খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর আবু বকর রা. ইসলামী রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করে শাসন করেছিলেন। উমার রা.-ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। উমার রা. তাঁর ১০ বছরের শাসনামলে প্রশাসকদের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। প্রয়োজনে তাদেরকে দায়িত্ব থেকে অপসারণও করেছিলেন।
মক্কা : মুহাম্মদ সা. ও আবু বকর রা.-এর শাসনামলে মক্কার গভর্নর ছিলেন আত্তাব ইবনে আসিদ রা.। তাঁর মৃত্যুর পর উমার রা. মুহরাজ ইবনে হারিসাকে মক্কার দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর ফুনকুজ ইবনে উমায়েরকে দায়িত্ব দেন। তারপর নাফি ইবনু হারিসকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন উমার রা.।
মদিনা : মদিনা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী। এখানে আলাদা কোনো প্রশাসক ছিলেন না। খলিফা নিজেই মদিনার তত্ত্বাবধান করতেন। তবে কোনো কারণে মদিনা থেকে বের হলে তিনি জায়িদ বিন সাবিত রা.-কে মদিনার তত্ত্বাবধায়ক করে যেতেন। কোনো সময় আলী রা.-কেও এই দায়িত্ব দিতেন।
তায়িফ : এখানকার শাসনকর্তা ছিলেন উসমান ইবনু আবুল আস রা.। তিনিও রাসূল সা. কর্তৃক নিযুক্ত ছিলেন। উমার রা. সময়ে তিনি জিহাদে যাওয়ার জন্য আবেদন করলে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় সুফিয়ান ইবনু আব্দুল্লাহ আস সাকাফিকে।
ইয়েমেন : আবু বকর রা.-এর সময়ে ইয়েমেনে বিদ্রোহীরা অস্থিরতা শুরু করে দিয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতে ইয়েমেনে অনেকজন প্রশাসক ছিল। যেমন মুহাজির ইবনে আবু উমাইয়া রা., আবু মুসা আশয়ারি রা., যিয়াদ ইবনু লাবীদ রা. ও আলা ইবনু আবি উমাইয়া রা.। উমার রা.-এর সময়ে ইয়েমেন ছিল স্থিতিশীল। উপরন্তু ইয়েমেনের যোদ্ধারা সিরিয়া ও ইরাক অভিযানে অংশ নিয়ে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করছিল। তাই উমার রা. সমগ্র ইয়েমেনে একজন প্রশাসক রাখেন আর তিনি হলেন আলা ইবনু আবি উমাইয়া রা.।
বাহরাইন : আবু বকর রা.-এর সময় থেকে এখানকার শাসনকর্তা ছিলেন আলা ইবনুল হাদরামী রা.। বসরা ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীনে আসলে উমার রা. আলা ইবনু হাদরামী রা.-কে বসরার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। তাঁর এই অপসারণের কারণ ছিল তিনি খলিফার অনুমতি ছাড়াই পারসিকদের সাথে নৌ-পথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তবে তিনি বসরার দায়িত্ব উমার রা. তাঁর স্থলে বাহরাইনের প্রশাসক নিযুক্ত করেন তায়িফের সাবেক শাসক উসমান ইবনু আবুল আস রা.-কে। তিনি উমার রা.-এর নির্দেশে পারসিকদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি যখন যুদ্ধে লিপ্ত তখন বাহরাইনে প্রশাসক নিযুক্ত হন আইয়াশ ইবনু আবু সাওর। এরপর কুদামা ইবনে মাজউন প্রশাসক হন। কুদামার বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ আসে। উমার রা. তদন্ত করে এর সত্যতা পান। তিনি তাকে প্রশাসক থেকে অপসারণ করে আবু হুরাইরা রা.-কে বাহরাইনের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। তিনি এর আগে বাহরাইনের বিচারক ছিলেন। উসমান বিন আবুল আস রা. যুদ্ধ শেষে ফিরে আসলে তিনি পুনরায় বাহরাইনের প্রশাসক হন। বাহরাইনের সাথে ওমান ও ইয়ামামাও যুক্ত ছিল।
ইরাক : ইরাক অধিকারে আসে আবু বকর রা.-এর সময়ে। তখন খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-কে সিরিয়ার প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। এরপর সিরিয়া অভিযানের সময় রোমানদের বিরুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদের সহায়তার প্রয়োজন হলে আবু বকর রা. খালিদ রা.-কে সিরিয়াতে সেনানায়ক করে পাঠান। আর ইরাকের দায়িত্ব দেন মুসান্না রা.-কে। মুসান্না রা.-ই প্রথম পারসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। উমার রা. খলিফা হওয়ার পর একইসাথে মুসান্না রা. ও খালিদ রা.-কে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন। এই প্রসঙ্গে উমার রা. বলেন, আমি তাদেরকে তাদের কোনো অপরাধের জন্য পদচ্যুত করিনি। তাদের পদচ্যুত করার কারণ মুসলিমরা তাদেরকে যুদ্ধজয়ের জন্য ভরসা করা শুরু করেছিল। যুদ্ধজয় খালিদ বা মুসান্নার জন্য হয় না বরং আল্লাহর সাহায্যে হয়। মুসান্না রা.-কে সরিয়ে ইরাকের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় আবু উবাইদ ইবনে মাসউদ রা.-কে। পদচ্যুত হয়ে মুসান্না রা. নিষ্ঠার সাথে আবু উবাইদ রা.-এর অধীনে যুদ্ধ করেছেন। আবু উবাইদ রা. শাহদাতবরণ করলে পুনরায় মুসান্না রা. প্রশাসকের দায়িত্ব পান।
সিরিয়া : সিরিয়াতে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.কে মুসলিম বাহিনীর সেনানায়ক হিসেবে পাঠান আবু বকর রা.। ইয়ারমুকের যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি আবু উবাইদা রা.-কে সরিয়ে যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ খালিদ রা.-কে সেনানায়ক করেন। যুদ্ধ চলাকালে আবু বকর রা. ইন্তেকাল করেন। ইয়ারমুকে রোমানদের পরাজিত করার পর উমার রা. খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-কে পদচ্যুত করে সিরিয়ার প্রশাসক নিযুক্ত করেন আবু উবাইদা অবনুল জাররাজ রা.-কে। তিনি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে শাহদাতবরণ করলে মুয়াজ বিন জাবাল রা.-কে সিরিয়ার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আবু উবাইদা সফরে ও জিহাদে গেলে মুয়াজ রা.-কে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। মুয়াজ রা.-ও প্লেগ মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে শাহদাতবরণ করলে ইয়াজিদ ইবনু আবু সুফিয়ানকে সিরিয়ার প্রশাসক নিযুক্ত করেন উমার রা.। ইয়াজিদ ইবনু আবু সুফিয়ানকে আবু বকর রা. সিরিয়া অভিযানের সময় কমান্ডার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি সেখানে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ ও জিহাদে লিপ্ত ছিলেন। এক বছরের মতো দায়িত্ব পালন করে তিনিও প্লেগ রোগে শাহদাতবরণ করেন। ইয়াজিদ রা. মৃত্যুর আগে তার ভাই মুয়াবিয়া রা.-কে দায়িত্ব দিয়ে যান। খলিফা উমার রা. এই দায়িত্বকে অনুমোদন করেন।
মিসর : মিসর বিজয়ের নেতৃত্ব দেন আমর ইবনুল আস রা.। সেই থেকে আমর ইবনুল আস রা.-কে মিসরের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন উমার রা.।
বসরা : বসরার ১ম শাসক নিযুক্ত হন শুরাইহ বিন আমর রা.। কিছুদিন পর তিনি জিহাদের সময় শাহদাতবরণ করলে তার স্থলাভিষিক্ত হন উতবা বিন গাজওয়ান। উতবা বিন গাজওয়ান ইন্তেকাল করলে খলিফা উমার রা. প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন মুগিরা বিন শুবা রা.-কে। ১৭ হিজরিতে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ আসে। অভিযোগের কারণে তাঁকে পদচ্যুত করা হয়। এই নিয়ে বিচার ও তদন্ত হয়। তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। উমার রা. তাঁকে পুনরায় একই পদে বহাল রাখেন নি, কুফায় পাঠিয়ে দেন। মিথ্যা সাক্ষ্যের অভিযোগে তিনজনের শাস্তি হয়। মুগিরা রা.-এর পর বসরার প্রশাসক হন আবু মুসা আশাআরি রা.। বসরার মানুষ আবু মুসা রা.-কে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
কুফা : কুফা ইসলামের অধীনে আসার পর সেখানে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.। জনগণদের মধ্যে কয়েকজন সা'দ রা.-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে উমার রা. তাঁকে সরিয়ে দেন। তার স্থলে আম্মার ইবনে ইয়াসির রা.-কে নিযুক্ত করেন। তার বিরুদ্ধেও জনগণ অভিযোগ আনলে তাকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। অতঃপর কুফার গভর্নর করা হয় মুগিরা বিন শুবা রা.-কে।
মাদায়েন : মাদায়েন ছিল পারস্য সম্রাট খসরুর রাজধানী। সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.-এর নেতৃত্বে মাদায়েন বিজয় করে মুসলিমরা। এই যুদ্ধে সা'দ রা.-এর অন্যতম সহযোগী ছিলেন সালমান ফারসি রা.। সা'দ রা.-কে কুফায় ও সালমান রা.-কে মাদায়েনের প্রশাসক নিযুক্ত করেন উমার রা.। সালমান রা. জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। কিন্তু তিনি এই দায়িত্বের ব্যাপারে সবসময় অব্যাহতি চাইতেন। অবশেষে উমার রা. তাঁর আবেদন কবুল করে তার স্থলে হুজাইফা ইবনে ইয়ামান রা.-কে প্রশাসক নিযুক্ত করেন।
আজারবাইজান : আজারবাইজান অভিযানে নেতৃত্ব দেন হুজাইফা ইবনে ইয়ামান রা.। আজারবাইজান ইসলামের অধীনে আসলে তিনিই হন প্রথম প্রশাসক। পরে তাঁকে মাদায়েনে পোস্টিং করা হলে উতবা ইবনে ফারকাদ রা.-কে আজারবাইজানের প্রশাসক হিসেব নিযুক্ত করেন উমার রা.।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন