সিরিয়ায় যখন মুসলিম বাহিনী সর্বাত্মক জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা. অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ধীরে ধীরে তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবু বাকর রা. প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায়ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলি ও খিলাফাতের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর মৃত্যু হতে যাচ্ছে।
তিনি আশংকা করলেন, এ সময় যদি তার মৃত্যু হয় এবং তার পরে মুসলিমদের মধ্যে আগের মতো খিলাফত নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয় এবং তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তবে এ দুর্বলতার সুযোগ নিবে দুই পরাশক্তি রোমান ও পারসিকরা। তারা ইসলামের নাম মুছে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তাই তিনি পরিকল্পনা করলেন, যদি সকলের মতামত নিয়ে কাউকে খলিফা হিসেবে নির্ধারণ করা যেতে পারেন, তা হলে তার পরে খিলাফাত নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতবিরোধ হবে না এবং তাদের ঐক্য ও সংহতি অটুট থাকবে। অবশেষে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তিনি জীবিত থাকতেই পরবর্তী খালীফা নির্বাচিত করে যাবেন।
আবু বকর রা. তাঁর ঘরে মজলিশে শুরার অধিবেশন আহবান করলেন। সিনিয়র সাহাবীরা উপস্থিত হলে তিনি বলেন, “তোমরা তো আমার অবস্থা দেখতে পাচ্ছো! আমার মনে হয় না যে, আর বাঁচবো! আল্লাহ তা'আলা আমার বাই'আত থেকে তোমাদের মুক্ত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের দায়িত্ব থেকে আমাকেও রেহাই দান করেছেন। উপরন্তু তোমাদের নেতৃত্বভার তোমাদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হলো। এখন তোমরা তোমাদের পছন্দ অনুযায়ী তোমাদের আমীর নিযুক্ত করো। যদি তোমরা আমার জীবদ্দশায় আমীর নিযুক্ত করতে পারো, তবে তা-ই সবচেয়ে ভালো হবে। তা হলে আমার পরে তোমাদের মতবিরোধে জড়িয়ে পড়তে হবে না।
সবাই সানন্দে তাঁর কথায় রাজি হলেন। আবু বকর রা. প্রত্যেকের কাছে জানতে চাইলেন উপস্থিত কেউ খিলাফতের দায়িত্ব নিতে রাজি কিনা? দেখা গেলো, কেউ নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হলো না বরং প্রত্যেকেই নিজের চেয়ে অন্যকে অধিকতর সং ও যোগ্য মনে করছেন। সর্বশেষ মজলিশে শুরার সকলেই মিলে খালিফা বাছাইয়ের দায়িত্ব আবু বকর রা.-এর হাতে অর্পণ করে বললেন, “হে খলিফাতুর রাসূল! আপনার রায়ই হলো আমাদের রায়। আপনিই নির্ধারণ করে দেন”
আবু বকর রা. বললেন, “পরে তোমরা কি মতবিরোধ করবে? তারা বললেন, না। আবু বকর রা. বললেন, “তা হলে কি আল্লাহর নামে অঙ্গীকার রইলো যে, তোমরা আমার মতের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে?" তারা বললো, হ্যাঁ। এরপর আবু বাকর রা. বললেন, "তা হলে আমাকে একটু ভাবার সুযোগ দাও। আমি দেখি, কে আল্লাহ তাঁর দ্বীন ও বান্দাহদের জন্য অধিকতর উপযুক্ত হন।
সভা শেষ হয়ে আবু বকর রা. প্রথমে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা.-কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার পরবর্তী খালিফা উমার হলে তুমি কেমন মনে করো? আবদুর রাহমান ইবনু আওফ রা. জবাব দিলেন, “আপনি আমাকে এমন একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলেন, যে সম্পর্কে আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন।” আবু বকর রা. বললেন, “তবুও তোমার মতামত চাই। আবদুর রাহমান রা. বললেন, “আল্লাহর কসম, তিনি তো অনেক ভালো লোক।" এরপর আবু বাকর রা. আবদুর রাহমান রা.-কে বললেন, “আমি তোমার সাথে যে বিষয়ে আলাপ করলাম, এ ব্যাপারে তুমি অন্য কাউকে কিছু বলো না।
একইভাবে আবু বকর রা. উসমান রা., আলী রা. উসাইদ বিন হুদাইর, সাঈদ ইবনু জায়েদ রা. সহ বহু মুহাজির ও আনসার নেতাদের সাথে উমার রা.-এর ব্যাপারে আলাপ করলেন। সকলের তাঁর ব্যাপারে পজেটিভ মতামত দিল। এভাবে পরামর্শ করতে গিয়ে মোটামুটি মদিনায় জানাজানি হয়ে গেল উমার রা.-ই হতে যাচ্ছেন পরবর্তী খলিফা। এই খবরে শুধু একজন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি হলেন তালহা রা.
তিনি শুয়ে থাকা আবু বকর রা.-এর পাশে বসে বললেন, হে খিলিফাতুর রাসূল! আপনি অবগত আছেন যে, উমার রা.-এর মেজাজ অত্যন্ত কঠোর। তা সত্ত্বেও যদি আপনি তাকে খলিফা নিযুক্ত করে যান তবে আল্লাহ জিজ্ঞাসা করলে কী উত্তর দিবেন?
খলিফা এই ধরণের কথায় কষ্ট পেলেন। তিনি উঠে বসতে গেলেন কিন্তু পারলেন না। পরে বললেন, আমাকে উঠাও। তিনি আর শুয়ে থাকতে পারলেন না। লোকজন বসিয়ে দিলে তিনি বললেন, আমাকে আল্লাহর ভয় দেখাচ্ছো! অন্যায়ভাবে যে কেউ তোমাদের নেতৃত্ব লাভ করলে সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমি যখন রবের সাথে মিলিত হবো তখন তিনি এই বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলবো, ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার বান্দাদের জন্য একজন সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই খলিফা নিযুক্ত করেছি।
এরপর তিনি বললেন, আমার নম্র ব্যবহার দেখেই উমার রা. কঠোরতা দেখাতেন। খিলাফতের দায়িত্ব মাথায় আসলে তাঁর কঠোর প্রকৃতি অনেকাংশে কমে যাবে। আমি নিজে লক্ষ্য করেছি আমি যেখানে নম্র ও কোমল ব্যবহার করেছি সেখানে তিনি কঠোর হয়েছেন। আবার আমি যেখানে কঠোর হয়েছি তিনি সেখানে কোমলতা দেখিয়েছেন।
এরপর তালহা রা. লজ্জিত হয়ে চলে গেলেন।
আবু বকর রা. এবার উমার রা.-কে ডেকে খলিফার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বললেন। তিনি রাজি হলেন না বরং অন্য কারো পরামর্শক হয়ে থাকতে চেয়েছেন। আবু বকর রা. তাঁকে ধমক দিয়ে দায়িত্ব নিতে বললেন। অবশেষে আবু বকর রা.-এর চাপে নতি স্বীকার করে দায়িত্ব নিতে সম্মত হন।
পরদিন আবু বকর রা. উসমান রা.-কে ডেকে খলিফা নিযুক্তির গেজেট লিখতে বললেন। আবু বকর রা. বলে দিচ্ছিলেন ও উসমান রা. লিখে যাচ্ছিলেন।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
এটি ইহলোক ত্যাগ করে পরপারের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার সময় আবু বকর ইবনু কুহাফার ওসিয়্যাত। এ অন্তিম মুহূর্তটি এমন কঠিন যে, এ সময় কাফিরও স্বেচ্ছায় ঈমান আনয়ন করে, পাপিষ্ঠ লোকও বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মিথ্যুক ব্যক্তিও সত্য কথা বলে। আমার পরে আমি উমার ইবনুল খাত্তাবকেই তোমাদের খলিফা মনোনীত করে যাচ্ছি। অতএব, তোমরা সকলেই তার কথা শুনবে ও মেনে চলবে। আল্লাহ, তাঁর রাসূল, দ্বীন এবং নিজের ও তোমাদের কল্যাণ কামনা করতে আমি কোনোরূপ ত্রুটি করিনি। আমার ধারণা ও বিশ্বাস, সে ন্যায়বিচার করবে। যদি সে অন্যায় করে, তবে প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আমি আমার বিবেক অনুযায়ী তোমাদের কল্যাণ সাধন করতে চেষ্টা করেছি। তবে আমি গায়েব জানি না। অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে তাদের পরিণাম কিরূপ!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
এরপর উসমান রা.-কে বললেন এতে মোহর মারতে এবং জনগণের সামনে তা ঘোষণা করে দিতে। মসজিদে নববীর সামনে জমায়েত হাজারো মানুষের সামনে উসমান রা. এই ওসিয়ত ঘোষণা করলেন। জনগণ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিলো এবং উমার রা.-এর কাছে বাইয়্যাত নিতে শুরু করলো।
এসময় খলিফা আবু বকর তাঁর স্ত্রীর সহায়তায় বহু কষ্টে মসজিদের সামনে আসলেন। তিনি বললেন, আমি যাকে তোমাদের জন্য খলিফা নিযুক্ত করেছি, তোমরা কি তাকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছো? আমি তো আমার কোনো আত্মীয়কে খলিফা নির্বাচিত করিনি। আমি উমারকেই খলিফা নিযুক্ত করেছি। তোমরা তার কথা শুনবে ও মেনে চলবে। আল্লাহর কসম! আমি আমার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করিনি।
জনগণ সমস্বরে বলে উঠলো, আমরা আপনার শুনলাম এবং আপনার কথা মেনে নিলাম।
এরপর আবু বকর রা. এবার উমার রা.-কে একান্তে ডেকে নিয়ে পরামর্শ দিতে লাগলেন,
//হে ‘উমার!, আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করো। জেনে রেখো যে, দিনের বেলা আল্লাহর প্রতি বান্দাহর যে কর্তব্য রয়েছে, তা তিনি রাতে কবুল করেন না, অনুরূপভাবে রাতের বেলা যে কর্তব্য রয়েছে, তা তিনি দিনের বেলা কবুল করেন না। (অর্থাৎ প্রত্যেকটি দায়িত্ব সময়মতো সম্পন্ন করা উচিত)। তিনি কোনো নফল কাজ কবুল করেন না, যতক্ষণ না ফরজ আদায় করা হয়।
উমার, তুমি কি মনে করো না যে, সুখ-শান্তি ও বিপদ-আপদ- দু'ধরনের আয়াতই অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে মু'মিনদের মধ্যে ভয় ও আশা দুটিই বিদ্যমান থাকে। কিন্তু আল্লাহর নিকট কোনো মুমিনের এমন কোনো কিছুই আশা করা উচিত নয় যে, যাতে তার কোনো অধিকার নেই। অনুরূপভাবে তার এমন কোনো কিছুকে ভয় করাও উচিত নয় যে, যাতে সে নিজেই পতিত হয়। (অর্থাৎ কেউ যদি কোনো বিষয়কে ভয় করে, তা হলে তার সে বিষয় থেকে দূরে থাকা উচিত।)
উমার, তুমি কি মনে করো না যে, আল্লাহ তা'আলা জান্নাতবাসীদের উল্লেখ তাদের উত্তম কার্যাবলির সাথে করেছেন। কেননা আল্লাহ তা'আলা তাদের যে অন্যায় কাজগুলো ছিল তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতএব যখন তুমি তাদেরকে স্মরণ করবে তখন বলবে, তাদের মতো আমাদের আমল কোথায়? অনুরূপভাবে আল্লাহ তা'আলা জাহান্নামবাসীদের উল্লেখ তাদের অন্যায় ও অবৈধ কার্যাবলির সাথে করেছেন। যখন তোমরা তাদেরকে স্মরণ করবে তখন বলবে, আমি একান্তই আশা পোষণ করি, যেন তাদের মতো না হই। এভাবে বর্ণনা করার কারণ হলো, যাতে বান্দাহদের মধ্যে আশা ও ভয়- দুটিই বিদ্যমান থাকে। ফলে কেউ আল্লাহর প্রতি অতি আশাবাদী হবে না, আবার কেউ আল্লাহর রহমাত থেকে নিরাশ হবে না।
যদি তুমি আমার উপদেশ মনে রাখো, তা হলে এমন কোনো অদৃশ্য বস্তু নেই, যা তোমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে বেশি প্রিয় হবে। আর এ মৃত্যু তোমার কাছে আসবেই। আর যদি আমার উপদেশ মনে না রাখো, তা হলে এমন কোনো অদৃশ্য বস্তু নেই, যা তোমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে বেশি অপ্রিয় হবে। আর এ মৃত্যুকে তুমি ফিরিয়েও রাখতে পারবে না। //
উমার রা.-কে কঠোরভাবে মৃত্যর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন খলিফা। উমার রা.-কে বিদায় দিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে উমার রা.-এর জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করলেন আল্লাহর কাছে। খলিফা আবু বকর রা.-এর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা. ইন্তেকাল করলেন। নতুন নেতা হিসেবে মিম্বরে বসলেন উমার ইবনুল খাত্তাব রা.। ইয়ারমুক নদীর তীরে যুদ্ধরত সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. যুদ্ধের চলাকালীন মদিনা থেকে আসা গোয়েন্দা মারফত খবর পেলেন আবু বকর রা. ইন্তেকাল করেছেন। নতুন খলিফা উমার রা.। যুদ্ধ জয়ের আগে তিনি এই খবর কাউকে জানান নি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন