১৭ নভে, ২০২১

মাওলানা ভাসানীর সাতকাহন

 

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনিজমকে একসাথে লালনকারী নেতা ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। নিজে মাওলানা নামধারী হলেও রাজনীতিতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ছিল তার ঘোর আপত্তি। আব্দুল হামিদ খান ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি সিরাজগঞ্জের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোট থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত ও দুই ছেলে মারা যায়। বেঁচে থাকেন ছোট শিশু আব্দুল হামিদ খান। পিতৃহীন হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে লজিং থাকেন। সেখানে তিনি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ সালে পীর নাসির উদ্দীনের সাথে আসাম যান। সেখানে পীরের সাথে দাওয়াতের কাজ করেন। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ মাদ্রসায় যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। সেখানে মাদ্রাসায় পড়ান ও দাওয়াতের কাজ করেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু নামে পরিচিত চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অণুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে গান্ধীর সাথে বিরোধ করে চিত্তরঞ্জন। গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে চিত্তরঞ্জন কংগ্রেস ত্যাগ স্বরাজ্য পার্টি গঠন করেন। ভাসানী স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন এবং আসামে এই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। চিত্তরঞ্জনের সাথে থেকেই ভাসানী কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন এবং কম্যুনিজম দ্বারা প্রভাবিত হন। ১৯২৫ সালে তিনি তার লজিং ছাত্রী ও জমিদার কন্যা আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯২৬ সালে তাকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। তিনি কৃষকদেরকে কম্যুনিস্টদের চটকদার কথা শুনিয়ে তাদের নিয়ে সম্মেলন করেন। ১৯২৯ সালে হওয়া ভাসান চরের এই সম্মেলনের পরেই তার নামের সাথে ভাসানী যুক্ত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ ওঠেন মাওলানা ভাসানী। সহজাত নেতৃত্ব যোগ্যতার কারণে তিনি একাই কম্যুনিজমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭ সালে মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। জিন্নাহর দাওয়াতে ১৯৪০ সালে তিনি মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে "বাঙ্গাল খেদাও" আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের সময় মারামারির অভিযোগে গ্রেফতার হন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। ততক্ষণে আসাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এরপর তিনি আসাম ছেড়ে টাঙ্গাইলের সন্তোষে চলে আসেন। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার কালে মোটাদাগে বাংলায় রাজনৈতিক দল ছিল দুইটি। এক মুসলিম লীগ, দুই কৃষক প্রজা পার্টি। ১৯৪৫-৪৬ সালের পরিস্থিতিতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি অস্তিত্ব হারিয়েছে হিন্দুদের সাথে মিলিত হওয়ার দায়ে। একইসাথে বাংলার মানুষের কাছে ফজলুল হক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর তিনি রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আইন পেশায় সময় দিতে থাকেন। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে নবগঠিত পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ছাড়া আর কারো প্রভাব ধর্তব্য ছিল না। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। তাদের প্রভাবে দলের মধ্যে প্রায় কোণঠাসা ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারীরা। তারা মূলত ইসলামী চেতনা ধারণ করতেন না। তারা মুসলিম জাতীয়তাবাদটাকেই বেশি ধারণ করতেন। তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। সোহরাওয়ার্দির নির্দেশে তার অনুগত শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে এসে তাদের সাথে যুক্ত হন। এদিকে ভাসানী এবং তার অনুসারীরা মুসলিম লীগকে সমাজতান্ত্রিক বামধারায় রূপান্তর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইসলামী চেতনাধারীদের তোপের মুখে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর কর্মস্থল আসাম ভারতের অধীনে হওয়ায় তিনিও ঢাকায় অনেকটা প্রভাবহীন অবস্থায় ছিলেন। তখন ভাসানী মুসলিম লীগ ছেড়ে অন্য দল তৈরি করার কথা ভাবছিলেন। ভাসানী টাঙ্গাইলের আরেক মুসলিম লীগ নেতা শামসুল হককে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বুঝান এবং তাকে সাথে রাখেন। ভাসানী আদর্শিক বিষয় গোপন রেখে বাঙালিদের নিয়ে আলাদা দল গঠনের উদ্যোগ নিতে থাকেন। তারই প্রস্তুতি হিসেবে সোহরাওয়ার্দির সাথে যোগাযোগ করেন। তারা সবাই মিলে একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি হন আর সেক্রেটারি শামসুল হক। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আর এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নিখিল পাকিস্তানে এই দলটি আসলে কার্যকর ছিল না। এটা মূলত বাঙালিদের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠেছে। এভাবেই ভাসানীর প্রত্যক্ষ প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মুসলিম চেতনা বিলুপ্ত করে বাঙালী জাতীয়তার বীজ রোপিত হয় এবং ফ্যাসীবাদী দল আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন হলেও তার সাথে ভাসানীর দন্দ্বে প্রাদেশিক সরকার টিকে নি। শুরু থেকেই ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে ইসলামী ভাবধারা ও চেতনা বিলুপ্তির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সোহরাওয়ার্দির বাধা সত্ত্বেও তার একক প্রচেষ্টায় ১৯৫৫ সালের শুরুর দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ভাসানী মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলের নাম শুধু আওয়ামী লীগ করে। এই ‘মুসলিম' শব্দ বাদ দেবার কারণে ২০ জন প্রাদেশিক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলবদ্ধ হয়। বাকীরা আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি করতে থাকে। ১৯৫৫ সাল থেকে আওয়ামী লীগ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে এবং দলের মধ্যে থেকে ইসলাম রিলেটেড সব শ্লোগান ও চেতনা বাদ দেয়। আর পুরো বিষয়টার নেতৃত্বে ছিল ভাসানী। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এর মাধ্যমে ভাসানীর দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসীন হয়। এটা অনেকেই জানে না যে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আসীন হয়। সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। মাওলানা ভাসানী সোহরাওয়ার্দিকে আমেরিকাকে বন্ধু না বানিয়ে চীনকে বন্ধু বানানোর পরামর্শ দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ আওয়ামীলীগ ও পাকিস্তানী রাজনীতিবিদেরা কম্যুনিস্টদের অপছন্দ করতো বিধায় সেই পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। মাওলানা ভাসানী নিজ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এর জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ইসলামপন্থীরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। যদিও এই আন্দোলনে তার দলের সাপোর্ট তিনি নিরঙ্কুশভাবে পাননি। মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় ইসলামী রিপাবলিকের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসীন হওয়ায় আওয়ামী লীগ অল্প সময়ের সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামল শান্তিপূর্ণ হতে পারেনি। কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার গৃহীত বিভিন্ন নীতির প্রশ্নে লীগের অভ্যন্তরে কোন্দল দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার সময় থেকেই অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী এই পার্টিতে ঢুকে পড়ে। পার্টির এই অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু করে। মাওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে সমালোচনা করে বলেন যে, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে তা পার্টির মেনিফেস্টো বিরোধী। এভাবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দুটি ভিন্নমতালম্বী গ্রুপের সৃষ্টি হয়। এই মতবিরোধ শক্তিশালী হয় ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে। কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় ভাসানী বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামুন আলাইকুম জানাতে বাধ্য হবে। এই সালাম নিয়ে আমাদের দেশে জনপ্রিয় কথা চালু আছে ভাসানী নাকি পাকিস্তানী শাসকদের সালাম দিয়ে বিদায় জানিয়েছেন। আসলে এই কথাটি তিনি বাঙালি ও নিজ দলের নেতা সোহরাওয়ার্দিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন। এই কথাটি যখন তিনি বলেন তখন পাকিস্তান কেন্দ্রের সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল। ভাসানী ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাওয়ার্দি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হচ্ছে এটা হচ্ছে ভাসানীর রাজনৈতিক মিথ্যে কথা। সে এর মাধ্যমে সমস্ত বাঙালি বিশেষত আওয়ামীলীগের লোকদেরকে সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। মূলত কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। এই চুক্তিতে চীন নাখোশ হয়েছে। চীনের খুশি বা অখুশিই ভাসানীর খুশি বা অখুশি। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তান সংবিধানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভাসানী তীব্র প্রতিবাদ করেন। সোহরাওয়ার্দী পৃথক নির্বাচনের পক্ষপাতি ছিলেন। ইসলামিক রিপাবলিকের ব্যাপারেও ভাসানীর আপত্তি ছিলো। এতে সংখ্যালঘুদের অধিকারহরণ হবে বলে তিনি মনে করতেন। ভাসানী তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা বৈদেশিক নীতিরও বিরোধিতা করেন। তিনি চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ভাসানী কাগমারি সম্মেলন করেছে মূলত চীনের চাপে। কাগমারি সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাসানী বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলতে থাকেন দলের ডানপন্থী ও উদারপন্থীরা। অনেকটা কোণঠাসা ভাসানী মাসখানেক পরে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সোহরাওয়ার্দীর চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। একই বছর ২৫ জুলাই ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকে তার বিরোধীরা উপহাস করে লাল মাওলানা বলতো। শেখ মুজিব বলতো চায়না হুজুর। ন্যাপ গঠনের পর প্রাদেশিক পরিষদের ২৮ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসে ন্যাপে যোগ দেন। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে ভাসানী আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। তিনি আইয়ুব ও চীনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ভাসানী ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর সাথে যুক্ত থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করেন ও আইয়ুবকে জিতিয়ে দেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের চীন ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ৬০ দশকে সারা পৃথিবীর সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। পাকিস্তানেও তার ব্যতিক্রম হয় না। ১৯৬৭ সালের কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে মস্কোপন্থী নেতারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা চালায়। তাই মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পরামর্শে রংপুরে কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের পর দেশিয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে ন্যাপ চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের (খাইবার পাকতুন) আবদুল ওয়ালী খান। পূর্ব পাকিস্তান ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ বাংলায় মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত হয়। ১৯৬৭ সালে ভুট্টোর নেতৃত্বে ও রাজনৈতিক জোট পিডিএমের নেতৃত্বে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে সেই আন্দোলন জমে উঠে। তখন ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করার ইস্যু নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু করেন। আইয়ুব শেখ মুজিবকে মুক্তি দিল ও আগরতলা মামলা থেকে অব্যাহতি দিল। এবার ভাসানী আর শেখ মুজিব মিলে আইয়ুবের পক্ষে ভূমিকা রাখে। মূলত শেখ মুজিবকে এই শর্তে ছাড়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনা করার জন্য তিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। তিনি চেয়েছেন যেন আন্দোলনকারী সব দল তার সাথে আলোচনায় বসে। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে আইয়ুব খান। শেখ মুজিবসহ ৩৪ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ তারিখ গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে। সেখানে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। সারা ঢাকা শহরে আনন্দ মিছিল করে ছাত্রলীগ। রণক্ষেত্র ঢাকা থেকে উৎসবের ঢাকায় পরিণত হয়। মুজিব তার জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান। বক্তৃতায় শেখ মুজিব সব বিরোধী দলকে শান্ত থাকার জন্য আহবান করেন এবং প্রেসিডেন্টের সাথে গোল টেবিল আলোচনায় যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি আইয়ুবের প্রতি আস্থা রাখার জন্য আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দলকে আহ্বান জানান। মুজিবের মুক্তির পর রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড়ে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি ভাসানী ও মুজিবের সাথে বৈঠক করেন। ধারণা করা হয় তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ঢাকায় আর কেউ আইয়ুব বিরুদ্ধে আন্দোলন করেনি। না মুজিব না ভাসানী। ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় আইয়ুব খানের ওপর সেনাবাহিনীর চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুজিবের মুক্তির ১ মাস পর অবশেষে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। এরপর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ভাসানী নির্বাচন থেকে মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। তিনি বাংলাদেশকে একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন পাকিস্তানের সাথে থেকে এই দেশকে কম্যুনিস্ট বানানো যাবে না। নির্বাচিত শাসক ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার দাবী দৃঢ় হবে না তাই তিনি আওয়াজ তুললেন, ভোটের বাক্সে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। কিন্তু এদেশের মানুষ তার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উল্টো তাকেই লাথি মেরে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিল। তার দল ন্যাপ এই ইস্যুতে দুইভাগ হয়ে যায়। বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে তাদের হারিয়ে ফেলা ইসলামী চেতনাকে ফিরিয়ে এনে মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলো। এরপরে তো ৭১ এর যুদ্ধ শুরু হলো। ভাসানী এই সময় থেকে মূলত দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তিনি পাকিস্তানকে ভাঙতে চেয়েছেন কিন্তু তার গুরু অর্থাৎ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাকে এই কাজে বাধা দিয়েছে। চীন ও পাকিস্তান তখন টেকনিক্যালি মিত্র ছিল কারণ উভয়ের শত্রু ভারত। একাত্তরের সময় থেকে ভাসানী বিভ্রান্ত ছিল সিদ্ধান্ত নিয়ে। তার অনুসারীর অনেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কেউ কেউ আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে। ভাসানী ভারতে অবস্থান করেছেন। ভারত চীনপন্থী হিসেবে তাকে প্রথমে বন্দি পরে ছেড়ে দিয়ে কড়া নজরদারীর মধ্যে রেখেছিলো। যুদ্ধের পরে দেশে ফিরে নানান সময়ে নানান আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে তিনি মুজিবের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। এরপর মুজিবের মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেননি। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। এর মাধ্যমে তার হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে শুরু করে। তিনি তৎকালীন শাসক জিয়াউর রহমানকে সাপোর্ট করেন। ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। এরপর তার দলের নেতৃত্বে আসেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। তিনি ন্যাপের সকল নেতা কর্মী নিয়ে জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে যোগ দেন। যদিও ভাসানী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তবে তার একনিষ্ঠ অনুসারীরা বিএনপিতে যুক্ত হয়েছে। দেশের শীর্ষ দুটি দল গঠনে তার ভূমিকা রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন