সন্দ্বীপের ইতিহাস বেশ পুরনো। এটি একসময় শিল্প, শিক্ষা, ব্যবসায় অনন্য ছিল। শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাহাজ, লবণ ও বস্ত্র। সন্দ্বীপের জাহাজ রপ্তানী হতো আরবে। এটা সেসময়ের কথা যখন ইউরোপিয়ানরা জাহাজ বানানো দূরে থাকুক, কেনারও সামর্থ রাখতো না।
সন্দ্বীপের লবণ ও কাপড় সারা পৃথিবীতে বিক্রি হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রিপোর্ট অনুসারে প্রতি বছর সন্দ্বীপে উৎপাদিত প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো।
একটি সমৃদ্ধ দ্বীপ ছিল সন্দ্বীপ। মধ্যযুগের বিখ্যাত বাঙালি কবি আব্দুল হাকিমের বাড়ি এখানেই। তিনি বলেছেন বিখ্যাত সেই কথা
//যেসব বঙ্গে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।//
মুঘল আমল পর্যন্ত এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভাঙ্গন, তুফান আর চট্টগ্রামের মগদের আক্রমণ। সীতাকুন্ড দিয়েই মগরা বেশিরভাগ আক্রমণ পরিচালনা করতো। সে কারণেই সম্ভবত সীতাকুণ্ডের দিকে সন্দ্বীপের যে ইউনিয়ন তার নাম মগধরা ইউনিয়ন। ১৬০০ সাল থেকে এটি বিদেশীদের নজরে পড়ে। তার আগে মুসলিম বণিকেরা এখানে ইসলাম কায়েম করে।
প্রথমে পর্তুগালের ব্যবসায়ীরা এখানের বাসিন্দাদের জিম্মী করে। এরপর মগরাজ। তাদের ঠেকিয়ে এখানে স্বাধীন রাজ্য কায়েম করেন দিলওয়াল খাঁ। তারপর শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এখানের মানুষদের সাথে নিয়ে শক্তিশালী নৌ-বাহিনী তৈরি করেন। তারপর তাদের সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম দখল করে মগদের অত্যাচার থেকে সন্দ্বীপবাসীকে উদ্ধার করেন।
ব্যবসা, যোগাযোগ ও শিল্পে এগিয়ে থাকার কারণে বঙ্গের একসময়ের বড় বন্দর ছিল সন্দ্বীপ। শিক্ষা-দীক্ষাও সন্দ্বীপ ছিল নামী এলাকা। তাই এখানে বড় বড় কবি সাহিত্যিকেরা আসতেন। শুধু তাই নয় এখানের সৌন্দর্যও ছিল নজরকাড়া। ইবনে বতুতা, সিজার ফ্রেডরিকের মতো বিখ্যাত পর্যটকরাও সন্দ্বীপকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। কবি নজরুল এখানে এসে লিখেছেন বিখ্যাত মধুবালা গীতিনাট্য। এছাড়া চক্রবাকের অনেকগুলো কবিতাও সন্দ্বীপে সাগরের পাড়ে বসে রচনা করেন।
সন্দ্বীপের অবনতি হতে শুরু করে ইংরেজ আমলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের ব্যবসা ঠিক রাখতে বঙ্গের সকল শিল্প বন্ধ করে দেয়। তাদের লবণ চালানোর জন্য এখানের লবণ কারখানা বন্ধ করে দেয়। ইউরোপীয় নিম্নমানের কাপড় ভারতে চালানোর জন্য এখানের সকল চরকা বন্ধ করে দেয়। যারা গোপনে চরকা চালাতো তাদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দেয়। আমার জানামতে আজ পর্যন্ত সন্দ্বীপে বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠেনি।
আমার তো মনে হয়, নবাবদের ভুলে যদি ব্রিটিশদের কাছে বাংলার পরাজয় না হতো তবে শিল্প বিপ্লব ইউরোপে হতো না, বাংলায় হতো। অবশ্য এটা আমার ধারণা। এখানের সকল শিল্পই বিশ্বে সর্বাধিক উন্নত ছিল যা ইংরেজরা দুইশ বছর বন্ধ রেখেছে। তাদের শোষণে একটি শিক্ষিত, ধনী ও উন্নত জাতি পর্যায়ক্রমে অশিক্ষিত ও গরীব জাতিতে পরিণত হয়েছে।
ইংরেজরা বঙ্গের এই সমৃদ্ধ এলাকা থেকে প্রচুর রাজস্ব আদায় করার চেষ্টা চালিয়েছে। শায়েস্তা খাঁ এখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আগের থেকেও খাজনা কমিয়ে দেয়। যার ফলে এখানের বাসিন্দারা মুঘলদের অনুগত থাকতে পছন্দ করেছিল। ইংরেজদের চাহিদা অনুসারে ব্যাপক খাজনা আদায় করা সম্ভব হয়নি বিধায় স্থানীয় মুসলিম জমিদাররা জামিদারি হারিয়েছে। সেসময়ে প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন আবু তোরাব।
মীরজাফরের জামাতা মীর কাসিম এখানে গোকুল ঘোষাল নামে কোলকাতার এক হিন্দু ব্যবসায়ীকে জমিদার হিসেবে অনুমোদন করে। গোকুল ঘোষাল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে জমিদার হিসাবে রাজস্ব সংগ্রহের উদ্দেশ্য সন্দ্বীপ আগমন করেন ১৭৬৩-৬৪ সালে। তার সাথে আবু তোরাবের বিরোধ চরমে পৌঁছে ১৭৬৭ সালে।
জমিদার আবু তোরাব ইংরেজ ওয়াদদাদারের কাজে রাজস্ব জমা দেয়া থেকে পুরাপুরি বিরত থাকেন। তাছাড়া, গোকুল ঘোষালের প্রতিনিধিদের সন্দ্বীপ থেকে বিতাড়ণের জন্য আবু তোরাব তাঁর সেনাপতি মালকামকে নির্দেশ প্রদান করেন।
অতঃপর মীর জাফরের জামাতা নবাব মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে নবাবের অনুগত একদল সৈন্য এসে তোরাব আলীর মুখোমুখি হয়। কিন্তু প্রতিরোধ ও চাপের মুখে কিছুদিনের মধ্যে গোকুলের লোকজন সন্দ্বীপ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স এবং আরো কয়েকজন সেনাধ্যক্ষের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী নদী পার হয়ে সন্দ্বীপে পৌঁছায়।
১৭৬৭ সালের মধ্যভাগে সন্দ্বীপ শহরের সামান্য উত্তরে চার আনি হাটের অদূরবর্তী কিল্লাবাড়িতে আবু তোরাব বাহিনীর সাথে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স-এর বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে আবু তোরাব পরাজিত ও নিহত হন। আবু তোরাব চৌধুরী জমিদার হলেও সুশাসনের কারণে কৃষক প্রজারা তাঁকে ভালবাসতেন। এ করণে উপরিউক্ত যুদ্ধে সন্দ্বীপের কৃষকগণ আবু তোরাব চৌধুরীর পক্ষাবলম্বন করেন। ইতিহাসে এটি সন্দ্বীপের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ বলেও খ্যাত হয়।
এরপরে আরো দুইবার এখানের লোকেরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। শেষ অন্তত বিশ বছর এখান থেকে খাজনা নিতে পারেনি ইংরেজরা।
সন্দীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা সব জায়গায় সমভাবে ভালো নয়। সীতাকুন্ড থেকে ২৫০ টাকা ভাড়া লাগে স্পিডবোটে। এখানে খুবই নৈরাজ্য চলে। সুযোগ পেলেই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। এখানে নিয়মিত চলাচল করার জন্য ওয়াটার বাস চালু করা দরকার তাহলে দুর্ভোগ কমবে আশা করি। এখানে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডের সাথে কানেক্ট করা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে এখানে মানুষ বিদ্যুতের পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালের আগ পর্যন্ত সন্দ্বীপ নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নোয়াখালী থেকে যাতায়াত সহজ ছিল না এবং সন্দ্বীপের পশ্চিম অংশ ভাংতে থাকায় এটি নোয়াখালী থেকে দূরে সরে গিয়েছে। প্রশাসনিক সুবিধা হাসিলের জন্যই চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হয়।
তবে এখানকার মানুষের কালচার ও ভাষা অনেকটাই নোয়াখালীর মতো। সকালবেলা নামাজ পড়েই এখানের চা-দোকানে চা খেতে খেতে এলাকাবাসীর সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম। এখানের গরুর দুধের চা আর গুলগুইল্লার স্বাদ বহুদিন মুখে লেগে থাকবে। সন্দ্বীপ ট্যুরে এসে এখানের স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি যা সত্যিই দারুণ ছিল।
বরাবরের মতো এখানের ইমাম সাহেবকে পেয়েছি নোয়াখালীর। এটা আমার এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমি বাংলাদেশের যত স্থানেই ঘুরতে গিয়েছি সেখানের মসজিদ বা মাদ্রাসায় নোয়াখালীর লোক আমি পেয়েছি। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ভদ্রলোক আমাদের জন্যে মসজিদ সর্বক্ষণ খোলা রেখেছেন। মসজিদের টয়লেট, টিউবওয়েল, পুকুর ইত্যাদি ব্যবহার আমাদের জন্য সহজ হয়েছে।
সাগরের পাড়ে ক্যাম্প করার জন্য একটি আদর্শ স্থান সন্দ্বীপের হরিশপুর। তবে অবশ্যই আবহাওয়া অনুকূলে থাকা প্রয়োজন। শীতকালের আশে পাশে হলে ভালো হয়। কিছুদিন পর কালবৈশাখী শুরু হলে এখানে আর আসা যাবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন