তাবলীগ শব্দের অর্থ- পৌঁছে দেওয়া। আল্লাহ তায়ালার কথা, নির্দেশনা, বিধি নিষেদ জনগণের নিকট পৌঁছে দেওয়ার নাম তাবলীগ। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম যে কাজটা করতে হয় সেটা হলো তাবলীগ। মহান রাব্বুল আলামীন সূরা মুদ্দাসসিরের ১ম সাত আয়াত নাজিলের মাধ্যমে মুহাম্মদ সা.-কে তাবলীগের নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
হে চাদরাবৃত! উঠুন, সতর্ক করুন। আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষনা করুন। আপন পোশাক পবিত্র করুন। এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন। অধিক প্রতিদানের আশায় অন্যকে কিছু দিবেন না। এবং আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে সবর করুন। - সূরা মুদ্দাসসির (১-৭)
এখানে যে নির্দেশগুলো পাওয়া যায়,
- জনগণকে সতর্ক করা
- আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা
- পবিত্র থাকা ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকা
- অধিক প্রতিদানের আশা না করা
- দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে ধৈর্য ধারণ করা।
এই প্রসঙ্গে সফিউর রহমান তাঁর আর রাহিকুল মাখতুমে সুন্দর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন,
সূরা মুদ্দাসসিরের প্রথম কয়েকটি আয়াতে প্রিয় নবীকে যেসব নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এসব নির্দেশ দৃশ্যত সংক্ষিপ্ত এবং সহজ সরল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব নির্দেশ খুবই সুদূর প্রসারী এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বাস্তব জীবনের ওপর এসব নিদেশের কার্যকারিতা ও প্রভাব অসামান্য।
১. সতর্ক করার জন্য যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, বিশ্বে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে সব কাজ হচ্ছে তার মারাত্মক পরিণাম সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। সেই ভয় এমনিভাবে দেখাতে হবে যাতে আল্লাহ তায়ালার আজাবের ভয় মানুষের মন মগজে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে।
২. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর জমিনে শুধুমাত্র তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব অটুট থাকবে, অন্য কারোর শ্রেষ্ঠত্ব বহাল থাকতে দেওয়া যাবে না বরং অন্য সব কিছুর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য নস্যাৎ করে দিতে হবে। ফলে আল্লাহর জমিনে একমাত্র তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমাই শুধু প্রকাশ পাবে এবং স্বীকৃত হবে।
৩. পোশাকের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থেকে এমন পর্যায়ে আসতে হবে যাতে করে আল্লাহ পাকের রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়া যায়। এটা শুধুমাত্র তারই হেদায়েত ও নূরের দ্বারা সম্ভব হতে পারে। উল্লেখিত পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জনের পর অন্তর আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমাই অন্তরে জাগ্রত হবে। এর ফলে সমগ্র বিশ্বের মানুষ বিরোধিতা অথবা আনুগত্যে তাঁর কাছাকাছি থাকবে। তিনিই হবেন সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।
৪. কারো প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ করার পর অধিক বিনিময়ে প্রত্যাশা না করার উদ্দেশ্য এই যে, নিজের কাজকে শ্রেষ্ঠ মনে করা যাবেনা, বেশি গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। বরং একটির পর অন্য কাজের চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। বড় রকমের ত্যাগও কোরবানী করেও সেটাকে তুচ্ছ মনে করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর কাছে জবাবদিহির বিপরীতে নিজের চেষ্টা সাধনাকে ক্ষুদ্র ও সামান্য মনে করতে হবে।
৫. শেষ আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, তাবলীগের কাজ শুরু হওয়ার পর শত্রুরা বিরোধিতা, হাসিঠাট্টা, উপহাস, বিদ্রূপ ইত্যাদির মাধ্যমে কষ্ট দেবে এবং প্রিয় নবীকে এবং তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তাঁকে এসব কিছুর সাথে মোকাবেলা করতে হবে। এমতাবস্থায় তাঁকে দৃঢ়তার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এই ধৈর্য মনের শান্তির জন্য নয় বরং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি এবং তাঁর দ্বীনের প্রচার প্রসারের জন্য। কেননা আল্লাহ পাক বলেছেন, ওয়া লি রব্বিকা ফাসবির অর্থাৎ তোমার প্রতিপালকের জন্য ধৈর্য ধারণ করবে।
কী চমৎকার! এসকল নির্দেশ স্বাভাবিক ও খালি চোখে সহজ সরল এবং সংক্ষিপ্ত। শব্দ চয়ন কতো হালকা এবং কাব্যধর্মী। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা কতো ব্যাপক! কতো তাৎপর্যমন্ডিত! এই কয়েকটি শব্দের প্রকৃত প্রয়োগের ফলে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছল এবং সারা বিশ্বের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন স্থাপিত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা এই ওহীর মাধ্যমে মুহাম্মদ সা.-কে তার দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। ঘুমের আরাম পরিত্যাগ করে জিহাদের কষ্টকর ময়দান অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তায়ালা ইঙ্গিত করেছেন, যে ব্যক্তি নিজের জন্য বাঁচবে শুধু সেই তো আরামের জীবন কাটাতে পারে, কিন্তু যার ওপর বিশাল মানবগোষ্ঠীর পথনির্দেশের দায়িত্বের বোঝা সে কী করে ঘুমিয়ে থাকতে পারে? উষ্ণ বিছানার সাথে, আরামদায়ক জীবনের সাথে তার কী সম্পর্ক?
আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে বুঝিয়েছেন, তুমি সেই মহান কাজের জন্য বেরিয়ে পড়ো যে কাজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তোমার জন্য প্রস্তুত বিরাট দায়িত্বের বোঝা পালনের জন্য এগিয়ে এসো। সংগ্রাম করার জন্য এগিয়ে এসো। কষ্ট করো। ঘুম এবং আরামের সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন সময় বিনিদ্র রাত কাটানোর। অনেক পরিশ্রমের। তুমি একাজ করার জন্য তৈরি হও। এই নির্দেশ প্রিয় নবীকে আরামের জীবন থেকে বের করে তরঙ্গ সঙ্কুল অথৈ সমুদ্রে নিক্ষেপ করে দিয়েছে। মানুষের বিবেকের সামনে এবং জীবনের বাস্তবতার সামনে এনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
নির্দেশ পেয়ে আল্লাহর রাসুল সা. উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং বাকী জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। এই সময় তিনি ছিলেন জীবন সংগ্রামে অটল, অবিচল। আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করেছেন, নিজের এবং পরিবার পরিজনের সুখ-শান্তি আরাম বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁর কাজ ছিল আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়া। কোন প্রকার চাপ ছাড়াই এ দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। আসমানী নিদেশে পাওয়ার পর থেকে কখনোই তিনি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থা সম্পর্কে অমনোযোগী বা উদাসীন ছিলেন না। আল্লাহ পাক তাকে আমাদের পক্ষ থেকে এবং সমগ্র মানব জাতির পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার দান করুন।
ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্বের এই বোঝা একা রাসূল সা.-এর ছিল না। রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবা সবার ওপরই ন্যস্ত ছিল। সবাই মিলে দিন-রাত কাজ করেছেন। অত্যাচার সহ্য করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, আহত হয়েছেন, শাহদাতবরণ করেছেন। অবশেষে দ্বীনের বিজয় হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তখন দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
তাই আজকে আমরা যারা নিজেদেরকে শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর উম্মত দাবি করি আমাদেরও একই কর্তব্য একই দায়িত্ব। দ্বীন প্রতিষ্ঠাকেই আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে নিতে হবে। আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য হবে দ্বীন কায়েম। নচেত আমরা কীভাবে নিজেদের মুহাম্মদ সা.-এর উম্মত দাবি করবো? কীভাবে নিজেদের মুসলিম দাবি করবো? কীভাবে কিয়ামতের দিন মহানবী সা.-এর শাফায়াত কামনা করবো? দায়িত্ব পালন না করে কীভাবে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা আশা করবো?
আমাদের মহানবী সা. তাবলীগের নির্দেশ পেয়ে প্রথমে একেবারে পরিবারভুক্ত লোকদের দাওয়াত দেন। যারা তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এরা প্রিয় রসুলের সততা, সত্যবাদিতা মহানুভবতা সম্পর্কে কখনোই কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করতেন না। ইসলামের ইতিহাসে এরা সাবেকীনে আউয়ালীন নামে পরিচিত। তাঁর দাওয়াতে কেউই তাঁকে নিরাশ করেনি। অত্যন্ত আনন্দচিত্তে ও খুশি মনে তাঁরা ইসলামের দাওয়াত কবুল করেন। যারা প্রথমেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁরা হলেন, নবীর স্ত্রী খাদিজা রা., তাঁর দাস ও পালকপুত্র জায়েদ, ভাই হিসেবে তাঁর পরিবারভুক্ত আলী রা. এবং প্রিয় বন্ধু আবু বকর রা.।
এখান থেকে আমাদের শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। ইকামাতে দ্বীনের কাজে শামিল করার ব্যাপারে আমাদের প্রথমেই নিজের পরিবারকে টার্গেট করতে হবে। পরিবারের সদস্যদেরকে ইসলাম মানার ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
আরেকটি ব্যাপার সেটা হলো রাসুলের পরিবারভুক্ত লোকেরা কেন ইসলামকে বিনাবাক্যে মেনে নিলেন এর গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তাঁরা কখনোই মুহাম্মদ সা.-কে মিথ্যা কথা ও খারাপ কাজে লিপ্ত হতে দেখেননি। বরং দেখেছেন একজন নীতিবান, উদার, কোমল আচরণের মানুষ হিসেবে। তাই তাঁর কথা বিশ্বাস করতে পরিবারের সদস্যদের কষ্ট হয়নি।
এগুলো আমাদের জন্য শিক্ষা। আমাদের আচরণ এমন না হলে আমাদের দাওয়াতে মানুষ ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান হিসেবে গ্রহণ করবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন