মদিনায় রাষ্ট্রগঠন করার পর হযরত মুহাম্মদ সা. ইহুদী গোত্রগুলোর সঙ্গে নানারূপ চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন এবং তাদের জান-মালের কোনো ক্ষতি না করার ও তাদেরকে সর্বপ্রকার ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তারপরও ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে ইহুদি আলিমগণ বিশেষভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলো।
প্রথমত তারা নিশ্চিত জানতো মুহাম্মদ সা. যা বলছেন তা সত্য। এর সত্যতা তারা তাদের আসমানী কিতাব তাওরাতেই পেয়েছে। সেখানে মুহাম্মদ সা.-এর সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল। যেহেতু তারা আশা ও ধারণা করেছিলো শেষ নবী তাদের বংশ থেকেই আসবে, কিন্তু সেটা না হওয়াতে তারা মুহাম্মদ সা. মেনে নিতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত নবী আসার ধারাবাহিকতার জন্য তাদের বংশ অর্থাৎ বনী ইসরাইল অত্যন্ত সুপরিচিত, এজন্য তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতো। এই বংশে বেশিরভাগ নবী এসেছেন। এজন্য তাদের বংশীয় অহমিকা ছিল ব্যাপক। মুহাম্মদ সা. নবী হিসেবে আসার আবির্ভাব হওয়ার পর তাদের বংশের মর্যাদা কমে গেল। তাই তারা মুহাম্মদ সা.-কে সত্য নবী জেনেও বিরোধীতা করতে থাকে।
তৃতীয়ত ধর্মীয় দিক থেকে এ পর্যন্ত ইহুদীদের এক প্রকার অহমিকা ছিলো। আল্লাহর বিশেষ বান্দা ও দ্বীনদারির দিক দিয়ে সবাই তাদেরকে শ্রদ্ধার পাত্র বলে গণ্য করতো। তারা নিজেদেরকে সাধারণ জনগণ ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করতো। আল্লাহর কাছে ইহুদি আলেমদের সুপারিশ পাওয়ার আশায় জনগণ তাদের কথা শুনতে ও মানতে বাধ্য হতো। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রসারের ফলে তাদের এই ভ্রান্ত ধার্মিকতা ও পেশাদারীর মুখোশ খসে পড়লো। সত্যিকার ধার্মিকতা কাকে বলে এবং যথার্থ তাকওয়ার তাৎপর্য কী, মুহাম্মদ সা.-এর বক্তব্য শুনে লোকেরা তা জানতে পরলো। ফলে ইহুদি আলিমদের পুরোহিত তন্ত্র ও ধর্ম ব্যবসায়ে মন্দাভাব দেখা দিলো।
ইহুদি আলেমদের এই সকল সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তারা জোরালোভাবে মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করতে থাকে। তাঁকে মিথ্যা নবী দাবীদার হিসেবে সাব্যস্ত করে। বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ করে তারা সমাজে ফিতনা তৈরি করছিল। ইহুদিদের মিথ্যা প্রচারণায় মদিনার মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদারেররাও প্রভাবিত হয়।
তাদের মিথ্যা প্রচারণার জবাবে আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদা, সূরা নিসা, সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে ইমরানে ইহুদিদের সমালোচনা করেছেন ও তাদের বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরেছেন। আর তাদের আলিমদের জন্য তিনটি বিশেষ আয়াত নাজিল করেছেন সূরা বাকারাহ'র ১৭৪-১৭৬ নং আয়াতে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, //নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে সমস্ত বিধান অবতীর্ণ করেছেন সেগুলো যারা গোপন করে এবং কিতাবের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই খায় না। আর কেয়ামতের দিন আল্লাহ্ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
তারাই হিদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা এবং মাগফিরাতের পরিবর্তে আজাব ক্রয় করেছে। আগুনের উপর তারা কতই না ধৈর্যশীল। তা এই কারণে যে, আল্লাহ যথার্থরূপে কিতাব নাযিল করেছেন। আর নিশ্চয়ই যারা কিতাবে মতবিরোধ উদ্ভাবন করেছে, তারা নিজেদের বিরোধের ক্ষেত্রে সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।//
অর্থাৎ তাওরাতের মধ্যে মুহাম্মদ সা.-এর গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কিত যেসব আয়াত রয়েছে সেগুলো যেসব ইহুদি আলিম তাদের শ্রেষ্ঠত্ব চলে যাওয়ার ভয়ে গোপন করে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এবং ঐ আলিম নামধারীরা সাধারণ আরবদের নিকট হতে হাদিয়া ও উপঢৌকন গ্রহণ করতো আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার জন্য, দোয়া করার জন্য তাদের এই বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দুনিয়ায় অর্থ লাভ ও প্রভাবের জন্য আল্লাহর আয়াত ব্যবহার করতো এবং তাদের ইচ্ছেমত আয়াত তারা জনগণের সামনে উপস্থাপন করতো। অর্থাৎ যেসব আয়াত উল্লেখ করলে বা প্রচার হলে তাদের সমস্যা হবে সেসব আয়াত তারা গোপন রাখতো। সাধারণ জনগণকে তাওরাত পড়তে দিত না।
এখানেও এও বলা হয়েছে আল্লাহর কথা ব্যবহার করে ও আল্লাহর ভয় দেখিয়ে তারা যে অর্থ উপার্জন করছে তা প্রকৃতপক্ষে আগুনের অঙ্গার দ্বারা তারা তাদের পেট পূর্ণ করছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তাদের সাথে কথা পর্যন্ত বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না বরং তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মধ্যে পতিত হবে। কেননা, তাদের কৃতকর্মের কারণে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ ও অভিশাপ তাদের উপরে বর্ষিত হয়েছে এবং আজ তাদের উপর হতে আল্লাহর করুণা দৃষ্টি অপসারিত হয়েছে।
এই আয়াতের প্রসঙ্গে উস্তাদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ. বলেন, "এখানে যেসব ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ মিথ্যা দাবি করে এবং জনগণের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণা চালায় এখানে আসলে তাদের সমস্ত দাবি ও প্রচারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজেদের পূত-পবিত্র সত্তার অধিকারী হবার এবং যে ব্যক্তি তাদের পেছনে চলবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার সুপারিশ করে তার গোনাহ খাতা মাফ করিয়ে নেয়ার ধারণা জনগনের মনে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করে এবং জনগণও তাদের একথায় বিশ্বাস করে।
জবাবে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, আমি তাদের সাথে কথাই বলবো না এবং তাদের পবিত্রতার ঘোষণাও দেবো না"।
মওদূদী রহ. আরো বলেন, "সাধারণ লোকদের মধ্যে যত প্রকার বিভ্রান্তিকর কুসংস্কার প্রচলিত আছে এবং বাতিল রীতিনীতি ও অর্থহীন বিধি-নিষেধের যেসব নতুন নতুন শরিয়ত তৈরি হয়েছে ও বিদয়াত চালু হয়েছে এগুলোর জন্য দায়ি হচ্ছে সেই আলিম সমাজ, যাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ছিল কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায়নি। তারপর অজ্ঞতার কারণে লোকদের মধ্যে যখন ভুল পদ্ধতির প্রচলন হতে থাকে তখনো ঐ জালেম গোষ্ঠী মুখ বন্ধ করে বসে থেকেছে তাদের অর্থনৈতিক লাভের জন্য। তারা আল্লাহর কিতাবের বিধানের ওপর আবরণ পড়ে থাকাটাই নিজেদের জন্য লাভজনক বলে তাদের অনেকেই মনে করেছে। এদেরকেই এই আয়াতগুলোতে হুমকি দেওয়া হয়েছে"।
এবার আসুন, ঐ সময়ের ইহুদি আলিমদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল সেগুলো এখন মুসলিম আলিমদের মধ্যে দেখা যায় কিনা? ইহুদি আলিম আর মুসলিম আলিম নামধারীদের মধ্যে মিল রয়েছে কিনা?
এর উত্তর হবে বেশিরভাগ আলিম নামধারীরার এইসব দোষে দুষ্ট। তারা তাদের প্রয়োজনমতো কুরআন-হাদিস ও ইসলামকে ব্যবহার করে। জালিম শাসকের জুলুমকে বৈধতা দেয়। কুরআনের দাওয়াত দেওয়াকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে। মোটা অংকের টাকা দাবি করে কুরআনের তাফসির করে। অথচ এই কাজটা ফরজ। ফরজ ইবাদতের জন্য তারা টাকা দাবি করে জনগণের কাছে।
আমাদের কিছু মুসলিম আলিমদের মধ্যে ইহুদিদের মতো মিথ্যা অহমিকা দেখা যায়। এক আলিম ওপর আলিমের সাথে বাহাস করে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। এক ঘরানার আলিম অন্য ঘরানার আলিমদের মুর্খ হিসেবে অভিহিত করে। আবার যারা নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে নি তাদের ইসলাম নিয়ে কথা বলার অধিকার ও দাওয়াত দেওয়ার অধিকার দিতে রাজি হয় না মিথ্যা অহমিকার জন্য।
সবচেয়ে খারাপ কথা হলো তারা প্রতি কথায় উঠতে বসতে মতবিরোধ করে। মতবিরোধের জেরে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। এভাবে মুসলিমদের ঐক্যের সাথে থাকার, জামায়াতবদ্ধ থাকার ফরজ নির্দেশকে তারা উপেক্ষা করেন। এদের জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা মতবিরোধের উদ্ভব ঘটিয়ে সত্য থেকে বহুদূরে চলে গেছে।
এদেশের বেশিরভাগ আলিম নামধারীরা কোনো মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার বিনিময়ে টাকা নেয় ও দাবি করে। কেউ কেউ তো কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার ধৃষ্টতাও দেখায়! কী ভয়ংকর! সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে যেখানে মুহাম্মদ সা. বিচলিত, সেখানে কীভাবে তারা সুপারিশ করার ধৃষ্টতা দেখায় ইহুদিদের মতো!
আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ৪১ নং আয়াতে সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছেন, আর আমি যে কিতাব পাঠিয়েছি তার ওপর ঈমান আন। সামান্য দামে আমার আয়াত বিক্রি করো না এবং আমাকে ভয় করো।
আল্লাহ তায়ালার এই নিষেধ সত্ত্বেও এদেশের আলিম নামের লোকেরা মোটা অংকের বিনিময়ে মাহফিল করে। এডভান্স নেয়। ফুল পেমেন্ট না করলে মাহফিলে যায় না। আবার নিজেদেরকে দ্বীনের দাঈও মনে করে। কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করলে বলে, ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ারদের, উকিল এদের উদাহরণ টানে। বলে, তাদের থেকে টাকা দিয়ে পরামর্শ নিলে আলিমদের থেকে নিতে কী সমস্যা?
সমস্যা যে কী তা তো আল্লাহই বলে দিয়েছেন। উপরোক্ত লোকেরা কেউই আখিরাতের অংশ পাওয়ার জন্য এই কাজ করেন না। যেসব আলিম দ্বীনের দাওয়াত ও নসিহতকে অন্যান্য পেশার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন তারা নিজেকে দাঈ বলা থেকে বিরত হন। নিজেকে মোটিবেশনাল বক্তা হিসেবে পরিচিত করুন। কেউ কেউ তো নিজেদেরকে কনসার্টের আর্টিস্টদের সাথেও তুলনা করেন। ভালো কথা! আপনারা নিজেদেরকে কনসার্ট/ যাত্রার বিনোদন কর্মী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করুন। এই পরিচয়ে পরিচিত হলে আমাদের কোনো কথা নাই।
নিজেদের আলিম দাবি করবেন, মুফাসসির, মুফতি, মুহাদ্দিস, ইসলামিক স্কলার এসবে পরিচিত হবেন আর আয়াত বেচে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন তা হতে দেয়া ঠিক হবে না।
ওয়াজের মৌসুম আসছে। এখন শুরু হবে আলেম নামধারী বহু লোকের ইহুদী আচরণ। তাদের ব্যপারে সাবধান থাকুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এদের থেকে হিফাজত করুন। ইহুদি কালচার থেকে আমাদের আলিমদের হিফাজত করুন। আল্লাহর আয়াত বেচা জাহান্নামের আগুন খাওয়া লোকদের থেকে ইলম অর্জন করতে যাবেন না।
আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন।
প্রথমত তারা নিশ্চিত জানতো মুহাম্মদ সা. যা বলছেন তা সত্য। এর সত্যতা তারা তাদের আসমানী কিতাব তাওরাতেই পেয়েছে। সেখানে মুহাম্মদ সা.-এর সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল। যেহেতু তারা আশা ও ধারণা করেছিলো শেষ নবী তাদের বংশ থেকেই আসবে, কিন্তু সেটা না হওয়াতে তারা মুহাম্মদ সা. মেনে নিতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত নবী আসার ধারাবাহিকতার জন্য তাদের বংশ অর্থাৎ বনী ইসরাইল অত্যন্ত সুপরিচিত, এজন্য তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতো। এই বংশে বেশিরভাগ নবী এসেছেন। এজন্য তাদের বংশীয় অহমিকা ছিল ব্যাপক। মুহাম্মদ সা. নবী হিসেবে আসার আবির্ভাব হওয়ার পর তাদের বংশের মর্যাদা কমে গেল। তাই তারা মুহাম্মদ সা.-কে সত্য নবী জেনেও বিরোধীতা করতে থাকে।
তৃতীয়ত ধর্মীয় দিক থেকে এ পর্যন্ত ইহুদীদের এক প্রকার অহমিকা ছিলো। আল্লাহর বিশেষ বান্দা ও দ্বীনদারির দিক দিয়ে সবাই তাদেরকে শ্রদ্ধার পাত্র বলে গণ্য করতো। তারা নিজেদেরকে সাধারণ জনগণ ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করতো। আল্লাহর কাছে ইহুদি আলেমদের সুপারিশ পাওয়ার আশায় জনগণ তাদের কথা শুনতে ও মানতে বাধ্য হতো। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রসারের ফলে তাদের এই ভ্রান্ত ধার্মিকতা ও পেশাদারীর মুখোশ খসে পড়লো। সত্যিকার ধার্মিকতা কাকে বলে এবং যথার্থ তাকওয়ার তাৎপর্য কী, মুহাম্মদ সা.-এর বক্তব্য শুনে লোকেরা তা জানতে পরলো। ফলে ইহুদি আলিমদের পুরোহিত তন্ত্র ও ধর্ম ব্যবসায়ে মন্দাভাব দেখা দিলো।
ইহুদি আলেমদের এই সকল সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তারা জোরালোভাবে মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করতে থাকে। তাঁকে মিথ্যা নবী দাবীদার হিসেবে সাব্যস্ত করে। বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ করে তারা সমাজে ফিতনা তৈরি করছিল। ইহুদিদের মিথ্যা প্রচারণায় মদিনার মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদারেররাও প্রভাবিত হয়।
তাদের মিথ্যা প্রচারণার জবাবে আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদা, সূরা নিসা, সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে ইমরানে ইহুদিদের সমালোচনা করেছেন ও তাদের বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরেছেন। আর তাদের আলিমদের জন্য তিনটি বিশেষ আয়াত নাজিল করেছেন সূরা বাকারাহ'র ১৭৪-১৭৬ নং আয়াতে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, //নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে সমস্ত বিধান অবতীর্ণ করেছেন সেগুলো যারা গোপন করে এবং কিতাবের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই খায় না। আর কেয়ামতের দিন আল্লাহ্ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
তারাই হিদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা এবং মাগফিরাতের পরিবর্তে আজাব ক্রয় করেছে। আগুনের উপর তারা কতই না ধৈর্যশীল। তা এই কারণে যে, আল্লাহ যথার্থরূপে কিতাব নাযিল করেছেন। আর নিশ্চয়ই যারা কিতাবে মতবিরোধ উদ্ভাবন করেছে, তারা নিজেদের বিরোধের ক্ষেত্রে সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।//
অর্থাৎ তাওরাতের মধ্যে মুহাম্মদ সা.-এর গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কিত যেসব আয়াত রয়েছে সেগুলো যেসব ইহুদি আলিম তাদের শ্রেষ্ঠত্ব চলে যাওয়ার ভয়ে গোপন করে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এবং ঐ আলিম নামধারীরা সাধারণ আরবদের নিকট হতে হাদিয়া ও উপঢৌকন গ্রহণ করতো আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার জন্য, দোয়া করার জন্য তাদের এই বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দুনিয়ায় অর্থ লাভ ও প্রভাবের জন্য আল্লাহর আয়াত ব্যবহার করতো এবং তাদের ইচ্ছেমত আয়াত তারা জনগণের সামনে উপস্থাপন করতো। অর্থাৎ যেসব আয়াত উল্লেখ করলে বা প্রচার হলে তাদের সমস্যা হবে সেসব আয়াত তারা গোপন রাখতো। সাধারণ জনগণকে তাওরাত পড়তে দিত না।
এখানেও এও বলা হয়েছে আল্লাহর কথা ব্যবহার করে ও আল্লাহর ভয় দেখিয়ে তারা যে অর্থ উপার্জন করছে তা প্রকৃতপক্ষে আগুনের অঙ্গার দ্বারা তারা তাদের পেট পূর্ণ করছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তাদের সাথে কথা পর্যন্ত বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না বরং তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মধ্যে পতিত হবে। কেননা, তাদের কৃতকর্মের কারণে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ ও অভিশাপ তাদের উপরে বর্ষিত হয়েছে এবং আজ তাদের উপর হতে আল্লাহর করুণা দৃষ্টি অপসারিত হয়েছে।
এই আয়াতের প্রসঙ্গে উস্তাদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ. বলেন, "এখানে যেসব ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ মিথ্যা দাবি করে এবং জনগণের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণা চালায় এখানে আসলে তাদের সমস্ত দাবি ও প্রচারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজেদের পূত-পবিত্র সত্তার অধিকারী হবার এবং যে ব্যক্তি তাদের পেছনে চলবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার সুপারিশ করে তার গোনাহ খাতা মাফ করিয়ে নেয়ার ধারণা জনগনের মনে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করে এবং জনগণও তাদের একথায় বিশ্বাস করে।
জবাবে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, আমি তাদের সাথে কথাই বলবো না এবং তাদের পবিত্রতার ঘোষণাও দেবো না"।
মওদূদী রহ. আরো বলেন, "সাধারণ লোকদের মধ্যে যত প্রকার বিভ্রান্তিকর কুসংস্কার প্রচলিত আছে এবং বাতিল রীতিনীতি ও অর্থহীন বিধি-নিষেধের যেসব নতুন নতুন শরিয়ত তৈরি হয়েছে ও বিদয়াত চালু হয়েছে এগুলোর জন্য দায়ি হচ্ছে সেই আলিম সমাজ, যাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ছিল কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায়নি। তারপর অজ্ঞতার কারণে লোকদের মধ্যে যখন ভুল পদ্ধতির প্রচলন হতে থাকে তখনো ঐ জালেম গোষ্ঠী মুখ বন্ধ করে বসে থেকেছে তাদের অর্থনৈতিক লাভের জন্য। তারা আল্লাহর কিতাবের বিধানের ওপর আবরণ পড়ে থাকাটাই নিজেদের জন্য লাভজনক বলে তাদের অনেকেই মনে করেছে। এদেরকেই এই আয়াতগুলোতে হুমকি দেওয়া হয়েছে"।
এবার আসুন, ঐ সময়ের ইহুদি আলিমদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল সেগুলো এখন মুসলিম আলিমদের মধ্যে দেখা যায় কিনা? ইহুদি আলিম আর মুসলিম আলিম নামধারীদের মধ্যে মিল রয়েছে কিনা?
এর উত্তর হবে বেশিরভাগ আলিম নামধারীরার এইসব দোষে দুষ্ট। তারা তাদের প্রয়োজনমতো কুরআন-হাদিস ও ইসলামকে ব্যবহার করে। জালিম শাসকের জুলুমকে বৈধতা দেয়। কুরআনের দাওয়াত দেওয়াকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করে। মোটা অংকের টাকা দাবি করে কুরআনের তাফসির করে। অথচ এই কাজটা ফরজ। ফরজ ইবাদতের জন্য তারা টাকা দাবি করে জনগণের কাছে।
আমাদের কিছু মুসলিম আলিমদের মধ্যে ইহুদিদের মতো মিথ্যা অহমিকা দেখা যায়। এক আলিম ওপর আলিমের সাথে বাহাস করে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। এক ঘরানার আলিম অন্য ঘরানার আলিমদের মুর্খ হিসেবে অভিহিত করে। আবার যারা নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে নি তাদের ইসলাম নিয়ে কথা বলার অধিকার ও দাওয়াত দেওয়ার অধিকার দিতে রাজি হয় না মিথ্যা অহমিকার জন্য।
সবচেয়ে খারাপ কথা হলো তারা প্রতি কথায় উঠতে বসতে মতবিরোধ করে। মতবিরোধের জেরে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। এভাবে মুসলিমদের ঐক্যের সাথে থাকার, জামায়াতবদ্ধ থাকার ফরজ নির্দেশকে তারা উপেক্ষা করেন। এদের জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা মতবিরোধের উদ্ভব ঘটিয়ে সত্য থেকে বহুদূরে চলে গেছে।
এদেশের বেশিরভাগ আলিম নামধারীরা কোনো মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার বিনিময়ে টাকা নেয় ও দাবি করে। কেউ কেউ তো কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার ধৃষ্টতাও দেখায়! কী ভয়ংকর! সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে যেখানে মুহাম্মদ সা. বিচলিত, সেখানে কীভাবে তারা সুপারিশ করার ধৃষ্টতা দেখায় ইহুদিদের মতো!
আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ৪১ নং আয়াতে সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছেন, আর আমি যে কিতাব পাঠিয়েছি তার ওপর ঈমান আন। সামান্য দামে আমার আয়াত বিক্রি করো না এবং আমাকে ভয় করো।
আল্লাহ তায়ালার এই নিষেধ সত্ত্বেও এদেশের আলিম নামের লোকেরা মোটা অংকের বিনিময়ে মাহফিল করে। এডভান্স নেয়। ফুল পেমেন্ট না করলে মাহফিলে যায় না। আবার নিজেদেরকে দ্বীনের দাঈও মনে করে। কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করলে বলে, ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ারদের, উকিল এদের উদাহরণ টানে। বলে, তাদের থেকে টাকা দিয়ে পরামর্শ নিলে আলিমদের থেকে নিতে কী সমস্যা?
সমস্যা যে কী তা তো আল্লাহই বলে দিয়েছেন। উপরোক্ত লোকেরা কেউই আখিরাতের অংশ পাওয়ার জন্য এই কাজ করেন না। যেসব আলিম দ্বীনের দাওয়াত ও নসিহতকে অন্যান্য পেশার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন তারা নিজেকে দাঈ বলা থেকে বিরত হন। নিজেকে মোটিবেশনাল বক্তা হিসেবে পরিচিত করুন। কেউ কেউ তো নিজেদেরকে কনসার্টের আর্টিস্টদের সাথেও তুলনা করেন। ভালো কথা! আপনারা নিজেদেরকে কনসার্ট/ যাত্রার বিনোদন কর্মী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করুন। এই পরিচয়ে পরিচিত হলে আমাদের কোনো কথা নাই।
নিজেদের আলিম দাবি করবেন, মুফাসসির, মুফতি, মুহাদ্দিস, ইসলামিক স্কলার এসবে পরিচিত হবেন আর আয়াত বেচে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন তা হতে দেয়া ঠিক হবে না।
ওয়াজের মৌসুম আসছে। এখন শুরু হবে আলেম নামধারী বহু লোকের ইহুদী আচরণ। তাদের ব্যপারে সাবধান থাকুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এদের থেকে হিফাজত করুন। ইহুদি কালচার থেকে আমাদের আলিমদের হিফাজত করুন। আল্লাহর আয়াত বেচা জাহান্নামের আগুন খাওয়া লোকদের থেকে ইলম অর্জন করতে যাবেন না।
আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন