২৮ মার্চ, ২০২২

ব্যাংক ডাকাতদের আস্ফালন


বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই সরকারের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের নজরে পড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। আর এসব ব্যাংক টার্গেটে নিয়ে বসানো হয় দলীয় লোক। ব্যাংকিং রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে অদক্ষ ও নন-ব্যাংকারদের হাতে তুলে দেয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, বেসিক, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকের দায়িত্ব। এতে সহজ হয় ঋণের নামে লুটপাটের পথ।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশি লুটপাটের শিকার হয়েছে সোনালী, বেসিক ও জনতা ব্যাংক। এ তিনটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিসহ পরিচালনা পর্ষদে অধিকাংশই দলীয় লোকদের বসানো হয়। বেসিক ব্যাংকের দায়িত্ব দেয়া হয় মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টির নেতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর হাতে। তিনি আবার শেখ হেলালের ঘনিষ্ঠ বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিচালকদের মধ্যে সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সাবেক ভিপি ছাত্রলীগ নেতা শুভাষ সিংহ রায়, সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আইনজীবী বলরাম পোদ্দার, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও নির্মাণ ব্যবসায়ী শাহজাদা মহিউদ্দিন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির আহমেদ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য, বুয়েট ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক আবদুস সবুর, কলামিস্ট ও মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের সম্পাদক শেখর দত্ত, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খন্দকার জাহাঙ্গীর কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাবেক ভিপি কেএমএন মঞ্জুরুল হক প্রমুখ।

এসব দুর্নীতিবাজদের জন্য বাংলাদেশে খেলাপী ঋণ বাড়ছেই। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল জাতীয় সংসদে ব্যাংকিং খাতের কিছু হতাশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরেন। এতে তিনি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া ৯১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম এবং ঋণের পরিমাণের কথা উল্লেখ করেন। সেই সাথে ঋণ গ্রহীতা ৮ হাজার ৭৯১টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এবং ঋণ আদায় করা সম্ভব হয়নি এমন ১ হাজার ৯৫৬ জন খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে জানা যায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্তসাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির মোট পরিমাণ ৯ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা! এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ৭ হাজার ৬২৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

এর বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার খারাপ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। গোপন রাখা এই বিশাল অঙ্ক খেলাপি ঋণ হিসাবের বাইরে রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে মোট খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি! অর্থনীতিবিদদের মতে, এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনিসংকেত!

১. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ লুট:
কোন রাষ্ট্রের রিজার্ভ লুট হওয়া এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। ফেব্রুয়ারিতে চুরি হলেও তা প্রকাশ পায় এক মাস পর মার্চে। এ নিয়ে তখন যথেষ্ট আলোঙন সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং অর্থ ফেরত আনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। নৈতিক দায় নিয়ে তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগও করেছিলেন। রহস্য উদঘাটনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠিত হয়, তারা যথাসময়ে তদন্তপ্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু সরকার সেই প্রতিবেদন আজও প্রকাশ করেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ দেশের বাইরে থেকে অজ্ঞাতনামা হ্যাকাররা ‘হ্যাকড’ করে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা এ ক্ষতির জন্য ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে দায়ী করেছেন। ইতিহাসে সবচেয়ে বঙ এই ব্যাংকিং হ্যাকিংয়ের ঘটনার পরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বলছে, তাদের ওখান থেকে হ্যাকিং হয়েছে-এর কোনো প্রমাণ নেই। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ ব্যাপারে খবর জানার পরই তারা সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করেছে। বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তঃব্যাংক আর্থিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট কর্তৃপক্ষও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। প্রেরণ ও গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে বার্তা বিনিময় হয়েছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য ছিল। সুইফট বলেছে, তাদের নেটওয়ার্ক অপব্যবহার হয়েছে- এ রকম কোনো আভাস পাওয়া যায়নি।

সরকারের একজন আইটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন এখানে সিস্টেমের কোন দোষ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকজনই এই চুরির সাথে জড়িত। এই কথা বলার অল্প সময়ের মধ্যেই ১৭ মার্চ ২০১৬ সরকার তাকে গুম করে এবং প্রায় এক সপ্তাহ তাকে গুম করে রাখা হয়। ২৪ তারিখ তাকে ফিরিয়ে দেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে এ বিষয়ে আর কথা বলতে রাজি হয়নি। অপরদিকে সরকার রিজার্ভ লুটের সাথে জড়িতদের রক্ষা করার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। কোন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।


২. বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনায় গন্ডগোল!
২০১৮ সালের ১৭ জুলাই দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত সোনায় অসঙ্গতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ব্যাংকে সোনার চাকতি ও রিং বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়। যেখানে ৮০ শতাংশ (১৯ দশমিক ২ ক্যারেট) বিশুদ্ধ সোনা ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে পরিদর্শন দল ওই চাকতি ও আংটি পরীক্ষা করে তাতে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২ ক্যারেট) সোনা পায়। আংটিতে পায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ সোনা (৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট)! বাকী সোনা গেলো কোথায়? 

তারপর ১৭ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় যে, সোনা সোনার জায়গাই আছে। সোনার বিষয়ে করণিক ভুল বা ক্ল্যারিকেল মিসটেক হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের দেওয়া সোনা জমা রাখার সময় ৪০ শতাংশই ছিল। কিন্তু ইংরেজি–বাংলার হেরফেরে সেটা ৮০ শতাংশ লিখে ভুলবশত নথিভুক্ত করা হয়েছিল। ২২ ক্যারেটের জায়গায় ১৮ ক্যারেট হওয়ার বিষয়টি দুটি ভিন্ন যন্ত্রে পরিমাপের কারণেই হয়েছে। সেই সাথে ভুলটা চাপিয়ে দেওয়া হলো স্বর্ণকারের উপর। তারপর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল বললেন যে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনার মধ্যে মাত্র তিন কেজি দূষিত হয়েছে। এটা কোনো সমস্যাই নয়। এটা নিয়ে ইউজলেস (অপ্রয়োজনীয়) আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে এনবিআরের কথা বলার প্রয়োজন ছিল না।’ এই ধাতু মিশ্রিত দূষিত সোনা নিয়ে সারাদেশে হইচই পড়ে গেলো। সোনায় হেরফের বাবদ সরকারের ১ কোটি ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬ টাকার ক্ষতি হয়ে গেলো। অথচ সোনা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তপ্রতিবেদন আজও প্রকাশিত হলো না!

৩. লুটপাটের শীর্ষে বেসিক ব্যাংক: 
 প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারিতে সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। সরকার গঠিত পরিচালনা পর্ষদ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনি। ইচ্ছেমতো হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। কোনো আইন বা বিধিমালা নয়, বেসিক ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদই সর্বেসর্বা। এমনকি প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও পর্ষদ ঠিকই ঋণের অনুমোদন দিয়েছে। গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করেছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবে আর কখনোই ঋণ বিতরণ করা হয়নি। বহুল আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারির সময় পরিচালনা পর্ষদের দাবি ছিল, তারা কিছু জানত না, শাখাই প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু বেসিক ব্যাংক করেছে উল্টোটা। পর্ষদই প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সব আয়োজন করে দিয়েছে।

পর্ষদের মাত্র ১১টি সভায় তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে বলেছে, অধিকাংশ ঋণই গুরুতর অনিয়ম করে দেওয়া হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনাও কম। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে শুরু থেকে মার্চ ২০১৩ পর্যন্তবেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ নয় হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। আর এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকাই দেওয়া হয়েছে গত ১১ মাসে।

ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন শেখ আবদুল হাই। তিনি এরশাদ সরকারের আমলে বাগেরহাট ১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে একবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা ব্যাংকে নানাভাবে প্রচার করা হয়। ব্যাংকের পরিচালক ও সরকারের সাবেক একজন যুগ্ম সচিব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমের কাছে একটি চিঠি দেন। আবদুল হাই সম্পর্কে তাতে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া তাই অন্য কাউকে পরোয়া করেন না তিনি। ব্যাংকের কার্যালয় ও লবিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তোলা তাঁর ছবিতে ভরপুর। সব সময় এবং সব জায়গায়ই তিনি বলে থাকেন, প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্তকাছের লোক তিনি। গোটা বেসিক ব্যাংকে এ রকম একটি আবহ অবস্থা তৈরি করেছেন আবদুল হাই।

ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, কার্যত ব্যাংকটির অধিকাংশ ঋণ বিতরণই হয় এই চেয়ারম্যানের ইচ্ছা অনুসারে। ব্যবস্থাপনায়ও রয়েছেন চেয়ারম্যানের নিজস্ব লোক। ব্যাংকের সূত্রগুলো বলছে, এভাবে পর্ষদের ঋণ বিতরণের পেছনে দুর্নীতিও রয়েছে। ঋণের একটি অংশ গোপন লেনদেনের মাধ্যমেই এভাবে দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল থেকে শুরু করে চলতি বছরের ২ মার্চ পর্যন্তমাত্র ১১ মাসে ব্যাংকের শান্তিনগর, গুলশান ও দিলকুশা শাখা থেকেই তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে, যার অধিকাংশই গুরুতর অনিয়মের ঋণ। এর মধ্যে গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে গত ২ মার্চ পর্যন্তপরিচালনা পর্ষদের ছয়টি সভায় (৩১৫ থেকে ৩২১তম) ঋণ অনুমোদন হয়েছে এক হাজার ২৫ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলোর কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করেছে।

এক সময়ের আদর্শ ব্যাংক বলে খ্যাত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক এখন দেউলিয়ার পথে। ব্যাংকটি থেকে গত ৮ বছরে বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানির নামে আট হাজার কোটিরও বেশি টাকা পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে বার বার জনগণের করের টাকা দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত জুন মাসে ব্যাংকটিকে মূলধন। ঘাটতি পূরণে একহাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। আর গত ৪ বছরে বেসিক ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টিই লোকসান গুনছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্তশেখ আবদুল হাই বাচ্চুর আমলের চার বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্তসময়ে আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই ব্যাংকটির অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণের উচ্চহার। বর্তমানে ব্যাংকটির ৫৯ দশমিক ২২ শতাংশই খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির এখন খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মাজিদ বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্তবিভিন্ন ভুয়া কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া হয়। আমরা তাদের অনেককে খুঁজে পাইনি। যেসব গ্রাহককে আমরা ধরে এনেছিলাম, তারাও ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। তিনি উল্লেখ করেন, সব টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় আমরা সাঙে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ রিসিডিউল করেছিলাম, কিন্তু দেখা গেল, সেখানকার তিন হাজার কোটি টাকাও চলে গেছে। এ জন্য টাকা উদ্ধারে অন্য কোনও পথ বের করতে হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি গত বছরে ৬৮৪ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। সব মিলিয়ে গত চার বছরে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালেও প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। ২০১২ সালে তা কমে দাঁঙায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়। পরের বছর ২০১৩ সাল থেকে লোকসান শুরু হয়। ২০১৩ সালে ৫৩ কোটি, ২০১৪ সালে ১১০ কোটি, ২০১৫ সালে ৩১৪ কোটি ও ২০১৬ সালে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করে বেসিক ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত মার্চ শেষে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩০৭ কোটি। এছাড়া ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। যদিও গত পাঁচ অর্থবছরে বেসিক ব্যাংকে ৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একদিকে বেসিক ব্যাংক ঋণ দেয়ার নাম করে টাকা লুটপাট করে খাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার জনগণের টাকা আবার তাদের দিচ্ছে লুটপাট করার জন্য।


৪. বারাকাত-আমিনুর লুটপাট কাণ্ডে জনতা ব্যাংকের বেহাল দশা: 
একটি ট্রাস্টের ২ কোটি টাকা অ্যাকাউন্ট পরিবর্তনের জন্য তিনবারের  সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন ৫ বছরের দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে। যা দেশের রাজনীতিকেও উলোট-পালট করে দিয়েছে। শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। ঠিক এ রায় ঘোষণার আগে ফাঁস হয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান- জনতা ব্যাংকের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য। আওয়ামী লীগের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ২২ প্রতিষ্ঠানে ৬ বছরের ব্যবধানে দেয়া হয়েছে এ ঋণ ও ঋণসুবিধা। যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এতে ব্যাংকটিই কার্যত এখন অচল। নতুন করে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। ঋণ পাওয়া সৌভাগ্যবান এক ব্যক্তির খেয়ালখুশির ওপরই এখন নির্ভর করছে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ। কারণ, তিনি ঋণের টাকা ফেরত না দিলে দেউলিয়া হতে পারে ব্যাংকটি নয়তো সরকার থেকে ঋণ নিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হবে। তাইতো মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে আড়াই হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ছত্রছায়ায় এ লুটপাট হয়। ব্যাংকটির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রহমানও এ অপকর্মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। মূলত বারাকাত-আমিনুর যৌথভাবেই ব্যাংকটিতে এ লুটপাট চালিয়েছেন।

আবুল বারাকাত ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমিনুরও সেই পর্যন্ত ব্যাংকটিতে এমডি পদে ছিলেন। এ সময়েই হয়েছে জনতা ব্যাংকের অর্থ হরিলুটের এমন কান্ড। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ব্যাংকটিতে হরিলুট চললেও এতদিন তা ধামাচাপাই ছিল। বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখতে তৎপর ছিলেন এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের অবৈধ সুবিধাভোগী কিছু অসাধু কর্মকর্তা। কিন্তু ব্যাংকটির পরিবর্তিত পরিচালনা পর্ষদের চাপাচাপিতে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ সব তথ্য তুলে ধরতে বাধ্য হয় এর ব্যবস্থাপনা বিভাগ। ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ হরিলুটের ভয়ংকর এ তথ্য উঠে আসায় নড়েচড়ে বসেছেন লুটপাটে সংশ্লিষ্ট অনেক রাঘব বোয়াল। যদিও চক্রের মূল হোতা বারাকাত অর্থ লুটকারী ওই আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। যা শুনে আশ্চর্য হয়েছেন স্বয়ং সাবেক অর্থমন্ত্রীও। বলেছেন, সংশ্লিষ্ট ‘দুষ্টচক্রের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও। তবে এক ব্যক্তিকে একটি ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের এ ঋণ দেয়ার তথ্য ফাঁস হওয়ায় সরকারের পুরো ব্যাংকিংখাতই নতুন করে বিতর্কে পড়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ব্যাংকটিতে আমানতকারীরা। কিন্তু দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা না হওয়ায় হতাশা আরো বেড়েছে। এই টাকা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব বলেও মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী একজন গ্রাহককে মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ এক গ্রাহক জনতা ব্যাংক থেকে কোনও অবস্থায়ই ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। অথচ এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেয়ায় বিপদে পড়েছে ব্যাংকটি। গ্রাহকও এখন ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ব্যাংক দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, সরকারের নিয়োগ দেয়া সেই পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাতই এই বিপজ্জনক হরিলুটের কাজটি করেছেন। যার সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রহমানও। হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর এটিকেই পারস্পরিক যোগসাজশে সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে ভয়ংকর কারসাজির আরেকটি বড় উদাহরণ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, এটি একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি। মূলত এটি সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক এবং বেসিক ব্যাংক কেলেংকারিকেও ছাড়িয়ে গেছে।

জানা গেছে, বারাকাত-আমিনুর ছাড়াও ওই সময় ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্য ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক নাগিবুল ইসলাম ওরফে দীপু, টাঙ্গাইলের কালিহাতী আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী যুবলীগ নেতা আবু নাসের প্রমুখ। বর্তমান এমডি আবদুস ছালাম আজাদও এই ঋণ কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংকের ওই পর্ষদের উৎসাহ-ই ছিল বেশি। পর্ষদের সিদ্ধান্তেবারবার ঋণ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্তঋণ দেয়া হয় খেয়ালখুশি মতো। ব্যাংকের উদার আনুকূল্য পাওয়া এই গ্রাহক হচ্ছেন এননটেক্স গ্রুপের মালিক মো. ইউনুস (বাদল)। তিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তারই স্বার্থসংশ্লিষ্ট ২২ প্রতিষ্ঠানের নামে সব ঋণ নেয়া হয়। ব্যাংকে ঋণের টাকায়ই এ প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক গড়ে উঠে এবং ইউনুস রাতারাতি বৃহৎ শিল্পপতি বনে যান। এক সময়ের বাসশ্রমিক তিনি। পরে আওয়ামী শ্রমিক লীগের নেতা। দল ক্ষমতায় আসার পর সফল উদ্যোক্তা। এখন শিল্পপতি মূল ব্যবসা বস্ত্র উৎপাদন ও পোশাক রফতানি।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঋণ পেতে পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করে দিতে ভূমিকা রেখেছিলেন সিবিএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম। ১৯৭৩ সাল থেকে জনতা ব্যাংক কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ, জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত) সভাপতি তিনি। তার নামে করা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে ২০১ গম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদ হচ্ছে ওই নেতার টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামের বাড়িতে। মসজিদের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘বাদল হেলিপ্যাড’। রফিকুল ইসলাম জানালেন, ‘মসজিদ বানাতে এতে ২৫০ কোটি টাকা লাগবে। এতে ইউনুস সাহেবের অনুদান শতকোটি টাকা ছাড়াবে।’ তবে ইউনুস বলেন, ‘সর্বোচ্চ আড়াই কোটি টাকা দিয়েছেন। সিবিএ সভাপতি সব সময় একটু বাড়িয়ে বলেন।’

জানা গেছে, ঋণ নেয়া কোম্পানির অধিকাংশই এননটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলোও মো. ইউনুসের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জনতা ব্যাংকের এখনকার পর্ষদের নথিতেও তাই। এ কারণেই জনতা ব্যাংক এখন এই ঋণ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটকারী ইউনুস ওরফে বাদলের দাবি, ‘পুরো অর্থ দিয়ে ২২টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। কারখানাগুলোর সবই আন্তর্জাতিক মানের।’ জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০৪ সাল থেকে জনতা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় প্রথম ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করে এননটেক্স গ্রুপের জুভেনিল সোয়েটার। ওই শাখার বেশি ঋণ দেয়ার ক্ষমতা না থাকায় ২০০৮ সালে জনতা ভবন করপোরেট শাখায় ঋণটি স্থানান্তর করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবুল বারাকাত হন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। এ সময় ব্যাংকটির এমডি পদে ছিলেন আমিনুর রহমান। 

চেয়ারম্যান-এমডির ছত্রছায়ায় থেকে এবং এদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ২০১০ সাল থেকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণসুবিধা নেয়া শুরু করে এননটেক্স গ্রুপ। এক ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে এত টাকা দেয়ায় নতুন ঋণ দেয়ার সব সামর্থ্যই এখন হারিয়ে ফেলেছে জনতা ব্যাংক। এর আগে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখা থেকে ২০১১ সালের দিকে হলমার্ক নামের গ্রুপটি বের করে নিয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। তাতে সোনালী ব্যাংক এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। জনতা ভবন করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ থেকে দায়িত্বে আছেন আহমেদ শাহনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শাখার ঋণ দেয়ার সব সীমা শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু আদায়ের পেছনে ছুটছি।’

৫. দেউলিয়া ফারমার্স ব্যাংক:
২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নয়টি ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। কার্যক্রম শুরুর বছর না পেরোতেই বঙ অনিয়মে জডড়য়ে পড়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। দুর্বল হতে থাকে ব্যাংকের অবস্থা। একের পর এক অর্থ আত্মসাৎ শুরু করে পরিচালকেরা। তাতে আস্থার সংকট দেখা দেওয়ায় আমানতকারীরা অর্থ তোলা শুরু করেন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে গত ২৭ নভেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী। এমনকি পরিচালক পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তারা। এরপর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার দায়ে ১৯ ডিসেম্বর ব্যাংকটির এমডি এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সাথে জডড়ত আছেন আওয়ামী ঘরানার লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন ও ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি নাজমুল আলম সিদ্দিকী। সংকটে পঙা ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

এখন ব্যাংকটিতে জমা রাখা অর্থ তুলতে গিয়ে আমানতকারীদের বেশির ভাগকেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। অনেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়েও টাকা পাচ্ছেন না। এতে পুরো ব্যাংক খাতে একধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে। একের পর এক শাখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছে না। এর মধ্যে একজন চাকুরীহারা ব্যাংক কর্মকর্তা ও ইনভেস্টর আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ১৯৭১ সালের শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের সন্তান।

৬. অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক দুর্নীতি: 
অগ্রণী ব্যাংক থেকে বহুতল ভবন নির্মাণে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ৩শ কোটি টাকা ঋণ নেয় মুন গ্রুপ। সে ঋণের কোনো হদিস নেই। রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৬৮৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। রূপালী ব্যাংক থেকে বেনিটেক্স লিমিটেড, মাদার টেক্সটাইল মিলস ও মাদারীপুর স্পিনিং মিলস নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে গেছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর ৮০১ কোটি টাকা আদায়ের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ হরিলুটের দায় কার?

৭. আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক
সাবেক অর্থমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতিতে আছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্তব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার ৪৮৫ কোটি১৩ লাখ টাকা। ব্যাংকটির বকেয়া ঋণ উত্তোলন করে ঘাটতি কমানোর চেষ্টা চলছে।

৮. ওরিয়েন্টাল ব্যাংক 
গত ০৯ জুলাই ২০১৮ তারিখ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মো: হারুন ওরফে এস এম হারুনকে সাত বছরের কারাদ-সহ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাভোগের আদেশ দিয়েছেন। এভিপি ফজলুর রহমান, এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ হোসেন এবং ইভিপি কামরুল ইসলামকে পাঁচ বছর করে কারাদ- ও ১৫ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছর কারাভোগের আদেশ দিয়েছেন। আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কোনোরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ প্রদানে কোনো নিয়ম-কানুন না মেনে বেনামি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুপার মেটাল ওয়ার্কসকে ঋণ প্রস্তাব প্রেরণ ও অনুমোদনপূর্বক একে অন্যকে লাভবান করে ব্যাংকের ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। ওই ঘটনায় দুদকের সাবেক সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপপরিচালক) এস এম এম আখতার হামিদ ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর মামলাটি করেন। (নয়াদিগন্ত, ১০ জুলাই, ২০১৮)

৯. ট্রাস্ট ব্যাংকের শত কোটি টাকা লোপাট 
ট্রাস্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী, ডিএমডি আবু জাফর হেদায়তুল ইসলাম এবং ইভিপি অ্যান্ড সিআরএম সৈয়দ মনছুর মোস্তফাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২৯ মে, ২০১৮ তারিখ রোজ মঙ্গলবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দুদক।  ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই ইউরোপা গ্রুপের স্বত্বাধিকারী সেলিম চৌধুরীর মালিকানাধীন বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড এবং রূপালী ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে ঋণের নামে শত কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তনেওয়া হয়। এর পরেই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করতে থাকে দুদকের অনুসন্ধান দল। (ইত্তেফাক, ২৯ মে, ২০১৮)

১০. এনআরবি ব্যাংক
এনআরবি ব্যাংকে তদন্তচালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৬ সালে ৭০১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম খুঁজে পায়। অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির মূলধন সংগ্রহেও। সংকট নিরসনে ১০ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ফরাছত আলীকে সরিয়ে দায়িত্বে আসেন তমাল এস এম পারভেজ। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যানকেও সরানো হয়। ছুটিতে পাঠানো হয় এমডি দেওয়ান মুজিবর রহমানকে।

এককটা ব্যাংক ঘাটতির সম্মুখীন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদন্তকমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ তদন্তকমিটির প্রতিবেদন জনগণের দেখার সৌভাগ্য হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ভুতুড়ে কান্ড’, এমনকি বেশকিছু ব্যাংকের দুর্নীতি-অনিয়ম-লুটপাট নিয়ে যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছিলো তার তদন্তকমিটির প্রতিবেদন আজ পর‌্যন্তজনগণের সামনে প্রকাশ কর হয়নি! তার মানে ব্যাংকিং খাতের এই ভরাডুবি আর হরিলুটে ব্যক্তিবিশেষ কেউ কী দায়ী নয়? অপরাধী চিহ্নিত না হওয়া, চিহ্নিত হরেও শাস্তির মুখোমুখি না করে ক্ষমতার মারপ্যাচে পার হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, চোরের মুখোশ উন্মোচন না হওয়ায় ব্যাংকিং খাত হয়ে উঠছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির নিদর্শন।

এই ব্যাংক লুটেরাদেরকে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দিয়ে অন্যজনকে বসানো হচ্ছে। ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’ সেই কথাটি এখানেও প্রয়োগ হচ্ছে। কিন্তু আগের যিনি দুর্নীতি করে ব্যাংকটিকে ঘাটতির মুখে ফেলে সর্বশান্তকরে দিয়ে গেলেন তার কোনো বিচার হচ্ছে না! তাছাড়া প্রতি বছরই বাজেটে থাকছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। এইখানেই সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। কেননা, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির দায়ে আমরা কোনো ব্যাংক পরিচালক কিংবা উচ্চ পর্যায়ের কাউকে উচ্চপর‌্যায়ের যোগসাজসের কারণে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারিনি। কেবল কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাকে শাস্তি দিয়ে রাঘববোয়ালদের আড়াল করা হচ্ছে। এইখানেই আমাদের রাষ্ট্রীয় অসহায়ত্ব, ব্যাংকিং খাতের দেউলিয়াপনা। এই সেই দেশ, যে দেশে একজন কৃষককে ১০ হাজার টাকা ঋণ অনাদায়ে জেলে যেতে হয়! অথচ ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হরিলুট হলে দেশবাসীকে সাবেক অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠে শুনতে হয়- ‘সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না’! ‘সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’

১১. গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে জোর করে ইসলামী ব্যাংক দখল 
ইসলামী ব্যাংক দখল নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে লন্ডন ভিত্তিক বিখ্যাত সাপ্তাহিকী দ্য ইকনোমিষ্ট । The government initiates a coup at Bangladesh’s biggest bank, (সরকার যেভাবে ক্যু করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক দখল করলো) শিরোনামে ৬ এপ্রিল ২০১৭ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন পত্রিকাটি লিখেছে, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ৫ জানুয়ারী ২০১৭ সকালে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান আর এম ডিকে ফোন করে । প্রথমে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে ডিজিএফআই সদর দপ্তর ঢাকা ক্যান্টমেন্টে নিয়ে আসা হয় । সেখানে একজন গোয়েন্দা কর্তা তাদের পদত্যাগ পত্র এগিয়ে দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করতে বলেন । বাধ্য হয়ে তারা পত্রে স্বাক্ষর করে চলে আসেন । এর পর গোয়েন্দা কর্তাদের উপস্থিতিতেই সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি হোটেলে ( হোটেল রেডিসন ব্লু ) সভা ডেকে নতুন পরিষদ গঠন করা হয়। পত্রিকাটি আরো লিখেছে, সরকার মূলত বহুদিন থেকেই ব্যাংকটি দখল করতে চেষ্টা করছিলো । ব্যাংক দখলে এটির মুল শেয়ার যাদের সেই ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক বা আইডিবিকে অন্ধকারে রাখা হয় । তারা অভিযোগ করেছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনে নিয়ম নীতির বালাই ছিলো না, তাদেরও জানানো হয়নি । মাত্র তিন দিন আগে বৈঠকের খবর দেয়া হয়। ফলে তাদের পক্ষে যোগদান সম্ভব ছিলো না । 

"IT WAS an odd job for a spy agency. On the morning of January 5th military intelligence operatives phoned the chairman, a vice-chairman and the managing director of Islami Bank Bangladesh, picked them up from their homes and brought them to the agencyÕs headquarters, in DhakaÕs military cantonment. Polite officers presented the bankers with letters of resignation and asked them to sign. They did so. A few hours later the bankÕs board, meeting under the noses of intelligence officers at a hotel owned by the army, selected their replacements."

বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গভীর সংকটে পড়েছে। ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আলোচিত পরিবর্তনের চার মাসের মাথায় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন পরিচালকরা। একজন পরিচালককে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে- এমন অভিযোগের মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায়। এ দ্বন্দ্বের পেছনে অন্যতম কারণ ব্যাংকটির মালিকানায় আসতে একাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের তৎপরতা। এ ছাড়া তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলার অভাব, নিয়োগ-পদায়ন নিয়ে অনিয়মসহ নানা কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

একাধিক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), সৌদি আরবের আল-রাজি গ্রুপ ও কুয়েত সরকারের মালিকানায় থাকা বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির খবরের পর থেকেই পরিচালকদের মধ্যে দলাদলি দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও শেয়ার বিক্রির আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা এখনও আসেনি। পর্ষদের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে আইডিবির প্রতিনিধি জানান, ব্যাংকে তাদের সাড়ে ৭ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ৫ শতাংশ বিক্রি করতে চান। একইভাবে আল রাজি গ্রুপ ও কুয়েত সরকারও তাদের শেয়ারের একটি অংশ বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করে। এক বছর ধরে ব্যাংকটি প্রমোশন বন্ধ। ২০১৫ সালে হোটেল রেডিসনে লোটাস, সালমান দরবেশ, এস আলম গ্রুপ, এইচটি ইমাম, এবং ডিজিএফআই মিটিং করে। এতে ব্যাংকটির বিদেশী পরিচালকদের প্রেশার দেয়া হয় শেয়ার ছাড়তে, নইলে ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া হবে। বাধ্য হয়ে শেয়ার সারেন্ডার করে, এবং ঐ শিখন্ডিরা বিভিন্ন নামে শেয়ারগুলি কিনে নেয়।

বেসরকারি খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক এখন ধ্বংষের দ্বারপ্রান্তে। বিভিন্ন নামে সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে ১৪ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে ইতিমধ্যেই ব্যাংকটির মালিক বনে গেছে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্পগ্রুপ। প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গ্রুপটি ঋণ বাবদ তুলে নিয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। লুটপাট আর সীমাহীন অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির পরিচালনাা পরিষদে দেখা দিয়েছে চরম দ্বন্দ্ব। এরই ধারবাহিকতায় মঙ্গলবার পদ হারিয়েছেন ব্যাংটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আহসানুল আলম।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের শুরু থেকেই ইসলামী ব্যাংকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে এস আলম গ্রুপ। সাত মাসে প্লাটিনাম এনডেভার্স, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল, ব্লু ইন্টারন্যাশনাল, এবিসি ভেঞ্চার, গ্রান্ড বিজনেস, এক্সেল ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, হযরত শাহজালাল (র.) ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটির নামে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনে। এগুলো ব্যাংকের মোট শেয়ারের ১৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার ধারণের পর গত জুনে এজিএম’এ নতুন পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। গত ডিসেম্বরে হযরত শাহজালাল (র.) ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি সব শেয়ার বিক্রি করে দেয় আরমাডা স্পিনিং মিলের কাছে।

এরপর গত ৫ জানুয়ারি পরিচালনা পরিষদের সভায় ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। পুনর্গঠন করা হয় পরিচালনা পরিষদ। তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ার পদত্যাগ করলে নতুন চেয়ারম্যান করা হয় সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে। তিনি কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। কমার্স ব্যাংকের ৪০ ভাগ শেয়ার এস আলম গ্রুপ কিনে নেয়ার পর তাকে ওই চেয়ারম্যান করা হয়। ব্যাংকের নতুন এমডির দায়িত্ব দেয়া হয় ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মো. আবদুল হামিদ মিঞাকে। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল আলম। ব্যাংকের কোম্পানি সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কোম্পানি সচিব জাহিদুল কুদ্দুস মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় গ্রাহকও এস আলম গ্রুপ। ২০১৫ সালে ব্যাংকটিতে গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণ ছিল ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ শেষে তা তিন হাজার ৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। বছরের ব্যবধানে এসআলম গ্রুপ ঋণ বাবদ ইসলামী ব্যাংক থেকে তুলে নেয় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে ওই প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধনের কমপক্ষে ২ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। বাজারমূল্য হিসেবে ২ শতাংশ শেয়ারের মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে পরিবর্তনের ধারায় যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন, তাঁদের পরিচয় নিয়েই রয়েছে নানা প্রশ্ন। বস্ত্র খাতের স্বল্প পরিচিত প্রতিষ্ঠান আরমাডা স্পিনিং মিলস ইসলামী ব্যাংকের ২ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনেছে। আরমাডা স্পিনিং মিলের কর্ণধার মো. আরশেদ বলে নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনেরও সদস্য নয়।

ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের চার মাসের মাথায় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন পরিচালকরা। এ দ্বন্ধের পেছনে অন্যতম কারণ ব্যাংকটির মালিকানায় আসতে একাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের তৎপরতা। এ ছাড়া তাদের স্বার্থের দ্বন্ধ, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলার অভাব, নিয়োগ-পদায়ন নিয়ে অনিয়মসহ নানা কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকের সদ্য সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গত ১১ মে হঠাৎ ফেসবুকে বিশাল বিবৃতি দিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে একটি পক্ষ হুমকি দিচ্ছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, পর্ষদে মাইনাস-প্লাস ষড়যন্ত্র চলছে। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়ে কয়েক দিন ধরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তখান ও ভাইস চেয়ারম্যান আহসানুল আলম পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন।

ইতোমধ্যে ব্যাংকে আরও পরিবর্তন এসেছে। নতুন চেয়ারম্যান ও এমডি দায়িত্ব নিয়েছেন। ৫ জন ডিএমডি ব্যাংক ছেড়েছেন। সামীম আফজাল ব্যাংক ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কারও হয়েছেন। ব্যাপক বদলি, নজরদারির মধ্যে কাজ করছেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।


১২. রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশে¬ষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৪৮৩ কোটি ডলার। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে তা কিছুটা বেড়ে হয় এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। কিন্তু ২০১৬ রেমিট্যান্স আসে এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসে এক হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার।

১৩. চৌদ্দ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক 
ঋণ জালিয়াতি, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা আর অনিয়ম ঠেকাতে ১৪ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ছাড়া সব কটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকের মধ্যে সাতটিতে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক। এছাড়া নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে যে শৃঙ্খলা ফেরাতে পর্যবেক্ষক দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছে না। অধিকাংশ ব্যাংকের আর্থিক সূচকে উন্নতি নেই। সুশাসনেও ঘাটতি দূর হয়নি। মূলত পর্যবেক্ষকদের চোখে অনিয়ম ধরা পড়লেও রাজনৈতিক চাপে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ সব ব্যাংকে বাড়ছে খেলপি ঋণ। মূলধন ঘটতিতে পড়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক।

১৪. দলীয় লোকদেরকে ব্যাংক করার অনুমোদন
আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদে ২০১২ সালে নয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া নিয়ে দ্বিমত ছিল। অর্থনীতিবিদেরাও এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সে সময় অনুমোদন পাওয়া সব ব্যাংকই পান সরকার-সমর্থিত ব্যক্তিরা। ব্যাংকগুলো হলো আয়কর উপদেষ্টা এস এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের মিডল্যান্ড ব্যাংক, সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমানের মেঘনা ব্যাংক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইউনিয়ন ব্যাংক, সরকারদলীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপসের মধুমতি ব্যাংক এবং এস এম আমজাদ হোসেনের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ফরাসত আলীর এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইকবাল আহমেদের এনআরবি ব্যাংক ও নিজাম চৌধুরীর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক অনুমোদন পায়। নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের কারণে ইতিমধ্যে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া গত বছর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দেওয়া হয় সীমান্তব্যাংক। ফলে ১০ ব্যাংক অনুমোদন পায় এই সরকারের মেয়াদে। দেশে বর্তমানে ৫৭টি ব্যাংকের কার্যক্রম রয়েছে।

জানা গেছে, বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন নতুন একটি ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেন। প্রস্তাবিত ওই ব্যাংকটির নাম ‘বাংলা ব্যাংক’। বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান নোয়াখালী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ মোরশেদ আলম। তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান। এ ছাড়া জসীম উদ্দিন ২০১২ সালে অনুমোদন দেওয়া মেঘনা ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার। 

জানা গেছে, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির নামে নড়াইলে একটি হাসপাতাল হচ্ছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত হাসপাতালের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শুভ্রা মুখার্জির মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য জসীম উদ্দিন। যিনি ‘বাংলা ব্যাংক’ নামে নতুন ব্যাংকের আবেদন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রীতি অনুযায়ী নতুন ব্যাংকের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়। এরপর আবেদনপত্র বিবেচনা নিয়ে রেটিং করা হয়। এরপরই নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয় পরিচালনা পর্ষদ। তবে আবেদন আহ্বান ছাড়াই সরকারের তালিকা অনুযায়ী অনুমোদন দেওয়ার নজির রয়েছে।
(দৈনিক প্রথম আলো, ০৬ মার্চ, ২০১৭)

১৫. ইসলামী ব্যাংকের মতোই সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) মালিকানায় বঙ ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পুনর্গঠন করা হয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ইসলামী ব্যাংকের স্টাইলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ড. রেজাউল হককে। পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শহিদ হোসেনকেও। এসআইবিএল-এর চেয়ারম্যান পদে নতুন নিয়োগ পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আনোয়ারুল আজিম আরিফ।

নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি কাজী ওসমান আলী। এছাঙা, ব্যাংকটির কার্যনির্বাহী কমিটির (ইসি) চেয়ারম্যান করা হয়েছে বেলাল আহমেদকে। তিনি এস আলম গ্রুপের একজন কর্মকর্তার আত্মীয়। এসআইবিএলের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ৩০ অক্টোবর ২০১৭ সালে রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এসআইবিএল-এর পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই রদবদল আনা হয়। বৈঠকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান রেজাউল হক, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল হক, এমডি শহীদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন না বা তাদের থাকতে দেয়া হয়নি। একই কায়দায় এস আলম গ্রুপ দখল করে নেয় কমার্স ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক।

১৬. লুটপাটের নায়করাই নীতি-নির্ধারণ করে চলেছেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে জুন ২০১৭ শেষে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে মন্দ-ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬১ হাজার ৬০২ কোটি টাকা এর সাথে অবলোপিত ৪৫ হাজার কোটি টাকা, বিভিন্ন অপকৌশলে (ভূয়া দলিল, ভূয়া কোম্পানি, ভূয়া এলসি ইত্যাদি) ৬৫ হাজার কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কোষাগার থেকে ৮শত কোটি টাকা; অর্থাৎ লুটতরাজ আর অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ১ লক্ষ ৭২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেছে। অনেকের মতে, ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে বলে যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এই অর্থের পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকার কম নয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের মতে,‘বর্তমানে ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে বলে যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এই অর্থের পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকার কম নয়’।

অর্থনীতির চালিকাশক্তির মূল নিয়ামক এই ব্যাংকিং খাতে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণই বাংলাদেশের ব্যাংক সংকটের মূল কারণ। ঋণের নামে গ্রাহকদের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত লুটে নিচ্ছে খেলাপিরা। ‘অবলোপন’-এর দোহাই দিয়ে ঋণের তালিকা থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে খেলাপিদের নাম। খেলাপি ঋণসংক্রান্তবাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। অর্থাৎ বাড়ার হার ৬.০১ শতাংশে। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা (জুন, ২০১৭ পর্যন্ত)। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অঙ্ক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেশি। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া ৫০ হাজার টাকার ওপরে ঋণ অবলোপনের আগে আদালতে মামলা করাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এসব নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেনি তারা। খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। পার্শ্ববর্তী ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক শূন্য ৭৪ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। আর তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫৪ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। অর্থাৎ ভারতের জিডিপির ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক ডেপুটি গভর্নরের মতে, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণের নামে সব টাকা বের করে নিয়ে গেছে। এসব টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ রাজনীতির ছত্রছায়ায় একটি প্রভাবশালী মহল ব্যাংকে দুর্নীতি করছে। এর জন্য পুরোপুরি অর্থ মন্ত্রণালয় দায়ী। কারণ সাবেক অর্থমন্ত্রী নিজেই সরকারি ব্যাংকে এমডি-চেয়ারম্যান এবং পরিচালক নিয়োগ দেন’ ।

১৭. ৩১ হাজার কোটি টাকা লুট

সরকারি অর্থের অনিয়মের অর্ধেকই হচ্ছে ব্যাংকিং খাত ঘিরে। বাংলাদেশ ক¤পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর বিগত চার বছরের অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে এমন তথ্য। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সিএজি-এর রিপোর্টে মোট ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়।

এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকাই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের। অর্থাৎ আর্থিক অনিয়মের ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। পাশাপাশি বিগত ৯ বছরে ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের পরিমাণ বেড়েছে ১৬ গুণ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সিএজির আর্থিক অনিয়ম রিপোর্টগুলো গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করা দরকার। সংশ্লিষ্টদের কাছে এর জন্য জবাব চাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি পর্যালোচনা করে এই অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম বেড়েছে, এতে সন্দেহ নেই। দুঃখজনক হচ্ছে-খেলাপি ঋণ না দেখিয়ে তা মুছে ফেলার সক্রিয় প্রায়াস চলছে। এতে অনিয়মে খেলাপি ঋণ বাড়লেও সেটি লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৪০ শতাংশই হচ্ছে খেলাপি ঋণ। করোনা মহামারির আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার কোটি টাকা প্রকাশ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি আরও চার গুণ হবে। তবে ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ও বিদেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে। এসব টাকা ফেরত আসবে না। আর এসব দুর্নীতি করা হয়েছে কতিপয় ব্যাংকার ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে। এর ফলে গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খারাপের দিকে গেছে।

একদিকে ব্যাংক দখল, অন্য দিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিত্য নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে দলীয় ক্যাডারদের ধনকুবের বানানোর যে অশুভ কার্যক্রম চলছে তাতে গোটা অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা লুটেরা, টাউট বাটপার আর দলীয় ক্যাডারদের হাতে বন্দী হয়ে পঙছে। এর আশু পরিণতি কখনো শুভকর হবার কথা নয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন আরো কয়েকটি ব্যাংককে নাকি সরকার লাইসেন্স দিচ্ছে। যে ব্যাংক বর্তমানে চালু আছে। সেগুলোর ঘাণি টানা যখন কষ্টকর হচ্ছে তার উপরে আবারো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে সরকার আসলে দেশের অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চায়?

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা যেমন প্রতিদিন অর্থনীতি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করছেন একইভাবে দেশের জনগণও দেশের অর্থনীতি নিয়ে চরমভাবে শংকিত। জনগণের এ শংকা কাটানোর জন্য বর্তমানে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে বলে মনে হয় না। জনগণের কাছে যাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই তারা এ সংকট কাটাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেবে না এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে সকল প্রকার অস্থিরতা, অন্যায়, দুর্নীতি এবং সীমাহীন লুটপাট বন্ধের আগে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ। গণতন্ত্র নামক রেলগাড়িটিকে তার লাইন থেকে বিচ্যুৎ করার কারণেই আজ এ অবস্থা। তাই সর্বাগ্রে দরকার গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তির উপর স্থাপন।

অব্যাহত লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ জনগণ। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মানে এর দায় নিতে হয় জনগণকে। একের পর এক লুটপাট হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো। আর দফায় দফায় সেই ব্যাংকগুলোর ঘাটতি পুরণ হচ্ছে জনগণের টাকায় গঠিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে সকল জ্বালানী, বিদ্যুত, গ্যাসসহ সকল নাগরিক সুবিধার মূল্য বাড়ানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিটি পণ্যে ও সেবায় ভ্যাট বাঙানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুর্বিষহ হচ্ছে জনজীবন। বাংলাদেশের জনগণ মুক্তি চায়। বাংলাদেশের মানুষ বাঁচতে চায় এই দুঃশাসন থেকে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন