ইসলামের মূলনীতি রক্ষায় উমার রা. প্রচেষ্টা ছিল অন্যরকম অনুপ্রেরণাদায়ক। তাঁর নিয়োগকৃত বিভিন্ন গভর্নর, সেনানায়ক ও প্রতিনিধিগণ জনগণের সাথে কীরূপ আচরণ করছে তা তিনি জনগণ থেকে শুনতে চাইতেন। তারা কি বাদশাহ হয়ে গেছে নাকি জনগণের খাদেম হয়ে আছে তা তিনি নিজে পরখ করতেন। তিনি এই কাজকে আমানত মনে করতেন।
তাঁর নিয়োগকৃত গভর্নররা যদি কারো প্রতি জুলুম করে তিনি এটাকে নিজের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন ও এর বিরুদ্ধে শক্ত, যথাযথ পদক্ষেপ নিতেন। তাকে প্রায়ই তাঁর সংবাদবাহকদের বিভিন্ন গভর্নরের কাছে রাষ্ট্রীয় কাজে পাঠাতে হতো। তিনি এই সংবাদবাহকদের কাজে লাগাতে চাইলেন জনগণের খবর জানতে। তিনি তাঁর সংবাদবাহকদের এই কাজে নিযুক্ত করেন।
তাঁর সংবাদবাহকরা যখন কোনো প্রদেশে যেতেন তখন মসজিদে দাঁড়িয়ে জানাতেন, আমি আমিরুল মুমিনিনের কাছ থেকে এসেছি। কয়েকদিন পর ফিরে যাবো। তোমরা যারা তাঁর কাছে কোনো খবর পাঠাতে চাও অথবা যেসব কথা তোমরা এই গভর্নরকে বলতে পারছো না সেসব কথা লিখে দাও। আমি তোমাদের চিঠি উমারের কাছে পোঁছে দেব।
জনগণের কথা শোনার জন্য উমার রা. এই দারুণ পলিসি গ্রহণ করেন। এই মাধ্যমে অনেক অভিযোগ জমা পড়ে। উমার রা. তদন্ত সাপেক্ষে সেইসব অভিযোগের জন্য গভর্নরদের ডেকে শাস্তি দিয়েছেন।
কয়েক বছরের মধ্যে এই চিঠি চালাচালি শুধু শাসক-জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। জনগণ যে কোনো প্রদেশের জনগণের কাছে চিঠি লিখতে শুরু করলো। উমার রা.-এর সংবাদ বাহকেরা চিঠিগুলো মদিনায় নিয়ে আসতেন। সেখান থেকে আবার চিঠি তার গন্তব্য প্রদেশে চলে যেত। এভাবে ডাক ব্যবস্থাপনা চালু হয়ে গেল বিনামূল্যে। উমার রা. যখন দেখলেন এই ডাক ব্যবস্থাপনা থেকে জনগণ উপকৃত হচ্ছে তখন তিনি এই ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেন। জনগণ এবার শুধু চিঠি পাঠানোতে সীমাবদ্ধ থাকে নি। তারা পণ্যও পাঠাতে শুরু করলো। আরবে চালু হয়ে গেল বিশ্বস্ত ডাক ব্যবস্থাপনা।
যাই হোক এই মাধ্যমে কিছু অভিযোগ জমা পড়ে প্রভাবশালী গভর্নরদের বিরুদ্ধে। তার কিছু নমুনা আমরা উল্লেখ করবো।
মুগিরা বিন শুবা রা. :
মুগিরা বিন শুবা রা. ছিলেন বসরার গভর্নর। একদিন উমার রা.-এর নিকট চিঠি আসলো আবু বাকরা রা. থেকে। তিনি জানিয়েছেন তিনি উম্মু জামিল নামে এক মহিলার সাথে তিনি মুগিরা রা.-কে ব্যভিচার করতে দেখেছেন। অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। অভিযোগ পেয়েই উমার রা. চিঠি পাঠালেন মুগিরা রা.-এর নিকট। যেহেতু অভিযোগ মারাত্মক তাই তিনি মুগিরা রা.-কে দায়িত্বে রাখা আর সমীচীন মনে করেন নি। চিঠিতে মুগিরা রা.-কে আবু মুসা আশায়ারি রা.-কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দ্রুত মদিনায় আসতে বলেন উমার রা.। আবু বাকরা রা.-কেও আলাদা চিঠিতে সাক্ষীসহ উপস্থিত হতে বলেন।
আবু বাকরা রা.-এর বাড়ি ও মুগিরা রা.-এর বাড়ি খুবই কাছাকাছি। একজনের জানালা দিয়ে আরেকজনের জানালা দেখা যেত। আর উম্মু জামিল হলো একজন বিধবা মহিলা। সে বনু হেলাল গোত্রের মেয়ে। তার স্বামী ছিল ছাকিফ গোত্রের। তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উম্মু জামিল বসরার বিভিন্ন প্রভাবশালী মানুষের দরবারে কারণে অকারণে যেতেন। এবং বসরার গভর্নর মুগিরা রা.-এর দরবারেও তাকে প্রায়ই দেখা যেত। কখনো সাহায্যপ্রার্থী হয়ে কখনো এমনিতেই আসতেন।
একদিন আবু বাকরা রা. মুগিরা রা.-কে আপত্তিকর অবস্থায় দেখলেন। তাঁর মনে হলো এটি উম্মু জামিল। তিনি আরো তিনজনকে ডেকে সাক্ষী করলেন এবং বললেন, তোমাদের শাসককে দেখো! সে উম্মু জামিলের সাথে ব্যভিচার করছে।
মদিনার উমার রা.-এর আদালতে আবু বাকরা রা. তাঁর সাক্ষ্য উপস্থাপন করলেন। উমার রা. জিজ্ঞাসা করলেন, উম্মু জামিলের মুখ তিনি দেখেছেন কিনা? উত্তরে আবু বাকরা রা. বলেন, তিনি পেছনদিক থেকে দেখে উম্মু জামিলের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। মুখ দেখেননি। অন্য তিনজন সাক্ষীর মধ্যে নাফি ও শিবল আবু বাকরার মতো করে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য সাক্ষী যিয়াদ ইবনে উমাইয়া বললেন, তিনি মহিলাটিকে চিনেননি।
উমার রা. সবাইকে আলাদাভাবে জেরা করেছেন। মুগিরা রা. নিজের ব্যাপারে বলেছেন তিনি তার স্ত্রীর সাথে ছিলেন। অবশেষে প্রমাণিত হলো মহিলাটি মুগিরা রা.-এর স্ত্রী ছিল এবং উম্মু জামিল ছিল না। সাক্ষীদের বেত্রাঘাত করা হলো নিশ্চিত না হয়ে অভিযোগ দায়েরের জন্য। আর মুগিরা বিন শুবা রা.ও বরখাস্ত হলেন গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারায় ও উম্মু জামিলকে দরবারে প্রশ্রয় দেওয়ায়। পরে অবশ্য কুফার গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুগিরা রা.-কে।
সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. :
কুফার জনগণের একটা অংশ ইসলামের ন্যায়নীতির সুযোগ নিয়ে বার বার বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করেছিল। এদের প্রথম শিকার হলেন সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তিনি নামাজ ঠিকভাবে আদায় করেন না ও শিকারে ব্যস্ত থাকেন। ফলে রাষ্ট্রীয় কাজ ব্যাহত হয়। উমার রা. এই অভিযোগের তদন্ত করেন এবং সা'দ রা. নির্দোষ প্রমাণিত হয়। কিন্তু উমার রা.-এর কাছে এই অভিযোগে অনেক চিঠি এসেছিল বিধায় উমার রা. আর সেখানে তাঁকে দায়িত্বে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। সা'দ রা.-কে খলিফার পরামর্শক পদ দিয়ে মদিনায় নিয়ে এলেন। সা'দ রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন কুফায় কাকে গভর্নর করবেন? সা'দ রা. আব্দুল্লাহ ইবনে উতবানকে মনোনীত করেন। তাকে নিয়েও অসন্তুষ্ট ছিল কুফার আরেক অংশ। এরপর সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হলো আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মতো তাকওয়াবান সাহাবীকে।
তার বিরুদ্ধে চিঠি পাঠাতে লাগলো কুফাবাসী। আম্মার রা.কেও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন উমার রা. অবশেষে তিনি কুফা নিয়ে মজলিসে শুরা আহবান করলেন। উমার রা. জিজ্ঞাসা করলেন, একজন কোমলচিত্ত ধার্মিক ব্যক্তি ও একজন দৃঢ়চিত্তের কিছুটা কম ধার্মিক ব্যক্তি সম্পর্কে আপনাদের মন্তব্য কী?
মুগিরা বিন শুবা রা. উত্তরে বলেন, হে আমিরুল মু'মিনিন, কোমলচিত্ত ও বিনয়ী ব্যক্তির কাজ কেবল তার নিজের কল্যাণ বয়ে আনে। কিন্তু তার দুর্বলতা আপনার ও মুসলিম জাতির ক্ষতির কারণ হতে পারে। আবার দৃঢ় চরিত্রের ব্যক্তির কম ধার্মিকতার কারণে কেবল সে নিজে কম লাভবান হয়, কিন্তু তার দৃঢ়তা আপনার ও মুসলিম জাতির কল্যাণ বয়ে আনে।
উমার রা. বললেন, আপনি সঠিক কথা বলেছেন। অবশেষে সবার পরামর্শে মুগিরা বিন শু'বা রা.-কেই কুফার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। দায়িত্ব নিয়ে যাওয়ার সময় উমার রা. মুগিরা রা.-কে বলেন, এমন একজন ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা করবেন যাতে সৎকর্মশীলরা বিশ্বাস করে, অসৎ লোকেরা ভয় পায়।
আমর ইবনুল আস রা. :
আমর ইবনুল আস রা. উমার রা.-এর প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু নানান কারণে আমর রা. শাস্তির মুখোমুখি হন। উমার রা. তাঁকে শাস্তি দিতে একটুও সংকোচ করেন নি। অন্যদিকে আমর ইবনুল আস রা.ও বিনা প্রতিবাদে উমার রা.-এর শাসন মেনে নেন। আমর রা. ছিলেন মিসরের গভর্নর। একবার আমর রা. তাঁর জন্য সুদৃশ্য উঁচু মিম্বর তৈরি করেন, যেখান থেকে তিনি ভাষণ দিতেন। উমার রা. চিঠি লিখে জানান ''আপনার জন্য কি এটাই যথেষ্ট নয় যে, আপনি নিজ পায়ে ভর করে মুসলিমদের সাথে দাঁড়াবেন। আমি খবর পেয়েছি মুসলিমদের মাথার উপরে দাঁড়ানোর জন্য আপনি একটি মিম্বর তৈরি করেছেন। আমি এটা ভেঙ্গে ফেলার জন্য জোর তাকিদ করছি।
একবার আমর রা.-এর ছেলে অন্যায়ভাবে এক মিসরিয়কে চাবুক মেরেছিল। মিসরিয় লোকটি আমর রা.-এর কাছে বিচার পাবে না ভেবে উমার রা.-কে চিঠি লিখলেন। উমার রা. চিঠিতে আমর রা.-কে তার ছেলেসহ উপস্থিত হতে বললেন। এরপর বিচার শেষে লোকটির হাতে চাবুক দিয়ে উমার রা. বললেন, তুমি আমরের ছেলের কাছ থেকে প্রতিশোধ নাও। লোকটি আমর রা.-এর ছেলেকে প্রহার করার পর উমার রা. বললেন, তুমি চাইলে আমরকেও চাবুক মারো। লোকটি বললো, না, তিনি কোনো অন্যায় করেন নি। আমর রা. আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, আমি এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। তাহলে এই বিচার আপনাকে করতে হতো না।
আরেকবার আমর রা. তাঁর নিজ বাহিনীর এক সৈন্যের প্রতি রাগান্বিত হয়ে মুনাফিক বলেছেন। এতে ভীষণ কষ্ট পায় সৈন্যটি। তিনি উমার রা.-কে চিঠি লিখলেন। উত্তরে উমার রা. আমর রা.-কে লিখলেন, এই ব্যক্তির অভিযোগ যদি সত্য হয় তবে সে আপনাকে প্রকাশ্যে চাবুক মারবে। মিশরের লোকজন সৈন্যটিকে অর্থ দিয়ে আমর রা.-কে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে চাইলেন। কিন্তু সৈনিকটি রাজি হয় নি। তিনি চাবুক হাতে নিয়ে আমর রা. এর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে বাধা দেয়ার জন্য এখানে কেউ আছে কি? আমর রা. বললেন, না! তোমাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা পালন করো। সে বললো, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম।
আবু মুসা আশআরি রা. :
আবু মুসা আশাআরি রা. ছিলেন বসরার শাসক। তিনি জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। যদিও তিনি কঠোর শাসক তারপরও বসরার জনগণ তাকে পছন্দ করেছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দু'জন লোক অভিযোগ করেছিল। একজন ওনার অধিনস্ত সৈন্য। অন্যজন একজন মদ্যপায়ী।
অধিনস্ত সৈন্যের অভিযোগ ছিল, তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ বাবদ গণিমাত লাভ করেছেন। কিন্তু হিসাব না হওয়ায় আবু মুসা রা. তখনো তাকে বুঝিয়ে দেননি। এই নিয়ে সে কর্কশ ভাষায় ও উচ্চ স্বরে কথা বলেছিল। রাগান্বিত হয়ে আবু মুসা রা. তাকে বেত্রাঘাত করেন ও তার চুল কেটে দেন। সৈন্যটি কাটা চুল নিয়ে উমার রা.-এর কাছে এলেন এবং অভিযোগ দায়ের করলেন। সব শুনে উমার রা. আবু মুসার কাছে চিঠি লিখে জানালেন, লোকটিকে যদি আপনি প্রকাশ্যে এই আঘাত করেন তবে তাকে প্রকাশ্যে প্রতিশোধ নিতে দেবেন। আর যদি গোপনে হয়ে থাকে তবে সে গোপনে প্রতিশোধ নিবে। আপনি এই রায় বাস্তবায়ন করবেন।
লোকটি প্রতিশোধ নিতে গেলে সকল সাহাবা ও সৈন্যরা লোকটিকে বললো, তুমি আবু মুসাকে ক্ষমা করে দাও। সে কোনো কিছুর বিনিময়ে প্রতিশোধ নেওয়া ত্থেকে বিরত থাকতে চাইলো না। অবশেষে আবু মুসা রা. নত মস্তকে তার হাতে চাবুক তুলে দিয়ে বললেন, তুমি প্রতিশোধ নাও। লোকটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি বিচার পেয়ে গেছি। আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম।
এক মদ্যপায়ীকে আবু মুসা রা. কঠোর শাস্তি দিলেন। এরপর তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করলেন। লোকজনকে তার সাথে কথা বলতে বারণ করে দিলেন। সে মদিনায় চলে এলো। উমার রা. এর সামনে কাঁদতে লাগলো। তিনি অভিযোগ করে বললেন, আবু মদপান করেছি, এজন্য আবু মুসা আমাকে চাবুক মেরেছে। আমার মাথা মুড়ে দিয়েছে। আমাকে এভাবে বাজারে হাঁটিয়েছে। শুধু তাই নয় আমার সাথে সবার মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আমার একবার মনে হয়, তলোয়ার দিয়ে নিজের মাথা কেটে ফেলি, আবার মনে হয় মুশরিকদের দেশে চলে যাই।
উমার রা. এই লোকের দুঃখে দুঃখী হলেন। তিনি চিঠি লিখে আবু মুসা রা.-কে জানালেন, আপনি অতিরিক্ত শাস্তি কখনো দেবেন না। আল্লাহর শপথ! আপনি যদি আর কখনো এমন করেন তবে আপনার চেহারায় আমি কালি মেখে দেব। চিঠি পাওয়ার পর সবাইকে তার সাথে মিশতে বলবেন। তাকে পোষাক, একটি ঘোড়া ও দুইশ দিরহাম উপহার দিবেন। তার জীবন স্বাভাবিক করে দেবেন।
অপরাধীর ওপর শাস্তি প্রয়োগে কোনো গভর্নর যাতে মাত্রা ছাড়িয়ে না যান তা নিশ্চিত করতে আমিরুল মুমিনিন উমার রা.-এর আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়েছে এই ঘটনায়।
সাঈদ ইবনে আমির রা. :
সিরিয়ার এমেসায় (হোমস, সিরিয়া) উমার রা. নিয়োগ করেন সাঈদ ইবনে আমির রা.-কে। উহুদ যুদ্ধের পর মক্কার মুশরিকদের কাছে বন্দী হলেন খুবাইব রা.। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে খুবাইব রা.-কে হত্যা করা হয়। সাঈদ ইবনে আমির রা. তখনো মুসলিম হন নি। অনেকের মতো তিনি এই হত্যাকাণ্ড পরিলক্ষিত করেন। সেদিন খুবাইব রা.-এর নামাজ, তাঁর কথা, মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি তাঁর সম্মান ও ভালোবাসা, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ইসলামের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি দেখে তাঁর মানসিক পরিবর্তন আসে। শাহদাতের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে খুবাইব রা. উপস্থিত লোকদের অভিশাপ দিতে থাকেন। অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য আবু সুফিয়ান হাতের কাছে থাকা তাঁর ছেলে মুয়াবিয়াকে শুইয়ে দেন। জাহেলি রীতি অনুসারে শুয়ে পড়লে অভিশাপ কার্যকর হয় না। সাঈদ ইবনে আমির সেসময় খুনের দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
এই ঘটনা তাঁর জীবনে প্রভাব তৈরি করে। তিনি মক্কা থেকে পালিয়ে যান ও মদিনায় এসে ইসলামগ্রহণ করেন। তিনি খুব তাকওয়াবান মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সম্পদ ও উন্নত জীবনের প্রতি তাঁর কোনো ঝোঁক ছিল না। তিনি গভর্নর হিসেবে পাওয়া ভাতা দান করে দিতেন। উমার রা. তাঁকে হোমসের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন।
একবার উমার রা. হোমসে গেলেন এবং খুব বড় আশা নিয়ে হোমসের জনগণের সামনে দাঁড়ালেন। হোমসবাসীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে এমেসাবাসী! আপনাদের প্রশাসক কেমন মানুষ? উমার রা. ভাবলেন তারা ভালো উত্তর করবে। তাই এমন প্রশ্ন করলেন জনসম্মুখে। কিন্তু উমার রা.-কে অবাক করে দিয়ে হোমসবাসী বললো, তার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ আছে।
উমার রা. লজ্জা পেয়ে গেলেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন, ইয়া আল্লাহ! সাঈদের প্রতি আমার সুধারণা তুমি পরিবর্তন করে দিও না। মাথা নিচু করে উমারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাঈদ। উমার রা. বললেন, তোমাদের অভিযোগ বলো।
জনগণ থেকে চারটি অভিযোগ পাওয়া গেল। ১ম অভিযোগ, তিনি দরবারে আসতে দেরি করেন। ২য় অভিযোগ রাতের বেলা তিনি কারো ডাকে সাড়া দেন না। ৩য় অভিযোগ মাসে একদিন তিনি কারো সাথে সাক্ষাত দেন না। ৪র্থ অভিযোগ তিনি মাঝে মাঝে দরবার চলাকালে অজ্ঞান হয়ে যান।
সাঈদ রা. অভিযোগগুলো মেনে নিলেন এবং উত্তর করতে চান নাই। উমারের নির্দেশে তিনি উত্তর করতে বাধ্য হলেন। ১ম অভিযোগের জন্য বললেন, আমার কোন ভৃত্য নেই। আমি আমার পরিবারের জন্য সারাদিনের খাবার তৈরি করি, তারপর অযু করে লোকজনের সামনে আসি। এতে আমার কিছুটা দেরি হয়ে যায়। ২য় অভিযোগের উত্তর হলো, আমি দিনের বেলা দায়িত্বের জন্য বরাদ্দ রেখেছি। রাতের বেলা আল্লাহর দরবারের জন্য নির্দিষ্ট করেছি। ৩য় অভিযোগের কারণ হলো, আমার একটা মাত্র কোর্তা। এটা আমি মাসে একবার ধুয়ে দিই। সেটি শুকানোর জন্য আমাকে একদিন দরবারে কামাই করতে হয়। ৪র্থ অভিযোগের কারণ হলো, যখন খুবাইব আনসারি রা.-কে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তখন আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। আমি মুশরিক ছিলাম। আমি তাকে সাহায্য করি নাই। মাঝে মাঝে এই দৃশ্য আমার চোখে ভাসে। খুবাইব রা. বদদোয়া ও আল্লাহর শাস্তির ভয়ে আমি বিচলিত হয়ে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ি।
সাঈদ রা.-এর উত্তরে উমার রা. অত্যন্ত খুশি হলেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বললেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর। যিনি আমার ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন নি। এরপর তিনি ১০০০ দিরহাম দিলেন সাঈদ রা.-কে। প্রয়োজন পূরণ করতে বললেন, কিন্তু সাঈদ রা. সব দান করে দেন।
ইয়াদ ইবনে গানাম রা.:
তিনি ছিলেন সিরিয়ার একটি অংশের প্রশাসক। তিনি একটি পরিষদবর্গ তৈরি করেন। তাদের নিয়ে আয়েশি জীবন যাপন করেন। পরে তিনি একটি হাম্মামখানা ক্রয় করেন। এই খবরে উমার রা. তাঁকে জরুরি তলব করেন মদিনায়। ইয়াদ রা. মদিনায় আসলে উমার রা. তাঁকে তিনদিন সাক্ষাতের অনুমতি দেননি। এরপর সাক্ষাত করে তাকে বাইতুল মালের সরকারি ভেড়া লালন পালনের দায়িত্ব দেন। এভাবে তিন মাস একজন গভর্নর মেষপালকে পরিণত হন। তিন মাস পার হলে উমার রা. তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আর ভুল হবে? উত্তরে তিনি 'না' বলেন। উমার রা. তাঁকে বললেন, যান, সিরিয়ায় গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করুন। এই প্রশিক্ষণ পেয়ে ইয়াদ রা. একজন প্রখ্যাত ও দক্ষ গভর্নরে পরিণত হন।
এভাবে উমার রা. জনগণের কথা শুনতেন ও গভর্নরদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। গভর্নরসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি মূলত পুরো ইসলামী রাষ্ট্রে ন্যয়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন