উমার রা. রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে পুরো মুসলিম জাহানকে অনেকগুলো প্রদেশে ভাগ করেন। আর সেখানে দায়িত্বশীল বা গভর্নর নিযুক্ত করেন। তাদের নিযুক্ত করার সময় তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দিতেন। এতটুকুতে ক্ষান্ত ছিলেন না, তিনি নিয়মিত তত্ত্বাবধান করতেন যাতে গভর্নররা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।
দাওয়াতের কাজ করা :
উমার রা. দাওয়াতের কাজকে গুরুত্ব দিতেন। যেভাবে মুহাম্মদ সা. গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু বকর রা. এর সময়ে মাত্র দুবছরে তিনি বিদ্রোহ দমন ও বহিঃশত্রু থেকে নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন বলে তিনি এদিকে ভালো নজর দিতে সক্ষম হননি। উমার রা. দায়িদের প্রশিক্ষণ ও উপদেশ দিয়ে বিজিত অঞ্চলে পাঠাতেন। সিরিয়ার মানুষ বেশিরভাগ ছিল খ্রিস্টান। তারা যুদ্ধে পরাজিত হলেও ধর্ম ত্যাগ করে নি। উমার রা. সিরিয়ায় বহু দায়িকে সেখানে পাঠান ও সেখানের গভর্নরকে এই ব্যপারে নির্দেশনা দেন যাতে তিনি প্রতিটি সিরিয়ানের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান। উমার রা. গভর্নরদের বলতেন, আমি আপনাদের নিযুক্ত করেছি এই জন্য নয় যে, আপনারা জনগণের মুন্ডুপাত করবেন ও প্রহার করবেন। বরং নিয়মিত সালাত প্রতিষ্ঠা করা ও তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমরা তোমাদের নিযুক্ত করেছি।
উমার রা. জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রায়ই বলতেন আল্লাহর শপথ আমরা গভর্নরদের তোমাদের প্রহার করা ও তোমাদের সম্পদ নেওয়ার জন্য পাঠাই না। বরং তাদের পাঠাই তোমাদের বিশুদ্ধভাবে দ্বীন ও সুন্নাহ শেখানোর জন্য।
নামাজ কায়েম :
নামাজ কায়েম শাসকদের অন্যতম প্রধান কাজ। আল্লাহ তায়ালা সূরা হজ্বের ৪১ নং আয়াতে এই ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। উমার রা. এই ব্যাপারে গভর্নরদের জোর দিতেন। তিনি প্রায়ই গভর্নরদের লিখতেন, আমার দৃষ্টিতে তোমাদের সকল কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজ। নিয়মিত যে নামাজ আদায় করে সে তার ঈমান রক্ষা করে। আর যে তাতে অবহেলা করে তার ঈমানের অন্যান্য অঙ্গ আরো বেশি অবহেলিত হতে বাধ্য। উমার রা. গভর্নরদের ওপর নজরদারি করতেন তারা নামাজ কায়েমের ব্যাপারে তৎপর কিনা।
মসজিদ প্রতিষ্ঠা :
উমার রা. ইসলামী রাষ্ট্রের গভর্নরদের মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য তাকিদ করতেন এবং মসজিদকে কেন্দ্র করেই সকল প্রশাসনিক কাজ আঞ্জাম দিতে বলতেন। এতে বিধর্মীরাও মসজিদের সংস্পর্শে আসতো তারা মুসলিমদের কালচার ও শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হতো। উমার রা.-এর দশ বছরে শুধু আরবেই চার সহস্রাধিক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ :
উমার রা.-এর সময়ে গভর্নরদের বড় কাজ ছিল জিহাদ করা ও ইসলামের সাম্রাজ্য বাড়ানো। আবু বকর রা.-এর সময়ে পৃথিবী বিখ্যাত দুই সাম্রাজ্য রোমান ও পারসিকদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া জিহাদ চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছে উমার রা.-এর আমলে। প্রায় অর্ধ পৃথিবীকে ইসলামের অনুগত করেছে উমার রা.-এর গভর্নররা। উমার রা. তাঁর প্রতিনিধি, সেনানায়ক ও গভর্নরদের জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ থেকে বিশ্রাম দেননি বলেই চলে। ফলশ্রুতিতে মাত্র কয়েকবছরে পৃথিবীর বেশিরভাগ সভ্যতা ইসলামের অনুগত হয়েছে।
পরামর্শভিত্তিক প্রদেশ পরিচালনা :
উমার রা. সময়ে গভর্নরদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা যাতে প্রদেশ পরিচালনাকালে প্রাদেশিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের বিশেষ ব্যক্তি ও নেতাদের সাথে পরামর্শ করে নেন। গভর্নররা এই নির্দেশ বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন। মাসিক ভিত্তিতে শহরের বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে গভর্নররা মতবিনিময় করতেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমুসলিম নেতাদেরও পরামর্শ সভায় রাখা হতো, যাতে তাদের বক্তব্যগুলো গভর্নররা জানতে পারেন।
দণ্ডবিধি ও ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা :
গভর্নর ও প্রতিনিধিদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল দণ্ডবিধি ও ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। দণ্ডবিধি কার্যকরের ক্ষেত্রে যাতে বৈষম্য না করা হয়, প্রভাবশালীদের জন্য যাতে বিচার পরিবর্তিত না হয় তা দেখভালের দায়িত্ব ছিল গভর্নরদের। সাধারণ মানুষ যাতে ন্যয়বিচার পায়, অন্যায়ের প্রতিবিধান যাতে হয় তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ ছিল উমার রা.-এর পক্ষ থেকে। প্রথম দিকে মৃত্যুদণ্ডের জন্য গভর্নররা স্বাধীন ছিল। তারা কোনো দ্বিধা ছাড়াই অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেন। পরবর্তীতে কয়েকটি সমস্যা তৈরি হওয়ায় শুধু মৃত্যুদণ্ডের কার্যকরের জন্য আমীরুল মু'মিনিনের অনুমতি নিতে হতো।
অসহায়দের জন্য ভাতার ব্যবস্থা :
উমার রা. তাঁর শাসনামলে জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। বিশেষত যারা দুর্বল, অসহায় ও বিপদ্গ্রস্থ তাদের খোঁজখবর তিনি নিজেও রাখতেন এবং গভর্নরদের নির্দেশ দিতেন যাতে তারা এই অসহায়দের খবর রাখে। তিনি ইরাকে গিয়ে এক ভাষণে বলেন, আমি যদি আর কিছুদিন হায়াত পাই তবে ইরাকের বিধবাদের এমন ব্যবস্থা করে যাবো যাতে তাদের কারো প্রয়োজন না পড়ে। তিনি তাদের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া অসুস্থ, ঋণগ্রস্থরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যাতে সাহায্য পায় তার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। উমার রা. সময়ে রাষ্ট্রের আয় ব্যপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আবার রাষ্ট্রের খরচও সেসময় অনেক বেশি ছিল না। তাই উমার রা. সেসময় ব্যাপক সম্পদ জমা রেখে রাষ্ট্রীয় কোষগারের আকার বড় করেননি। তিনি এই টাকা সকল জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন গভর্নরদের মাধ্যমে।
কর্মকর্তা নিয়োগ :
গভর্নরদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যাতে তাঁরা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করেন। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উমার রা. প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগে কার্পন্য নিজেও করতেন না এবং গভর্নরদেরও করতে দিতেন না। গভর্নররা নিজ নিজ কর্মী নিয়োগে স্বাধীন ছিলেন।
জিম্মী নাগরিকদের তত্ত্বাবধান :
উমার রা. গভর্নরদের আরেকটি বিষয়ে তাকিদ করতেন। আর তা হলো জিম্মীদের খোঁজখবর। জিম্মী মানে হলো রাষ্ট্রে অবস্থানকারী অনুগত অমুসলিম নাগরিক। গভর্নররা তাদের কাছ থেকে নামমাত্র জিজিয়া কর আদায় করতেন নিরাপত্তার বিনিময়ে। তাই উমার রা. কড়া নির্দেশ দিতেন যাতে তাদের ধর্ম পালন ও বসবাসে কোনোরূপ বাধা তৈরি না হয় এবং তারা যাতে কোনোরূপ অসুবিধায় না পড়েন। যাদের সাথে যেরূপ চুক্তি ছিল তাদের সাথে সেরূপ চুক্তি যথাযথভাবে মানার দায়িত্ব ছিল গভর্নরদের।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড :
এখন যেরকম সরকারকে ব্যপকভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে হয়, তখনকার সমাজব্যবস্থা সেরকম ছিল না বিধায় শাসকরা উন্নয়ন কর্মকান্ডে খুব একটা যুক্ত হতো না। কিন্তু উমার রা. সময়ে তিনি এই বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। এই কাজে তিনি প্রাদেশিক গভর্নরদের কাজে লাগান। তাঁর উন্নয়নের মধ্যে মূল গুরুত্বপায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও খাবার পানি বন্টন। প্রত্যেক প্রদেশের সাথে রাজধানী তথা মদিনার যোগাযোগের রাস্তা তিনি মসৃন ও সহজ করার দায়িত্ব গভর্নদের ছিল। এই রাস্তায় মুসাফিরদের নিরাপত্তার জন্য তারা পুলিশের পেট্রোল টহলের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। পন্যের দাম কমেছিল। খাবার পানি যাতে প্রত্যেক নাগরিক পায় সেই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গভর্নরদের ছিল।
গভর্নরদের আরেকটি দায়িত্ব ছিল কৃষিকাজে কৃষকদের সহায়তা করা। এক্ষেত্রে ভালো বীজের ব্যবস্থা করা ও পানি সেচের ব্যবস্থা করা ছিল গভর্নরদের দায়িত্বের অংশ। প্রয়োজনীয় খাল খনন, ফসল বিক্রীর ব্যবস্থা করা ও ভূমিহীনদের জন্য ভূমি বরাদ্দ দেওয়া গভর্নরদের দায়িত্ব ছিল। দুর্গম স্থানে যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মান অন্যতম কাজ ছিল।
জনগণের সাথে সম্পর্ক :
উমার রা. গভর্নরদেরকে জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার ব্যাপারে নির্দেশ দিতেন। জনগণ যাতে সবসময় প্রয়োজনে গভর্নরদের পায় সে সুযোগ রাখতে বলতেন। যেসব গভর্নর সবসময় জনগণের মুখোমুখি হতেন তাদের চিঠি দিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন। তিনি জনগণকে সাথে নিয়ে সামাজিক কাজ করার ব্যাপারে গভর্নরদের নির্দেশ দিতেন। ফলে গভর্নর ও জনগণের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হতো না।
হজ্ব ব্যবস্থাপনা :
উমার রা.-এর শাসনামলে গভর্নরদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল হজ্ব ব্যবস্থাপনা। প্রত্যেক গভর্নর তার প্রদেশ থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হজ্বযাত্রীদের একত্র করে নিরাপত্তা দিয়ে মক্কায় পাঠাতেন ও নিরাপদে নিয়ে আসতেন। আর মক্কার গভর্নরের দায়িত্ব ছিল হাজিদের থাকার ব্যবস্থা ও নির্বিঘ্নে হজ্ব পালনের সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থার আয়োজন করা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন