যে স্থানে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সেই স্থানে অর্থাৎ সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের সীমান্তে আবারো রোমানরা একত্রিত হয়েছে। তারা সৈন্য সমাবেশ করেছে এমন খবর রাসূল সা. পেয়েছেন তাঁর অসুস্থ অবস্থায়। মুতার যুদ্ধের শহীদ সেনাপতি জায়েদ রা.-এর ছেলে উসামা রা.-এর নেতৃত্বে রাসূল সা. নতুন বাহিনী গঠন করলেন। তাদেরকে সিরিয়া সীমান্তে রোমানদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন রাসূল সা.।
তারা রওনা হয়ে যাওয়ার পর মুহাম্মদ সা.-এর শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটে। তাই সেই সেনাবাহিনী মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে জুরফ নামক স্থানে তাঁবু ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশেষে মুহাম্মদ সা. ইন্তেকাল করলেন। নানাবিধ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবু বকর রা. খলিফা হলেন। আবু বকর রা. খলিফা হওয়ার পরই নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো। রাষ্ট্রের ওপর মহাবিপর্যয় নেমে আসলো। মক্কা মদিনার আশেপাশের বেদুইন গোত্রগুলো মুরতাদ হয়ে গেলো। তারা ইসলাম ত্যাগ করলো। মুনাফিকরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। একদল যাকাত দিতে অস্বীকার করলো।
এই যখন পরিস্থিতি তখন আবু বকর রা. বিজ্ঞ সাহাবীদের নিকট পরামর্শ চাইলেন। অধিকাংশ সাহাবী এই মুহুর্তে উসামা রা.-এর বাহিনীকে এখন সিরিয়ায় না পাঠানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বরং তাদেরকে বিদ্রোহ দমনে কাজে লাগানোর জন্য বলেছেন। এরকম পরামর্শদাতার মধ্যে উমার রা.ও ছিলেন। কিন্তু আবু বকর রা. রাসূল সা.-এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন করতে চাইছিলেন না। রাসূল সা.-এর নির্দেশ পূর্ণ করাকেই তিনি সর্বোত্তম মনে করেছিলেন।
তাই তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! যদি আমার মনে হয় যে, হিংস্র প্রাণীগুলো আমাকে ছিঁড়ে ফেলবে তবুও আমি রাসূলের নির্দেশ মতো উসামার অভিযান কার্যকর করবো এবং মদিনার চারপাশে পাহারা জোরদার করবো[১][২]। আবু বকর রা.-এর এমন দৃঢ় কথা শুনে সাহাবারা বুঝলো তিনি রাসূল সা.- সিদ্ধান্তকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিবেন। তাই আর কেউ প্রতিবাদ করেননি। এদিকে উসামা রা. ছিলেন আজাদকৃত দাস জায়েদ রা.-এর ছেলে। তাছাড়া তার বয়সও ছিল কম। আঠারো থেকে বিশ বছরের মধ্যে। তাই কিছু আনসার সাহাবী এমন তরুণের অধীনে এই ভয়ংকর যুদ্ধে যেতে গড়িমসি করছিল।
অবস্থা পর্যবেক্ষন করে উমার রা. পরামর্শ দিলেন, উসামা রা.-কে সরিয়ে অন্য কোনো সিনিয়র সাহাবীর অধীনে এই অভিযান প্রেরণ করা হোক। উমার রা.-এর পরামর্শ শুনে আবু বকর রা. অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন এবং বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! ধিক তোমাকে। স্বয়ং রাসূল সা. উসামাকে বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করেছেন। অথচ তুমি বলছো যে, আমি সেই পদ থেকে তাকে অপসারণ করি!
উমর রা. এই জবাব শুনে লজ্জিত হলেন এবং আনসারদের কাছে এসে বললেন, যাও, ধিক তোমাদের! আজ তোমাদের কারণে আমাকে খলিফাতুর রাসূলের নিকট থেকে অপ্রিয় কথা শুনতে হলো।[২]
রাসূল সা.-এর মৃত্যুর তিন পরেই আবু বকর রা. ঘোষণা করলেন, যারা উসামা রা.-এর বাহিনীতে যুক্ত ছিলেন তারা যেন দ্রুত জিহাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে জুরফে অবস্থানরত উসামা রা.-এর বাহিনীতে সমবেত হন। এই নির্দেশের ফলে সকল সিরিয়া অভিজানের সৈন্যরা জুরফে সমবেত হলো। আবু বকর রা. নিজেও সেখানে উপস্থিত হন। এই বাহিনীর মধ্যে উমার রা.-ও ছিলেন। তিনিও জিহাদের প্রস্তুতি নিয়ে উসামা রা.-এর বাহিনীতে যুক্ত হয়ে যান।
অবশেষে রাসূল সা.-এর মৃত্যুর ১৯ দিন পরে আবু বকর রা. সবাইকে নিয়ে জুরফে মিলিত হলেন। সেখানে তিনি পায়ে হেঁটে উপস্থিত যান আর তার সাথে সেনাপতি উসামা রা. ঘোড়ায় চড়ে যান। উসামাকে নেতা বানিয়ে তিনি তিন মাইল হেঁটে গেলেন। যাতে উসামাকে নেতা মানতে কারো সমস্যা না হয়। এরপর তিনি সেখানে একটি উদ্দীপ্ত ভাষণ দেন। সৈন্যরা জিহাদের জন্য প্রেরণা পেয়ে উজ্জীবিত হলো।
এরপর আবু বকর রা. উসামা রা.-এর কাছে অনুরোধ করলেন যাতে তার অধীনস্ত সেনাদের মধ্য থেকে উমার রা.-কে ছেড়ে দেয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় উমার রা.-কে প্রয়োজন। তাই তিনি উসামা রা.-কাছে উমার রা.-এর জন্য আবেদন করলেন। উসামা রা. সন্তুষ্টচিত্তে সম্মত হলেন। [৩]
বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি আবার বাহিনীকে থামালেন এবং তাদেরকে দশটি নির্দেশনা দিলেন। এই নির্দেশনাই ইসলামের যুদ্ধনীতির গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে আছে। তিনি বললেন,
হে লোকেরা! তোমরা একটু থামো। আমি তোমাদেরকে দশটি নির্দেশনা দিবো। তোমরা এগুলো স্মরণ রাখবে।
১. বিশ্বাসঘাতকতা করবে না এবং গানীমতের মালে খিয়ানত করবে না।
২. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না।
৩. শত্রুদের হাত পা কেটে বিকৃত করবে না।
৪. শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাদেরকে হত্যা করবে না।
৫. কোনো খেজুর বৃক্ষ উপড়ে ফেলবে না এবং জ্বালাবেও না।
৬. অন্য কোনো ফলের বৃক্ষ কর্তন করবে না।
৭. কোনো বকরী, গাভী ও উট খাবার প্রয়োজন ছাড়া জবাই করবে না।
৮. যাত্রাপথে তোমাদের সাথে এরূপ লোকের সাক্ষাত হতে পারে, যারা তাদের জীবনকে ইবাদাতখানার মধ্যে উৎসর্গ করে দিয়েছে (খ্রিস্টান পাদ্রী), তাদেরকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেবে।
৯. এরূপ লোকের সাথেও তোমাদের সাক্ষাত হতে পারে, যারা তোমাদের জন্য বিভিন্ন খাবার নিয়ে আসবে, যখন তোমরা ঐ খাবার খাবে, তখন অবশ্যই আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে।
১০. এরূপ লোকের সাথেও তোমাদের সাক্ষাত হতে পারে, যারা নিজেদের মাথার মধ্যাংশকে পাখির বাসার ন্যায় পরিণত করে এবং তার চতুষ্পর্শে পাগড়ির মতো কাপড় ফেলে রাখে (মরুভূমির ডাকাত), তাদেরকে তোমরা তরবারি দিয়ে আঘাত করবে।
যাও, আল্লাহর নামে অগ্রসর হও। আল্লাহ তোমাদেরকে শত্রুদের বর্শা ও মহামারী থেকে রক্ষা করুন!” [৪]
এরপর উসামা রা.-এর বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেলো। বাহিনীতে ১ হাজার অশ্বারোহীসহ তিনহাজার সৈন্য ছিল। আর আবু বকর রা. উমার রা.কে সাথে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
উসামা রা. দ্রুতবেগে বাহিনী নিয়ে সিরিয়া সীমান্তে পৌঁছে গেলেন আগে থেকেই তিনি গুপ্তচর নিয়োগ করে খবর সংগ্রহ করছিলেন। রোমানরা মুসলিম বাহিনীর আগ্রাসী অবস্থান দেখে রণেভঙ্গ দিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই তারা পালাতে থাকে। উসামা রা. তাঁর পিতা শাহদাতের সময় যে ঘোড়ায় ছিলেন সেই ঘোড়া নিয়েই যুদ্ধ করেন। যুদ্ধশেষে তিনি তার পিতার হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেন ও শিরচ্ছেদ করেন। এর মাধ্যমে মুতার যুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়া হয়।
উসামা রা. নিজে বাহিনীসহ পৌঁছার আগেই মদিনায় বিজয়ের খবর পাঠান। এই যুদ্ধে একজন মুসলিম সৈন্যও হতাহত হননি। বিজয়ের খবর মদিনায় পৌঁছলে মুসলিমদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ দেখা যায়। রাসূল সা.-এর মৃত্যুর পরে এই প্রথম মুসলিমদের আনন্দিত হতে দেখা গেল। এই খবরের আগে মদিনার মুসলিমরা কেবল মুরতাদ হওয়ার আর বিদ্রোহী হওয়ার খবর পেয়েছিল। তাই এমন আনন্দের খবরে উসামা রা.-কে স্বাগত জানাতে খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা. নিজে শহর ছেড়ে বহুদূর এগিয়ে গেছেন। মদিনার মহিলারাও বিজয়ী বাহিনীকে স্বাগত জানাতে মদিনার উপকন্ঠে জড়ো হন।
একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় রোমান শক্তির বিরুদ্ধে এমন জয় একইসাথে আবু বকর রা. এবং উসামা রা.-এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। উসামা রা. মদিনায় প্রবেশ করে মসজিদে নববীতে দুই রাকায়াত সালাতুশ শুকর আদায় করেন। এই বিজয় মুসলিমদের একতাবদ্ধ থাকতে প্রেরণা দিয়েছে।
মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ে অত্যন্ত হতবাক হয়ে পড়েন রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস। তিনি বললেন, এরা কেমন অদ্ভূত! তাদের নেতা মারা গেল। আর তারা এর পরক্ষণেই আমাদের ভূখন্ড আক্রমণ করলো। [৫] এই বিজয়ের মাধ্যমে সমস্ত শত্রু ও বিদ্রোহীদের কাছে বার্তা পৌঁছে গেল যে, মুহাম্মদ সা.-এর মৃত্যুতে মুসলিমরা শোকাকিভূত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। তাদের মধ্যে আগের মতো জজবা উপস্থিত রয়েছে।
তথ্যসূত্র :
১. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৬ষ্ঠ খন্ড / পৃ. ৪৫৪
২. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৪০৫
৩. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৬ষ্ঠ খন্ড / পৃ. ৪৫৬
৪. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৪০৭
৫. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৪১৩
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন