ঢাকা বিমানবন্দর। নভেম্বর ২০০৩। একটি বিমান ছেড়ে যাবে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে। সব কিছু ঠিকঠাক। এর মধ্যে বিমানে ঘটাঘট উঠে পড়লেন সিকিউরিটি অফিসাররা। ইনকিলাব পত্রিকার এক সাংবাদিক সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরিকে তল্লাশি করা শুরু করলেন। তারপর নিশ্চিত হয়ে তাকে নিয়ে নেমে গেলেন বিমান থেকে। ইনকিলাব পত্রিকা এদেশের হুজুরবান্ধব পত্রিকা। এই পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরি।
গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে ডিবি তাকে এরেস্ট করে। পরে তার কাছে তল্লাশি করে সে তথ্যের সত্যতা পায়। শোয়েব চৌধুরির কাছে তেলআভিভে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি সেমিনারের আমন্ত্রণপত্র পাওয়া যায়। শোয়েব ব্যাংকক হয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ইসরাঈলের রাজধানী তেলআভিভে যাওয়ার কথা স্বীকার করে। তাকে নিয়ে বেশ কৌতুহলী হয়ে পড়ে সরকার। তাকে নিয়ে তদন্ত ও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তেল আভিভে যে সেমিনারটিতে সে জয়েন করার কথা তা ২০০৩ সালের ডিসেম্বরের ১-৩ তারিখ হয়েছিল।
'এডুকেশন টুয়ার্ডস কালচার অব পিস’ শীর্ষক ঐ কনফারেন্সে উপস্থাপনের জন্য একটি ভাষণের কপি ও সিডি শোয়েবের কাছে পাওয়া যায়। সেখানে সে বাংলাদেশের মসজিদ্গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। অথচ ইনকিলাবের সাংবাদিক হিসেবে শোয়েব প্রায়ই ইসলাম ও ইসলামী জাতিয়তাবাদের পক্ষে লেখালেখি করতো।
সেসময় তার কাছে একটি প্রজেক্ট প্রোফাইল পাওয়া যায়, যাতে ইসরাইলের কাছে তিনটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য ১২ কোটি টাকার চাহিদাপত্র ছিল। এই প্রকাশিতব্য পত্রিকাগুলোর নাম ছিল দৈনিক সোনালী দিন, দৈনিক রূপান্তর, দৈনিক পরিবর্তন। তার প্রজেক্ট প্রোফাইলে তার মন্তব্য পাওয়া যায়, যেখানে সে ইসরাইলী বন্ধুদের মুসলিম প্রধান দেশে মিডিয়া গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, "কোটি কোটি ডলার খরচ করে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চেয়ে মিডিয়া সৃষ্টি করুন, এতে ইসরাইল বেশি লাভবান হবে।" শোয়েবের কাছে প্রাপ্ত নথিপত্র ও তার ইমেইল ঘেঁটে জানা যায়, বাংলাদেশ নাকি অচিরেই জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং আফগানিস্তানের মতো তালেবান রাষ্ট্র হবে। কিন্তু তখনো বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি।
পুলিশ তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে ২৪ জানুয়ারি ২০০৪ তারিখে। কিন্তু তৎকালীন সরকার তাকে আটক করে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। শোয়েবকে মুক্ত করতে আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন ও ই ইউ থেকে বেশ চাপ প্রয়োগ করা হয়। মাত্র ১ বছর তাকে আটক রাখা গেছে। ২০০৫ সালের ২৯ এপ্রিল শোয়েবকে কারামুক্ত করতে বাধ্য হয় সরকার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে বর্তমান মার্কিন সিনেটর ও তখনকার কংগ্রেসম্যান মার্ক স্টিভেন কির্ক ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের ওপর চাপ প্রয়োগ করায় সে জামিনে মুক্ত হয়েছে। সালাউদ্দিন শোয়েবের মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসে ২০০৭ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি একটি প্রস্তাবও পাস হয়।
কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ২০০৬ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাক্ষাৎকারে শোয়েব বলে, //আমি যখন প্রথম সাপ্তাহিক ব্লিতস (weekly blitz) প্রকাশ করি তখন সিদ্ধান্ত নেই ইহুদী খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে বিশেষত ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে সংঘবদ্ধ প্রচারনা চলছে তার অবসান ঘটাতে। বাংলাদেশে শুক্রবারের খুতবায় মোল্লারা মূলত জিহাদের বাণী প্রচার করে এবং ইহুদী খ্রীস্টানদের হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমি এর অবসান চেয়েছি।//
মোসাদ কানেক্টেড প্রমাণিত হওয়ার পরও থেমে থাকে নি শোয়েবের পথচলা। সে ইসরাঈলভিত্তিক সংগঠন ইফলাক (IFLAC, international forum for literature and culture for peace)এর সদস্য এবং ইসরাইল-ইসলাম বন্ধুত্বের একজন উপদেষ্টা। তার জেলমুক্তির জন্য জোর লবিং চালাতে এগিয়ে আসেন মার্কিন ইহুদী মানবাধিকার কর্মী ড. রিচার্ড বেনকিন। পরবর্তিতে বেনকিন দৈনিক আমাদের সময়ের আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা ও বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে যুক্ত থাকেন। বেনকিন ও সালাউদ্দীন শোয়েব চৌধুরী মিলে ইন্টার*ফেইথ কার্যক্রম চালানো শুরু করে।
এই ইন্টার*ফেইথের বেসিক হলো, সব ধর্মই সঠিক এবং ভালো কথা বলে। অতএব সব ধর্মকেই আমরা মেনে নিবো। অন্য ধর্মের মানুষদের আহ্বান করবো না। সবাই যার যার ধর্ম নিয়ে থাকবো। প্রয়োজনে একে অন্যের ধর্মীয় প্রার্থনা ও উৎসবে যোগদান করবো। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কয়েকটি ইন্টারফেইথ ডায়ালগের আয়োজন হয়েছে এমনকি খ্রিস্টানদের পোপ বাংলাদেশে আসলে সর্বধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছিলো। তাদের এই কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে কওমি আলেমদের মধ্য থেকে ফরিদ উদ্দিন মাসুদ এবং জামায়াতঘেঁষা বুদ্ধিজীবী ও সাবেক প্রধান বিচারপতি আব্দুর রউফ।
বেনকিন ও শোয়েবের ইন্টারফেইথ সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন
২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। এসময় শোয়েব অনেক কাজ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কারণ তখন রাষ্ট্রের পরিচালক ফখরুদ্দিন-মঈনরা বিদেশীদের ক্রীয়ানক ছিল। শোয়েব ইসরাঈল পাসপোর্ট নিয়ে টঙ্গি ইজতেমায় যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে নেয়। একই বছর সে জোট আমলে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নিয়ে আসে। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে হুজি প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে।
২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর প্রতিবেদনে থেকে পাওয়া যায়, আইডিপি গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে সালাহউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী বলে, আইডিপির আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন রাজনীতির জন্ম হলো। আইডিপির সঙ্গে হরকাতুল জিহাদের নাম জড়িত। অনুষ্ঠানে আমার দেশ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী বলেন, ‘আফগানফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের মূলধারার সদস্যরা আইডিপি গঠন করেছে। পরিচয়সূত্রে আমি এদের সঙ্গে অনেক কাজ একত্রে করেছি। আমরা এই অনুষ্ঠান আরো আগে করতাম, কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টদের অনুমতি পেতে দেরি হয়েছে। ২০০৩ সালে যার নথিপত্রে তালেবান নিয়ে ভবিষ্যতবাণী পাওয়া গেছে সেই ব্যক্তিই জেএমবি’র পতনের প্রেক্ষাপটে আবার ২০০৮ সালে জঙ্গীদের সংগঠিত করেছে।
এই সঞ্জিব চৌধুরী একজন হিন্দু, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। অথচ হরকাতুল জিহাদ ও আইডিপি গঠনের নায়ক সে! কী বিচিত্র ঘটনা!
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০০ সালের ১২ জানুয়ারি। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট কলকাতা থেকে ঢাকা আসার জন্য প্রস্তুত। এমন সময় ভারতীয় গোয়েন্দারা ১১ জন বিভিন্ন দেশের নাগরিককে আটক করে সন্দেহজনক বিমান ছিনতাইকারী হিসেবে। তারা সবাই গত দু'মাস ধরে ভারতে তাবলীগ জামায়াতের কাজ করছিল। এখন তারা বাংলাদেশে টঙ্গীর ইজতেমাতে জয়েন করতে যাচ্ছে বলে জানায়। ভারতীয়রা যাচাই বাছাই করে তাদের ছেড়ে দেয়।
এদিকে ঘটনা জানাজানি হলে বাংলাদেশ তাদের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে অবতরণের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু তাদের কারো কাছেই বাংলাদেশের ভিসা ছিল না। হয়তো ঢাকার কোনো চ্যানেলে তারা বাংলাদেশে ঢুকে যেত। অথবা তাবলীগের মুসল্লি বিবেচনায় তারা ঢাকায় প্রবেশ করতে পারতো। কিন্তু সন্দেহভাজন আটক হওয়াতে বাংলাদেশ তাদের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করে। ভারতীয় গোয়েন্দারা তাদের পিছু ছাড়ে না। অধিকতর তল্লাশি চালিয়ে তাদের প্রত্যেকের কাছে ইসরাঈলি পাসপোর্ট পাওয়া যায়। এটা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বেশ জোরালো আলোচনার জন্ম দেয়। পরে ইসরাইলি চাপের মুখে ভারত তাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে তেল-আভিভ ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।
বর্তমান সময়ে যাকে নিয়ে বেশ শোরগোল হচ্ছে সে অনন্ত জলিলও তাবলীগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে জড়িত। এদেশের এখন পর্যন্ত যাদেরকে ইসরাইলি দূত হিসেবে আবিষ্কৃত হয়েছে তারা ডান ও জাতীয়তাবাদী ধারার সাথে জড়িত। ২০১৬ সালে বিএনপি নেতা আসলাম এক ইহুদি নেতার সাথে ভারতে বৈঠক করে পত্রিকার শিরোনাম হয়ে এখন জেলে আছে। শোয়েব চৌধুরীও বহুদিন জেলে ছিল। ২০১৪ সালে ১০ বছর আগের সেই মামলায় তার ৭ বছরের জেল হয়েছিল।
এই ডান বলয়ের বাইরে শুধু প্রকাশ্যে একজনকে দেখা যায় যে দায়িত্ব নিয়ে ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছে সে হলো সাংবাদিক আনিস আলমগীর। তার যুক্তির ভিত্তি হলো ১৯৭১ সালে ইসরাঈল আমাদের সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে। ইসরাঈলের টেকনোলজি ও ইন্টারন্যশনাল কানেকশন ভালো। অতএব আমাদের উচিত ইসরাঈলের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করা। বিভিন্ন লেখায় সে ইনিয়ে বিনিয়ে এগুলোই বলতে চায়।
আর গোপনে কে কীভাবে কাজ করছে তা জানিনা। যতটুকু প্রকাশ হয়েছে ততটুকুই কেবল জানতে পারি। তবে আমার দেখায় এখন পর্যন্ত মোসাদ-ইসরাঈল বাংলাদেশে কাজ করছে ডান ধারার লোকদের নিয়ে। তারা এদের মাধ্যমেই এদেশে প্রভাব রাখতে চায়। এদেশে জঙ্গী তৈরি তাদেরই এজেন্ডা। শোয়েব চৌধুরির আরেকটা এজেন্ডার কথা মিস হয়ে গেছে। সে এদেশের নাটক সিনেমায় পয়সা ইনভেস্ট করে।
তবে আমি মনে করি সম্প্রতি বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে Except Israel বাদ দেওয়া আগের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নয়। এটি হলো ট্রাম্পের জেরুজালের শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ। সৌদি ও আমেরিকার চাপে এই কাজ হয়েছে ৮ - ১০ মাস আগে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়ে প্রকাশিত হয়েছে এখন।
সাম্প্রতিক হামাস-ইসরাঈল যুদ্ধে এই শান্তি প্রক্রিয়া নস্যাত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। যারা এবং যেসব রাষ্ট্র ইসরাঈলকে স্বীকৃতি দিয়েছে তারাও সেখান থেকে সরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
ইনশাআল্লাহ
উত্তরমুছুনকিছু ভুল তথ্য আছে ।
উত্তরমুছুন