১৯৪০ সালের কথা। তখন জাপান ছিল পরাশক্তিদের মধ্যে একটি। পৃথিবীর বেশিরভাগ সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা বেশ মরিয়া। ১৯৪১ সালে তারা আরেক পরাশক্তি আমেরিকার বিশাল নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারে আক্রমণ চালিয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। আমেরিকার ৮ টি বিশাল রণতরীর চারটি পুরোপুরি ডুবে যায়, বাকী চারটি ক্ষটিগ্রস্থ হয় মারাত্মকভাবে। সাড়ে তিনশ যুদ্ধ বিমান ধ্বংস হয় ও ২৩৩৫ জন আমেরিকান নেভি মৃত্যুবরণ করে।
এই আক্রমণ চালিয়ে সমুদ্রে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করে জাপান। জাপানকে সমীহ করতে থাকে সব পরাশক্তিগুলো। ১৯৪২ সালে আমরা তখন ইংল্যান্ডের অধীনে। জাপান মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরে থাকা ইংল্যাণ্ডের নৌঘাঁটি দখল করে ফেলে। বাকী থাকে ইংল্যান্ডের কলকাতা নৌ-ঘাঁটি। জাপান ইংল্যান্ডকে হুমকির ওপরে রাখছিল। ইংল্যান্ডের এই দিশেহারা অবস্থার সুযোগ নিয়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে 'ভারত ছাড়' আন্দোলন শুরু করে।
আমার ধারণামতে এই আন্দোলনই পাকিস্তান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। এই প্রথম উপমহাদেশের হিন্দুরা ইংল্যান্ডকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। যাই হোক জাপানের কলকাতা আক্রমণ ইংল্যান্ড ঠেকিয়েছে চীনের মাধ্যমে। পূর্ব চীন সাগরে আক্রমণ চালিয়ে চীন কোরিয়া উপদ্বীপে পৌঁছে গেলে জাপান সেদিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। হিন্দুস্থান জাপানের দৃষ্টি থেকে সরে যাওয়ার পর ইংল্যান্ড গান্ধী ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। ইংরেজদের ও হিন্দুদের মারাত্মক অবিশ্বাস তৈরি হয়। এই অবিশ্বাসকে পুঁজি করেই জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিমরা পাকিস্তান আদায় করে নেয়।
১৯৪৫ সালে বিশ্বে জাপান ও জার্মানীর জয়জয়কার। ২য় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে এই দুই পরাশক্তি ভালো অবস্থানে রয়েছে। এমন সময়ে আমেরিকা তাদের পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে। ১৯৪৫ সালের আগস্টে এই ঘটনা ঘটায় আমেরিকা। এটা শুধু জাপানকে নয়, সারাবিশ্বকে থমকে দিয়েছে। জাপান সারাবিশ্ব থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে সেপ্টেম্বরে আত্মসমর্পন করে।
বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান তার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পারমাণবিক শক্তি অর্জনের দিকে দৃষ্টিপাত করে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৫১ সালে আমেরিকার সাথে পারপমাণবিক চুক্তি করে পাকিস্তান। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য যে, সৃষ্টির পর পাকিস্তান আমেরিকাপন্থী ও ভারত সোভিয়েতপন্থী অবস্থান নেয়। তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার 'এটম ফর পিস প্রোগ্রাম' ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তান হচ্ছে এই প্রোগ্রামের প্রথম পার্টনার। পরমাণু শক্তি কেবল মানবজাতির কল্যাণে ব্যয় হবে এমন চুক্তিতে পাকিস্তান পারমাণবিক গবেষণা শুরু করে।
এর ধারাবাহিকতায় যখন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ক্ষমতায় ও বাঙালি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন পরমাণবিক গবেষণা নিয়ে পাকিস্তান সরকার 'পাকিস্তান এটমিক এনার্জি কমিশন' নামে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে। কমিশন স্পষ্ট উল্লেখ করে তারা কোনো অস্ত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখবে না। তারা খাদ্য সংরক্ষণ, বীজ সংরক্ষণ, নিউক্লিয়ার মেডিসিন ও ক্যান্সার চিকিৎসায় পারমাণবিক এনার্জি নিয়ে গবেষণা করবে।
অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তান পরমাণু এনার্জি নিয়ে কৃষি, শিল্প ও চিকিৎসায় সফলতা পেতে শুরু করে। মুলতানে নিউক্লিয়ার এনার্জি ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট স্থাপিত হয়। করাচিতে জিন্নাহ মেডিকেলে নিউক্লিয়ার ক্যান্সার ইউনিট চালু করা হয়। তিনটি ভার্সিটির সাথে সমন্বয় করে পাকিস্তান এটমিক এনার্জি কমিশনের ল্যাব স্থাপন করা হয়। পাঞ্জাব, লাহোর ও ঢাকা। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমন্বয় করে পাকিস্তান এটমিক এনার্জি কমিশনের ল্যাব স্থাপন করা হয়। এই ল্যাব এখন বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হয়। আইয়ুব খানের আমলে এই ল্যাবের জন্য কম্পিউটার আনা হয় এবং তা এখানে স্থাপন করা হয়। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম কম্পিউটার যা ঢাকায় ইন্সটল করা হয়।
১৯৫৯ সালে আইয়ুব খানের আমলে দু'টি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের পরিকল্পনা হয়। ১ম টি করাচিতে ২য় টি পাবনার রূপপুরে। পাবনার রূপপুরে এখন যে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট হচ্ছে তা মূলত ১৯৬১ সালের একনেকে পাশ হওয়া। জমি অধিগ্রহণ ও প্রাথমিক অনেক কাজ, লোক নিয়োগ ইত্যাদি বিষয় হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আইয়ুব খান পারমাণবিক বোমার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছেন। তিনি কয়েক ধাপে পাকিস্তানের সেরা ৬০০ ছাত্র শুধু এই বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার জন্য সারাবিশ্ব ছড়িয়ে দিয়েছেন। তবে যেহেতু পাকিস্তানের পুরো পারমাণবিক কার্যক্রমে আমেরিকা জড়িত তাই তিনি তাদের চোখ এড়িয়ে সুবিধা করতে পারেন নি। তবে তিনি এই গবেষণার জন্য ঢাকার ল্যাব ব্যবহার করেছেন।
অন্যদিকে পাকিস্তান এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ভারতও জোরালোভাবে পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিচ্ছিলো। তারা এই ব্যাপারে রাশিয়া থেকে সাহায্য পেয়েছিলো এবং পরমাণু অস্ত্রের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
পাকিস্তানে পরমাণু অস্ত্রের কাজ গোপনে চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালে প্রথম ভারত তাদের নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। এতে পাকিস্তান নিশ্চিত হয়ে যায়, অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ভারত পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে। আইয়ুবের সময় পরমাণু অস্ত্র প্রজেক্টের হেড ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম। তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলও পেয়েছেন। তবে তিনি সফলতা পাননি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান হেরে যাওয়ায় পাকিস্তানের ভয় তৈরি হয়।
যুদ্ধের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এই বিষয়ে নজর দেন। তখন পরমাণু অস্ত্র প্রজেক্টের প্রধান ছিলেন মুনির আহমেদ খান। ড. আব্দুল কাদির খান তখন নেদারল্যান্ডে একটি ফিজিক্স ল্যাবে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি আব্দুস সালামের সাথে জড়িত থাকায় এই গোপন প্রজেক্ট সম্পর্কে জানতেন। ড. আব্দুল কাদির খান এই বিষয়ে নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সাথে শেয়ার করেন। ভুট্টো তাকে পাকিস্তান এটমিক এনার্জি কমিশনের ডেপুটি হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন।
মুনির আহমেদ খানের প্ল্যান হচ্ছে প্লুটোনিয়াম(plutonium) এনরিচমেন্টের মাধ্যমে বোমা বানানো। আর এখানেই বিপত্তি তৈরি হয় কাদির খানের সাথে। কাদির খানের বক্তব্য হলো প্লুটোনিয়াম নয় ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্টের মাধ্যমেই সম্ভব বোমা বানানো। এটা নিয়ে সমস্যা তৈরি হলো এবং তা সরকার পর্যন্ত গড়ালো। সরকার ছিল মরিয়া। এদিকে ১৯৭৪ সালে ভারত তাদের প্রথম নিউক্লিয়ার অস্ত্র 'স্মাইলিং বুদ্ধ' পরীক্ষা চালায়। যদিও তারা এটাকে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের ঘোষণা দেয়। মরিয়া হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো উভয়কেই তাদের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করার সুযোগ করে দেয় এবং টাকা ঢালে। অবশেষে আব্দুল কাদির খান সফলতা লাভ করেন।
অনুমান করা হয় আব্দুল কাদির খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান ১৯৮০ সাল থেকেই পরামাণু অস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতা লাভ করে। পাকিস্তান অর্থনৈতিক অবরোধের মুখোমুখি হতে পারে বিধায় তারা সেটা পৃথিবীকে জানতে দেয়নি।
১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি)। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। প্রবল জনসমর্থনের ভিত্তিতে তিনি ঘোষণা করেন যে, বিশ্বদরবারে প্রাপ্য সম্মানটুকু পেতে হলে ভারতকে এবার পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র থেকে পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্র হতে হবে। পৃথিবীতে তখন বিশ্বের পাঁচ মোড়লই পরমাণু অস্ত্রধর রাষ্ট্র। ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ইংল্যান্ড।
১৯৯৮ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয়ে কাশ্মীরে ব্যাপক নির্যাতন। এই নিয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। পাকিস্তানকে ভয় দেখাতে ভারত মে মাসের ১১ তারিখ কোনো রাখ-ঢাক ছাড়াই পারমাণবিক অস্ত্রের ঘোষণা দিয়ে তিনটি বোমা বিস্ফোরণ করে। দু'দিন পর ১৩ তারিখ আরো দুটি বোমা বিস্ফোরণ করে।
এই বিস্ফোরণের পর পাকিস্তান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। কিন্তু আমেরিকার মৃদু প্রতিবাদ ছাড়া বিশ্ব মোড়লরা খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বরং সবাই পাকিস্তানকে চাপ দিতে থাকে যাতে পাকিস্তান এই পথে না হাঁটে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নওয়াজ শরীফ। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন পাল্টা পরীক্ষা করার। নইলে সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়বে। ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করবে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিষদে দীর্ঘ আলোচনার পর নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালের ২৮ মে ও ৩০ মে দু'দিন দু'টি বোমার বিস্ফোরণ করে পাকিস্তান তার শক্তির কথা জানান দেয়।
বিস্ফোরণের পর নওয়াজ শরীফ পৃথিবীবাসীকে জানান, "নিরাপত্তা হুমকির ব্যাপারে নির্বিকার থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এত বড় হুমকিকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থ থেকেই এই পারমাণবিক বিকল্প বেছে নেয়া হয়েছে।"
পাকিস্তান সাময়িক অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়ে। তবে ভারতের আস্ফালন বন্ধ হয়ে যায়। চীন ও পাকিস্তান একইসাথে যৌথমহড়া দিয়ে ভারতকে নিষ্ক্রীয় করে দেয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন