আবু বকর রা.-এর সময়ে বাইতুলমাল / কোষাগার প্রতিষ্ঠা হলেও এটি স্বাতন্ত্র ও পূর্ণতা পায়নি। উমার রা. অর্থনৈতিক বিভাগ গঠন করেন এবং এর তত্ত্বাবধানের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করেন। উমার রা.-এর সময়ে রাষ্ট্রের আয় ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এগুলোর হিসেব রাখা ও খরচ করার নিমিত্তে তিনি পারসিকদের অনুকরণে নথিপত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। যার নাম দেওয়া হয় দিওয়ানী।
বাইতুলমালে আয়ের খাত :
১. যাকাত : উমার রা.-এর সময়ে যাকাত ছিল বড় রাষ্ট্রীয় আয়ের মাধ্যম। উমার রা. যাকাত আদায়, যাকাতের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং যাকাতের সম্পদ ব্যায়ের জন্য আলাদা যাকাত ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করে দেন। যাকাত ব্যয়ের নির্দিষ্ট খাতে যাকাত ব্যয় করা হতো।
২. জিজিয়া : উমার রা.-এর সময়ে রোমান ও পারসিকদের বিশাল সাম্রাজ্য ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে আসে। এখানের মানুষজনের একটা বড় অংশ ইসলামগ্রহণ করেনি। যারা অমুসলিম ছিল তারা নিরাপত্তা কর বা জিজিয়া দিতেন। এটাও রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য আয়ের খাত হিসেবে দেখা দেয়। এই কর প্রত্যেক অমুসলিম স্বাধীন সামর্থবান পুরুষের ওপর ধার্য ছিল। কোনো অক্ষম পুরুষ, মহিলা, শিশু ও দাসের ওপর ধার্য ছিল না। এই করের বিনিময়ে অমুসলিম পুরুষেরা তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করবে ও নিরাপত্তা পাবে। তারা প্রতিরক্ষায় কোনো যুদ্ধ বা প্রতিরক্ষা ব্যয়ে কোনো ভূমিকা রাখবে না। মুসলিম সামর্থবান পুরুষেরা এই কর দিবে না। কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ও প্রতিরক্ষায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে।
৩. খারাজ : ইসলামী রাষ্ট্র যে জমি কোন অমুসলিমকে বন্দোবস্ত দিয়েছে, এমন জমিকে খারাজি জমি বলে। আর এই জমি হতে যে রাজস্ব আদায় করা হয় তাকে খারাজ বলে। খারাজ সাধারণত বছরে একবার আদায় করা হয়। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। ভূমির উর্বরা শক্তি , ধরন, সেচ ইত্যাদির উপর এর পরিমাণ নির্ভর করে। ইসলামের ২য় খলিফা উমার রা. ইরাক, সিরিয়া ও মিশরের বিশাল বিস্তৃত উর্বর ভূমির উপর খারাজ নির্ধারণের জন্য ভূমি রাজস্ব বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম সদস্য উসমান বিন হানিফকে জমির জরিপকার্য সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করে খারাজ নির্ধারণের নির্দেশ জারী করেছিলেন। উমার রা. সময়ে খারাজ থেকে বড় রাষ্ট্রীয় আয় হতো।
৪. বিদেশী পণ্যের উশর : উশর মানে এক দশমাংশ বা ১০%। ইসলামী রাষ্ট্র যখন অনেক বড় হয়ে যায় তখন এখানে ব্যবসা করার জন্য বহু ব্যবসায়ি আসতে থাকে। ফলে রাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তৎকালীন বিশ্বের নিয়ম অনুসারে বিদেশী ব্যবসায়ীদের ওপর ১০% কর আরোপ করা হয়।
৫. উশর : কৃষিজাত পণ্যের ওপর নির্ধারিত যাকাতকে উশর বলে। এটা মুসলিমদের ওপর নির্ধারিত ছিল। সেচবিহীন জমিতে উৎপাদিত ফসলের যাকাত ছিল ১০%। আর সেচ দেওয়া জমিতে উৎপাদিত ফসলের যাকাত ছিল ৫%। এছাড়া গবাদি পশুর ওপরও নির্দিষ্ট হারে যাকাত দিতে হতো।
৬. গনিমতের এক পঞ্চমাংশ : রাসূল সা.-এর সময় গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের পাঁচভাগের এক ভাগ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হতো। এর আবার পাঁচ ভাগ করা হতো। ১ম ভাগ রাসূল সা.-এর, ২য় ভাগ রাসূল সা.-এর আত্মীয়দের, ৩য় ভাগ ইয়াতিমদের, ৪র্থ ভাগ মিসকিনদের এবং ৫ম ভাগ মুসাফিরদের। আবু বকর রা. এবং উমার রা.-এর সময়ে গণিমতের সম্পদ একইভাবে ভাগ হতো। ১ম ভাগ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা থাকতো, বাকি ভাগগুলো আহলে বাইত, ইয়াতিম, মিসকিন ও মুসাফিররা পেয়ে যেত। রাসূল সা.-এর অংশ দিয়ে জিহাদের জন্য যুদ্ধ সরঞ্জাম কেনা হতো।
৭. ফাই : যুদ্ধ ছাড়াই শত্রুপক্ষ থেকে যেসব সম্পদ অর্জিত হতো সেগুলোকে ফাই বলা হয়। ফাইয়ের পুরোটাই বাইতুলমালে জমা হতো।
৮. খনিজ সম্পদ : খনির মালিক রাষ্ট্র। এর আয় বাইতুলমালে জমা হতো।
৯. গুপ্তধন : গুপ্তধনের এক পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রীয় কোষগারে জমা করার নির্দেশ দেন উমার রা.।
বাইতুলমালের ব্যয়ের খাত :
১. যাকাতের অর্থ ব্যয় : উমার রা. যাকাতের অর্থ থেকে রাষ্ট্রের অনেক খরচ মিটিয়ে ফেলতেন। ফকির, মিসকিন, ঋণগ্রস্থদের সাহায্য করতেন। মুসাফিরদের সেবা ও আপ্যায়নে খরচ করতেন। মুসলিম দাসদের মুক্তির জন্যও এই অর্থ ব্যবহার করতেন। জিহাদের ব্যয় মিটাতেও তিনি যাকাতের অর্থ ব্যবহার করতেন। শুধু একটি যাকাতের নির্ধারিত একটি খাতে তিনি ব্যয় করতেন না। সেটা হলো ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য অমুসলিমদের সাহায্য ও উপহার দেওয়া। উমার রা. মনে করতেন যেহেতু সে সময় মুসলিমরা বেশ ক্ষমতাবান ছিল তাই এই খাতে অর্থ ব্যয়ের দরকার নেই।
২. গভর্নর ও সরকারি চাকুরেদের বেতন : উমার রা. তাঁর শাসনামলে সরকারি কাজে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছেন। রাষ্ট্রও তখন অনেক বড় হয়েছিল। তাই রাষ্ট্রীয় কাজে বহু মানুষের দরকার হয়ে পড়ে। তিনি সবার জন্য মর্যাদা অনুসারে বেতনের ব্যবস্থা করেন, যাতে করে তারা সরকারি কাজে মননিবেশ করতে পারে। মুহাম্মদ সা. ও আবু বকর রা.-এর সময়ে এমন বেতনধারী সরকারি লোক ছিল না। উমার রা. রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থা করেছেন।
৩. সেনাবাহিনীর বেতন : মুহাম্মদ সা. ও আবু বকর রা.-এর সময়ে নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। যুদ্ধের প্রয়োজন হলে সাহাবারা সবাই যোদ্ধা হয়ে যেতেন আবার ফিরে এসে নিজ নিজ পেশায় চলে যেতেন। উমার রা.-এর সময়ে নিয়মিত রাজ্যজয় ও বিশাল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি নিয়মিত সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। যাদের কাজ ছিল শুধুমাত্র যুদ্ধ করা ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করা। তাদের অন্য পেশায় লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রীয় খরচের একটা অংশ ছিল সেনাবাহিনীর বেতন।
৪. নাগরিকদের ভাতা : উমার রা.-এর সময়ে যখন রাষ্ট্রীয় আয় অনেক বেশি হয়ে যায় তখন তিনি সকল নাগরিকদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দেন। এক্ষেত্রে যারা মুহাজির ও বাদরি সাহাবী তাদের পরিমাণ সবার চেয়ে বেশি ছিল। এরপর হুদায়বিয়ার আগ পর্যন্ত যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের স্থান ছিল। তারপর যারা মক্কা বিজয়ের আগে ইসলামগ্রহণ করেছে তাদের স্থান ছিল। এরপর ছিল মক্কা বিজয়ের পরে যারা ঈমান এনেছে তাদের স্থান। এই ভাতা থেকে কেউ বঞ্চিত ছিল না। একজন নবজাতক শিশু জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই তার ভাতা পেয়ে যেত।
এজন্য সরকারি দিউয়ানী কর্মকর্তা ও পিতা-মাতাদের প্রতি নির্দেশ ছিল জন্ম হলেই যেন শিশুকে নিয়ে জন্ম নিবন্ধন করিয়ে নেওয়া হয়। জন্ম নিবন্ধন করে শিশুকে তার প্রাপ্য ভাতা দিয়ে দেওয়া হতো। শুধু এই ভাতা দিতে গিয়েই উমার রা. পুরো অর্ধ পৃথিবীর আদমশুমারি করে ফেলেন।
৫. গনীমতের সম্পদ ব্যয় : গনীমতের সম্পদ পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাইতুলমালে জমা হতো। আর বাকী চার ভাগ মুজাহিদদের মধ্যে বন্টিত হতো। পদাতিক সৈন্যরা পেত এক ভাগ আর অশ্বারোহীরা পেত তিন ভাগ। অশ্বারোহীরা বাড়তি ঘোড়া ক্রয় ও লালনপালনের জন্য। এই কারণে দেখা যেত সেসময়ে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিল সেনাবাহিনী।
৬. খলিফার ভাতা : উমার রা. একেবারে সুনির্দিষ্ট ভাতা নিতেন না। প্রয়োজন অনুসারে নিতেন। ঐতিহাসিকগণ বর্ণনামতে সেটা বার্ষিক ৮০০০ থেকে ১০০০০ হাজার দিরহামের মতো হতো। বর্তমান টাকায় তা দাঁড়ায় বাৎসরিক আনুমানিক ২১ লক্ষ থেকে ২৬ লক্ষ টাকা। তুলনা করার জন্য একটি উদাহরণ দিই। সেসময় একজন মুহাজির ও বদরি সাহাবির জন্য নাগরিক ভাতা নির্ধারিত ছিল ৫০০০ দিরহাম। একজন মুহাজির সাহাবি রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্ব পালন না করলেও তিনি ৫০০০ দিরহাম পেতেন। সেই হিসেবে উমার রা. বেশি ভাতা নিতেন না। সেনা কমান্ডার ও অন্যান্য গভর্নরদের জন্যও প্রায় একই পরিমাণ বেতন বরাদ্দ ছিল।
উমার রা. এই ব্যাপারে বলেন, //আমি আপনাদের জানিয়েছি, আমি নিজের জন্য আল্লাহর সম্পদ থেকে কতটুকু রেখেছি। শীতের পোষাক, গরমের পোষাক, চলাচলের জন্য বাহন (উট ও ঘোড়া), আর রেখেছি ততটুকু খাবার যতটুকু কুরাইশদের জন্য যথেষ্ট। আমার জীবন যাপন দরিদ্র ব্যক্তির মতো নয়, আবার বিলাসী ধনী ব্যক্তির মতোও নয়। আমিও একজন মুসলিম। আপনারা যে অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন আমিও একই অবস্থার মধ্যে আছি।
আল্লাহ জানেন, আমি যতটুকু খাওয়া প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি খাই না। যতগুলো পোশাক প্রয়োজন তার চাইতে বেশি বানাই না। আর আমি আমার অধিকার ব্যতীত কিছুই গ্রহণ করি না।//
এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমরা এতোদিন বিভিন্ন গল্প শুনেছি যে তিনি তালি ওয়ালা জামা গায়ে দিয়েছেন, ছেলের জন্য জামা বানাতে পারেন নি এবং ছেলে কিছু খাবার খেতে চেয়েছিল সে আবদার পূরণ করা যায় নি। এই কথাগুলো কি তাহলে ভুল? না এগুলোও ভুল নয়। এগুলো একটি বছরের ঘটনা। উমার রা. ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এর মধ্যে এক বছর আরবে খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। উমার রা. সেইবছর নিজের লাইফস্টাইল দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মতো করে ফেলেছিলেন। এভাবে ইনসাফ করে চলেছিলেন আমাদের নেতারা! আল্লাহু আকবার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন