হুসাইন রা. তার পরিবারসহ শ'খানেক সঙ্গী সাথীদের নিয়ে কারবালায় পৌঁছলেন। সেখানে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে তাঁর দেখা হয়। এই বাহিনীর নেতা ছিলেন হুর বিন ইয়াজিদ। তিনি হুসাইন রা.-কে বললেন, আমীর উবাইদুল্লাহ আপনাকে তার কাছে যেতে বলেছেন অথবা আমিরুল মু'মেনিন ইয়াজিদের বাইয়াত গ্রহণ করতে বলেছেন।
হুসাইন রা. তাকে বুঝালেন কেন তিনি এই পথ গ্রহণ করেছেন। কেন ইয়াজিদের শাসন ও ক্ষমতা গ্রহণ বৈধ নয়। একইসাথে তিনি হুরকে কুফা থেকে পাঠানো চিঠিগুলো দেখিয়েছেন। এসময় যোহরের নামাজের ওয়াক্ত হলো। হুসাইন রা. হুরকে বললেন, তুমি কি তোমার সঙ্গীদের নিয়ে আলাদা নামাজ পড়বে? হুর বললো, অবশ্যই নয়। আপনি ইমামতি করুন। আপনার পেছনে আমরা নামাজ পড়বো।
নামাজ শেষে হুসাইন রা. সবার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। এরপর তিনি যাত্রা শুরু করতে চাইলে হুর আবারো বাধা দিল। সে বললো, আমি আমার কর্তব্য পালন করবো। আপনাকে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া আমার কাজ। আমি আপনার পিছু ছাড়বো না।
হুসাইন রা. তার সঙ্গীদের অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন। তখন হুর পথ আগলে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি নবিজীর নাতি না হলে এতক্ষণে আপনাকে ধুলিস্যাত করে ফেলতাম। হুসাইন রা. বললেন, আমি চাইনা তোমার মা পুত্রহারা হোক। হুর বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি এই কথার প্রতিশোধ নিতাম। কিন্তু আমি আপনাকে সম্মান করি। আপনি যদি আমার সাথে ইবনে যিয়াদের কাছে না যেতে চান তবে কুফা ভিন্ন অন্য পথ ধরুন। আমি এই বিষয়ে ইবনে যিয়াদের কাছে পত্র লিখবো।
এদিকে ইয়াজিদ বুঝতে পেরেছে অগ্রবর্তী বাহিনী যদি হুসাইন রা.-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং ঐ অঞ্চলের গোত্রগুলো হুসাইন রা.-এর সাথে যুক্ত হয়ে যাবে। এখন হুসাইন রা. পরিবার নিয়ে সেনাবাহিনী ছাড়া রয়েছে। তাই সে হুরকে চিঠি লিখেছে তার মূলবাহিনী না আসা পর্যন্ত যাতে হুসাইন রা.-কে আক্রমণ বা তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়। শুধু গতিরোধ করাই তার কাজ হবে।
এদিকে ইয়াজিদের নির্দেশে বসরা ও কুফার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ উমর বিন সা'দের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন হুসাইন রা.-কে বশ করার জন্য। ইবনে যিয়াদ উমরকে নির্দেশ দেন যাতে হুসাইন রা.-কে পানির উৎসের কাছে যেতে বাধা দেওয়া হয়। এতে হুসাইন রা. সহজে আত্মসমর্পন করবে এবং উসমান রা.-কে পানি না দেওয়ার প্রতিশোধ নেওয়া হবে। উমর বিন সা'দ ও তার সৈন্যরা এসে হুসাইন রা.-কে ঘিরে ফেললো এবং তাদেরকে পানি সংগ্রহে বাধা দিল।
হুসাইন রা. উমর বিন সা'দকে আলোচনার জন্য আহ্বান করলেন। সেখানে তিনি প্রস্তাব করলেন তিনি কুফা যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন যদি তাকে দামেশকে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকী আলোচনা তিনি ইয়াজিদের সাথে করবেন। উমর বিন সা'দ রাজি হলো না। পরে তিনি অন্যদিকে অর্থাৎ তুর্কি অঞ্চলের দিকে যেতে চাইলে উমর চিঠি দিল ইবনে যিয়াদের কাছে।
ইবনে যিয়াদ রাজি হয়নি। ইবনে যিয়াদ দুটো কথা বললেন, হয় হুসাইন রা.-কে ইবনে যিয়াদের কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে নতুবা যুদ্ধ করতে হবে। এভাবে কয়েকদিন চলে গেল আলোচনা করতে। এদিকে পানির অভাবে হুসাইন রা.-এর তাঁবুতে হাহাকার পড়ে গেল।
৬১ হিজরির মহররম মাসের ৯ তারিখ আসরের নামাজের পর উমর বিন সা'দ হুসাইন রা.-এর দিকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলো। এসময় তাঁবুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ছিলেন হুসাইন রা.। তাঁর তন্দ্রা এসে গেল। ইয়াজিদ বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবর দেওয়ার জন্য হুসাইন রা.-এর বোন তাঁকে জাগিয়ে দিলে তিনি বললেন, স্বপ্নে আমি রাসূল সা.-কে দেখছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তো আমাদের কাছে চলে আসছো! এই কথা শুনে বোন চিৎকার করে বলে উঠলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য! হুসাইন রা. বললেন, তোমার কোনো দুর্ভাগ্য নেই। তুমি শান্ত হও।
এরপর আব্বাস বিন আলী এসে বললো, ভাইজান! আমাদের শত্রুরা তো এসে পড়েছে। হুসাইন রা. উঠে তাদের কাছে কয়েকজন সঙ্গীকে পাঠিয়ে তাদের মনোভাব বুঝতে বললেন। তারা গেলেন ও জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কী চাও? উমর বিন সা'দ বললো, আমরা আমাদের আমীরের নির্দেশে এসেছি। হয় তোমরা আত্মসমর্পন করবে নতুবা আমাদের সাথে লড়াই করবে। হুসাইন রা.-এর প্রতিনিধিরা ফিরে এসে তাঁকে জানালে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন, আজ তোমরা ফিরে যাও। রাতে চিন্তা করে কালকে তোমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো। উমর বিন সা'দ বললো, ঠিক আছে, তবে কাল অবশ্যই আমরা লড়াই করবো।
রাত নেমে এলে হুসাইন রা. তাঁর সঙ্গীদের ডাকলেন। বক্তব্য রাখলেন। রাষ্ট্রের ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা জানালেন। ইস্তেগফার করলেন। তারপর সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললেন, তারা আমাকে চায়। আমি তাদের কাছে আত্মসমর্পন করবো না এবং আমি কখনো অবৈধ শাসকের অনুগত হবো না। আর তোমাদের ব্যাপারে আমার কথা হলো তোমরা যে যার মতো চলে যাও। আমি তোমাদের অনুমতি দিলাম। এখানে থাকা মানে নিশ্চিত মৃত্য। তোমরা অন্ধকার থাকতেই ফিরে যাও পরিবারসহ।
তখন সবাই প্রতিবাদ করে বললেন, আপনি ভিন্ন আমাদের অস্তিত্ব নেই। আমরা কেউ আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনার সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। আপনি আমাদের নেতা। তারপরও হুসাইন রা. তার আত্মীয়দের ডেকে ডেকে বুঝালেন তারা যেন চলে যায়। তবে কেউ যায়নি। সবাই দৃঢ়ভাবে হুসাইন রা. পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা সারারাত ইবাদতে কাটালেন।
১০ মহররম সকালে হুসাইন রা. উমর বিন সা'দের দলের উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য রাখলেন। তাদেরকে সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে আসার অনুরোধ করলেন। এসময় হুর বিন ইয়াজিদ উমরকে বললেন, তোমরা কি হুসাইন রা.-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? উমর বললো, অবশ্যই যতক্ষণ না তাদের সবার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন না হয়! তখন সে বললো, আল্লাহর শপথ। আমি জাহান্নাম ও জান্নাতের মাঝামাঝি আছি। আর আমি অবশ্যই জাহান্নাম থেকে জান্নাতকে প্রাধ্যান্য দেব। এরপর হুর বিন ইয়াজিদ তার কিছু সৈন্যকে নিয়ে হুসাইন রা.-এর দলে যোগ দিল। যাওয়ার সময় উমরের বেশ সমালোচনা করলেন হুসাইন রা.-এর পানি আটকানোর জন্য।
এরপর রেওয়াজ অনুযায়ী দুইদলের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হলো। এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে হুসাইন রা.-এর সঙ্গীরা জিতে গেল। এরপর শুরু হলো অসম যুদ্ধ। একে একে হুসাইন রা.-এর সৈন্যরা বহু শত্রু সৈন্যকে শেষ করে শাহদাতবরণ করতে লাগলেন। সব সামর্থবান পুরুষ শাহদাতবরণ করলেন। বাকী রইলেন কেবল হুসাইন রা.। বহু শত্রু সৈন্য তার হাতে নিহত হলেন। একপর্যায়ে শত্রুরা সবাই তাঁর তলোয়ারের এরিয়া থেকে দূরে চলে গেল। দূর থেকে তারা রাসূল সা.-এর কলিজার প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। তিনি আহত অবস্থায় পড়ে যান। অতঃপর শাম্মার ইবনে জুল জাওশানের নেতৃত্বে একটি দল হুসাইন রা.-এর মাথা কেটে আনলো।
মারাত্মক হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালালো ইয়াজিদের বাহিনী। সমস্ত বালকদের হত্যা করা হলো একমাত্র জাইনুল আবেদিন ছাড়া। তিনি অসুস্থ ছিলেন। এই অসুস্থতার কারণে সন্ত্রাসীরা তাঁকে খুন করেনি। তিনি হুসাইন রা.-এর সন্তান। বাকী নবী পরিবারের সব সদস্যকে এইদিন খুন করা হয়েছে। নবী পরিবারের ২৩ জন পুরুষকে এইদিন হত্যা করা হয়।
উমর বিন সা'দ নবী পরিবারের এই সদস্যদের কাটা মাথা উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে নিয়ে আসে। সে তার সামনে প্লেটে করে এক মাথাগুলো উপস্থাপন করায় এবং লাঠি নিয়ে হুসাইন রা. মাথায় আঘাত করেছেন ও সৌন্দর্য নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। উপস্থিত এক বৃদ্ধ সাহাবি যায়দ বিন আরকাম রা. এর প্রতিবাদ করলে ইবনে যিয়াদ তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
আটক নারী ও শিশুদের এক দড়িতে বেঁধে বেশ অপদস্ত করে নিয়ে আসা হয় কুফায়। সেখানে জাইনুল আবেদিনকে দেখতে পেয়ে ইবনে যিয়াদ ক্ষেপে গেল। কেন তাকে হত্যা করা হলো না এই নিয়ে হইচই শুরু করলো। জাইনুল আবেদিন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে কিনা তা চেক করার জন্য তাকে উলঙ্গ করে ফেলা হয়। যখন নিশ্চিত হলো তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন তখন তাকে খুন করার আদেশ দেয়। এসময় হুসাইন রা.-এর বোন জয়নাবের হৃদয়বিদারক আহাজারিতে ইবনে যিয়াদ অবশেষে খুন করা থেকে বিরত থাকে।
ইবনে যিয়াদ এই মাথাগুলো নিয়ে কুফার মসজিদে গিয়ে আল্লাহ বিজয় দিয়েছেন ও শত্রুদের ধ্বংস করেছেন উল্লেখ করে উল্লাস করে। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আফিফ এর প্রতিবাদ করেন এবং তুমি নবীর সন্তানদের হত্যা করেছ আর ভাষণ দিচ্ছো আলেমদের মতো! এই অপরাধে আব্দুল্লাহকে শূলবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। এরপর কুফার বাজারে হুসাইন রা. -এর মাথার প্রদর্শনীর আয়োজন করে। আব্দুল্লাহর পরিণতি দেখে কেউ এর প্রতিবাদ করেনি।
অতঃপর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ সবগুলো মাথা দামেশকে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার কাছে পাঠিয়ে দেয়। ইয়াজিদও কুফার গভর্নরের মতো হুসাইন রা.-এর কাটা মাথার সাথে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ও বেয়াদবি করে। তবে সে আটক মহিলাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। তাদের মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
হুসাইন রা. ইয়াজিদের আনুগত্যের পরিবর্তে আল্লাহর আনুগত্যকেই বেছে নিলেন। কারণ তিনি নিজেই দোয়া করতেন, "হে আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত আমি তোমার আনুগত্য করি অনুসরণ করি, ততদিন আমার হায়াত বাড়িয়ে দিও। আর যদি তা শয়তানের চারণভূমিতে পরিণত হয় তাহলে আমাকে তোমার কাছে তুলে নিও।"
হুসাইন রা. তার সঙ্গী সাথীসহ সবাইকে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তবু ইয়াজিদের শাসনক্ষমতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেননি। ইয়াজিদ প্রায় ৫ সহস্রাধিক সেনাবাহিনী নিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে হুসাইন রা.-এর ক্ষুদ্র ঈমানদার ১শ জন সাহাবীকে শহীদ করে তার ক্ষমতা সাময়িকভাবে রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চিরদিনের জন্য তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের তথা সত্যপ্রেমীদের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। আর হুসাইন রা. অন্যায়ের প্রতিবাদ করে জীবন দিয়ে শাহাদাত বরণ করে ইহকাল ও পরকালে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। আজো যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনগণের সমর্থন না নিয়ে ক্ষমতা দখল করে অন্যায় নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের জন্য এ ঘটনা অবশ্যই শিক্ষণীয়। যদি তাদের কপালে হিদায়াত থাকে তবেই তারা শিক্ষা নিতে পারবে। নতুবা তারাও বরণ করবে ইয়াজিদের পরিণতি।
এই কারবালার ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা হলো এর স্মরণের মাধ্যমে অন্যায় ও অবৈধ শাসকের কাছে মাথা নত না করা। আজকেও আমাদের দেশে আমাদের ওপর চেপে বসেছে অবৈধ শাসক। এই শাসকের বিরোধীতা করে জনগণের রায়ের সরকার প্রতিষ্ঠা করাই কারবালার শিক্ষা। এই শিক্ষা নিতে না পারলে কারবালা স্মরণ করা বৃথা। হুসাইন রা. তার বক্তব্যে কখনো ইয়াজিদের অযোগ্যতা নিয়ে কথা তুলেননি। বরং তিনি শুরার রায়ে শাসক নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন