খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা. বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দিয়ে আসার পর নজদের আবস ও যুবইয়ান গোত্র ভয়ংকর কাজ করে। তাদের গোত্রে থাকা নিষ্ঠাবান কয়েকজন মুসলিমকে হত্যা করে। খবর পেয়ে আবু বকর রা. খুবই মর্মাহত হন। তিনি শপথ করলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এই গোত্রগুলোর লোকদের ওপর মুসলিমদের অন্যায় রক্তপাতের প্রতিশোধ গ্রহণ না করবো, ততক্ষণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবো না। [১]
ইতোমধ্যে রোমানদের বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে বিশাল বিজয় অর্জন করে ফিরেছেন উসামা রা.। আলী রা. তাঁকে বীরোচিত সংবর্ধনা প্রদান করেন এবং তাদের বিশ্রাম নিতে বলেন। মুহাম্মদ সা. তরুণ উসামা রা.-কে রোমানদের বিরুদ্ধে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। অনেক সাহাবি এতে আস্থা না রাখলেও আলী রা. মুহাম্মদ সা.-এর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোনোরূপ সংশয়ে ছিলেন না। উসামা রা. তাঁর রাজনৈতিক নৈপুণ্যে প্রমাণ করলেন তিনি যোগ্য নেতা। রোমানদের অপ্রস্তুত রেখেই তিনি যুদ্ধ জয় করে নিলেন ও মুতার যুদ্ধে তাঁর পিতার খুনের প্রতিশোধ নেন। খলিফা আবু বকর রা. উসামা রা.-এর মধ্যে নেতৃত্বের গুণ দেখতে পান। তাই আবস ও যুবইয়ান গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার প্রাক্কালে উসামা রা.-কে মদিনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন। [২]
আবস ও যুবইয়ান গোত্রের ধৃষ্টতা দেখে এই কথা নিশ্চিত করে বলা যায় তারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধের জন্য ভালো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাই সাহাবীরা খলিফা আবু বকর রা.-কে বারণ করছিলেন তিনি নিজে না গিয়ে যাতে অন্য সেনাপতিদের পাঠান। এই ব্যাপারে আবু বকর রা.-কে মদিনায় থেকে যেতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন আলী রা.। তিনি বলেছেন, আলী রা. বলেন, হে খলিফাতুর রাসূল! আপনি কই যাচ্ছেন? আপনি তারবারি কোষবদ্ধ করুন। নিজের জীবনকে বিপন্ন করে আমাদের বিপদে ফেলবেন না। আপনি মদিনায় ফিরে যান। আল্লাহর কসম! যদি আমরা আপনার কারণে বিপদে পড়ে যাই তাহলে ইসলামে আর কখনোই শৃঙ্খলা আসবে না। [৩][৪]
আবু বকর রা. আলী রা.-এর এই পরামর্শকে সাথে সাথেই মেনে না নিলেও দীর্ঘমেয়াদে তা মেনে নেন। যাই হোক আবু বকর রা. আবস ও যুবইয়ানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে যুহুসা ও যুল কাসসার দিকে যাত্রা শুরু করেন। আবস ও যুবইয়ান গোত্র যুদ্ধ না করেই পালিয়ে গেছে। আবু বকর রা. তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। আবু বকর রা. সেখানে কিছুদিন থাকেন ও সেখানকার মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সাহস যুগিয়ে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন।
বিদ্রোহীরা বার বার ধাওয়া খেলেও তারা নির্মূল হয়নি। বরং সকল পরাজিত গোত্র নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে মদিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করছিল। মদিনার বিভিন্ন দিকে বিদ্রোহীরা তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে আবু বকর রা. আলী রা.-এর পরামর্শ গ্রহণ করলেন। এবার তিনি নিজে যুদ্ধ পরিচালনা না করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। তিনি সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করে টোটাল সেনাবাহিনীকে ১১ টি ব্রিগেডে ভাগ করেন। এর মধ্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের বাহিনী ছিল মূল বাহিনী।
১ম বাহিনী ছিল খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর নেতৃত্বে। তিনি প্রথমে বুজাখার আসাদ গোত্রের ভন্ড নবী তুলাইহা বিন খুওয়াইলিদ ও পরে বুতাহর মালিক বিন নুয়াইরার বিরুদ্ধে প্রেরিত হন।
২য় বাহিনী ছিল ইকরিমা ইবনে আবি জাহল রা.-এর নেতৃত্বে। তিনি ইয়ামামার ভণ্ড নবী মুসায়লিমার সাথে লড়াই করেন।
৩য় বাহিনী ছিল আমর ইবনুল আস রা.-এর নেতৃত্বে। তিনি তাবুক ও দুমাতুল জান্দালের কুজা ও ওয়াদিয়া গোত্রের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
৪র্থ বাহিনী ছিল শুরাহবিল ইবনে হাসানা রা.-এর নেতৃত্বে। তিনি ইকরিমাকে অনুসরণ করেন ও খলিফার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন।
৫ম বাহিনী ছিল খালিদ বিন সাইদ রা.-এর নেতৃত্বে, তিনি সিরিয়ান সীমান্তের কিছু বিদ্রোহী গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
৬ষ্ঠ বাহিনী ছিল তুরাইফা বিন হাজিজ রা.-এর নেতৃত্বে, তিনি লড়াই করেছেন মদিনা ও মক্কার হাওয়াজিন এবং বনি সুলাইমের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে।
৭ম বাহিনী ছিল আলা বিন আল হাদরামি রা.-এর নেতৃত্বে, তাঁর দায়িত্ব ছিল বাহরাইনের বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করা।
৮ম বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হুজায়ফা বিন মুহসিন রা., তাঁকে ওমানের বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৯ম বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন আরফাজা বিন হারছামা রা., তাকে ইয়েমেনের মাহরা গোত্রের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১০ম বাহিনী ছিল মুহাজির বিন আবি উমাইয়া রা.-এর নেতৃত্বে, তিনি প্রথমে ইয়েমেনের সানার ভন্ড নবী আসওয়াদ আনসারীর অনুসারীদের বিদ্রোহ দমন করেন,পরে হাদরামাওতের কিন্দার বিদ্রোহীদের বশে আনেন।
১১শ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সুয়াইদ বিন মুকাররিন রা., তাকে ইয়েমেনের উত্তরে উপকূলীয় অঞ্চল তিহামার বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। [৫]
মধ্য আরবের বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব ছিল ইয়ামামার উর্বর অঞ্চলের স্বঘোষিত নবী মুসায়লিমা। শক্তিশালী বনু হানিফা গোত্র তাকে সমর্থন করত। উত্তর মধ্য আরবের বুজাখায় আরেকজন স্বঘোষিত নবী বনু আসাদের গোত্রীয় প্রধান তুলায়হা বিদ্রোহ করে ও বনু গাতাফান, হাওয়াজিন ও তায়ি গোত্রের মিত্রতা লাভ করে। নজদে মালিক ইবনে নুয়াইরা বনু তামিম গোত্রের নেতৃত্ব দেয়। এরাই ছিল মদিনার সবচেয়ে শক্তিমান শত্রু।
নির্দিষ্ট দায়িত্বের পাশাপাশি কমান্ডারদেরকে নিম্নোক্ত নির্দেশনা দেয়া হয়:
১. যেসব গোত্র তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের অনুসন্ধান করা।
২. আজান দেওয়া।
৩. গোত্রগুলো যদি আজানের উত্তর দেয় তবে তাদের আক্রমণ করা যাবে না।
৪. আজানের পর গোত্রগুলোকে জাকাত প্রদানসহ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে হবে। যদি তারা তা মেনে নেয় তবে আক্রমণ করা যাবে না।
৪. আজানের পর গোত্রগুলোকে জাকাত প্রদানসহ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে হবে। যদি তারা তা মেনে নেয় তবে আক্রমণ করা যাবে না।
৫. যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের আক্রমণ করা হবে না।
৬. যারা আজানের উত্তর দেবে না বা আজানের পর পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করবে না তাদের সাথে তলোয়ার দ্বারা ব্যবহার করা হবে।
৭. যেসকল বিদ্রোহী মুসলিমদের হত্যা করেছে তাদের হত্যা করা হবে।
এসকল নির্দেশনাসহ আবু বকর মুসলিম বাহিনীকে ধর্মত্যাগী ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেন। [৬]
বুজাখার যুদ্ধ
মুসলিমদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে তুলাযইহা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। তার মিত্র গোত্রগুলো তার সেনাবাহিনী বড় করতে সাহায্য করে। তুলাইহার বিরুদ্ধে খালিদ রা. অগ্রসর হওয়ার আগে আবু বকর রা. প্রতিপক্ষের শক্তি খর্ব করার চেষ্টা করেন রাজনৈতিকভাবে। তায়ি গোত্রের নেতা ছিলেন বিখাত হাতেম তায়ির ছেলে আদি ইবনে হাতেম রা.। আদি রা.-কে দিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালান আবু বকর রা.। আদি রা.-এর এই তৎপরতা ফলপ্রসূ হয়। আদি রা. তার গোত্রের ৫০০ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে খালিদ রা.-এর বাহিনীতে যোগ করে। [৭] খালিদ এরপর আরেক বিদ্রোহী গোত্র জাদিলার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এখানেও আদি ইবনে হাতিম আলোচনার দায়িত্বপালন করেন। বনি জাদিলা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের ১০০০ যোদ্ধা খালিদ রা. সেনাদলে যোগ দেয়। খালিদ এবার বুজাখার দিকে যাত্রা করেন। এখানে তুলাইহাকে বুজাখার যুদ্ধে পরাজিত করেন। সে পালিয়ে সিরিয়ায় চলে যায়। তুলাইহার অবশিষ্ট সেনারা গামরার দিকে পিছু হটে। তাদেরকে গামরার যুদ্ধে তারা পরাজিত করা হয়। বুজাখার দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে খালিদ রা. ৬০০০ সৈনিক নিয়ে নাকরায় পৌছান। এখানে নাকরার যুদ্ধে খালিদ রা. বিদ্রোহী গোত্র বনু সালিমকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি নজদের বিদ্রোহী গোত্র বনু তামিমের দিকে অগ্রসর হন। [৮]
নজদের যুদ্ধ
বুজাখায় খালিদের বিজয়ের কথা শুনে বনু তামিমের অনেক গোত্র খালিদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য এগিয়ে যায় কিন্তু বনু তামিমের একটি শাখা বনু ইয়ারবু তাদের নেতা মালিক ইবনে নুওয়ায়রার অধীনে সরে আসে। মালিক যোদ্ধা, উদার ও কবি হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। মুহাম্মদ সা. এর মৃত্যুর পর মালিক জাকাত দিতে অস্বীকার করে। মুহাম্মদ সা. তাকে বনু তামিমের জাকাত সংগ্রাহক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মালিকের পিছু হটা দেখে বনু তামিম যুদ্ধের সাহস হারিয়ে ফেলে।
খালিদ রা. নজদে পৌঁছে কোনো বিরুদ্ধ বাহিনী দেখতে পাননি। তিনি তার অশ্বারোহীদের কাছের গ্রামে পাঠান ও তাদের সাথে দেখা হওয়া প্রতি দলের জন্য আজান দেয়ার নির্দেশ দেন। জিরার বিন আজওয়ার রা. মালিকের পরিবারকে গ্রেপ্তার করে দাবি করেন যে তারা আজানের উত্তর দেয়নি। মালিক খালিদের সেনাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে যায় এবং নিজের অনুসারীদের ছড়িয়ে পড়ার আদেশ দেয়। মালিক নিজ পরিবারসহ মরুভূমির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। সে জাকাত দিতে অস্বীকার করে। নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে মালিক বিদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত হয়। একইসাথে ভণ্ড নবী সাজাহর সাথে খিলাফতের বিরুদ্ধে মিত্রতার অভিযোগও উঠে। খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. মালিককে তার অপরাধের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তার উত্তর খালিদের কাছে অপরাধসূচক প্রতীয়মান হওয়ায় খালিদ তার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন ও কার্যকর করেন। তার এই আদেশের ফলে আবু বকর রা. তাকে মদিনায় তলব করেন এবং সতর্ক করেন। মালিকের পরিবারকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রক্তপণ দেওয়া হয়। [৯][১০]
ইয়ামামার যুদ্ধ
আবু বকর রা. ইকরিমা ইবনে আবি জাহলকে মিথ্যা নবী দাবীদার মুসায়লিমার সাথে ইয়ামামায় যোগাযোগের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে তাকে বলা হয় যাতে খালিদ রা. আসা পর্যন্ত তিনি লড়াইয়ে না জড়ান। মুসায়লিমাকে সাহায্য করছে শক্তিশালী বনু হানিফ গোত্র। এদিকে নজদের এক মহিলা সাজাহ নিজেকে নবী দাবি করেছে। সাজাহর অনুসারীরা মুসায়লিমার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মুসায়লিমা সাজাহর সাথে সমঝোতা করে ফেলে এবং তাকে বিবাহ করে। এতে মুসায়লিমার শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। [১১] [১২]
মুসায়লিমার সাথে যুদ্ধ করা কঠিন হবে বিধায় আবু বকর রা. ইকরামা রা.-কে অপেক্ষা করতে বলেছেন। খালিদ রা. নজদ থেকে আসার আগেই আবু বকর রা. শুরাহবিল ইবনে হাসানা রা.-কে ইয়ামামায় প্রেরণ করেন। খালিদ রা. খলিফার নির্দেশে নজদ থেকে ইয়ামামার দিকে রওনা হন। ইয়ামামায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। মুসলিমদের পক্ষে ১৩ হাজার ও ভন্ডনবীর সৈনিক ছিল প্রায় ৪০ হাজার। অবশেষে মুসায়লিমা নিহত হয় ও যুদ্ধে মুসলিমরা জয়ী হয়। মুসাইলামাকে হত্যা করে হামজা রা.-এর হত্যাকারী ওয়াহশী। সে এর মাধ্যমে তার পূর্বের পাপ মোচন করতে চেয়েছিল। [১৩] এই যুদ্ধে প্রায় ১২০০ সাহাবী শাহদাতবরণ করেন। তার মধ্যে ৩৭০ জন ছিলেন কুরআনের হাফিজ। এই যুদ্ধে উহুদের বীর আবু দুজানা রা.-ও শাহদাতবরণ করেন। [১৪] এতো বেশি হাফিজ সাহাবী ইন্তেকাল করায় আবু বকর রা.-কে কুরআন সংরক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়। তিনি উমার রা.-এর সহায়তায় কুরআনের ১ম লিখিত রূপ তৈরি করেন। এরপর পাণ্ডুলিপিটি উমার রা.-এর মেয়ে ও উম্মুল মু'মিনিন হাফসা রা.-এর কাছে সংরক্ষণ করেন।
ওমানের যুদ্ধ
খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা. হুজায়ফা বিন মুহসিন রা.-কে ওমানের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এখানে ওমানের সংখ্যাগুরু গোত্র আজদ তাদের নেতা লাকিত বিন মালিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। কিছু সূত্র মতে সেও নিজেকে নবী দাবি করে। হুজায়ফা ওমানে প্রবেশ করেন। লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট সেনা না থাকায় তিনি সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং খলিফাকে এ ব্যাপারে চিঠি লেখেন। খলিফা আবু বকর রা. ইকরিমাকে তার সাহায্যার্থে পাঠান। ইকরিমা ইয়ামামা থেকে ওমানের দিকে যাত্রা করেন। তাদের সম্মিলিত বাহিনী দাবার যুদ্ধে লাকিত বিন মালিককে পরাজিত করে। লাকিত বিন মালিক যুদ্ধে নিহত হয়। এরপর হুজায়ফা রা. ওমানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং আইন শৃঙ্খলয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হন। ইকরিমার কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না। তিনি তার বাহিনী নিয়ে পার্শ্ববর্তী দাবা অঞ্চলে যান এবং আজদ গোত্রের যারা বিদ্রোহী ছিল তাদের পরাজিত করেন। [১৫]
উত্তর আরব
আমর ইবনুল আস রা.এর বাহিনী সিরিয়ার সীমান্তে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়। এদের মধ্যে তাবুক ও দুমাতুল জান্দালের কুজা ও ওয়াদিয়া (বনি কালবের শাখা) গোত্র গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমর রা. তাদের বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ জয় তুলে নিতে পারেননি। অবশেষে ইয়ামামার যুদ্ধের পর শুরাহবিল রা.-কে পাঠানো তাঁর সাহায্যে। অবশেষে তারা উত্তর আরবে সিরিয়া সীমান্তের বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হন।
ইয়েমেন
ইয়েমেনের আসওয়াদ প্রথম ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তখন রাসূল সা.-এর অন্তিম সময়। তাদের নেতা আল আসওয়াদ নিজেকে নবী ঘোষণা করেছিল। পরে মুহাম্মদ এর জীবদ্দশায় ফাইরুজ আল দাইলামি তাকে হত্যা করেন। ফাইরুজ এরপর সানায় ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ সা. এর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর ইয়েমেনে আবার বিদ্রোহ দেখা দেয়। এসময় কাইস বিন আবদ ইয়াগুস নামক এক ব্যক্তি এসময় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। মুসলিমদের ইয়েমেন থেকে বের করে দেয়া বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল। তারা ফাইরুজ ও অন্যান্য মুসলিম নেতাদের হত্যার মাধ্যমে মুসলিমদের নেতৃত্বশূণ্য করার উদ্যোগ নেয়। ফাইরুজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং পার্বত্য এলাকায় আশ্রয় নেন। পরবর্তী ছয় মাস এখানে অবস্থান করেন। পরে ইয়েমেন থেকে আসা কয়েক হাজার মুসলিম তার সাথে যোগ দেয়। মুহাজির ইবনে আবু উমাইয়া রা. নেতৃত্বে আবু বকর রা.-এর পাঠানো বাহিনী সা'নায় আক্রমণ করার পর ফাইরুজ তার লোকদের নিয়ে কাইসের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তারা কাইসকে পরাজিত করেন। কাইস তার লোকদের নিয়ে উত্তর পূর্বে আবয়ানে চলে যায়। সেখানে তারা আত্মসমর্পণ করে এবং খলিফা তাদের ক্ষমা করে দেন। [১৬]
মাহরা
খলিফা আবু বকর রা.-এর নির্দেশে ইকরিমা রা. আরফাজা বিন হারসামা রা.-এর সাথে যোগ দেয়ার জন্য ওমান থেকে মাহরার দিকে অগ্রসর হন। আরফাজা রা. তখনও না পৌঁছায় ইকরিমা রা. তার জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে স্থানীয় বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করেন। জাইরুত নামক স্থানে ইকরিমা দুইটি বিদ্রোহী সেনাদলের মুখোমুখি হন। তাদের একটিকে তিনি ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। তারা তা গ্রহণ করে তার সাথে যোগ দেয় ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়। মাহরায় ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ইকরিমা তার সেনাদের নিয়ে আবয়ানের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে তিনি তার সেনারা বিশ্রাম নেয় ও পরবর্তী কাজের জন্য অপেক্ষা করে।
বাহরাইন
ইয়ামামার যুদ্ধের পর খলিফা আবু বকর রা. আলা বিন আল হাদরামিকে বাহরাইনের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আলা এক রাতে আচমকা হামলা চালান ও শহর অধিকার করে নেন। বিদ্রোহীরা উপকূলের দিকে পিছু হটে। তারা আরো একবার লড়াই করে তবে পরাজিত হয়। অধিকাংশ আত্মসমর্পণ করে ও ইসলামে ফিরে আসে।
হাদরামাওতের যুদ্ধ
ইয়ামামার পরে সর্বশেষ বড় বিদ্রোহটি পূর্ব ইয়েমেনের হাদরামাওতের নাজরানের অধিবাসী কিন্দা গোত্র কর্তৃক সংঘটিত হয়। হাদরামাওতের মুসলিম গভর্নর জিয়াদ বিন লুবাইদ রা. তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এরপর কিন্দার লোকেরা পরিপূর্ণভাবে বিদ্রোহ শুরু করে। আশআস বিন কাইস তাদের নেতা ছিল। দুপক্ষের সেনাসংখ্যা ভারসাম্য অবস্থায় ছিল বিধায় ব্যাপক লড়াই শুরু করতে কেউ আগ্রহী ছিল না। জিয়াদ রা. সাহায্য আসার অপেক্ষা করতে থাকেন। সানার বিদ্রোহ দমন শেষ হলে আবু বকর রা. মুহাজির রা.-কে জিয়াদ রা.-কে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। এছাড়াও খলিফা ইকরিমা রা.-কে আদেশ দেন যাতে তিনি জিয়াদ ও মুহাজিরের সাথে যোগ দেন। মুহাজির ও জিয়াদের সেনারা হাদরামাওতের রাজধানী জাফারে মিলিত হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধে তারা আশআসের বাহিনীকে পরাজিত করেন। আশআস নুজাইরের দুর্গ শহরে পিছু হটে। যুদ্ধের পর পরই ইকরিমা রা. পৌঁছান।
মুহাজির রা.-এর নেতৃত্বে তিনটি মুসলিম সেনাদল নুজাইরের দিকে অগ্রসর হয় ও শহর অবরোধ করে। অবরোধের কয়েকদিনের মধ্যে নুজাইর দখল হয়। আশআস আত্মসমর্পন করে এবং পুনরায় মুসলিম হয়। এর মাধ্যমে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আরব পুনরায় ইসলামের অধীনে আসে। [১৭]
হিজরতের ১১তম বছরে এসব বিদ্রোহ সংঘটিত ও দমন করা হয়। ৬৩৩ সালের ১৮ মার্চ ১২ হিজরিতে সমগ্র আরব খলিফা আবু বকর রা.-এর একক নেতৃত্বের অধীনে আসে। এই অভিযান আবু বকরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও সামরিক বিজয় ছিল। বিদ্রোহ দমনের এই সব অভিযানকে একত্রে রিদ্দার যুদ্ধ বলা হয়। রিদ্দা শব্দটি আরবি, যার অর্থ ফিরে যাওয়া, প্রত্যাবর্তন করা। সুতরাং রিদ্দা বলতে কৃত্রিম ধর্মপ্রবর্তক এবং তাদের অনুগামীদের ইসলাম ত্যাগ ও বিদ্রোহ বোঝায়!
হিজরতের ১১তম বছরে এসব বিদ্রোহ সংঘটিত ও দমন করা হয়। ৬৩৩ সালের ১৮ মার্চ ১২ হিজরিতে সমগ্র আরব খলিফা আবু বকর রা.-এর একক নেতৃত্বের অধীনে আসে। এই অভিযান আবু বকরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও সামরিক বিজয় ছিল। বিদ্রোহ দমনের এই সব অভিযানকে একত্রে রিদ্দার যুদ্ধ বলা হয়। রিদ্দা শব্দটি আরবি, যার অর্থ ফিরে যাওয়া, প্রত্যাবর্তন করা। সুতরাং রিদ্দা বলতে কৃত্রিম ধর্মপ্রবর্তক এবং তাদের অনুগামীদের ইসলাম ত্যাগ ও বিদ্রোহ বোঝায়!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন