যখন মুসলিমরা পারসিকদের পর্যদস্তু করে ইরাকে একের পর এক শহর দখল করছিলেন তখন রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত অনুমান করেছিলেন ইরাকের পরই মুসলিমরা সিরিয়া আক্রমণ করবে। এদিকে খালিদ রা.-কে মুসলিমরা 'সাইফুল্লাহ' বা আল্লাহর তরবারি হিসেবে বিখ্যাত করে তুলেছিল। সাইফুল্লাহর ব্যাপারে মুশরিকদের ভয় না থাকলেও খ্রিস্টানরা ভয় পেতে শুরু করে। তারা ভেবেছিল মুহাম্মদ সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো তরবারি পেয়েছেন।
আবু বকর রা.-এর বিশ্রামবিহীন জয়যাত্রা অব্যাহত রাখায় রোমানরা সিরিয়া সীমান্তে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে পরিখা খনন করে। ব্যাপক গোয়েন্দা নিযুক্ত করে। সৈন্য সমাবেশ করে। সৈন্যদের উৎসাহ দিতে হেরাক্লিয়াস নিজেই রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) থেকে সিরিয়ার হিমসে অবস্থান করেন। রোমানদের মূল শক্তি নিয়ে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করেন।
মুসলিমদের মূল শক্তি ইরাকে থাকায় আবু বকর রা. সিরিয়ায় এগুতে পারছিলেন না। তাই তিনি খালিদ বিন সাঈদ রা. নেতৃত্বে একটি বাহিনী সিরিয়া সীমান্তে প্রেরণ করেন যাতে রোমানরা আগ্রাসী হয়ে এগুতে না পারে। তবে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন মদিনা থেকে নির্দেশ আসার আগে যেন তাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে না পড়ে। এদিকে খালিদ বিন সাঈদ রা. তাঁর গোয়েন্দা মারফত খবর পেলেন রোমানরা যুদ্ধের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। খালিদ ইবনে সাঈদ রা. চিঠি লিখে আবু বকর রা.-কে জানান রোমানরা প্রস্তুত, এমতাবস্থায় আমরা আগে আক্রমণ না করলে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা. তৎক্ষণাৎ ইকরিমা বিন আবু জাহলের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান। কিন্তু তিনি এতে নিশ্চিন্ত ছিলেন না। কারণ রোমানরা বীর যোদ্ধা, তারা পারসিকদের মতো অল্পতে মনোবল হারায় না। তদুপরি তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগামী। কিছুদিন আগে তারা পারসিকদের এক বিশাল বাহিনীকে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে পরাস্ত করেছিল। রোমানদের সাথে যুদ্ধ মোটেই সহজ ছিল না। আবু বকর রা. মজলিশে শুরা আহবান করলেন। সেখানে সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলেন। বেশিরভাগ সাহাবী যুদ্ধের পক্ষে রায় দিলেন। যদিও এটা কঠিন সিদ্ধান্ত তবে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। অবশেষে সবার মতামত নিয়ে রোমানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন খলিফা আবু বকর রা.।
আবু বকর রা. মদিনায় থাকা মুসলিম বাহিনীকে চারটি ইউনিটে ভাগ করেন।
১ম ইউনিট : এর নেতা ছিলেন ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান রা.। তাঁর দায়িত্ব ছিল সিরিয়ার দামেশক শহর অধিকার করা।
২য় ইউনিট : এর নেতা ছিলেন শুরাহবিল বিন হাসানাহ রা.। তাঁর দায়িত্ব ছিল বসরা নিয়ন্ত্রণে আনা।
৩য় ইউনিট : এর নেতা ছিলেন আবু উবাইদাহ ইবনে জাররাহ রা.। তাঁর দায়িত্ব ছিল হিমস দখল করা। যেখানে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস অবস্থান করছেন।
৪র্থ ইউনিট : এর নেতা ছিলেন আমর ইবনুল আস রা.। তাঁর দায়িত্ব ছিল ফিলিস্তিন দখল করা। ঐ সময় ফিলিস্তিন সিরিয়ার অংশ ছিল।
এর চার বাহিনীকে সিরিয়ায় পাঠানোর সময় আবু বকর রা. সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। তাদের উজ্জীবিত করেছেন। যুদ্ধের সময় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর বিধান সবসময় মনে রাখার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন।
মদিনা থেকে সব বাহিনী প্রেরণের পর এবার আবু বকর রা. সিরিয়া সীমান্তে থাকা খালিদ ইবনে সাঈদ রা.-কে যুদ্ধের জন্য অনুমতি দিলেন। সাথে সতর্ক করে দিলেন রাজ্যের আভ্যন্তরীণ পথ দিয়ে না এগুতে। তাহলে অতিক্রম করার পর রোমান জনগণ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
অনুমতি পেয়ে খালিদ ইবনে সাঈদ রা.-এর ছোট বাহিনী সিরিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। রোমান সীমান্তরক্ষীরা তাদের আগমনে পালাতে লাগলো। কামতান নামক স্থানে রোমানরা বাধা দিল। কিন্তু পরক্ষণেই পরাজিত হয়ে পিছু হটলো। রোমান সেনানায়ক বাহান ছিল অভিজ্ঞ। সে দামেশকের দিকে পিছু হটছিল। খালিদ বিন সাঈদ রা. ভেবেছিল তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আসলে রোমানরা মুসলিমদের তাদের জনপদের ভেতরে নিয়ে ঘিরে ফেলছিল। এই ব্যাপারে আবু বকর রা. তাঁকে সাবধান করেছিলেন। খালিদ বিন সাঈদ রা. চতুর্দিক থেকে আক্রমনের শিকার হলেন। তাঁর ছেলে শাহদাতবরণ করেন। এসময় মুসলিম বাহিনীর সাহায্যে ইকরিমা রা. পৌঁছে গেলেন। তিনি রোমানদের বেষ্টনী থেকে মুসলিমদের মুক্ত করে পিছু হটে পুনরায় সিরিয়া সীমান্তে চলে এলেন।
এদিকে রোমানরা মুসলিমদের চার বাহিনীর জন্য চারটি বিশাল বাহিনী তৈরি করেছে। ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান রা.-এর জন্য সারজিশের নেতৃত্বে ৪০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী দামেশকে প্রস্তুত হয়েছে। ইয়াজিদ রা.-এর ছিল চার হাজার সৈন্য। ৫০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী হেরাক্লিয়াস নিযুক্ত করেছে শুরাহবিল রা.-কে ঠেকানোর জন্য। বিনিময়ে মুজাহিদ আছে ৪ হাজার। এই দলের নেতৃত্বে ছিল রোমান বীর দারাকুস। পিটারের নেতৃত্বে ৬০ হাজার সৈন্যের আরেকটি বাহিনী নিযুক্ত করা হয়েছে হিমসে আবু উবাইদাহ রা.-কে ঠেকানোর জন্য। আবু উবাইদাহ রা.-এর কাছে সৈন্য ছিল মাত্র ৪ হাজার। আমর ইবনুল আস রা.-কে ঠেকানোর জন্য ৯০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী পাঠানো হয়েছে জেরুজালেমে। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল সম্রাট হেরাক্লিয়াসের ভাই থিয়োডর। বিনিময়ে আমর রা.-এর কাছে ছিল ৮ হাজার সৈন্য।
মুসলিম সেনাপতিরা যুদ্ধের ভয়াবহতা আঁচ করে আবু বকর রা.-কে খবর পাঠালেন। আবু বকর রা. নতুনভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা করলেন। তিনি সব বাহিনীকে একত্রিত হতে বললেন। ইকরিমা রা. নিজের বাহিনী ও খালিদ বিন সাঈদ রা.-এর বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার এক প্রান্তরে ব্যাকআপ বাহিনী হিসেবে অপেক্ষায় ছিলেন। তাকেও চলে আসতে বললেন। আবু বকর রা. সব বাহিনীকে আবু উবাইদাহ রা.-এর কাছে জমায়েত হতে নির্দেশ দিলেন। মুসলিমরা সবাই এক্ত্র হয়ে ইয়ারমুকের তীরে তাঁবু তৈরি করলো। মুসলিমরা একত্রিত হলে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসও সব দলকে একত্রিত হতে বললেন। থিয়োডর সম্মিলিত রোমান বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
আবু বকর রা. দেরি না করে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-কে নির্দেশ দিলেন অশ্বারোহী বাহিনী দ্রুত ইরাক থেকে যেন সিরিয়ার দিকে রওনা হয়। রোমানদের মোকাবেলা তাকেই করতে হবে। একইসাথে তাকে সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। খালিদ রা. মুসান্না রা.-কে ইরাকের দায়িত্ব দিয়ে দ্রুতগতিতে সিরিয়ায় যুদ্ধের প্রস্তুতিরত মুজাহিদদের সাথে মিলিত হলেন। তাঁর আসতে পাঁচদিন সময় লেগেছিল। মুসলিমরা তাঁর আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঐদিকে হেরাক্লিয়াসের নির্দেশে থিয়োডরও নিজেকে সংযত রাখছে। হেরাক্লিয়াস পূর্বেই মুহাম্মদ সা. নবী হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাই সে যুদ্ধ করতে সবসময় উদ্যত ছিল না।
খালিদ সাইফুল্লাহ রা. এসে বাহিনী পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি দেখলেন মুসলিমরা চার সেনাপতির অধীনে চারভাগে বিভক্ত। তিনি এটা ভেঙে দিতে চেয়েছেন। তাঁর আগে তিনি খলিফার পত্র মুসলিম সেনাপতিদের দেখালেন। তারা সবাই তাঁকে আমির মেনে নিয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে গেল। যুদ্ধক্ষেত্রে মজলিশে শুরায় মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-কে কমান্ড প্রদান করেন। এরপর খালিদ রা. সেনাবাহিনীকে ৩৬টি পদাতিক রেজিমেন্ট ও ৪টি অশ্বারোহী রেজিমেন্টে বিভক্ত করেন এবং তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকে ভ্রাম্যমান বাহিনী হিসেবে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রের বাম অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইয়াজিদ বি আবু সুফিয়ান রা.-কে। ডান অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমর ইবনুল আস রা.-কে। মাঝখানের ডান দায়িত্ব দেওয়া হয় আবু উবাইদা রা. ও শুরাহবিল রা.। খালিদ রা. কা'কা বিন আমর রা. এবং ইকরামা রা.-এর নেতৃত্বে একটি ছোট অগ্রবর্তী দল তৈরি করলেন। তারা খালিদ রা.-এর নির্দেশে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। এসময় হঠাৎ রোমানদের অগ্রবর্তী বাহিনীর কমান্ডার জর্জ যুদ্ধ থামাতে ইশারা করে বললেন তার কথা আছে। তিনি খালিদ রা.-এর সাথে কথা বলতে চান। জর্জ ছিলেন থিয়োডরের পুত্র এবং সম্রাট হেরাক্লিয়াসের ভাতিজা।
খালিদ রা. মুসলিমদের যুদ্ধ থামাতে বলেন। জর্জ খালিদ রা.-কে বললো,
- আমাকে সত্য কথা বলবেন। মিথ্যা বলবেন না। আপনাদের নবী কি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো তরবারি পেয়েছে? যার দ্বারা আপনারা একের পর এক বিজয় অর্জন করছেন?
- না
- তাহলে আপনাকে কেন সাইফুল্লাহ বলা হয়?
- আমার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে মুহাম্মদ সা. আমাকে এই উপাধি দিয়েছেন। সেই থেকে আমি সাইফুল্লাহ।
- আপনি সত্য বলেছেন। এখন বলুন, ইসলামের মূল শিক্ষা কী?
- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ
- কেউ যদি এই কথা না মানে?
- তাহলে তাকে জিজিয়া দিয়ে অনুগত থাকতে হবে।
- যদি কেউ জিজিয়া দিতে অস্বীকার করি?
- তবে তাদের সাথে আমরা লড়াই করবো।
- কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করে তবে তাকে সমাজে কীরূপ স্থান দেওয়া হবে?
- ইসলামে সবাই ভাই ভাই। কেউ আজ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে অন্যান্য মুসলিমের মতোই অধিকার দেওয়া হবে।
- আপনি শপথ করে বলুন, আপনি কোনো মিথ্যা বলেন নি।
- আল্লাহর শপথ আমি কোনো মিথ্যা বলিনি।
- আমি বিশ্বাস করেছি, আপনি সত্য কথাই বলেছেন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
এই বলে জর্জ মুসলিম হয়ে গেল। মুজাহিদরা আল্লাহু আকবার বলে আনন্দ প্রকাশ করতে শুরু করলো। অন্যদিকে রোমান বাহিনী এই ঘটনায় বিস্মিত ও ক্রোধান্বিত হয়ে আক্রমণ শুরু করে দিন। খালিদ রা. ও জর্জ বীরবিক্রমে যুদ্ধে শামিল হলেন। এর কিছুক্ষণ পর জর্জ শাহদাতবরণ করেন।
মুসলিমরা বিশাল বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গেল। কোনো স্থানে মুজাহিদরা বিপদে পড়লে ভ্রাম্যমান অশ্বারোহীরা তাদের উদ্ধারে নিয়োজিত ছিল। মুজাহিদদের প্রবল আক্রমণে রোমানরা দিশেহারা হয়ে পড়লো। কিন্তু তারা পালাতে পারছিল না। খালিদ রা. এই অবস্থার সুযোগ নিলেন। তিনি একপাশ থেকে মুসলিম সৈন্যদের সরিয়ে রাস্তা উন্মুক্ত করে দিলেন। ফলে বহু সৈন্য পালিয়ে গেল। ধীরে ধীরে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ মুসলিমদের হাতে চলে এলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা বিজয় দান করলেন। প্রায় আড়াই লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র ৩০ হাজারের বাহিনীকে আল্লাহ বিজয়ী করলেন।
এই যুদ্ধে বিজয় আসলেও বহু মুসলিম শাহদাতবরণ করেন। প্রায় তিনহাজার মুসলিম শাহদাতবরণ করেন। এই যুদ্ধেই মুসলিমরা ভ্রাতৃত্বের অনন্য নজির স্থাপন করেন। এক সাহাবী পানি পানি বলে চিৎকার করলে যখন তাঁর কাছে পানি নিয়ে যাওয়া হয় তখন আরেক সাহাবি পানি বলে চিৎকার করেন। ১ম জন ২য় জনের কাছে পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। এসময় আরেক পানি বলে ডাক দেয়। ২য় জন ৩য় জনের কাছে পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। এভাবে চলতে থাকে ৬ষ্ঠ জন পর্যন্ত। সাহাবারা একজন আরেক জনের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়। শেষ জনের কাছে পানি নিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল তিনি শাহদাত বরণ করেছেন। এভাবে সবাই পানি খাওয়া ছাড়াই শাহদাত বরণ করেছেন।
এই যুদ্ধ শেষে মুজাহিদরা আরেকটি খবর পেল। আর তা হলো খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা. ইন্তেকাল করেছেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন