১৮ জুল, ২০২১

পর্ব : ২৬ - খন্দকের যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতি ও আল্লাহর সাহায্য

 


উহুদ যুদ্ধের সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ও ষড়যন্ত্র রাসূল সা. কৌশলে ও সামরিক তৎপরতা চালানোর মাধ্যমে কন্ট্রোল করেন। ফলে জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। চারিদিকে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটে। এই সময়ে ইহুদিরা তাদের ঘৃণ্য আচরণ, ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতরা কারণে নানা ধরনের অবমাননা ও অসম্মানের সম্মুখীন হয়।

ইহুদি গোত্র বনু নাদিরকে বহিষ্কার করার পর তারা খায়বারে থাকা ইহুদিদের কাছে আশ্রয় নেয়। তারা যখন দেখলো আবু সুফিয়ান নিজে চ্যালেঞ্জ দিয়েও সেই প্রতিশ্রুত যুদ্ধ করেনি। নজদের বনু গাতফান ভয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না তখন তারা মরণ কামড় দেওয়ার পরিকল্পনা করলো। আবার তারা দেখলো যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই মুসলিমদের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে, তাই তারা সময় ক্ষেপন করতে রাজি ছিল না। 

বনু নাদিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাবের নেতৃত্বে ইহুদিরা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। মুসলনাদের ওপর সর্বশেষে আঘাত হানার জন্যে তারা প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তারা ভালো করে জানে তারা যুদ্ধে ভালো নয়, তাই তারা সব পক্ষকে একত্র করে যুদ্ধে নামানোর ষড়যন্ত্র শুরু করলো।  

বনু নাদিরের ২০ জন সর্দার ও নেতা মক্কায় কুরাইশদের কাছে হাজির হলো। তারা মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মুশরিকদের উদ্বুদ্ধ করে বললো যে, তারাও সর্বাত্মক সাহায্য করবে এবং খরচের একটি বড় অংশ বহন করবে। মক্কার মুশরিকরা রাজি হয়ে গেলো। কুরাইশদের একটি দল প্রতিশ্রুত যুদ্ধ করতে পারে নি বলে লজ্জিত ছিল। তারা ইহুদিদের এই অফারকে লুফে নিল। 

ইহুদি প্রতিনিধিদল এরপর বনু গাতফানের কাছে গিয়ে তাদেরও মুক্কার মুশরিকদের মতোই যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করলো। তারাও প্রস্তুত হয়ে গেলো। এরপর ইহুদিদের এই প্রতিনিধিরা আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে ঘুরে ঘুরে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে লাগলো এবং একটি সমন্বিত যুদ্ধের জন্যে আহ্বান জানালো। এতে বহু লোক যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলো। মোটকথা, ইহুদি রাজনীতিকরা সফলতার সাথে কাফেরদেরকে একত্র করতে সক্ষম হলো এবং বহু লোককে মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করলো।

এরপর পরিকল্পিত কর্মসূচী অনুযায়ী দক্ষিণ দিক থেকে কুরাইশ, কেনানা এবং তোহামায় বসবাসকারী অন্যান্য নিত্র গোত্র মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। এদের অধিনায়ক ছিলো মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান। সম্মিলিত সৈন্য সংখ্যা ছিলো ৪ হাজার। সফরকালে বনু সালিম গোত্রের লোকেরাও তাদের সাথে শামিল হলো। একই সময়ে পূর্ব দিকে থেকে গাতফান গোত্র, ফাজরাহ, মাররা এবং আশজাআ রওয়ানা হলো।

নির্দিষ্ট দিনে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুসারে সবাই মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। অল্পদিনের মধ্যেই মদিনার চারপাশে ১০ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী সমবেত হলো। এই সৈন্য সংখ্যা হিসাব করলে এতো বড় ছিলো যে, মদীনার নারী শিশুসহ মোট জনসংখ্যাও তাদের সমান ছিলো না। এ বিরাট সেনাদল যদি হঠাৎ করে মদীনায় গিয়ে চড়াও হতো, তবে মুসলমানদের জন্যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। এটাও বিচিত্র ছিলো না যে, মুসলমানদের তারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতো।

যদিও আরবের পরিস্থিতি শান্ত ছিল ও মুসলিমদের অনুকূলে ছিল তবুও রাসূল সা. সক্রিয় ছিলেন। তিনি গোয়েন্দাদের থেকে নিয়মিত তথ্য পাচ্ছিলেন। আরবের মুশরিকরা খুব দ্রুতই একত্রিত হয়েছিল। আর এই খবর পাওয়া মাত্র মুহাম্মদ সা. মজলিসে শুরার বৈঠক ডাকলেন। সেখানে সবাই মদিনার প্রতিরক্ষা নিয়ে কথা বলছিলেন। যেহেতু মুশরিকরা সৈন্যরা বিভিন্ন দিক থেকে আসছিলো তাই মদিনা থেকে বের হয়ে তাদের কোন একটি প্রান্তরে আটকানোর সুযোগ ছিল না।  

ইরানের সাহাবি সালমান ফারসি রা. বললেন, ইরানে যখন অবরুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন সেখানে পরিখা বা গর্ত খনন করা হয়। আমরা যদি মদিনার উত্তর পাশে (অন্য সবদিকে পাহাড় ও বনভূমি) পরিখা খনন করি তাহলে শত্রুরা মদিনায় ঢুকতে পারবে না। যেহেতু শত্রুদের গতিরোধ করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল তাই শুরায় সালমান রা.-এর প্রস্তাবটি পাশ হয়।  

এটা ছিলো একটি সুচিন্তিত প্রতিরক্ষা প্রস্তাব। আরবের জনগণ এ ধরনের কৌশল সম্পর্কে অবহিত ছিলো না। মুহাম্মদ সা. এ প্রস্তাব অনুমোদন করে অবিলম্বে খনন কাজ শুরু করলেন। রাসূল সা. নিজেই এ কাজ দেখা শোনা করতেন। তিনি নিজেও পরিখা খননে অংশগ্রহণ করেন। সেসময় মদিনায় অভাব চলছিল। সাহাবারা ও রাসূল ক্ষুদার্ত থেকে এই কাজ করেছেন। আল্লাহর রাসূল সা. ক্ষুদায় পেটের সাথে পাথর বেঁধেছেন।  

পরিখা খননের সময় একটি বিরাট পাথর অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালা। কোদাল দিয়ে আঘাত করলে কোদাল ফিরে আসছিলো। এ ব্যাপারটি মুহাম্মদ সা.-কে জানানো হলে তিনি কোদাল হাতে নিয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে আঘাত করলেন। পাথরের একাংশ ভেঙ্গে গেলো। ভেঙে যাওয়া দেখে তিনি বললেন, ‘আল্লাহু আকবর! আমাকে শাম দেশের (সিরিয়া) চাবি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি এখন সেখানে লাল মহল দেখতে পাচ্ছি। এরপর দ্বিতীয় আঘাত করলেন। আরো একটি টুকরো বের হলো। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি এখন মাদায়েনের শ্বেত মহল দেখতে পাচ্ছি। এরপার তৃতীয় আঘাত করলেন। এতে পাথরের বাকি অংশ কেটে গেলো। তিনি বললেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে ইয়েমেনের চাবি দেয়া হয়েছে। আমি এখন সানআর ফটক দেখতে পাচ্ছি।

মদীনা শহর উত্তর দিকে খোলা, অন্য তিনদিকে পাহাড় পর্বত এবং খেজুর বাগানে ঘেরা। একটি বড় অংশ খনন করতে হয়েছে বিধায় প্রতিজন সাহাবীর ওপর চল্লিশ হাত পরিখা খনন করার দায়িত্ব পড়ে। মুসলমানরা পরিখা খননের কাজ সমভাবে চালিয়ে যান। সারাদিন তারা খনন কাজ করনে, সন্ধায় ঘরে ফিরে যেতেন। এসময় খনন কাজ যাতে দ্রুত হয় এবং শত্রুরা আসার আগেই যাতে তা শেষ হয় সেজন্য মুসলিমরা নামাজ কাজা করেছেন। তারা ফজর নামাজ পড়ে কাজ শুরু করতেন। একেবারে অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত খনন করতেন। এরপর একসাথে চার নামাজগুলো পড়তেন। আল্লাহর রহমতে শত্রু বাহিনীর মদিনার কাছাকাছি আসার আগেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিখা খননের কাজ শেষ হয়ে যায়।

মদিনার মুনাফিকরা ভীত হয়ে পড়লো। তাদের প্ররোচনায় দুর্বল ঈমানের মুসলিমরাও ভীত হয়ে উঠলো। তারা যুদ্ধ করতে চাইলো না। তারা নিশ্চিত পরাজয় দেখতে পাচ্ছিল। তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, মুশরিকরা যদি মদিনায় ঢুকে পড়ে তবে তারা মুশরিকদের সাহায্য করবে এবং তাদেরই দলভুক্ত হয়ে যাবে। 

আল্লাহর রাসূল সা. মদিনার সকল সামর্থবানকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও মদিনা রক্ষার জন্য নির্দেশ দিলেন। মহিলাদেরও প্রস্তুত থাকতে বললেন। নারী ও শিশুদের বিভিন্ন সুরক্ষিত বাড়ি ও দুর্গে রাখা হলো। মদিনা শাসনের ভার আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের হাতে ন্যস্ত করে মুহাম্মদ সা. যুদ্ধের সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন।  

মুশরিকরা মদিনায় অতর্কিত হামলা করতে এসে পরিখা দেখে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে। এমন একটি অপরিচিত বাধার মুখে পড়ে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়ে যায়। তারা পরিখার বাইরে মদিনা অবরোধ করে পড়ে থাকলো। এই বাধা মুকাবিলা করার প্রস্তুতি তাদের ছিল না। এ কারণে মুশরিকরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো।

এদিকে মুসলমানরা কাফেরদের গতিবিধির ওপর নজর রাখে এবং তাদেরকে পরিখার ধারে কাছে আসতে দিচ্ছিলো না। কাছে এলে তীর নিক্ষেপ করছিলো। ফলে বিধর্মীরা দারুণ বেকায়দায় পড়লো। তাছাড়া পরিখাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তাই গণহারে পরিখায় নামা এবং পরিখার কাছে আসার সাহস পাচ্ছিলো না। মাটি ফেলে পরিখা ভরাট করাও ছিলো অচিন্তনীয়।

মক্কার মুশরিকদের কয়েকটি সাহসী গ্রুপ জীবন বাজি রেখে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করে। তারা কয়েকজন পরিখায় নেমে মাথার ওপরে ঢাল দিয়ে রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা করলো। সেই রাস্তায় আমর ইবনে আব্দে ইকরামাসহ কয়েকজন ঘোড়া দিয়ে অতিক্রম করার চেষ্টা করলো। আলী রা. কয়েকজন সাহাবাকে নিয়ে তাদের চেষ্টা নস্যাৎ করে দিলেন এবং পরিখার নিরাপত্তা জোরদার করলেন। এর মধ্যে আমর আলী রা.-এর সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ হারায়। আবু জাহলের পুত্র ইকরামা তার সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে গেল।     

মুশরিকরা পরিখা অতিক্রম করা অথবা পরিখা ভরাট করে রাস্তা তৈরির সব রকম চেষ্টা করলো। কিন্তু মুসলমানরা তাদেরকে পরিখার কাছে আসতে দিচ্ছিলেন না। তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ অথবা বর্শা তাক করে এমনভাবে প্রতিহত করলেন যে, তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।

মুশরিকরা পরিখা অতিক্রম করে মদীনায় হামলা করতে কয়েকদিন যাবত প্রাণপণ চেষ্ট করছিলো এবং মুসলমানরা সে চেষ্টা প্রতিহত করছিলেন। উভয় দলের মাঝখানে পরিখা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এ কারণে মুখোমুখি রক্তাক্ত সংঘর্ষের সুযোগ হয়নি। বরং পরস্পরের প্রতি তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তীর নিক্ষেপে উভয় পক্ষে কয়েকজন নিহত হয়েছে। তবে তাদের সংখ্যা ছিলো দশ। নিহত পৌত্তলিকদের মধ্যে দুই জন কি একজন তলোয়ারের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে।

যেহেতু পরিখা বা খন্দক খনন করে প্রতিরক্ষা দেওয়া হয়েছে তাই এই যুদ্ধ খন্দকের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এছাড়া কুরআনে এটিকে আহযাবের যুদ্ধ বলেও উদ্ধৃত করা হয়েছে। আহযাব মানে সম্মিলিত বাহিনী। যেহেতু মুশরিকরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করেছে তাই এটি আহযাবের যুদ্ধ নামেও পরিচিত। মদিনায় তখন একটি মাত্র ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা ছিল। তারা যাতে কোনো ষড়যন্ত্রে যুক্ত না হয় এজন্য আহযাবের যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূল সা. তাদের কাছ থেকে পুনরায় অঙ্গীকার নিলেন, যুদ্ধের সময় তারা মদিনা রাষ্ট্রকে সাহায্য করবে, শত্রুদের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ থেকে দূরে থাকবে। এটা একাধারে চুক্তি ও হুমকি দুইটাই ছিল। যদি তারা মদিনা সনদের চুক্তি অগ্রাহ্য করে তবে তাদের পরিণতি বনু কাইনুকা ও বনু নাদিরের মতো হবে। 

এদিকে অবরোধের দিন সংখ্যা বাড়ছে। মুশরিকদের বিশাল সেনাবাহিনীর খাবার ও অন্যান্য রশদ ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছে। যুদ্ধের মূল অণুঘটক বনু নাদিরের নেতা হুয়াই বিন আখতাব বিচলিত হয়ে পড়লো। কোনোভাবেই বিশাল সেনাবাহিনী পরিখা অতিক্রম করতে পারছে না। পুরো আরবের সম্মিলিত বাহিনী পরিখার সামনে অসহায় হয়ে পড়ে আছে। তাই সে নতুন পরিকল্পনা করলো, মদিনার দক্ষিণে থাকা বনু কুরাইজা যদি মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করে তবে উত্তরে থাকা বিশাল সেনাবাহিনী সহজেই পরিখা অতিক্রম করতে পারবে। মুসলিমরা দুইদিক থেকে আক্রমণের শিকার হলে সহজেই ধ্বসে যাবে। 

হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইজা গোত্রের লোকদের কাছে এসে তাদের সর্দার কা‘ব ইবনে আসাদের কাছে হাজির হলো। হুয়াই এসে কা‘ব-এর দরজায় নক করলো। হুয়াইকে দেখামাত্র কা‘ব দরজা খুলে দিলো। দরজা খোলার পর হুয়াই বললো, হে কা’ব, আমি তোমার জন্যে পৃথিবীর সম্মান এবং উত্তাল সমুদ্র নিয়ে এসেছি। আমি সব কুরাইশ সর্দারসহ সব কুরাইশকে রুমার মাজউল আসওয়ালে এনে সমবেত করেছি। বনু গাতফান গোত্রের লোকদেরকে তাদের সব সর্দারসহ উহুদের কাছে একত্রিত করেছি। তারা আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গীদের পুরোপুরি নির্মুল না করে তারা সেই স্থান ত্যাগ করবে না।

কা’ব বললো, আল্লাহর কসম! তুমি আমার কাছে যুগের অপমান এবং বৃষ্টিবর্ষণকারী মেঘ নিয়ে হাজির হয়েছ। সেই মেঘ থেকে শুধু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গর্জন বেরোচ্ছে। কিন্তু ওতে ভালো কিছু অবশিষ্ট নেই। হুয়াই, তোমার জন্যে আফসোস, আমাকে আমার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। আমি মোহাম্মদের মধ্যে সত্য এবং আনুগত্য ব্যতীত অন্য কিছু দেখিনি। 

কিন্তু হুয়াই কা’ব এর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝাতে লাগলো। এক পর্যায়ে মুসলিমদের ওপর আক্রমণের ব্যাপারে তাকে রাজি করিয়ে ফেললো। তবে এজন্য হুয়াইকে এ অঙ্গীকার করতে হলো যে, কুরাইশ যদি মুহাম্মদকে খতম না করেই ফিরে যেতে বাধ্য হয়, তবে আমিও তোমার সাথে তোমার দুর্গে প্রবেশ করবো। এরপর তোমার যে পরিণাম হবে আমি সেই পরিণাম মেনে নেব। হুয়াই এর এই ওয়াদার পর কা’ব ইবনে আসাদ ও তার গোত্র বনু কুরাইজা মুহাম্মদ সা.-এর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ এবং মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করে তাদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলো।

এরপর বনু কুরাইজার ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। এমন সময় এক ইহুদি মুসলিম নারী ও শিশুদের দুর্গের চারপাশে টহল দিচ্ছিল এবং ইহুদীদের ঐ দুর্গ আক্রমণের জন্য উস্কে দিচ্ছিল। এটা দেখে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে রাসূল সা.-এর ফুফু সাফিয়্যা রা. খঞ্জর দিয়ে ঐ ইহুদিকে হত্যা করে ফেলেন। মুসলমান নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় রাসূল সা.-এর ফুফুর এই বীরত্বপূর্ণ কাজ দারুণ প্রভাব পড়লো। ইহুদীরা মনে করলো যে, দুর্গের ভেতর মুসলমানদের সহায়ক সেনা ইউনিট রয়েছে। ইহুদীরা এ কারণে সেই দুর্গের কাছে অন্য কউকে পাঠাতে সাহসী হয়নি। অথচ সেখানে কোনো সৈন্যই ছিলো না। কবি হাসান বিন সাবিত রা. শুধু সেখানে ছিলেন। যিনি যুদ্ধের জন্য নিজেকে ফিট মনে করতেন না।  

যদিও বনু কুরাইজার ইহুদিরা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণে ভয় পাচ্ছিল তবে তারা মক্কার কুরায়শ সৈন্যদের সাথে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশের প্রমাণ দেওয়ার জন্যে তারা তাদেরকে নিয়মিতভাবে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করছিলো। এক পর্যায়ে মুসলমানরা সেই রসদের মধ্য থেকে ২০টি উট কেড়ে নেয়।

বনু কুরাইজার এই চুক্তিভঙ্গের কথা হযরত মুহাম্মাদ সা. জানতে পারেন। তাদের এরূপ কর্মকাণ্ডের ফলে তিনি শঙ্কিত হন। মদিনা সনদ অনুযায়ী বনু কুরাইজার ইহুদিরা মুসলিমদের মিত্র ছিল তাই তাদের এলাকার দিকে মুসলিমরা কোনো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। হযরত মুহাম্মাদ সা. প্রকৃত খবর সংগ্রহের জন্য সাহাবি সাদ বিন মুয়াজ, সাদ বিন উবাদা, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা ও খাওয়াত বিন জুবায়েরকে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের বলেন যে বনু কুরাইজা যদি মিত্রতা বহাল রাখে তবে তা যেন প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় যাতে মুসলিম সৈনিকদের মনোবল বজায় থাকে। কিন্তু মনোবল হ্রাসের আশঙ্কা থাকায় সম্ভাব্য চুক্তি লঙ্ঘনের সংবাদ ইঙ্গিতে তাকে জানানোর নির্দেশ দেন।

প্রেরিত সাহাবিরা বনু কুরাইজার দুর্গে গিয়ে দেখতে পান তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বনু কুরাইজা প্রতিনিধি দলের কাছে চুক্তি লঙ্ঘন ঘোষণা দিয়েছে। কুরাইজার লোকেরা শত্রুতা প্রদর্শন করে বলে যে মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে তাদের কোনো চুক্তি হয়নি। রাজির ঘটনার আদাল ও কারাহ গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অনুসারে প্রতিনিধি দল মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এসে শুধু বলেন আদাল ও কারাহ। এতে রাসূল সা. বুঝে যান, ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। কিছুক্ষণের মধ্য মুসলিমরা সবাই জেনে যায় বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এতে মুসলিমদের মনোবল নষ্ট হয়। এই প্রসঙ্গে সূরা আহযাবের ১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

// যখন তারা তোমাদের ওপর দিক থেকে এবং তোমাদের নিম্ন দিক থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছিল, এবং যখন তোমাদের চক্ষু বিস্ফোরিত হয়েছিল, প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিল আর তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা রকম ধারণা করতে শুরু করেছিলে।//  

এখানে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের দূরাবস্থার কথা প্রকাশ করেন। চারদিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এছাড়া মুসলিমদের সাথে মুনাফিকরা তো ছিলই। তারাও মনোবল ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত ছিল। অনেকেই আসন্ন পরাজয় দেখে আল্লাহর রাসূলের প্রতি ও আল্লাহর প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে।

আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. ও মুসলিমদের কঠিন অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়ে পরীক্ষা করলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ১১ নং আয়াতে বলেন, 

// তখন মু’মিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল।//

একইসাথে আল্লাহ তায়ালা সেসময় মদিনায় থাকা মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন সূরা আহযাবের ১১-২০ নং আয়াতে। মুনাফিকদের সম্পর্কে তিনি ১২-১৩ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। 

//আর যখন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে তারা বলেছিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর স্মরণ করো! যখন তাদের মধ্য থেকে এক দল বলেছিল: হে ইয়াসরিববাসী! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, অতএব তোমরা ফিরে যাও আর তাদের মধ্যে এক দল নবীর কাছে অব্যাহতি চেয়ে বলেছিল, আমাদের বাড়ি-ঘর অরক্ষিত। প্রকৃতপক্ষে তা অরক্ষিত ছিল না। বরং তাদের পালাবারই ইচ্ছা ছিল।//

মুনাফিকরা আল্লাহর রাসূল সা.-কে প্রতারক বলেছিল। তারা ভয় পেয়ে যুদ্ধ থেকে পালানোর অজুহাত খুঁজে বের করেছে। তারা মুসলিমদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে মুসলিমদের কাবু করতে চেয়েছে এবং আগের জাহেলি ধর্মে ফিরে যেতে চেয়েছে। 

এরপর আল্লাহ তায়ালা ১৪ নং আয়াতে বলেন, // আর যদি শত্রুরা নগরীর চারদিক থেকে প্রবেশ করে কুফরীর জন্য তাদেরকে প্ররোচিত করতো, তবে তারা তৎক্ষণাৎ তাই করতো; এবং তারা সেথায় খুব অল্পই বিলম্ব করতো।// 

যদি আবু সুফিয়ান বাহিনী মদিনায় প্রবেশ করতো তবে তারা সবাই কাফের হয়ে যেত। 

১৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, //অথচ এরাই পূর্বে আল্লাহর সাথে শপথ করেছিল যে, তারা পিছু হটে ফিরে যাবে না। অবশ্যই আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারের জবাবদিহি করতেই হবে তাদেরকে।//

তারপর নবী সা.-কে উদ্দেশ করে আল্লাহ ১৬-১৭ নং আয়াতে বলেন, //তুমি বলে দাও, তোমরা যদি মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে পালায়ন করো, তবে পলায়ন তোমাদের কোনই উপকারে আসবে না এবং তখন তোমাদেরকে অল্পই ভোগ করতে দেয়া হবে। আরো বলে দাও সে কে, যে তোমাদেরকে আল্লাহর (শাস্তি) থেকে রক্ষা করতে পারে, যদি তিনি ইচ্ছা করেন তোমাদের কোন ক্ষতি করতে? অথবা (সে কে, যে রোধ করতে পারে তাঁর অনুগ্রহকে,) যদি তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে ইচ্ছা করেন? আর তারা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের জন্য কোন বন্ধু ও কোন সাহায্যকারী পাবে না।//

তাদের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ ১৯ নং আয়াতে বলেন, //তারা তোমাদের প্রতি কার্পণ্য করে। আর যখন কোন ভয়ের কারণ সামনে আসে, তখন তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে যে, তারা মৃত্যুভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে তোমার দিকে তাকায়। অতঃপর যখন সে ভয় চলে যায়, তখন তারা ধন-সম্পদের লোভে তীব্র ভাষায় তোমাদেরকে আক্রমণ করে। তারা ঈমান আনেনি। অতএব আল্লাহ তাদের কার্যসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। আর এরূপ করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ।//

অর্থাৎ তারা যুদ্ধের সময় দানের ক্ষেত্রে খুব দান করবে। মুসলিমরা যখন যুদ্ধের মুখোমুখি তারা তারা অচেতন ব্যাক্তির মতো চোখ উল্টিয়ে যুদ্ধ থেকে পালাতে চাইবে। কিন্তু যখন যুদ্ধ জয় হবে তখন গনিমতের সম্পদ পাবার ক্ষেত্রে তাদের দাবি খুব উচ্চস্বরে করবে। সেক্ষেত্রে মুসলিমদের আক্রমণ করবে। 

আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ২১-২৪ নং আয়াতে মুমিনদের কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২৩ নং আয়াতে বলেন, //মু’মিনদের মধ্যে কতক লোক এমনও আছে যারা আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে; তাদের মধ্যে কেউ কেউ শাহাদাতবরণ করেছে এবং কেউ কেউ অপেক্ষায় রয়েছে। তারা স্বীয় সংকল্প একটুও পরিবর্তন করেনি//

হযরত মুহাম্মদ সা. বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার কথা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বনু কুরাইজার দিক থেকে মদিনার উপর আক্রমণ আসবে দ্রুত এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য হযরত মুহাম্মদ সা. প্রথমে সামরিক পদক্ষেপ নেন। প্রথমে নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য শহরের ভেতরের দিকে ১০০ জন সেনা প্রেরণ করা হয়। এরপর আরো ৩০০ অশ্বারোহী প্রেরণ করা হয়। তারপর তিনি তার কূটনৈতিক পদক্ষেপ শুরু করেন। তিনি মুশরিকদের সম্মিলিত জোটের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চেয়েছেন যাতে তাদের মনোবল দুর্বল হয়। 

প্রথমে রাসূল সা. বনু গাতাফানদের দুই নেতা উয়াইনা বিন হিসন ও হারিস বিন আউফের কাছে বার্তা পাঠান। সেখানে উল্লেখ করেন, তারা যদি জোট বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করলে মদিনায় উৎপন্ন খেজুরের এক তৃতীয়াংশ তাদের দেয়া হবে। তারা এই শর্তে সন্ধিতে রাজি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে তিনি সাদ ইবনে মুয়াজ ও সাদ বিন উবাদার কাছে তাদের পরামর্শ চান। তারা জানান যে যদি এটি আল্লাহর নির্দেশ হয় তবে তাদের আপত্তি নেই কিন্তু যদি মদিনাবাসীর দুরবস্থার কথা চিন্তা করে এই পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে তার প্রয়োজন নেই। হযরত মুহাম্মদ সা. জানান যে সমগ্র আরব অস্ত্র ধারণ করেছে বলে তিনি তাদের জন্যই এই পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। অভিজ্ঞ সাহাবীরা নিষেধ করায় তিনি এ বিষয়ে আর আগান নি।

এই অবস্থায় হযরত মুহাম্মদ সা. তার গোয়েন্দা নুয়াইম ইবনে মাসুদ রা.-কে গোপনে ডেকে পাঠান। তিনি ছিলেন গাতফানের একজন নেতা ও জোটবাহিনীর কাছে সম্মানিত। তিনি মুসলিম ছিলেন তবে ছিল গোপন। আল্লাহর রাসূল সা. তাকে জোট ভাঙার দায়িত্ব দেন যাতে তারা পরস্পরের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। 

নুয়াইম রা. এরপর একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেন। তার সাথে বনু কুরাইজার সুসম্পর্ক ছিল। তাই তিনি প্রথমে বনু কুরাইজার কাছে যান এবং জোটের বাকিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের সতর্ক করেন। তিনি তাদের বলেন বনু কুরাইজার সাথে কুরাইশ ও গাতাফানের পরিস্থতির কোনো মিল নেই। এখানে দুই গোত্রের ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ বলতে কিছু নেই। তারা তাদের স্বার্থ দেখলে গ্রহণ করবে, আর না দেখলে চলে যাবে। কিন্তু এই এলাকা বনু কুরাইজার নিজস্ব, যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন তাদেরকে এখানেই থাকতে হবে এবং যদি তারা মুসলিমদের শত্রুর সাথে হাত মেলায় তবে অবশ্যই মুসলিমরা এর প্রতিশোধ নেবে। এই কথা শোনার পর বনু কুরাইজা ভীত হয়ে করণীয় সম্পর্কে জানতে চায়। নুয়াইম রা. মত দেন যে যতক্ষণ কুরাইশদের মধ্য থেকে কিছু লোককে জামিন হিসেবে বনু কুরাইজার জিম্মায় না দেয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত যাতে তাদের সহায়তা করা না হয়।

এরপর নুয়াইম রা. কুরাইশদের শিবিরে যান। তিনি বলেন যে ইহুদিরা তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে লজ্জিত। তাই তারা কুরাইশদের কিছু লোককে জামিন হিসেবে গ্রহণ করে মুসলিমদের সমর্পণ করতে চায় যাতে অঙ্গীকার ভঙ্গের ক্ষতি পূরণ হয়। তাই ইহুদিরা যদি জামিন হিসেবে কিছু লোক চায় তবে তা যাতে মেনে নেয়া না হয়। নুয়াইম একইভাবে বনু গাতাফানের কাছে গিয়ে একই বার্তা দেন। 

নুয়াইম রা.-এর কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়। তার পরামর্শের পর কুরাইশ নেতারা বনু কুরাইজার নিকট বার্তা পাঠিয়ে জানায় যে তাদের নিজেদের অবস্থা প্রতিকূল। উট ও ঘোড়াগুলিও মারা যাচ্ছে। তাই যাতে দক্ষিণ দিক থেকে বনু কুরাইজা এবং উত্তর দিক থেকে জোট বাহিনী আক্রমণ করে। কিন্তু এসময় শনিবার ছিল বিধায় ইহুদিরা জানায় যে এই দিনে যুদ্ধ করা তাদের ধর্মবিরুদ্ধ এবং ইতোপূর্বে তাদের পূর্বপুরুষদের যারা এই নির্দেশ অমান্য করেছিল তাদের ভয়াবহ পরিণতি হয়। তাছাড়া কুরাইশ পক্ষের কিছু লোককে জামিন হিসেবে বনু কুরাইজার জিম্মায় না দেয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধে অংশ নেবে না। এর ফলে কুরাইশ ও গাতাফানরা নুয়াইমের কথার সত্যতা পায় এবং জামিন হিসেবে লোক প্রেরণের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ফলে কুরাইশ ও গাতাফানের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে কুরাইজাও নুয়াইমের কথার সত্যতা পেয়ে শঙ্কিত হয়। ফলে জোটে ভাঙ্গন ধরে যায়। সবাই সবার প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে থাকে।  

আবু সুফিয়ানের বাহিনী প্রায় একমাস ধরে অবরোধ অব্যাহত রাখলো মদিনার উত্তর দিকে। যদিও মুশরিকরা খন্দক অতিক্রম করতে সক্ষম হলো না তবে তারা মাসাধিককাল ধরে মুসলমাদেরকে ঘিরে বসে থাকলো। এতে মুসলমানরা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। 

অতঃপর আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে ভীষণ বেগে ঝড় তুফান ও ঘূর্ণিবার্তা প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এর ফলে কাফিরদের সমস্ত তাঁবু মূলোৎপাটিত হলো। কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। অগ্নি জ্বালানো কঠিন হয়ে গেল। কোন আশ্রয়স্থল তাদের দৃষ্টিগোচর হলো না। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ৯ নং আয়াতে বলেন, 

//হে মুমিনগণ, তোমরা স্মরণ করো! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে। যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছিল, তখন আমি তাদের ওপর প্রেরণ করেছিলাম এক প্রচণ্ড বায়ু এবং এমন এক সৈন্যদল যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখেন।// 

সেই রাতের বর্ণনা দেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা.। তিনি বলেন, “আমার মামা হযরত উসমান ইবনে মাযউন রা. খন্দকের যুদ্ধের রাত্রে কঠিন শীত ও প্রচণ্ড বাতাসের সময় খাদ্য ও কম্বল আনার জন্যে আমাকে শহরে প্রেরণ করেন। ভীষণ জোরে বাতাস বইতেছিল। বাতাস আমার ঢালে ধাক্কা দিচ্ছিল এবং আমি তাতে আঘাত পাচ্ছিলাম। এমনকি ঢাল থেকে লোহা খুলে আমার পায়ে পড়ে গেল। আমি ওটাকে ফেলে দিয়ে চলে গেলাম। 

এই ভয়ংকর অবস্থায় আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে সকলকে সম্বোধন করে বললেন, হে কুরাইশের দল! আল্লাহর কসম, আমাদের আর কোথাও দাঁড়াবার স্থান নেই। আমাদের গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুগুলো এবং আমাদের উটগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বনু কুরাইজা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা আমাদেরকে খুব কষ্ট দিয়েছে। অতঃপর এই ঝড়ো হাওয়া আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। আমরা রান্না করে খেতে পারছি না। তাঁবু ও থাকার স্থান আমরা ঠিক রাখতে পারছি না। তোমরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আমি তো ফিরে যাবার কথা চিন্তা করছি। আমি তোমাদের সকলকেই ফিরে যাবার নির্দেশ দিচ্ছি।” এ কথা বলেই পাশে যে উটটি বসিয়ে রাখা হয়েছিল তার উপর তিনি উঠে বসলেন। 

কুরাইশদের ফিরে যাবার পর বনু গাতফানও বিনা বাক্য ব্যয়ে অবরোধ তুলে নিয়ে চলে গেলো। খন্দকের যুদ্ধ বা আহযাবের যুদ্ধে লড়াই ছাড়াই পরাজয় হলো সম্মিলিত জোট বাহিনীর। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন