আজ ১২ রবিউল আউয়াল। ১১ হিজরির এই দিনে আমাদের নেতা মুহাম্মদ সা. দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেন। অনেকের মতে আজকের এই দিনে রাসূল সা. জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মতামত হচ্ছে মুহাম্মদ সা. ৯ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছেন। মুহাম্মদ সা. বহুবার বলেছেন তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। সেই হিসেবেও ৯ রবিউল আউয়াল সঠিক হয়। আমুল ফিল বা হস্তির বছরে ১২ রবিউল আউয়াল ছিল বৃহস্পতিবার।
মুহাম্মদ সা. আয়িশা রা.-এর কোলে মাথা রাখা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে সাহাবারা হতাশ হয়ে কান্না করতে থাকে। তখন উমার ইবনুল খাত্তাব রা. দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “কতকগুলো মুনাফিক বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসুল সা. মারা গেছেন। আল্লাহর কসম, তিনি মারা যাননি। তিনি কেবল মূসা আ.-এর মত সাময়িকভাবে আল্লাহর কাছে গিয়েছেন। মূসা আ. চল্লিশ দিনের জন্য আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। তখন প্রচার করা হয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন। অথচ তার পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহর কসম, মূসার আ. মত রাসূলুল্লাহ সা. আবার ফিরে আসবেন। তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, যারা বলছে যে, তিনি মারা গেছেন তাদের হাত পা কেটে দেওয়া হবে।
আবু বকর রা. মুহাম্মদ সা.-এর ইন্তিকালের খবর পেয়ে ছুটে এলেন। উমার রা. তখন ঐ কথা বলে চলেছেন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি আয়িশার রা.-এর ঘরে রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে চলে গেলেন। তখন তাঁকে একটি কাপড় দিয়ে ঘরের এক কোণে ঢেকে রাখা হয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের কাপড় সরিয়ে চুমু খেলেন। অতঃপর বললেন, “আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার জন্য যে মৃত্যু নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা আপনি আস্বাদন করেছেন। এরপর আপনার কাছে আর কখনো মৃত্যু আসবে না।” অতঃপর মুখ ঢেকে দিলেন।
আবু বকর রা. এই ঘটনার জন্য আগেই প্রস্তুত ছিলেন। বিদায় হজ্বে যখন দ্বীন পরিপূর্ণ হয়েছে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তখন থেকেই তিনি জানতেন যে কোনো সময়ই মুহাম্মদ সা. চলে যাবেন। তিনি বাহিরে বেরিয়ে দেখেন উমার রা. সেই একই কথা বলে চলেছেন। তিনি বললেন, “উমার। তুমি ক্ষান্ত হও। চুপ করো।” উমার রা. কিছুতেই থামতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ অবস্থা দেখে আবু বকর রা. জনতাকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথা শুনে জনতা উমারকে রা.-কে রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে এল।
তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন, “হে জনমন্ডলী, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করতো সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদাত করতো সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর।” তারপর তিনি সূরা ইমরানের ১৪৪ নং আয়াত উল্লেখ করেন,
//মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বৈ আর কিছুই নন। তার পূর্বে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান কিংবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা ইসলাম থেকে ফিরে যাবে? যে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কৃতজ্ঞ লোকদের আল্লাহ যথোচিত পুরস্কার দেবেন।//
আবু বকর রা.-এর এই বক্তব্যের পর সাহাবারা বুঝতে পারলেন রাসূল সা. আর নেই। উমার রা. একদম শান্ত হয়ে বসে পড়লেন, যেন তিনি সব হারিয়ে ফেললেন। তবে অবশ্য অল্পসময় পর সবাই শোক চেপে রেখে স্বাভাবিক হলেন।
আনসারদের একজন নেতা হলেন সা'দ বিন উবাদা রা.। তিনি খাজরাজদের অন্তর্গত বনু সাঈদা গোত্রের প্রধান। তিনি আকাবার ২য় শপথের সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যেসব মানুষের কারণে মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মুহাম্মদ সা. আনসারদের নেতা হিসেবে তাকে বিবেচনা করতেন। কোনো ব্যাপারে আনসারদের মনোভাব জানতে মুহাম্মদ সা. সবসময় সা'দ বিন উবাদা রা.-কে জিজ্ঞাসা করতেন। তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকায় শুধু খাজরাজরা নয়, আওস গোত্রের লোকেরাও তাঁকে নেতা মানতেন।
মুহাম্মদ সা.-এর মৃত্যুর পর বনু সাঈদা গোত্রে খাজরাজদের একদল লোক সমবেত হলো। তারা সা'দ বিন উবাদার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তাকে আমীর ঘোষণা করলো। আলী রা.-এর ঘরে ছিল তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. ও যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা.। তারা এখন এসব ঝামেলায় জড়াতে চাননি। একদল লোক তাদের আনুগত্য করলো। তারা সম্ভবত আলী রা.-কে পরিবারের সদস্য হিসেবে নেতা মানতে চেয়েছিল। আওস গোত্রের শাখা আব্দুল আশহাল গোত্রের নেতা উসাইদ বিন হুদাইর রা.-এর নেতৃত্বে কিছু সাহাবী আলাদা হয়ে তাকে আমীর ঘোষণা করলো। অল্প সময়ের মধ্যে সাহাবারা তিনভাগ হয়ে গেল। সা'দ বিন উবাদা রা.-এর নেতৃত্বে বেশি মানুষ জমায়েত হলো। তিনজন নেতা দেখা দিলেও মদিনার বেশিরভাগ সাহাবী এই তিনদলের কারো সাথেই যুক্ত হননি। মুহাজিররা সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য আবু বকর রা.-এর কাছে হাজির হলো।
এই প্রসঙ্গে উমার রা. বলেন, //রাসূলুল্লাহ সা. ইন্তিকালের পর আমরা খবর পেলাম আনসারগণ আমাদের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বনু সাঈদা গোত্রের চত্বরে তাঁদের গণ্যমান্য মুরব্বীদের নিয়ে সমবেত হলেন। আলী রা., তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা., যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. ও তাঁদের সহচরগণ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাইলেন। আর আবু বকর রা.-এর কাছে জমায়েত হলেন মুহাজিরগণ। আমি আবু বকরকে বললাম, “আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের আনসার ভাইদের কাছে চলুন।”
তাদের কাছে যাওয়ার পথে তাদের দু’জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে আমাদের দেখা হলো। তারা আনসারদের মনোভাব জানালেন। অতঃপর আমরা বনু সাঈদা গোত্রে গেলাম। আমরা সেখানে বসলে তাঁদের এক বক্তা আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের রিকালাতের সাক্ষ্য দিয়ে এবং আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। বললেন, “আমরা আল্লাহর আনসার এবং ইসলামের বীর সেনানী। আর হে মুহাজিরগণ! আপনার আমাদেরই একটি দল। আপনাদের একটি শান্তশিষ্ট মরুচারী দল আমাদের সাথে এসে ইতোমধ্যেই যোগদান করেছে।”
উমার বলেন, আমরা দেখতে পেলাম, তারা আমাদেরকে আমাদের মূল আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করতে চাইছে এবং তার ওপর জোরপূর্বক নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে। আমি এর জবাবে চমৎকার একটা বক্তৃতা তৈরি করলাম এবং তা আমার নিজের কাছে অত্যন্ত যুৎসই মনে হয়েছিল। আমি আবু বকরকে শোনাতে চাইলাম। আবু বকরের মধ্যে এক ধরনের তেজস্বিতা ছিল যার জন্য তাঁকে আমি খুবই ভয় পেতাম এবং যথাসম্ভব তাঁর মনরক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম।
আবু বকর বললেন, “উমার। তুমি কিছু বলো না।” তিনি তাঁদের কথার এত সুন্দরভাবে জবাব দিলেন যে, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি যে বক্তব্য তৈরি করে এটি ছিল তার চাইতেও অনেক সুন্দর। তিনি বললেন, “তোমরা নিজেদের মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী ও অবদান সম্পর্কে যা বলেছো তা যথার্থ বলেছো। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই কুরাইশ গোত্রের অবদান না থাকলে আরবরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতো না। তারা আরবদের মধ্যে মধ্যম ধরনের বংশীয় মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের আবাসিক এলাকাও সমগ্র আরব জাতির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমি তোমাদের সবার জন্য এই দুইজনের যেকোনো একজনকে পছন্দ করি। তোমরা এদের মধ্যে যাকে পছন্দ করো তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হও ও বাইয়াত করো।” এই বলে তিনি আমার ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর হাত ধরলেন। তাঁর এই শেষের কথাটি ছাড়া আর কোনো কথা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। আল্লাহর কসম, আমার মনে হচ্ছিল, আবু বকর থাকতে অন্য মুসলমান নেতা হতে পারে না।
আবু বকরের এই ভাষণের পর আনসারদের একজন বললেন, “আমরা আরবদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তায় যেমন নির্ভরযোগ্য, মান মর্যাদায়ও তেমনি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমাদের পক্ষ থেকে একজন এবং তোমাদের (কুরাইশদের) তরফ থেকে আরো একজন আমীর হোক।” এরপর প্রচুর বাকবিতন্ডা হলো এবং বেশ চড়া গলায় কথা কথাবার্তা হতে লাগলো। আমার আশংকা হলো যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের দুই গোষ্ঠী মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটা বিভেদ বা কলহের সৃষ্টি হয়ে না যায়। আমি (সকল বিতর্কের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে) তৎক্ষণাৎ বললাম, “হে আবু বকর! আপনার হাতখানা বাড়িয়ে দিন।” তিনি বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাত ধরে বাইয়াত করলাম। এরপর মুহাজিররা বাইয়াত করলেন। তারপর আনসাররাও বাইয়াত করলেন। এরপর আমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে বকাঝকা করতে আরম্ভ করলাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের একজন বললেন, “তোমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।” আমি বললাম, “আল্লাহই সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলেন।”//
নেতা নির্বাচন নিয়ে ঘটে যাওয়া এসব কাণ্ডের কারনে সোমবার গত হয়ে যায়। মঙ্গলবারের রাত চলে আসে। আরবি ক্যালেন্ডার অনুসারে দিন শুরু হয় সূর্য অস্ত যাওয়ার পর সন্ধ্যা থেকে। মঙ্গলবার সকালে আবু বকর রা. নামাজ শেষে মিম্বরে বসলেন। রাসূল সা. অসুস্থ থাকতেই মসজিদে নববিতে আবু বকর রা. ইমামতি করতেন। আমীর হিসেবে বাইয়াত নেওয়ার পরও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। আবু বকর রা. কিছু বলার আগে উমার রা. তার অনুমতি কিছু বলার জন্য দাঁড়ালেন।
আল্লাহর প্রশংসা করে তিনি বলেন, “হে জনতা! গতকাল আমি তোমাদেরকে যে কথা বলেছিলাম [অর্থাৎ মুহাম্মদ সা. মারা যাননি, তিনি মুসা আ. মত সাময়িকভাবে অন্তর্ধান হয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি] তা আমি কুরআন থেকে পাইনি এবং রাসূলুল্লাহু সা.ও আমাকে তা বলেননি। আমার ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক পুরোপুরিভাবে গুছিয়ে দিয়ে সবার শেষে ইনতিকাল করবেন। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়।
আল্লাহর যে কিতাব দ্বারা তাঁর রাসূল সা.কে নিজের মনোনীত লক্ষ্যে পরিচালিত করেছেন সে কিতাব আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বহাল রেখেছেন। এই কিতাবকে যদি তোমরা আঁকড়ে ধর তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যেদিকে পরিচালিত করেছেন সেদিকে তোমাদের চালিত করবেন। আজ আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠতম তাঁর কাছেই তোমাদের নেতৃত্ব সমর্পণ করেছেন। তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সা.-এর অন্যতম সঙ্গী, সওর পর্বত গুহায় তাঁর একনিষ্ঠ সহচর। অতএব তোমরা তাঁর কাছে বাইয়াত করে তাঁকে খলিফা বা আমীর হিসাবে গ্রহণ করো।” উমার রা.-এর এই কথার পর সাহাবার একযোগে সবাই বাইয়াত করলো। যারা গতকাল করেছিল তারা আজ আবার বাইয়াত করলো।
অতঃপর আবু বকর রা. বক্তব্য রাখলেন। প্রথমে আল্লাহর যথোচিত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “হে জনতা! আমাকে তোমাদের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে। আসলে আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। আমি যদি ভাল কাজ করি তাহলে আমাকে সাহায্য করবে। আর যদি অন্যায় করি তাহলে আমাকে শুধরে দেবে। সত্যবাদিতাই বিশ্বস্ততা। আর মিথ্যাবাদিতা হলো বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের কাছে যে দুর্বল বিবেচিত হয়ে থাকে সে আমার শক্তিশালী যতক্ষণ আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তার প্রাপ্য হক না দিতে পারবো। আর তোমাদের মধ্যে যে শক্তিশালী বিবেচিত হয়ে থাকে তার কাছ থেকে যতক্ষণ প্রাপ্য হক আদায় না করবো ততক্ষণ সে আমার কাছে দুর্বল।
মনে রেখ কোনো জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাকে লাঞ্চনা গঞ্জনা ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেন। আর অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নোংরামি যে সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করে সে সমাজকে আল্লাহ বিপদ মুসিবত ও দুর্যোগ দিয়ে ভরে দেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করবো ততক্ষণ তোমরা আমার কথামতো চলবে। কিন্তু যখন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবো তখন তোমাদের আনুগত্য আমার প্রাপ্য হবে না। তোমরা নামাযের প্রতি যত্নবান থেকো আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত নাযিল করুন।”
আবু বকর রা. বাইয়াত সুসম্পন্ন হওয়ার পর মঙ্গলবার দিন জনগণ রাসূলুল্লাহ সা.-এর দাফনের আয়োজন করলো। আলী রা., আব্বাস রা., ফযল ইবনে আব্বাস রা., কুসাম ইবনে আব্বাস রা., উসামা ইবনে যায়িদ রা. ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুক্ত গোলাম শাকরান রা. তাঁকে গোসল দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত হলেন। আওস রা. আলী রা.-কে বললেন, “হে আলী! আল্লাহর দোহাই। রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাফন-দাফন আমাদের অংশ নিতে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।”
আলী রা. বললেন, “এসো।” তিনি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোসলে অংশগ্রহণ করলেন। গোসলের আয়োজন করতে গিয়ে গোসলের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরা মতবিরোধের শিকার হলেন। প্রশ্ন ছিল এই যে, অন্যান্য মৃতের মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাপড় খুলে ফেলে গোসল দেওয়া হবে, না কাপড় গায়ে রেখেই গোসল দেওয়া হবে। এই মতভেদ চলাকালে সহসা আল্লাহ তাদের ওপর ঘুম চাপিয়ে দিলেন। ঘুমের কারণে সকলেরই মুখ রাসূলুল্লাহ সা.-এর বুকের ওপর এসে পড়লো। সেই অবস্থায় ঘরের একপাশ থেকে এক অচেনা ব্যক্তি তাদেরকে বললো, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাপড় গায়ে রেখেই গোসল দাও।” এই কথা শুনে সবাই হতচকিত হয়ে জেগে ওঠলেন এবং সকলেই এই কথা শুনেছেন বলে জানালেন। অতঃপর জামা গায়ে রেখেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোসল দেওয়া হলো এবং কাপড়ের ওপর দিয়েই গা কচলানো হলো।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর গোসল সম্পন্ন হলে তিনটি কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হলো। মঙ্গলবার রাসূলুল্লাহ সা.-কে কাফন ও গোসল দিয়ে তাঁর বাড়ীতে তাঁর খাটে শুইয়ে রাখা হলো। এরপর দাফন নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে আবার মতান্তর ঘটলো। কেউ বললেন, মসজিদে নববীতে দাফন করবো।” কেউ বললেন, “অন্যান্য সাহাবীদের কবরের পার্শ্বে দাফন করবো।” আবু বকর রা. মীমাংসা করে দিলেন এই বলে যে, রাসূলুল্লাহ সা.-কে আমি বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক নবীকে তার ইনতিকালের জায়গাতে দাফন করা হয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সা. যে বিছানার শুয়ে ইনতিকাল করেছিলেন তা তুলে ফেলে তার নীচেই কবর খনন করা হলো।
এরপর শুরু হলো জানাজার নামাজ। রাসূল সা.-এর জানাজার নামাজ অন্য মুসলিমদের মতো জামায়াতবদ্ধভাবে হয়নি। রাসূল সা.-কে তাঁর ছোট্ট ঘর থেকে বের করা হয়নি। তিনি সেখানেই ছিলেন। এরপর একে একে সাহাবারা সেই ঘরে প্রবেশ করলেন ও জানাজার নামাজ পড়লেন। এভাবে প্রথমে সকল পুরুষরা পড়লেন, তারপর মহিলারা অবশেষে শিশু-কিশোররা জানাজার নামাজ পড়লেন। এভাবে কেন হয়েছে তা অনেক চেষ্টা করেও সঠিকভাবে জানতে পারিনি।
এভাবে জানাজার নামাজ পড়তে গিয়ে অনেক সময় লেগেছে। মঙ্গলবারের সূর্য অস্ত গিয়েছে। বুধবারের রাত চলে এসেছে। এরপরও জানাজা চলছিল। মধ্যরাতে জানাজা শেষ হলে মুহাম্মদ সা.-কে কবরস্থ করা হলো। মহানবীকে কবরে শোয়ানোর জন্য রাসূল সা. তিনজন চাচাতো ভাই আলী রা., ফজল রা., কুসাম রা. ও আজাদকৃত দাস শাকরান রা.। আল্লাহর রাসূল সা.-এর ইন্তিকালের পর প্রায় ৪০-৪৫ ঘন্টা পর তাঁর দাফন সম্পন্ন হলো।
দাফন সম্পন্ন হলে আলী রা. আব্বাস রা.-সহ নিকটাত্মীয়রা জানতে পারলো আবু বকর রা. খলিফা হিসেবে বাইয়াত নিয়েছেন। অভিষেক ভাষণও দিয়ে ফেলেছেন। এতে তাঁরা ভীষণভাবে আহত হন। তাঁদের কাছে পুরো প্রেক্ষাপটও জানা ছিল না। তাঁরা মুহাম্মদ সা.-এর লাশের পাশেই ছিলেন এবং লাশ সামলানোকেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে নিয়েছেন। মুহাম্মদ সা. এর রাজনৈতিক উত্তরসূরী নির্ধারিত হয়ে গেল অথচ তার পরিবার কোনো পরামর্শও দিতে পারলো না এটা তাঁদের ব্যথিত করলো।
আলী রা.সহ অন্যদের এই মনঃকষ্ট দূর হতে প্রায় ছয়মাসের মতো সময় লেগেছে। আবু বকর রা. সেসময় নানান সমস্যায় পড়েছিলেন। চারদিকে মানুষ মুরতাদ হয়ে যাচ্ছিল, মিথ্যা নবী দাবীদার বের হয়েছিল, মুসলিমরা জাকাত দিতে অস্বীকার করছিল। এসব পরিস্থিতিতে আলী রা. অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আবু বকর রা.-কে সাহায্য করেছেন এবং মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য ফিরিয়ে আনতে শক্ত ভূমিকা রেখেছিলেন।
আলী রা.-এর উগ্র অনুসারী শিয়াদের কেউ কেউ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবু বকর রা.-এর খিলাফতকে অস্বীকার করেন। এটা সঠিক নয়। তারা বলতে চান আলী রা. বাধ্য হয়ে আবু বকর রা.-এর আনুগত্য করেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে আলী রা. কখনো এই জন্যে বাইয়াত নিতে দেরি করেননি যে, তিনি আবু বকর রা.-কে অযোগ্য মনে করেন বা তাকে অপছন্দ করেন। বরং তারা ঘটনার পরম্পরায় ব্যথিত হয়ে বাইয়াত নিতে দেরি করেছেন।
বস্তুত আলী রা. আবু বকর রা.-কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। আবু বকর রা.-এর সাথে মিলিয়ে তিনি তার নাতির নাম রেখেছেন আবু বকর। আলী রা. আবু বকর রা.-কে অপছন্দ করতেন বা তার নেতৃত্ব আন্তরিকভাবে মেনে নেননি এই দাবি ভুয়া ও অগ্রহণযোগ্য।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন