আবু বকর রা.-এর ইন্তেকালে মুষড়ে পড়েছে মদিনাবাসী। আনসার মুহাজির নির্বিশেষে সবাই শোক প্রকাশ করলেন। যদিও অনুমিত ছিল কিছুদিনের মধ্যেই খলিফাতুর রাসূল ইন্তেকাল করবেন। তবুও তাঁর ইন্তেকালে মুসলিমেরা ভেঙে পড়েছিল। মুহাম্মদ সা. একান্ত অনুসারীকে মুসলিমরা পেয়েছিলো পরম অভিভাবকরূপে।
আবু বকর রা.-এর মৃত্যুর খবর শুনে আলী রা. ইন্নালিল্লাহ বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আবু বকর রা.-এর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি একটি বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন,
“হে আবু বকর! আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আপনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু, বিপদের সহায়, সমবেদনা জ্ঞাপনকারী, রহস্যের আধার, বিশ্বস্ত সাথী ও সকল কাজের পরামর্শদাতা। আপনি হলেন সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী এবং সর্বাপেক্ষা সাচ্চা ও সুদৃঢ় ঈমানদার। আপনি হলেন সর্বাধিক মুত্তাকি। আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে আপনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ চিন্তার অধিকারী । আপনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাহচর্যের প্রকৃত হক আদায়কারী, রাসূলুল্লাহ সা.-এর দরবারে সর্বাপেক্ষা অধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত, আপনার গুণাবলি অসংখ্য ও অসীম, আপনার মর্যাদা অতি উচ্চ, রাসূলুল্লাহ সা.-এর একান্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তি, মহান মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। আল্লাহ তা'আলা আপনাকে ইসলামের পক্ষ থেকে এবং রাসূলুল্লাহ সা.-এর পক্ষ থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন!
আপনি রাসূলুল্লাহ সা.-এর পাশে কান ও চোখের মতো ছিলেন। হে আবু বকর, আপনি রাসূলুল্লাহ সা.-এর ওপর এমন সময় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন, যখন দুনিয়ার সমস্ত লোক তার প্রতি অবিশ্বাস করেছিল। আল্লাহ তা'আলা আপনার নাম রেখেছেন আস সিদ্দীক। আপনি ইসলামের জন্য আপনার ধন-সম্পদ এমন সময়ে অকাতরে ব্যয় করেছেন, যখন সকল মানুষই কৃপনতা করেছে।
আপনাকেই রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাওর গুহার সাথী এবং দু'জনের একজন বলা হয়েছে। গুহার মুখে শত্রুর আভাস পেয়ে আপনি রাসূলুলাহ সা.-এর জন্য অস্থির হয়ে পড়লে আপনাকে আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে সান্ত্বনা প্রদান করা হয়েছিল। আপনি খিলাফতের যাবতীয় কর্তব্য অতীব সুন্দরভাবে পালন করেছেন। লোকজন যখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তখন আপনি ছিলেন পূর্ণ কর্মতৎপর। যখন তারা অক্ষম হয়ে পড়েছিল তখন আপনি পূর্ণ শক্তি নিয়ে প্রকাশ পেয়েছিলেন। আপনি রাসূলুল্লাহ সা.-এর আদর্শকে সে সময় আঁকড়ে ধরেছিলেন, যখন তারা তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল।
আপনি কোনোরূপ বিতর্ক ও অনৈক্য ছাড়াই খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন, যদিও এ নির্বাচন মুনাফিকদের ক্রোধ ও কাফিরদের মনোবেদনা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বিদ্রোহীদের হিংসার কারণে পরিণত হয়েছিল। যখন লোকজন দুর্বল হয়ে পড়েলি, তখন আপনি সত্যের ওপর অবিচল ছিলেন। যখন তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন আপনি অনড় ছিলেন। যখন তারা বিচলিত হয়ে যায়, তখন আপনি আল্লাহর নূর নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছেন। অবশেষে তারা আপনাকে অনুসরণ করেছে এবং হিদায়াত লাভ করেছে। তাদের তুলনায় আপনার আওয়াজ ক্ষীণ ছিল; কিন্তু সবার চেয়ে আপনার মর্যাদা অধিক, আপনার কথোপকথন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সঠিক ছিল। আপনি ছিলেন স্বল্পভাষী।
আপনার বক্তব্য সবচেয়ে অলঙ্কারপূর্ণ ছিল। বীরত্বের দিক দিয়ে আপনি ছিলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী। আপনি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট বিজ্ঞ ছিলেন। সঠিক আমলের দিক দিয়ে আপনি সবার চেয়ে উত্তম ছিলেন। আপনি দ্বীনের প্রথম নেতা ছিলেন। যখন লোকেরা দ্বীন ছেড়ে চলে যায়, তখন আপনি ছিলেন কঠোর। যখন তারা পুনরায় দীনের দিকে ফিরে আসে, তখন আপনি ছিলেন মুমিনদের জন্য অত্যন্ত দয়ালু নেতা।
যে ভারী বোঝা তারা ওঠাতে সক্ষম হয়নি, তা আপনি উঠিয়েছেন। লোকেরা যে সকল বস্তু ছেড়ে রেখেছে, তা আপনি হিফাজত করেছেন। যা কিছু তারা হারিয়েছে আপনি তা সংরক্ষণ করেছেন। তারা যা জানতো না, তা আপনি তাদেরকে শিখিয়েছেন। যখন তারা ক্লান্ত ও অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন আপনি পূর্ণ কার্যক্ষম ছিলেন। যখন তারা ভীত হয়ে পড়ে, তখন আপনি সহনশীলতার সাথে কাজ করেন।
যখন তারা হিদায়াতের জন্য আপনার আদর্শ গ্রহণ করে তখন তারা সফলতা অর্জন করে এবং তারা এমন কিছু লাভ করে যা তারা কল্পনাও করে না। আপনি কাফিরদের জন্য আযাবের বৃষ্টি এবং অগ্নির গলিত শিখা ছিলেন এবং মু'মিনদের জন্য ছিলেন রহমত ও আশ্রয়স্থল। আপনি বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন। আপনাকে যেগুলো প্রদান করা হয়েছিল, আপনি তার উত্তমগুলোই অর্জন করেছিলেন।
আপনার যুক্তি পরাভূত হয়নি, আপনার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়নি, আপনার মন দুর্বল হয়নি। আপনার অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয়নি এবং তা কখনো দুর্বল হয়ে যায় নি। আপনি ছিলেন ঐ পাহাড়ের মতো, যেটাকে কোনো ঝড়ও নাড়াতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ সা.-এর বক্তব্য অনুযায়ী আপনি বন্ধুত্ব ও সম্পদ দ্বারা সবচেয়ে উত্তম খিদমত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর বক্তব্য অনুযায়ী দৈহিক নিয়ে যদিও আপনি জীর্ণ ছিলেন; কিন্তু আল্লাহর বিধি-বিধানের ব্যাপারে ছিলেন খুবই শক্তিশালী।
আপনি মনের দিক দিয়ে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, আল্লাহর নিকট মর্যাদাশীল এবং লোকদের চোখে অত্যন্ত সম্মানিত। আপনার প্রতি কেউ বিদ্রুপ করতে পারেনি এবং আপনার সামনে কেউ বাকচাতুরী করতে সাহস পায়নি। আপনার প্রতি কারো বিদ্বেষ ছিল না, আপনি কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেননি। দুর্বল ও নীচ ব্যক্তি আপনার নিকট ছিল শক্তিশালী। কেননা আপনি তার অধিকার বা দাবি আদায় করে দিতেন। অপরদিকে শক্তিশালী ব্যক্তিও আপনার নিকট দুর্বল ছিল। কেননা আপনি তাদের নিকট থেকে অন্যের দাবি আদায় করে দিতেন।
দূরবর্তী-নিকটবর্তী উভয় প্রকার লোকই আপনার নিকট সম্মানিত ছিল। যে ব্যক্তি আল্লাহকে বেশি ভয় করে চলতেন, তিনিই আপনার নিকট অধিক প্রিয় ছিলেন। সততা ও বিনয় ছিল আপনার ভূষণ, আপনার কথা ছিল অকাট্য, কার্যক্রম ছিল সহনশীলতা ও দূরদর্শিতাপূর্ণ। আপনার মতামত ছিল জ্ঞানগর্ভ ও দৃঢ়তাপূর্ণ। আপনি এ অবস্থায় দুনিয়া ত্যাগ করে যাচ্ছেন, যখন পথ নিষ্কন্টক হয়েছে, বিপদাপদ সহজ হয়ে গেছে। আগুন নির্বাপিত হয়ে গেছে, দ্বীন সঠিক পথে এসে পৌঁছেছে। ঈমান শক্তিশালী হয়েছে, ইসলাম ও মুসলিমদের অবস্থা দৃঢ় ও স্থায়ী হয়েছে, আল্লাহর বিধান সফলতা অর্জন করেছে, যদিও এতে কাফিরদের বিরোধিতা ছিল।
আল্লাহর কসম, আপনি এমন দ্রুত গ্রসর হয়েছেন যে, আপনার পরবর্তীদেরকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আপনি কল্যাণ অর্জন করার ক্ষেত্রে মহাসাফল্য অর্জন করেছেন। আপনার ওপর আক্ষেপ করা হবে- এমন কিছু থেকে আপনি অনেক উর্ধ্বে। আপনার মৃত্যুর বেদনা আকাশে অত্যন্ত দুঃখের সাথে অনুভূত হচ্ছে। আপনার বিচ্ছেদ সমস্ত পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। আল্লাহ প্রদত্ত ভাগ্যের ওপর আমরা সন্তুষ্ট আছি এবং আমাদের সকল বিষয় তাঁর কাছে সোপর্দ করে দিয়েছি।
আল্লাহর কসম, রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওফাতের পর আপনার মৃত্যুর মতো এমন বিপদ মুসলিমদের ওপর পতিত হয়নি। আপনি ছিলেন দ্বীনের গৌরব ও আশ্রয়স্থল। আপনি মুসলিমদের জন্য ছিলেন দুর্গ ও দয়ার ঝরণা এবং মুনাফিকদের জন্য কঠোর । আল্লাহ আপনাকে আপনার নবীর সাথে মিলিত করুন! তিনি যেন আমাদেরকে আপনার পরে আপনার প্রতিদান থেকে বঞ্চিত না করেন অথবা আপনার পথ থেকে পথভ্রষ্ট না কৱেন- এ কামনাই পোষণ করি।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
উপস্থিত মদিনাবাসী নীরবে আলী রা.-এর এই ভাষণ শুনলেন এবং কাঁদলেন। অতঃপর সবাই বললেন, হে রাসূলের জামাতা! আপনি সঠিক বলেছেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন