অন্য ব্যাপারগুলোর মতো উমার রা. এই কাজেও মুহাম্মদ সা.-এর নীতি অনুসরণ করেছেন। সবচেয়ে যোগ্য, দক্ষ ও সংশ্লিষ্ট কাজের উপযোগী লোককেই দায়িত্ব দিতেন। প্রশাসকসহ সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের কাজকে তিনি আমানত হিসেবে নিয়েছেন। যোগ্য লোককে প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করতে না পারাকে তিনি জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও খিয়ানত হিসেবে ভাবতেন।
পরামর্শের ভিত্তিতে নিয়োগ :
উমার রা. যত কর্ককর্তা নতুন করে নিয়োগ করেছেন প্রত্যেকের ব্যাপারে শুরার সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে নিয়েছেন। কুফার শাসক নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন উমার রা.। সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. ও পরে তাকে সরিয়ে আম্মার ইবনে ইয়সারকে নিযুক্ত করেন। দুজনেই ছিলেন প্রসিদ্ধ, জ্ঞানী, খোদাভীরু ও বিনয়ী। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ করেছিল কুফাবাসী। তাই তাদেরকে সরাতে বাধ্য হন উমার রা.।
এই নিয়ে পরামর্শ করছিলেন উমার রা.। পরামর্শ সভায় তিনি বলেন, একজন কোমলচিত্ত ধার্মিক ব্যক্তি ও একজন দৃঢ়চিত্তের কিছুটা কম ধার্মিক ব্যক্তি সম্পর্কে আপনাদের মন্তব্য কী? মুগিরা বিন শুবা রা. উত্তরে বলেন, হে আমিরুল মু'মিনিন, কোমলচিত্ত ও বিনয়ী ব্যক্তির কাজ কেবল তার নিজের কল্যাণ বয়ে আনে। কিন্তু তার দুর্বলতা আপনার ও মুসলিম জাতির ক্ষতির কারণ হতে পারে। আবার দৃঢ় চরিত্রের ব্যক্তির কম ধার্মিকতার কারণে কেবল সে নিজে কম লাভবান হয়, কিন্তু তার দৃঢ়তা আপনার ও মুসলিম জাতির কল্যাণ বয়ে আনে।
উমার রা. বললেন, আপনি সঠিক কথা বলেছেন। অবশেষে সবার পরামর্শে মুগিরা বিন শু'বা রা.-কেই কুফার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। দায়িত্ব নিয়ে যাওয়ার সময় উমার রা. মুগিরা রা.-কে বলেন, এমন একজন ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা করবেন যাতে সৎকর্মশীলরা বিশ্বাস করে, অসৎ লোকেরা ভয় পায়।
নিয়োগপূর্ব যাচাই :
উমার রা. যাদের নিয়োগ করতেন তাদের সামগ্রিক জীবন যাচাই করতেন। তিনি যাদের ভালোভাবে চিনতেন তাদের কথা ভিন্ন। বাকীদের ক্ষেত্রে তিনি সম্ভাব্য প্রশাসককে মদিনার নিজের সাথে রাখতেন। যাতে ঐ ব্যক্তিকে ভালোমতো যাচাই করা যায়। আহনাফ ইবনে কাইসকে প্রায় একবছর তিনি এভাবে যাচাই করেন।
নিজ সম্প্রদায় থেকে প্রশাসক :
উমার রা. চাইতেন যে সমাজের প্রশাসক নিয়োগ করা হচ্ছে সেই সমাজ বা সম্প্রদায় থেকেই নিয়োগ করতে। যাতে প্রশাসক ও জনগণের মধ্যে দুরত্ব কম হয়। রাসূল সা. একইভাবে প্রসাশক নিয়োগ করতেন। যদি সেখানে যথাযথ লোক না পাওয়া যেত তখনই ভিন্ন কাউকে চিন্তা করা হতো।
জ্ঞান, যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা :
উমার রা. জ্ঞান, যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে। যাদের মধ্যে তিনি এগুলোর সমন্বয় দেখতেন তাদের তিনি নিয়োগ দিতেন। এজন্য তিনি দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অসৎকর্মশীলের যোগ্যতা ও সৎকর্মশীলের অযোগ্যতা থেকে আশ্রয় চাই। একবার উত্তর ফিলিস্তিনের কমান্ডার শুরাহবিলের ইবনে হাসানাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
শুরাহবিল রা. তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আমার কোনো কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়েছেন। উত্তরে উমার রা. বললেন, না। আমি আপনার ব্যপারে ভালো ধারণা পোষণ করি। কিন্তু আমি আরো যোগ্যতাসম্পন কাউকে সেখানে নিয়োগ করতে চাই।
অধীনস্তদের প্রতি কোমল :
উমার রা. চাইতেন প্রশাসকরা তাদের অধীনস্তদের ব্যপারে দয়ালু ও কোমল হৃদয়ের হতে হবে। তিনি সব প্রশাসক ও সেনা কমান্ডারদের উপদেশ দিতেন যাতে বিপদসংকুল পথে অভিযান না চালায়। সেনাদের যাতে বিশ্রাম দেয়। সেনাদের যাতে গুরুতর বিপদের মুখোমুখি না করে। একবার এক লোক উমার রা.-এর সাক্ষাতে এসে দেখতে পান তিনি এক শিশুকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। এটা দেখে ঐ ব্যক্তি বললো, আপনি এমনটা করেন! আমি কখনোই আমার কোনো সন্তানকে চুমু খাইনি।
একথা শুনে উমার রা. বললেন, আল্লাহর শপথ! তাহলে তুমি মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে কম দয়ালু। সাক্ষাতের আগে উমার রা. এই ব্যক্তিকে সেনা কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার কথা শুনে বললেন, তোমাকে আমি কখনোই কোনো কাজে নিযুক্ত করবো না।
ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর পারস্যের নগরীগুলো একের পর এক দখলে নিচ্ছিল মুসলিম বাহিনী। এমন সময়ে একজন কমান্ডার একটি নদীর মুখোমখি হন। পার হওয়ার জন্য কোনো সেতু ছিল না। শীতের দিন। সেনা কমান্ডার এক সৈন্যকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে সে মধ্যে পানিতে নেমে পানি পরিমাপ করে এবং কম গভীরতার স্থান ফাইন্ড আউট করে। সৈন্যটি পানিতে নামতে ভয় পাচ্ছিল এবং কমান্ডারকে বলছিল, আমি ভয় পানি খুবই ঠান্ডা। আমি পানিতে নামলে মারা যাবো।
কমান্ডার তার আবেদন গ্রাহ্য করেনি। তাকে পানিতে নামতে বাধ্য করেছিল। সত্যিই সৈন্যটি ঠান্ডায় মারা যায়। এই ঘটনা উমার রা.-এর পৌঁছলে তিনি সাথে সাথেই তাকে বরখাস্ত করেন। সৈন্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে নইলে তিনি এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেন বলেও জানিয়েছেন। উমার রা. প্রশাসকদের বলতেন, জেনে রাখো একজন নেতার ক্ষামশীলতা ও দয়াশীলতার চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় আর কিছু নেই। আর একজন নেতার মূর্খতা ও বোকামির চেয়ে আল্লাহর নিকট ঘৃণ্য আর কিছু নেই।
স্বজনপ্রীতি না করা :
উমার রা. স্বজনপ্রীতি করা তো দূরে থাক, নিজ আত্মীয়দের কেউ যোগ্য হলেও তাকে দায়িত্ব দেননি। কুফার প্রশাসকের ব্যাপারে তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা.-এর নাম অনেকেই প্রস্তাব করেছিলো। উমার রা. দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এছাড়া তাঁর চাচতো ভাই সাঈদ ইবনে জাইদ রা.-কে দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে অনেকে পরামর্শ দিলেও তিনি তা আমলে নেন নি।
পদপ্রার্থী ব্যক্তিকে দায়িত্ব না দেওয়া :
আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি দায়িত্ব চেয়ে নেয় সে দায়িত্ব পালনের অযোগ্য। উমার রা. তাঁর শাসনামলে এই নীতি ফলো করেছিলেন। কেউ তাঁর কাছে কোনো দায়িত্ব চাইলে তিনি তাকে দায়িত্ব দিতেন না। প্রশাসক বা সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের ক্ষেত্রে এই নীতি আরো স্ট্রিকলি ফলো করতেন।
প্রশাসক, প্রতিনিধি ও সেনা কমান্ডারদের জন্য ব্যবসা নিষিদ্ধ :
যারা সরকারি উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেতন নির্ধারণ করেছিলেন উমার রা.। আর একইসাথে তাদের ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন যাতে তারা সর্বক্ষণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ব্যাপারে সজাগ থাকতে পারে। তাছাড়া ব্যবসায় বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত হলে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও দায়িত্ববোধ কমে যেতে পারে।
সম্পদের হিসাব রাখা :
প্রশাসকসহ উচ্চপদস্থ সকল কর্মকর্তার সমুদয় সম্পত্তির হিসাব লিখে রাখার ব্যবস্থা করেছেন উমার রা.। কারো কাছে সম্পদের আধিক্য দেখা দিলে তিনি সম্পদের তদন্ত করতেন। অতিরিক্ত সম্পদের হিসাব চাইতেন। সঠিক হিসাব দিতে না পারলে দুর্নীতির অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন। তাদের জন্য ব্যবসা করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচিত হতো।
রাষ্ট্রীয় কাজে অমুসলিমদের সহায়তা না নেওয়া :
উমার রা. কঠোরভাবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ও সেনাবাহিনীতে অমুসলিম নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছিলেন। রাসূল সা.-ও এই ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। উহুদের যুদ্ধে অনেকে ইহুদিদের সাহায্য নিতে চাইলে রাসূল সা. নিষেধ করেন। আবু মুসা আশয়ারি রা. তাঁর কাতিব (অফিস সহকারী) হিসেবে এক খ্রিস্টানকে নিয়োগ করেছিলেন। এর জন্য উমার রা. তাঁকে তিরস্কার করেন এবং ঐ কাতিবকে অবিলম্বে বিদায় দিতে বলেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন