কী অবিশ্বাস্য ঘটনা! মন্ত্রীর কথাই সঠিক। সকালে মোবাইল চেক করে দেখলাম রাতের চাইতে ধনী হয়ে গেলাম! একজনের কাছে কিছু টাকা পেতাম। তিনি গত রাত দুইটায় তা পাঠিয়ে দিয়েছেন বিকাশে।
মাথাপিছু আয় নিয়ে আওয়ামীলীগের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান যেভাবে বলেছেন, আমাদের অজান্তেই আমরা ধনী হয়ে যাচ্ছি। এটা আসলে তার অর্থনীতি নিয়ে জ্ঞান কম থাকার কারণে এই কথা বলেছেন আমি তা বিশ্বাস করি না। উনি ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি সর্বশেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালকও ছিলেন।
এমন একজন ব্যক্তি যখন মাথাপিছু আয় নিয়ে হাস্যকর কথা বলে তখন বড় দুঃখ হয়। তিনি বলেছেন, আমাদের মাথাপিছু আয়ও বড়েছে। আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শনৈ শনৈ বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, আমরা টেরই পাচ্ছি না। আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।’ এ কেমন আয় যে, টের পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে সামান্য আয় করতে সবার চামড়া পুড়ে লাল হয়ে যাচ্ছে সেখানে কীভাবে টের পাওয়া ছাড়া হুদাই আয় হয়।
বিনা ভোটের সন্ত্রাসীরা মূলত জনগণকে ছাগল জ্ঞান করে। তাই এসব মন্তব্য করে তাদের অনুসারী সন্ত্রাসীদের চাঙ্গা রাখে। আর সন্ত্রাসীরাও জনগণকে শোষণ করে লুটপাট করে। সেই লুটপাটের টাকা মন্ত্রীর একাউন্টেও যায়। তিনিও সম্ভবত সকালে প্রতিদিন একাউন্ট চেক করে অবাক হয়ে যান। তৃণমূলের সন্ত্রাসীরা তার একাউন্টে হিসেব ছাড়া টাকা পাঠিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আমাদের জানিয়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৫০০ ডলার। তার মানে একজন মানুষের বার্ষিক আয় (২৫০০*৮৫) = ২১২৫০০ টাকা। এবং মাসিক আয় (২১২৫০০/১২) = ১৭৭০৮ টাকা। এক বছরের শিশু থেকে নিয়ে একদম বৃদ্ধ পর্যন্ত দেশের প্রতিটি মানুষের আয় গড়ে ১৭৭০৮ টাকা। এটা একটা রূপকথা। কারণ আমরা জানি আমাদের দেশের মানুষের আয়ের অবস্থা কী?
আমার নিজের কথাই ধরি। আমাদের পরিবারে যে ইনকাম হয় তা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর চাইতেও বেশি। তারপরও আমাদের পরিবারের আয় মাথাপিছু আয় অতিক্রম করতে পারছে না। এখানে অনেকেই বলবেন আমরা তো অনেকেই ১৭০০০ হাজারের চাইতে বেশি ইনকাম করি। কিন্তু আপনার আয় আপনার একার নয়। আপনার ওপর নির্ভরশীল প্রতিটা ব্যাক্তির হিসেবে সেটা কম হয়ে যাবে। যেমন একটি পরিবারে ৫ জন মানুষ আছে। আয় করেন কেবল একজন। তার আয় যদি ৮৮৫৪০ টাকা হয় তবেই কেবল তিনি মাথাপিছু আয়ের সমান ইনকাম করতে পারেন।
যাই হোক এবার আমরা জানার চেষ্টা করি এই মাথাপিছু আয় কীভাবে নির্ধারিত হয়। একটি দেশের এক বছরে মোট জাতীয় আয়কে সেই দেশের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়।
মাথাপিছু আয় = বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় / মোট জনসংখ্যা
মোট জাতীয় আয় (GNP) : একটি দেশের নাগরিক (দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত) দ্বারা যত উৎপাদন ও সেবা পাওয়া যায় তার টাকার মূল্য হিসেব করে মোট জাতীয় আয় বা উৎপাদন নির্ধারণ করা হয়।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) : একটি দেশে অবস্থানরত (দেশি ও বিদেশী নাগরিক) সব মানুষ দ্বারা মোট যত উৎপাদন ও সেবা পাওয়া যায় তার টাকার মূল্য হিসেব করে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি পাওয়া যায়।
মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) = GDP - বাংলাদেশে থাকা বিদেশীদের আয় + বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের আয়।
অর্থাৎ জিডিপি থেকে বিদেশীদের আয় বিয়োগ করা হয় এবং বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের আয় যোগ করে আমরা বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় বের করি।
আমার বিশ্বাস যদি সঠিকভাবে হিসেব করা হয় তবে আমাদের মাথাপিছু আয় আরো অনেক কম হওয়ার কথা। এখন এমন এক পরিসংখ্যান হাজির করা হলো যে, দেশের পরিকল্পনা মন্ত্রীই পর্যন্ত সেই হিসেব বিশ্বাস না করে বলেছেন দেশের আয় বেড়ে যাচ্ছে অথচ আমরা টের পাচ্ছি না।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি : গত বছরের তুলনায় এই বছর জিডিপি কত বেড়েছে তার শতকরা হিসেব কে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বলা হয়। যেমন গত বছর যদি আমাদের জিডিপি হয় ১০০০০ টাকা আর এই বছর যদি জিডিপি হয় ১১০০০ টাকা তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি হবে, (১১০০০-১০০০০)*১০০/১০০০০ = ১০%
যত ঝামেলা এই প্রবৃদ্ধিকে নিয়ে। সরকার চায় এই প্রবৃদ্ধি বেশি দেখাতে তাহলে তার আমলে আয় বেড়েছে এটা বুঝা যাবে। প্রবৃদ্ধি যত বেশি তত গতিশীল অর্থনীতি নিশ্চিত হয়। বিবিএস বা পরিসংখ্যান ব্যুরো যেটা ঝামেলা করে সেটা হলো তারা হিসেব হিসেবটা রাজনৈতিকভাবে করে। আগেই সরকার প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করে তারপরে ব্যাক ক্যাককুলেশন করে হিসাব মিলায়। প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে সরকার প্রতিবছর আমাদের বেশি জিডিপি হিসেব করছে। আসলেই সেই উৎপাদন বা আয় হচ্ছে কিনা তার খবর কেউ রাখছে না।
২০ আগস্ট ২০২০ সালে প্রথম আলোতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম বলেন, //আগে প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়, পরে হিসাব মেলানো হয়। ফলে দেশের অর্থনীতির সাথে জিডিপির হিসেব মিলে না।//
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২১২৫০০ টাকা যা পরিসংখ্যান ব্যুরো বলেছে এটা পুরোটাই ভাঁওতা ও প্রতারণা।
আরেকটি প্রতারণা হলো জনসংখ্যা নিয়ে। মাথাপিছু আয় বের করতে হলে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে হয়। এই জনসংখ্যাকে কমিয়ে রেখেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। বিভিন্ন গবেষণায় দেশের মানুষ বিশ কোটি ছাড়িয়ে গেলেও আমাদের দেশে অফিসিয়ালি জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লক্ষ। ২০১১ সালে এটি ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লক্ষ। সরকারের হিসেবে গত দশ বছরে দেশের জনসংখ্যা বাড়ে নাই বললেই চলে। অথচ এই পরিসংখ্যান ব্যুরো দেখিয়েছে গত দশ সব ধরণের মৃত্যুর হার কমেছে। আমাদের গড় আয়ু ৬৩ থেকে ৭৩ হয়েছে।
সুতরাং সরকারি হিসেবের ভ্যালু একেবারে থার্ডক্লাশ লেভেলের। একদিকে বলছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গড় আয়ু ১০ বছর বেড়ে গেছে। অন্যদিকে আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোনো খবর নেই।
আমাদের মাথাপিছু আয়ে তাই মারাত্মক গলদ রয়েছে। একদিকে জিডিপি বাড়তি দেখানো হচ্ছে অন্যদিকে জনসংখ্যা কম দেখানো হচ্ছে। তাই আমাদের মাথাপিছু আয় একটি দানবীয় সংখ্যায় রূপ নিয়েছে আর তা হলো ২১২৫০০ টাকা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন