নাম তার আমর ইবনে হিশাম। বড্ড জ্ঞানী মানুষ। তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কূটনীতির কারণে তিনি মক্কার নেতা হন। লোকজন তাকে আবুল হাকাম বলে ডাকতো। আবুল হাকাম মানে জ্ঞানীর পিতা। মুহাম্মদ সা. দুইজন ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে বেশি দোয়া করতেন একজন হলেন আমর ইবনে হিশাম অন্যজন হলেন উমার ইবনে খাত্তাব। কিন্তু আমরের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা.-এর দোয়া কবুল হয়নি। আমর সম্পর্কে মুহাম্মদ সা.-এর চাচা হন। মুহাম্মদ সা.-কে তিনি স্নেহ করতেন।
কিন্তু মুহাম্মদ সা. নবুয়্যত পাওয়ার পর আমর তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়। মুহাম্মদ সা.-কে কষ্ট দেওয়ার জন্য হেন কাজ বাকী ছিল না যা সে করেনি। আল্লাহর রাসূল সা. যাদের অভিশাপ দিতেন এর মধ্যে একজন আমর ইবনে হিশাম। তিনি আমরের উপাধি 'আবুল হাকাম' পরিবর্তন করে নাম দেন 'আবু জাহাল' অর্থাৎ মূর্খের পিতা। আবু জাহাল মক্কায় ঈমান গ্রহণ করা মুসলিমদের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালাতেন।
ইয়াসির রা.-এর পরিবারের ওপর তার নির্যাতন ছিল ভয়াবহ। ইয়াসির রা. ছিলেন দাস। তাই তাঁর ওপর নির্যাতন প্রতিরোধে কারো সাহায্য পাননি রাসূল সা.। ইয়াসির রা. স্ত্রী সুমাইয়া রা. ওপর অশ্লীলভাবে প্রতিদিন নির্যাতন করতো আবু জাহাল। তাদের সন্তান আম্মার রা.-এর ওপর চলেছে নির্যাতনের পাহাড়। একদিন হজরত সুমাইয়া রা.-এর লজ্জাস্থানে বর্শা গেঁথে খুন করে আল্লাহর এই দুশমন। সুমাইয়া রা. হন ইসলামের প্রথম শহীদ। অসহায় মুহাম্মদ সা. সেই পরিবারকে উদ্ধার করতে পারেন নি। এরপর খুন হন ইয়াসির রা.। রাসূল সা.-কে কাবার সামনে নামজরত অবস্থায় দেখলে আবু জাহল ময়লা, আবর্জনা, পশুর নাড়িভূড়ি সন্ত্রাসীদের দিয়ে ওনার মাথায় চাপিয়ে দিতেন। একবার তো রাসূল সা.-এর দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। ফাতিমা রা. খবর পেয়ে দৌড়ে এসে আবর্জনা সরিয়ে মুহাম্মদ সা.-কে উদ্ধার করেছিলেন।
হিজরতের পর রাসূল সা. মদিনায় রাষ্ট্র কায়েম করেন। সেখানে তিনি ও মক্কার মুহাজির সাহাবারা মক্কায় গত ১৩ বছর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ফিরিস্তি দিতেন। এসব বর্ণনায় প্রায়ই আবু জাহালের নাম উঠে আসতো। মদিনায় আল্লাহর রাসূল সা. শিশু-কিশোরদেরও নসিহত করতেন। সেখানেও জালিম আবু জাহালের নাম উঠে আসতো। আল্লাহর রাসূল সা. নসীহতে জিহাদী জজবায় উজ্জিবীত হন দুই মহান কিশোর। আর আল্লাহর রাসূলের মুখে আবু জাহালের নির্যাতনের কথা শুনে তার প্রতি তারা চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
বদর যুদ্ধে দুই মহান কিশোর যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত হলেন। এই প্রসঙ্গে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আওফ বলেন,
বদর যুদ্ধের দিনে আমি মুসলমানদের কাতারের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখি যে, ডানে বাঁয়ে দু'জন আনসার কিশোর। তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি তাদের চিনতাম না।
হঠাৎ একজন চুপিসারে আমাকে বললো, চাচাজান, আবু জাহাল কে? তা আমাদের একটু দেখিয়ে দিন। আমি বললাম, ভাতিজা, তুমি তাকে কী করবে?
সে বললো, আমি শুনেছি, আবু জাহাল প্রিয় নবী সা.-কে বেশি কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর শপথ! যদি আমরা আবু জাহাল কে দেখতে পাই তবে ততক্ষণ পর্যন্ত পর্যন্ত তার কাছ থেকে আলাদা হব না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার এবং আমাদের মৃত্যু মৃত্যু না হয়।
আব্দুর রহমান রা. বলেন, একথা শুনে আমি অবাক হলাম। অন্যজন আনসার কিশোরও আমাকে চুপিসারে একই কথা বললো। কয়েক মুহুর্ত পরে আমি আবু জাহালকে লোকদের মধ্যে বিচরণ করতে দেখছিলাম। আমি উভয় আনসার কিশোরকে বললাম, ওই দেখো তোমাদের শিকার। যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছো। একথা শোনামাত্র উভয় আনসার কিশোর আবু জেহেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলল।
এই দুইজন কিশোর হলেন মায়াজ ইবনে আমর ও মাউজ ইবনে আফরা।
এই প্রসঙ্গে মায়াজ ইবনে আমর বলেছেন, আবু জাহাল কাফেরদের দুর্ভেদ্য পাহারার ভেতর ছিলো। আমি আবু জাহালকে চিনে রাখলাম এবং তার কাছাকাছি থাকতে লাগলাম। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমি তার ওপর হামলা করলাম। তাকে এমন আঘাত করলাম যে, তার পা হাঁটুর নীচে দিয়ে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ঝরে পড়া খেজুরের মত তার পা উড়ে গেলো। এদিকে আবু জাহালকে আমি আঘাত করলাম আর ওদিকে তার পুত্র ইকরামা আমার কাঁধ বরাবর তরবারি দিয়ে আঘাত করলো। এতে আমার হাত কেটে গেল কিন্তু তা চামড়ার সাথে লেগে ঝুলে রইলো।
আমার লড়াই করতে অসুবিধা হচ্ছিলো। কর্তিত হাত পেছনে রেখে অপর হাতে তরবারি চালাচ্ছিলাম। এতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো। আমি তখন হাতের কার্তিত অংশ পায়ের নীচে রেখে এক ঝটকায় হাত দেহ পৃথক করে ফেললাম। এরপর আবু জাহালের ওপর এমন আঘাত করলাম যে, সে ঢলে পড়লো। ইতোমধ্যে মাউজ ইবনে আফরা আবু জাহাল ও ইকরামার সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেল। এরপর মায়াজ ইবনে আমর আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে জানালেন যে, তিনি আল্লাহর দুশমন আবু জাহালকে হত্যা করেছেন। মহানবী সা. অত্যন্ত খুশি হলেন।
মুহাম্মদ সা.-এর যেন আবু জাহালের লাশ দেখার জন্য তর সইছে না। তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বললেন, আবু জাহালের পরিণাম কে দেখবে দেখে আসো। সাহাবারা তখন আবু জাহালের সন্ধান করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আবু জাহালকে এমতাবস্থায় পেলেন যে, তা নিঃশ্বাস চলাচল করছিলো। তিনি আবু জাহালের ধড়ে পা রেখে মাথা কাটার জন্যে দাড়ি ধরে বললেন, ওরে আল্লাহর দুশমন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা তোকে অপমান অসম্মান করলেন তো?
আবু জেহেল বললো, কিভাবে আমাকে অসম্মান করলেন?
তোমরা যাকে হত্যা করেছো তার চেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষ আছে নাকি? তার চেয়ে বড় আর কে? আহা, আমাকে যদি কিশোররা ছাড়া অন্য কেউ পরাজিত করতো! এরপর সে বলতে লাগলো, বলো তো আজ জয়ী হয়েছে কারা? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আবু জেহেলের কাঁধ পা দিয়ে চেপে রেখেছিলেন। আবু জাহাল তাঁকে বললো, ওরে বকরির রাখাল, তুই অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে গেছিস।
এ কথোপকথনের মধ্যেই আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আবু জাহালের মাথা কেটে মুহাম্মদ সা.-এর সামনে হাজির করে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, এই হচ্ছে আল্লাহর দুশমন আবু জাহালের মাথা। নবী সা. অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ সত্যই, সেই আল্লাহর শপথ! যিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। এই কথা তিনবার বললেন।
এরপর নবী সা. বললেন, আল্লাহ তায়ালা সুমহান। সকল প্রসংশা তাঁরই জন্যে নিবেদিত, তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি সত্য করে দেখিয়েছেন, নিজের বান্দাদের সাহায্য করেছেন এবং একাকীই সকল দলকে পরাজিত করেছেন।
নবী সা. আরো খুশি হতে চাইলেন। আরো সন্তুষ্ট হতে চাইলেন! তিনি বললেন, চলো। আমাকে তার লাশ দেখাও। সাহাবারা নবী সা.-কে আবু জাহালের লাশের কাছে নিয়ে গেল। তিনি বললেন, ও হচ্ছে এই উম্মতের ফিরাউন। অতঃপর নবী সা. কিশোর মায়াজ ইবনে আমর রা.-কে আবু জাহালের আনীত সম্পদ দিয়ে দিলেন। আর আবু জাহালের তরবারি দিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে।
এই ঘটনা বর্ণনা করার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের প্রোগ্রামগুলোতে মাদ্রাসা ছাত্রদের নিয়ে আসার ব্যাপারে সেক্যুলার সমাজের ব্যাপক প্রতিবাদ উঠছে। আর এই ইস্যুতে মুসলিমদের মধ্যে হীনমন্যতা দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো ইসলামপন্থী বলতে চাইছেন কিশোর ও মাদ্রাসা ছাত্রদের (বিশেষত যারা আন্ডার এইটিন) রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যাতে না আনা হয়। এতে নাকি কিশোরদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।
অথচ ব্যাপারটা হচ্ছে উল্টো। কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন না করানোর ফলে মূলত আমাদের দেশে এক অথর্ব যুবসমাজ তৈরি হচ্ছে। এদের না আছে রাজনৈতিক জ্ঞান না আছে কূটনীতিক জ্ঞান। এক ভোগবাদী সমাজ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ কিশোর বেশি ক্ষিপ্ত হয় যখন ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশের প্রতি ইনজাস্টিস করা হয়। অথচ ফেনী নদীর পানি, কিংবা তিস্তার পানি অথবা সীমান্তে মানুষ হত্যা নিয়ে তাদের বিকার নেই।
আমাদের প্রতিবেশী মুশরিক রাষ্ট্র ভারত ও এদেশে তাদের দালাল সেক্যুলাররা চায় এমন একটি অথর্ব জনগোষ্ঠী। তাতেই তাদের শোষণ করা সহজ হয়। অথচ ইসলামের ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। কিশোররা যুদ্ধপ্রস্তুতি দিয়েই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতেন। যার মাধ্যমে হিন্দুস্থানে ইসলামের পতাকা উচ্চকিত হয়েছে সেই মুহাম্মদ বিন কাসিম ১৭ বছর বয়সে শুধু যুদ্ধে এটেইন করেনি বরং তাঁর নেতৃত্বে বিশাল ভারত ইসলামের ছায়াতলে এসেছে। এছাড়াও উসামা বিন জায়েদ, তারিক বিন যিয়াদ ইত্যাদি কম বয়স্ক সেনাপতি ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে।
অতএব আপনার সন্তানকে ইতিহাস ও রাজনীতির শিক্ষা দান করুন। তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করুন। উম্মাহ চেতনা জাগ্রত করুন। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য শোনান। নইলে আমি-আপনি মুশরিকদের বন্দিশালা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হবো না। মনে রাখবেন, রাজনীতি ও জিহাদ নিয়ে আমাদের মধ্যে যেন কোনো হীনমন্যতা কাজ না করে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন