ কিছুকাল থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা ধীরে ধীরে তাঁর প্রিয় হাবিবকে আমানতের বিরাট বোঝা বহনের এবং বিশ্ব মানবের জীবন ধারায় পরিবর্তনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি করছিলেন। তাঁকে আমানতের জিম্মাদারি অর্পণের তিন বছর আগে নিজনে ধ্যান করা তাঁর জন্য আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এই নির্জনতায় কখনো এক মাস পর্যন্ত তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন।
এই প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা রা. বলেন, প্রিয় রসুলের ওপর ওহি নাজিলের সূচনা স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছিল। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন সে স্বপ্ন শুভ্র সকালের মত প্রকাশ পেতো। এরপর তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে যান। তিনি হেরা গুহায় ইবাতদ বন্দেগীতে কাটাতে থাকেন এবং এ সময় একাধারে কয়েকদিন ঘরে ফিরতেন না। পানাহার সামগ্রী শেষ হয়ে গেলে সেসব নেয়ার জন্য পুনরায় বাড়িতে ফিরতেন। এমনি করে এক পর্যায়ে হযরত জিবরাইল আ. তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁকে বলেন, পড়ো। তিন বললেন, আমি পড়তে জানিনা। ফেরেশতা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, পড়ো। তিন বলেন, আমার সব শক্তি যেন নিংড়ে নেয়া হলো। এরপর ফেরেশতা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো। তিনি বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। পুনরায় ফেরেশতা আমাকে বুকে জড়িয়ে চাপ দিলেন।
এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো, তৃতীয়বার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, পড়ো, ইকরা বি-ইসমে রাব্বিকাল্লাজি খলাক। এভাবে সূরা আলাকের ১ম পাঁচ আয়াত পড়ানো হয়েছিল।
এই আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর প্রিয় নবী ঘরে ফিরে এলেন। তার বুক ধুকধুক করছিল। স্ত্রী হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদকে বললেন, আমাকে চাদর গিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। বিবি খাদিজা প্রিয় নবীকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন।
এরপর বিবি খাদিজাকে সব কথা খুলে বলে প্রিয় রসুল বললেন, আমার কি হয়েছে? নিজের জীবনের আমি আশংকা করছি। বিবি খাদিজা তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, আল্লাহ পাক আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করেন, বিপদগ্রস্ত লেকদের সাহায্য করেন মেহমানদারী করেন, সত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করন।
বিবি খাদিজা এরপর প্রিয় নবীকে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে নিয়ে গেলেন। ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আবদুল ওযযা আইয়ামে জাহেলিয়াতে ঈসায়ী ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষায় লিখতে জানতেন। সে সময় তিন ছিলেন বয়সের ভোরে ন্যুজ এবং দৃষ্টিহীন। বিবি খাদিজা বললেন, ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকা বললেন, ভাতিজা তুমি কি দেখেছ?
রসূল (সা.) যা যা দেখেছেন সব তাকে খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, তিনি সেই দূত যিনি হযরত মুসার আ.-এর কাছে এসেছিলেন। হায় যদি আমি সেই সময় বেঁচে থাকতাম যখন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে। রসুল অবাক হয়ে বললেন, তবে কি আমার কওম আমাকে সত্যি সত্যিই বের করে দেবে, ওয়ারাকা বললেন, হ্যাঁ। তুমি যে ধরনের বাণী লাভ
প্রথম কুরআন নাজিল হওয়ার পর কিছুদিন ওহি নাজিল হওয়া স্থগিত থাকে। এই সময়ে প্রিয় রসুল বিষণ্ণ এবং চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি মানসিক অস্থিরতা এবং উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। ওহীর আগমন স্থগিত হওয়ার পর মুহাম্মদ সা. এতোটাই অস্থিরতা এবং চিন্তার মধ্যে ছিলেন যে কয়েকবার উঁচু পাহাড়ের চুড়ায় উঠেছিলেন যেখান থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু পাহাড় ওঠার পর জিবরাঈল আসতেন এবং বলতেন হে, মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর প্রিয় রসুল। এ কথা শোনার পর তিনি থমকে দাঁড়াতেন। তাঁর উদ্বেগ অস্থিরতা কেটে যেতো। প্রশান্ত মনে তিনি ঘরে ফিরে আসতেন। পুনরায় ওহি না আসার কারণে তিনি অস্থির হয়ে উঠতেন। সেখানে জিবরাঈল এসে হাযির হতেন এবং বলতেন। হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসুল। হাফেজ ইবনে হাজার লিখেছেন ওহি কিছুকাল স্থগিত থাকার কারণ ছিল এই যে, তিনি যে ভয় পেয়েছিলেন সই ভয় যেন কেটে যায় এবং পুনরায় ওহী প্রাপ্তির আগ্রহ এবং প্রতীক্ষা যেন তাঁর মনে জাগে।
বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাওয়ার পর, বাস্তব অবস্থা তার সামনে প্রকাশ পেলো, তিনি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন যে, তিনি আল্লাহ তায়লার নবী হয়েছেন। তিন আরো বুঝতে সক্ষম হলেন যে, তাঁর কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি ওহির বাণী বহনকারী, আসমানী সংবাদবাহক। এইরূপ বিশ্বাস তাঁর মনে দৃঢ় হওয়ায় পর তিনি আগ্রহের সাথে ওহির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁকে দৃঢ় হয়ে থাকতে হবে এবং এ দায়িত্ব বহন করতে হবে। মানসিক অবস্থার এ পর্যায়ে হযরত জিবরাঈল আ. পুনরায় এসে হাজির হলেন। এই প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেছেন, আমি পথ চলছিলাম, হটাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়াজ শোনা গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ফেরেশতা যিনি হেরা গুহায় আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি আসমান জমিনের মাঝখানে একখানি কুর্সিতে বসে আছেন।
আমি ভয় পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এরপর বাড়িতে এসে আমার স্ত্রীর কাছে বললাম, আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও, আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও। স্ত্রী আমাকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা সুরা মুদ্দাসসিরের ‘অররুজযা ফাহজুর’ পর্যন্ত নাযিল করেন। এ ঘটনার পর থেকে ঘন ঘন ওহী নাযিল হতে থাকে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন