আল্লাহর রাসূল সা. ছিলেন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক। বদর যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর পরই তিনি গোয়েন্দা তথ্য পান যে, গাতফান গোত্রের শাখা বনু সুলাইম মদিনার বিরুদ্ধে সোইন্য সংগ্রহ করছে। এই খবর পাওয়ার পর মুহাম্মদ সা. দুইশত সৈন্য নিয়ে আকস্মিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। বনু সুলাইম গোত্র এ ধরনের আকস্মিক হামলার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। তারা হতবুদ্ধি হয়ে পলায়ন করলো। যাওয়ার সময় পাঁচশত উট রেখে গেলো। মুসলমানরা সেইসব উট অধিকার করে নিলো। মুহাম্মদ সা. সেই উটের চার পঞ্চমাংশ ভাগ করে দিলেন। প্রত্যেকে দু’টি করে উট পেলেন।
মক্কার এক যুবক ওয়াহেব ইবনে উমায়ের বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে বন্দি ছিল। তার পিতা উমায়ের বদরের প্রতিশোধ হিসেবে আল্লাহর রাসূল সা.-কে হত্যা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। এই ব্যাপারে তাকে সহায়তা করলো মুশরিক নেতা সাফওয়ান। সাফওয়ান উমায়েরের যাবতীয় ঋণ ও তার পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিল। এরপর উমায়ের তার তরবারি ধারালো করে তাতে বিশ মেশালো। মদীনার দিকে রওয়ানা হয়ে এক সময় সে মদীনায় পৌঁছালো।
তাকে দেখে উমার রা. সতর্ক দৃষ্টিতে রাখলেন। সে মুহাম্মদ সা.-এর সামনে উপস্থিত হয়ে তার ছেলের মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনা করতে চাইলো। কিন্তু মুহাম্মদ সা. বললেন, হে উমায়ের তুমি কেন এসেছ তা আমি জানি। তোমার ও সাফওয়ানের পরিকল্পনা আমি জানি। এরপর তাদের পরিকল্পনা নবী সা. তার সামনে উপস্থাপন করলেন। এতে সে আশ্চর্য হয়ে পড়ে।
এরপর উমায়ের বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রসূল। হে আল্লাহর রসূল, আপনি আমাদের কাছে আকাশের যে খবর নিয়ে আসতেন এবং আপনার ওপর যে ওহী নাযির হতো, সেসব আমরা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এটাতো এমন ব্যাপার যে, আমি এবং সাফওয়ান ছাড়া সেখানে অন্য কেউ উপস্থিত ছিলো না। কাজেই আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি যে, এই খবর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ আপনাকে জানাননি। সেই আল্লাহর জন্যে যিনি আমাকে ইসলামের হেদায়েত দিয়েছেন এবং এই জায়গা পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। একথা বলে উমায়ের কালেমা তাইয়েবার সাক্ষ্য দিলেন। নবী সা. সাহাবাদের বললেন, তোমাদের ভাইকে দ্বীন শেখাও, কোরআন পড়াও এবং তার বন্দীকে মুক্ত করে দাও। ইসলাম গ্রহণের উমায়ের মক্কায় এসে পৌঁছুলো এবং ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলো। তার আহ্বানে বহু লোক ইসলাম কবুল করলো।
ইহুদীরা যখন লক্ষ্য করলো যে, বদরের প্রান্তরে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বিরাট সাহায্যে করেছেন এবং তাদের মর্যাদা ও প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তখন তারা ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুতা শুরু করলো। প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করলো এবং মুসলমানদের কষ্ট দেয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো। তারা প্রায়ই আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকদেরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতো।
তিনটি ইহুদী গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল বনু কাইনুকা। বাকী দুই গোত্র শহরের বাইরে থাকলেও এরা মদীনার ভেতরে থাকতো। মদিনায় তাদের বাজারই সর্বাপেক্ষা বড় বাজার। এরা পেশায় ছিলো কর্মকার, স্বর্ণকার এবং থালাবাটি নির্মাতা। এ কারণে এদের কাছে সবসময় প্রচুর সমর সরঞ্জাম বিদ্যমান থাকতো। যুদ্ধ করার মতো বলদর্পী লোকের সংখ্যা তাদের মধ্যে ছিলো সাতশত। তারাই প্রথম মদিনাতে বিদ্রোহ করে ও মদিনা সনদের চুক্তি ভঙ্গ করে।
তারা তাদের দুর্বৃত্তপনা, ঘৃণ্য কার্যকালাপ এবং উস্কানিমূলক কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখে। মুসলমানরা বাজারে গেলে তারা তাদের প্রতি উপহাসমূলক মন্তব্য করতো এবং ঠাট্টা-বিদ্রূপ চালাতো সবসময়। এমনি করে মুসলমানদের মানসিকভাবে কষ্ট দিতো। তাদের ঔদ্ধত্য এমন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো যে, তারা মুসলিম মহিলাদেরও উত্যক্ত করতো।
ক্রমে অবস্থা নাজুক হয়ে উঠলো। ইহুদীদের ঔদ্ধত্য ও হঠকারীতা সীমা ছাড়িয়ে গেলো। এ সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের সমবেত করে একদিন ওয়ায নসিহত করে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এছাড়া তাদের নিপীড়নমূলক কাজের মন্দ পরিণাম সম্পর্কেও সতর্ক করে দিলেন। কিন্তু এতে তাদের হীন ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ বেড়ে গেলো।
এই প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মুহাম্মদ সা. বদর যুদ্ধের পর একদিন বনু কাইনুকার বাজারে ইহুদীদের এক সমাবেশ আহব্বান করেন। সেই সমাবেশে তিনি বলেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! কুরাইশদের ওপর যেরকম আঘাত পড়েছে, সে রকম আঘাত তোমাদের ওপর আসার আগেই তোমরা ইসলাম গ্রহন করো। তারা বললো, হে মুহাম্মদ! তুমি আমাদের ব্যাপারে ভুল ধারণা করছো। কুরাইশ গোত্রের আনাড়ি ও অনভিজ্ঞ লোকদের সাথে তোমাদের মোকাবেলা হয়েছে। এতেই তোমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছো। তোমরা ওদের মেরেছো, সেটা পেরেছো ওরা আনাড়ি বলেই। আমাদের সাথে যদি তোমাদের যুদ্ধ হয়, তবে তোমরা বুঝতে পারবে যে, পুরুষ কাকে বলে! আমরা হচ্ছি বীর। তোমরা তো আমাদের কবলে পড়োনি। তাই আমাদের ব্যাপারে ভুল ধারণা করে বসে আছ।
তাদের এ উক্তির জবাবে আল্লাহ তায়ালা সূরা ইমরানের ১২ ও ১৩ আয়াতে বলেন, //যারা কুফুরী করে, তাদের বলো তোমরা শীঘ্রই পরাভূত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামে একত্র করা হবে। আর সেটা কতোই না নিকৃষ্ট আবাস্থল। দু’টি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছিলো অন্য দল ছিলো কাফের। ওরা তাদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয়ই এতে অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্যে শিক্ষা রয়েছে।//
মোটকথা, বনু কাইনুকা যে জবাব দিয়েছিলো তার অর্থ হচ্ছে সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা। কিন্তু মুহাম্মদ সা. ক্রোধ সংবরণ করলেন এবং ধৈর্য ধারণ করেন। মুসলমানরাও ধৈর্য ধারণ করে ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকেন।
এরপর একজন আবর মুসলিম মহিলা কাইনুকার বাজারে দুধ বিক্রি করতে আসে। দুধ বিক্রির পর সেই মহিলা কি এক প্রয়োজনে এক ইহুদী স্বর্ণকারের দোকানে বসে। ইহুদী তাঁর চেহারা অনাবৃত করতে বলে কিন্তু মহিলা রাজি হননি। এতে স্বর্ণকার সেই মহিলার কাপড়ের একাংশ গোপনে দরজার সাথে বেঁধে দেয়। মহিলা কিছুই বুঝতে পারেননি। মহিলা উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে কাপড় খুলে গেলো ও তিনি অনাবৃত হয়ে গেলো। এত ইহুদীরা খিল খিল করে হেসে উঠলো। মুসলিম মহিলাকে তারা অপমান ও অপদস্ত করতে থাকলো।
এভাবে অপমানিত হয়ে তিনি কান্না শুরু করলেন। তার কান্না শুনে একজন মুসলমান কারণ জানতে চাইলেন। সব শুনে ক্রোধে অস্থির হয়ে তিনি সেই ইহুদির ওপর হামলা করে তাকে মেরে ফেললেন। ইহুদীরা যখন দেখলো যে, তাদের একজন লোককে মেরে ফেলা হয়েছে এবং মেরেছে তাদের শত্রু মুসলমান। তখন তারা সম্মিলিত হামলা করে সেই মুসলমানকেও মেরে ফেললো। মেরে ফেলেই তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে নিল।
এই ঘটনার সমাধান করার জন্য আল্লাহর রাসূল সা. হামজা রা.-কে সাথে নিয়ে বনু কাইনুকা পোত্রে এলেন। ইহুদিরা রাসূল সা.-কে দেখে দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিলো। রাসূল সা. সাহাবাদের ডেকে তাদের দুর্গ অবরোধ করলেন। একটানা ১৫ দিন অবরুদ্ধ থেকে তার ভীত হয়ে পড়লো। তারা ভেবেছিল অন্য ইহুদি গোত্রদ্বয় এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের সাথে মিলে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করবে। কিন্তু তাদের সাহায্যে কে এগিয়ে আসে নাই দেখে তারা আত্মসমর্পন করলো।
এসময় আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মুহাম্মদ সা.-এর কাছে তাদের শাস্তি মওকুফের আবেদন জানালো। উল্লেখ্য যে, এই ঘটনার মাসখানেক আগে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সে বললো, হে মুহাম্মদ সা.! আমার মিত্রদের ব্যাপারে অনুগ্রহ করুন। উল্লেখ্য, বনু কাইনুকা ছিলো খাযরাজ গোত্রের মিত্র। আল্লাহর রাসূল সা. তখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। মুনাফেক নেতা বার বার তার কথার পুনরাবৃত্তি করলো।
অবশেষে রাসূল সা. সিদ্ধান্ত দিলেন বনু কাইনুকার লোকেরা আরবে থাকতে পারবে না। সাথে করে যা নেওয়া যায় এমন সম্পদ নিয়ে বনু কাইনুকা সিরিয়ার চলে গেল। মুহাম্মদ সা. ইহুদিদের পরিত্যাক্ত ধন-সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করলেন।
মদিনার আরেক ইহুদি গোত্র বনু নাজিরের সাথে মক্কার মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ানের সম্পর্ক ভালো ছিল। আবু সুফিয়ান তাদের গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ করেছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে মক্কার মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ান গোপনে ২০০ সৈন্য নিয়ে মদিনায় ঝটিকা আক্রমণ করে। তাদের টার্গেট ছিল মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা। তবে খবর পেয়েই মুহাম্মদ সা. তড়িৎ পাল্টা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসেন। তারা শহরে ঢুকতে পারেনি। মদিনার উপকণ্ঠে আরজ নামক স্থানে কয়েকটি গাছ কাটে ও আগুন লাগিয়ে দেয়। দুইজন আনসারকে হত্যা করে। মহানবী সা.-কে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে আসতে দেখে আবু সুফিয়ান ও তার দলবল পালিয়ে যায়। এটা সাভিকের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
এই ঘটনা মুহাম্মদ সা.-কে বিচলিত করে। মদিনার নিরাপত্তা নিয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি এর তদন্ত করেন। তদন্তে কা'ব বিন আশরাফের নাম আসে। সে আবু সুফিয়ানকে চিঠি লেখে ও মদিনায় আক্রমণ চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। সে মক্কার লোকদের জন্য কবিতা লেখে যাতে তারা মুহাম্মদ সা. বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ও বদর যুদ্ধে নিহতদের প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
কাব বিন আশরাফ ছিল মদিনার একজন ইহুদি নেতা ও কবি। কাবের পিতা আরবের বনু তায়ি গোত্র এবং মাতা বনু নাজির গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তাকে তার মায়ের গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হতো, যেখানে সে একজন অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিল। আল্লাহর রাসূল সা. মদিনা সনদের চুক্তি ভঙ্গের অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।
ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী, মুহাম্মদ সা. কাবকে হত্যা করার জন্য তার অনুসারীদেরকে নির্দেশনা দেন, এর কারণ; কাবের প্রেরিত একটি চিঠি বদর যুদ্ধের পর মক্কায় পৌঁছেছিলো এবং তা মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে কুয়াইশদেরকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল। সে এমন কবিতাও লিখত যেগুলোতে সে বদর যুদ্ধে নিহত কুরাইশদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতো। মদিনা থেকে ফেরার অল্পদিন পরেই সে মুসলিম মহিলাদের প্রকৃতি সম্পর্কে কটাক্ষ করে কবিতা রচনা করে।
অন্যান্য ঐতিহাসিক সূত্র দাবি করে যে, কাবকে হত্যা করা হয়েছিল কারণ ফেরেশতা জিবরাইল আ. মুহাম্মাদ সা.-কে কাবের চুক্তি সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে কাব তার মক্কা সফরের সময় কুরাইশ এবং চল্লিশজন ইহুদির মধ্যে মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক সন্ধিচুক্তিতে আবু সুফিয়ানের সাথে সাক্ষর করেন।
আল্লাহর রাসূল সা. কাব বিন আশরাফকে হত্যা করার ব্যাপারে কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি তার দুধভাই আবু নায়েলাকে দিয়ে তাকে হত্যা করান। ফলে বিষয়টা তাদের নিজস্ব বিষয়ে পরিণত হলো। মুহাম্মদ সা.-এর ওপর রাজনৈতিক চাপ আসে নি। এই ঘটনায় তিনি বনু নাজিরদের সবাইকে দোষী না করে শুধু মূল দোষী কাবকে শাস্তির আওতায় এনেছেন। বনু নাজিরকে তিনি আরো সুযোগ দিতে চেয়েছেন। বনু কাইনুকার পরপরই আরেকটি ইহুদি গোত্রের সাথে সরাসরি বিরোধে জড়াতে চাননি মুহাম্মদ সা.।
বনু কায়নুকা অবরোধের সময় মদিনার শাসনভার কার হাতে অর্পিত
উত্তরমুছুনছিল