মুহাম্মদ সা. যখন হুদায়বিয়ার সন্ধি শেষ করে ফিরছিলেন তখন আল্লাহ তায়ালা সূরা ফাতহ নাজিল করলেন। সেখানে আল্লাহ তায়ালা এই সন্ধিচুক্তিকে মহাবিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সেই সাথে একটি সুসংবাদ দিয়েছেন অচিরেই মুসলিমরা যুদ্ধ করবে ও বিপুল সম্পদের মালিক হবে। কিন্তু সেসময় ছিল জিলহজ্ব মাস। যুদ্ধ নিষিদ্ধ। তাই সেই মাসে নতুন করে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেননি মুহাম্মদ সা.। তবে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।
এদিকে জিলহজ্বের পরের মাস মহররমেও যুদ্ধ নিষিদ্ধ আরব রেওয়াজ অনুসারে। মুহাম্মদ সা. এই দুই মাসে আরবে সরাসরি তাবলিগ ও তারবিয়াতে ব্যস্ত ছিলেন। আর প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন সারা বিশ্বের শাসকদের কাছে। সেখান থেকে বেশ ভালো খবর পাওয়া গেল। ৭ম হিজরির ১ম মাস মহররমের শেষ দিকে মুহাম্মদ সা. খায়বারে ইহুদিদের শায়েস্তা করার জন্য বের হলেন।
খন্দকের যুদ্ধে মদিনার মুসলিমরা যে বেকায়দায় পড়েছিলো এর জন্য মূলত দায়ি খায়বারের ইহুদিরা। তারাই কুরাইশ, বনু গাতফান, বনু কুরাইজাকে একত্র করে সম্মিলিত মুশরিক বাহিনী তৈরি করেছিল। আল্লাহর সাহায্যে খন্দকে বিজয় আসলে মুহাম্মদ সা. নজদের বনু গাতফানকে ও মদিনার বনু কুরাইজাকে শায়েস্তা করলেও মুসলিমদের ওপর আক্রমনের মূল কারিগর খায়বারের ইহুদিদের কিছু করতে পারেন নি। এর কারণ খায়বারের দুর্গ শক্তিশালী। সেখানে যদি মুহাম্মদ সা. মূল ফোর্স নিয়ে যায় তাহলে মদিনা অরক্ষিত হয়ে পড়ে ও মক্কার দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়।
যেহেতু সন্ধি হয়ে আছে তাই মক্কার দিক থেকে ইসলামী রাষ্ট্র মদিনা এখন নিরাপদ। তাই মুহাম্মদ সা. কালবিলম্ব না করে মুহররমের শেষ দিকেই রওনা হলেন। যাতে মুহররম শেষ হলেই খায়বার অধিকার করা সম্ভব হয়। খায়বার বিজয় ছিলো আল্লাহর ওয়াদা। তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যুদ্ধলব্ধ বিপুল সম্পদের, যার অধিকারী হবে তোমরা। তিনিতো তোমাদের জন্য ত্বরান্বিত করেছিলেন।“ [সূরা ফাতহ, আয়াত ২০]
'তা তোমাদের জন্য ত্বরান্বিত করেছেন' বলে হুদায়বিয়ার সন্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। আর 'যুদ্ধলভ্য বিপুল সম্পদ' বলতে খায়বারের কথা বোঝানো হয়েছে। এই যুদ্ধজয় যেহেতু সন্ধির মাধ্যমে হবে তাই হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় উপস্থিত থাকা ব্যক্তিরাই খায়বার অভিযানে জয়েন করেতে পারবে। আল্লাহ এই শর্ত দিয়েছেন। হুদাইবিয়া সন্ধির প্রাক্কালে যখন মুহাম্মদ সা. সবাইকে হজ্ব করার জন্য প্রস্তুত হতে বললো, তখন কিছু মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানের মুসলিম মদিনায় থেকে গেছে। তারা আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাথী হয়নি।
এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে সে সম্পর্কে আদেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে, তখন যারা ঘরে রয়ে গিয়েছিলো, তারা বলবে, আমাদেরকে তোমাদের সঙ্গে যেতে দাও। ওরা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন করতে চায়। বলো, তোমরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গী হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা পূর্বেই এরূপ ঘোষণা করেছেন। ওরা বলবে, তোমরা তো আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছো। বস্তুত ওদের বোধশক্তি সামান্য।“ [সূরা ফাতহ, আয়াত ১৫]
মুহাম্মদ সা. খায়বার অভিমুখে যাত্রা হওয়ার সময় ঘোষণা করলেন যে, তাঁর সাথে শুধু ওসকল লোকই যেতে পরবে, যাদের প্রকৃতই জিহাদের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। এ ঘোষণার পর শুধুমাত্র তারাই যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো, যারা হুদায়বিয়াতে গাছের নিচে বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশ নিয়েছিলো। এদের সংখ্যা ছিলো প্রায় আঠারশত।
এ সময় ইহুদীদের সাহায্যার্থে মুনাফিকরা যথেষ্ট ছুটোছুটি করেছে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আগেই খায়বারে খবর পাঠিয়েছিলেন যে, মুহাম্মদ তোমাদের ওদিক যাচ্ছেন, সতর্ক হয়ে যাও। প্রস্তুত হও, ভয় পেয়ো না যেন। তোমাদের সংখ্যা এবং অস্ত্র শস্ত্র তো অনেক। মোহাম্মদের সঙ্গীদের সংখ্যা বেশি নয়, তাও তারা নিঃস্ব। তাদের কাছে যেসব অস্ত্র রয়েছে, তাও খুব সামান্য। খায়বারের অধিবাসীরা এই খবর পাওয়ার পর বনু গাতফান গোত্রের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলো। বনু গাতফান গোত্র ছিলো খায়বারের ইহুদিদের মিত্র। তবে তারা শুরুতে রাজি হয়নি কারণ মুহাম্মদ সা.-এর বিরোধীতা করায় তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তারপর ইহুদিরা বনু গাতফানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, তাদের সাহয্যে মুসলমানদের ওপর জয়লাভে সক্ষম হলে খায়বারের মোট উত্পাদনের অর্ধেক বনু গাতফানকে দেওয়া হবে। এরপর বনু গাতফান রাজি হয়।
একদিন রাতে মুহাম্মদ সা. খায়বারে পোঁছালেন। সেদিন খুব ভোরে কিছুটা অন্ধকার থাকতে তিনি সবাইকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করেন। এরপর মুসলমানরা সওয়ার হয়ে খয়বরের দিকে অগ্রসর হন। খয়বরের অধিবাসীদের অনেকেই কাঁধে কোদাল নিয়ে ক্ষেতে খামারে কাজ করতে বেরিয়েছিলো। হঠাৎ মুসলিম সেনাদের দেখে চিত্কার করে পালাতে লাগলো। চিত্কার করে করে তারা বলছিলো, খোদার কসম, মুহাম্মদ সসৈন্যে হাজির হয়েছেন।
এদিকে বনু গাতফান ৪০০০ সেনা নিয়ে রওনা হলো। তারা রওনা হওয়ার পর নজদে কী একটা নিয়ে হইচই হলো। গাতফানের সৈন্যরা ভাবলো মুসলিমরা তাদের এলাকায় আক্রমণ করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বনু গাতফানের সৈন্যরা ফিরে যায় তাদের বাড়িঘর রক্ষা করতে। এভাবে তারা খায়বারের ইহুদিদের সহায়তা করতে পারেনি।
মুহাম্মদ সা. দুর্গ আক্রমণ করার আগে একস্থানে তাঁবু করতে চাইলেন। তখন হাব্বাব ইবনে মুনজির রা. এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর আদেশে আপনি এখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নাকি রণ-কৌশলগত কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? তিনি বললেন, রণ-কৌশলগত কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একথা শুনে হাব্বাব রা. বললেন, এই স্থান নাজাত দুর্গের খুব কাছে। ওরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারবে, অথচ আমরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবো না। ফলে তারা তাদের কৌশল আমাদের উপর প্রয়োগ করতে পারবে, তাদের নিক্ষিপ্ত তীর আমাদের কাছে পৌঁছবে অথচ আমাদের নিক্ষিপ্ত তীর তাদের কাছে পৌঁছবে না। রাতের বেলা তারা আমাদের ওপর আকস্মিক হামলা চালাতে পারে, এ আশঙ্কাও পুরোপুরি থেকে যাবে। এছাড়া এ জায়গার চারিদিকে খেজুর বাগান, জায়গাটা নিচু। কাজেই এই সব সমস্য যেখানে নেই, সেই রকম একটা জায়গায় অবস্থানের ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।
মুহাম্মদ সা. বললেন, তুমি যে অভিমত প্রকাশ করেছো তা সঠিক। এরপর রাসূল সা. সাহাবাদের থামতে বললেন। সবাইকে নিয়ে মুহাম্মদ সা. আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। কল্যাণ কামনা করলেন, অকল্যাণ থেকে পানাহ চাইলেন। দোয়া শেষে সেনাবাহিনীকে অগ্রসর হতে বললেন। এরপর উপযুক্ত স্থানে অবস্থান নিলেন। মুহাম্মদ সা. বললেন, আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে যুদ্ধের পতাকা দেব যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ এবং তাঁর রসূলও তাকে ভালোবাসেন। সাহাবারা আল্লাহর রাসূলের সামনে হাজির হলেন। সবাই পতাকা পাওয়ার জন্যে মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করছিলেন। মুহাম্মদ সা. বললেন, আলী ইবনে আবু তালিব কোথায়?
সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা.! তার চোখ উঠেছে। তাই তিনি পেছনে বসে রইলেন। মুহাম্মদ সা. বললেন, তাকে নিয়ে এসো। আলী রা.-কে নিয়ে আসা হলো। মুহাম্মদ সা. তাঁর চোখে সামান্য থুথু লাগিয়ে দোয়া করে দিলেন। আলী রা. এমন সুস্থ হয়ে গেলেন যে, মনে হলো তার চোখের অসুখ ছিলোই না। এরপর আলী রা.-কে পতাকা প্রদান করা হয়। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ওদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়বো, যতক্ষণে তারা আমাদের মতো হয়ে যায়।
খায়বারে ছিল ইহুদিদের শক্ত ঘাঁটি। এখানে আটটি দুর্গ রয়েছে। প্রতিটি দুর্গই শক্তিশালী। আগে মুহাম্মদ সা. মদিনার তিনটি ইহুদি গোত্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারা কেউ শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে সাহস পায়নি। এখানের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তারা সংখ্যায় ছিল ১০০০০ যোদ্ধা। আটটি শক্তিশালী দুর্গ। বহু যুদ্ধ সরঞ্জাম। এবার তারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
আটটি দুর্গের মধ্যে প্রথম নাইম দুর্গ অবরোধ করে মুসলিমরা। এই দুর্গের নেতা ছিল মারহাব। বীর হিসেবে তার খ্যাতি ছিল অনেক। আলী ইবনে আবু তালেব রা. মুসলমান সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে এ দুর্গের সামনে গিয়ে ইহুদিদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো। নিজেদের নেতা মারহাবের নেতৃত্বে তারা মুসলমানদের মোকাবেলায় এসে দাঁড়ালো। রণাঙ্গনে এসে মারহাব মুখোমুখি দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানালো। মুসলিমদের পক্ষ থেকে এগিয়ে গেল আমের রা.। একপর্যায়ে আমের রা. আহত হয়ে ফিরে এলেন। এবার এগিয়ে গেলেন আলী রা.। তিনি মারহাবকে হত্যা করে ফেললেন। মুসলিমরা তাকবির ধ্বনি দিল। তারপর যুদ্ধ শুরু হলো ইহুদিদের সাথে। কয়েকদিন যুদ্ধ করার পর ইহুদিরা রণে ভঙ্গ দিয়ে দুর্গ থেকে নেমে পেছেনের আরেক দুর্গে আশ্রয় নিল। নায়েম দুর্গ জয় হলো।
নাইম দুর্গ জায়ের পর সায়াব দুর্গ ছিলো নিরাপত্তা ও শক্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দুর্ভেদ্য দুর্গ। মুসলমানরা হাব্বাব ইবনে মুনজির আনসারি রা.-এর নেতৃত্বে এ দুর্গ হামলা করেন এবং তিনদিন যাবত অবরোধ করে রাখেন। তৃতীয় দিনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুর্গ জয়ের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা, ইহুদীদের এমন দুর্গ জয় করিয়ে আামদের সাহায্য করো যে দুর্গ জয় আমাদের জন্যে সর্বাধিক ফলপ্রসূ হয়, যে দুর্গে সবচেয়ে বেশী খাদ্য-সামগ্রী ও চর্বি পাওয়া যায়। আল্লাহর রসূলের এই দোয়ার পর সাহাবারা হামলা করলেন। আল্লাহ তায়ালা এবার সায়াব দুর্গ মুসলিমদের অধিকারে এনে দিলেন। এ দুর্গের চেয়ে অধিক খাদ্যদ্রব্য এবং চর্বি খায়বারের অন্য কোন দুর্গে ছিলো না। এছাড়াও অস্ত্র শস্ত্রো অনেক পাওয়া গেছে।
এরপর সকল ইহুদিরা যুবায়ের দুর্গে সমবেত হয়। এটি ছিলো একটি নিরাপদ ও সংরক্ষিত দুর্গ। পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত এই দুর্গে উঠার পথ ছিলো খুবই কঠিন। কোন সওয়ারি নিয়ে ওঠাতো সম্ভবই ছিলো না পায়ে হেঁটে ওঠাও ছিলো খুবই কষ্টসাধ্য। মুহাম্মদ সা. তিনদিন পর্যন্ত দুর্গ অবরোধ করে রাখেন। এরপর রাসূল সা.-এর একজন গোয়েন্দা যিনি ঈমান গোপন করে ইহুদীদের সাথে ছিলেন তিনি খবর দিলেন, যদি একমাস যাবত দুর্গ অবরোধ করে রাখা হয়, তবুও ইহুদিরা পরোয়া করবে না। তবে তারা নিচের ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে। রাতের বেলা তারা এসে পানি পান করে এবং সারাদিনের প্রয়োজনীয় পানি তুলে নিয়ে যায়। আপনি যদি ওদের পানি বন্ধ করে দিতে পারেন, তবে তারা নত হবে। এ খবর পেয়ে মুহাম্মদ সা. ওদের পানি বন্ধ করে দিলেন। ইহুদীদের তখন টনক নড়লো। তারা নিচে নেমে এসে প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হলো। এতে কয়েকজন মুসলমানও শাহাদাত বরণ করলেন। ইহুদিদের অনেকে মৃত্যুবরণ করলো। সবশেষে এ দুর্গেরও পতন হলো।
যুবায়ের দুর্গের পর ইহুদিরা উবাই দুর্গে গিয়ে সমবেত হয়। মুসলমানরা সেই দুর্গও অবরোধ করেন। এবার শক্তি গর্বে গর্বিত দুইজন ইহুদি পর্যায়ক্রমে প্রতিপক্ষকে মুকাবিলার আহ্বান জানায়। উভয়েই মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। দ্বিতীয় ইহুদির হত্যাকারী ছিলেন লাল পট্টিধারী বিখ্যাত যোদ্ধা সাহাবী আবু দোজানা রা.। তিনি দ্বিতীয় ইহুদিকে হত্যা করে দ্রুত বেগে দুর্গে প্রবেশ করেন। তাঁর সাথে সাহাবারাও ভেতরে গিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে। কিছুক্ষণ তুমুল যুদ্ধের পর ইহুদিরা দুর্গ থেকে সরে যেতে শুরু করে। যুবায়ের দুর্গের পতন হলো।
অবশেষে ইহুদিরা সবাই গিয়ে নেজার দুর্গে সমবেত হয়। এ দুর্গও ছিলো সুরক্ষিত ও নিরাপদ। ইহুদিদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে, মুসলমানরা মর্বাত্মক চেষ্টা করেও এ দুর্গে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই এতে তারা নারী ও শিশুদের সমবেত করেছিলো, অন্য কোন দুর্গে নারী-শিশুদের রাখেনি। মুসলমানরা এ দুর্গে কঠোর অবরোধ আরোপ এবং ইহুদীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। একটি উঁচু পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত এ দুর্গে প্রবেশে মুসলমানরা সুবিধা করতে পারলেন না। ইহুদীরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে মুসলমানদের সাথে মোকাবেলা করতেও সাহস পাচ্ছিল না। তবে উপর থেকে তীর নিক্ষেপ এবং পাথর নিক্ষেপ করে তীব্র মোকাবেলা করে যাচ্ছিলো।
নেজার দুর্গ জয় কঠিন হওয়ায় মুহাম্মদ সা. ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েনের নির্দেশ দেন। কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করা হয়। এতে দুর্গের দেয়ালের এক স্থানে ফাটল ধরে ও ভেঙে যায়। সেই ছিদ্রপথে মুসলমানরা ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর দুর্গের ভেতরে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ইহুদিরা পরাজিত হয়। অন্যান্য দুর্গের মতোই এ দুর্গ থেকেও ইহুদীরা চুপিসারে সটকে পড়ে। নারী ও শিশুদেরকে মসলমানদের দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে তারা নিজেদের প্রাণ রক্ষা করে।
অবশেষে কঠোরভাবে প্রহরায় পরিবেষ্টিত কামুস দুর্গে তারা অবস্থান নেয়। যা মুসলিমগণ ১৩তম থেকে ১৯তম দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রেখেছিলেন। কামুস দুর্গ দখলের জন্য একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিমদের বেশ কিছু উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। মুহাম্মদ সা. আলী রা.-কে বিশেষভাবে নির্দেশ দিলেন জোরালো আক্রমণ করতে। তিনি কিল্লার নিচে একটা পাথর স্তুপের মধ্যে পতাকা স্থাপন করলেন। উপর থেকে একজন ইহুদি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে?” তিনি বললেন, “আমি আবু তালিবের পুত্র আলী।” ইহুদি বললো “তাওরাতের শপথ! তোমরা বিজয়ী হয়েছো।”
আলী রা. দুর্গের নিকট পৌঁছুলে ইহুদি সেনাদল দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো এবং যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ চলাকালে এক ইহুদির আঘাতে আলী রা. তার ঢাল হারিয়ে ফেলেন। বিকল্প হিসেবে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি দেয়াল থেকে টান দিয়ে বিশাল একটি দরজা তুলে নেন। দরজাটি এতোই ভারি ছিল যে পুনরায় একে এর কব্জায় বসানোর জন্য আটজন লোককে মিলে এটিকে তুলতে হয়েছিল। এই বিশাল দরজা যখন এক হাতে নিয়ে ফেললেন আলী রা. তখন ইহুদিরা ব্যাপক ভয় পেল। তারা রণে ভঙ্গ দিল। এভাবে যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিমদের বিজয় অর্জিত হয়। নবী মুহাম্মাদ সা. আলী রা.-কে 'আসাদুল্লাহ' উপাধি দিলেন।
কামুস দুর্গের মধ্য দিয়ে আটটি দুর্গের মধ্যে ৬ টির পতন হলে ইহুদিরা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিল। শর্তসমূহ আলোচনা করার জন্য ইহুদি নেতারা মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করলো। অবশিষ্ট দুই দুর্গ আল ওয়াতি এবং এবং আল সুলাইম গোত্রের লোকেরা মুসলিমদের কাছে এই শর্তে আত্মসমর্পণ করল যে তাদের প্রতি সদয় আচরণ করা হবে এবং মুসলিমগণ তাদের রক্তপাত করা থেকে বিরত থাকবে। মুহাম্মাদ উক্ত শর্তসমূহ মেনে নিলেন এবং উক্ত দুই দুর্গ থেকে কোন মালামাল ও সম্পদ অধিগ্রহণ করলেন না।
সন্ধির আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় মুসলিমরা সকল ইহুদি সৈন্যকে মুক্তি দেবে। তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরও মুক্তি দেওয়া হবে। সকল ঘোড়া, অস্ত্র ও সম্পদ তারা রেখে যাবে। শুধু পরিধেয় বস্ত্র ও সওয়ারি (উট-গাধা) তারা নিয়ে যেতে পারবে। এভাবে ইহুদিরা নিজেদের আত্মসমর্পন করে ও খায়বারে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের বিজয় দান করেন।
ইহুদি নেতা আবুল হাকিকের দুই পুত্র সন্ধির শর্ত লংঘন করে প্রচুর ধন-সম্পদ লুকিয়ে রাখে। একটি চামড়া তারা লুকিয়ে রাখে, সেই চামড়ার ভেতরে স্বর্ণমুদ্রা এবং হুয়াই ইবনে আখতাবের অলংকার সমূহ ছিলো। হুয়াই ইবনে আখতাব মদীনা বনু নাদিরের বহিষ্কারের সময় এসব অলংকার নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো।
আবুল হাকিকের পুত্ররা নিজেরা জীবন দেয় তারপরও সব লুকানো সম্পদের তথ্য দেয়নি। যা পরে উদ্ধার হয়েছিলো। হুয়াই বিন আখতাবের কন্যা সাফিয়্যা ছিল আবুল হাকিকের ছেলে কেনানার স্ত্রী। যেহেতু কেনানা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে তাই তার অধীনস্ত সাফিয়্যাকে আটক করা হয়। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সা. তাঁকে বিয়ে করেন।
মুহাম্মদ সা. ইহুদিদের খায়বার থেকে বহিষ্কারের ইচ্ছা করেন। চুক্তির মধ্যেও এটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ইহুদীরা সবশেষে বললো, হে মুহাম্মদ! আপনি আমাদের এই জমিনেই থাকতে দিন। আমরা এখানে চাষবাস করবো, তত্ত্বাবধান করবো। এই ভূখণ্ড সম্পর্কে আমরা আপনাদের চেয়ে বেশি অবগত। এদিকে মুহাম্মদ সা.-এর কাছে পর্যাপ্তসংখ্যক দাস ছিলো না, যারা এ জমি আবাদ এবং দেখাশোনা করতে পারে। এ কাজ করার মতো পর্যাপ্ত লোকজন সাহাবায়ে কেরামেরও নেই। এসব কারণে মুহাম্মদ সা. ইহুদিদের কছে খায়বারের জমি বর্গা হিসেবে দেন। উত্পন্ন ফসলের অর্ধেক মুসলমানরা পাবেন এ শর্তে দেওয়া হয়। মুহাম্মদ সা. যতদিন চাইবেন, ততদিন ইহুদিরা এ সুযোগ পাবে। আবার যখন ইচ্ছা করবেন তখন বহিস্কার করবেন। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা.-কে খায়বারের জমির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন।
খায়বারের জমির বন্টন এভাবে করা হয়েছিলো যে, মোট জমি ৩৬০০ ভাগে ভাগ করা হয়। এর অর্ধেক অর্থাৎ আঠরশত ভাগ ছিলো যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের। বাকি আঠারশত ভাগ মুহাম্মদ সা. মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন এবং জরুরি কোনো সমস্যা মোকাবেলার জন্য পৃথক করে রেখেছিলেন। আঠারশত ভাগে বিভক্ত করার উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, খায়বারের জমি ছিলো হুদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের জন্যে আল্লাহর বিশেষ দান।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন