কাদেসিয়া ইরাকের একটি শহর। ৬৩৬ সালে এখানে সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ও রুস্তম ফররুখজাদের নেতৃত্বে মুশরিক পার্সিয়ান বাহিনীর ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৫ হিজরির তথা ৬৩৬ সালের মাঝামাঝিতে পার্সিয়ানরা তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায়। তারা সবাই মিলে ইয়াজদিগার্দকে তাদের রাজা নির্বাচিত করে। ইয়াজদিগার্দও বুদ্ধিমান শাসক ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাদের অন্তঃকোন্দলের কারণে তারা সাম্রাজ্য হারিয়ে ফেলছে। তাই তিনি সকল পার্সিয়ানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেন ও সফল হন।
ইয়াজদিগার্দের ঐক্য প্রচেষ্টার অন্যতম উপলক্ষ ছিল মুসলিমদের দমন করা। তাই তিনি ক্ষমতায় আরোহন করেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেন। তার এই প্রচেষ্টায় ইরাকে মুসলিমদের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে মুশরিকরা বিদ্রোহ শুরু করে। অনেক স্থানেই শহরের বাসিন্দারা জিজিয়া দিতে ও মুসলিমদের অনুগত থাকতে অস্বীকার করে। তারা চুক্তি ও অঙ্গিকার ভঙ্গ করতে শুরু করে। কয়েকটি স্থানে মুসলিম সৈন্যদের ওপর তারা আক্রমণ করে।
সেনাপতি মুসান্না সব বিষয় উল্লেখ করে খলিফা উমার রা.-কে চিঠি লিখলেন। জবাবে উমার রা. মুসলিম সৈন্যদেরকে শহরের বাইরে এসে সংঘবদ্ধভাবে থাকার নির্দেশ দেন।
একইসাথে আবু উবাইদা রা. ও খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর নেতৃত্বে সিরিয়া ফ্রন্টে রোমান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চলমান থাকায় উমার রা. ইরাকের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিজেই একটি বাহিনী নিয়ে ইরাকের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন তা কাউকে জানাননি। মদিনায় ভারপ্রাপ্ত খলিফার দায়িত্ব দেন আলী রা.-কে।
মদিনা থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে তিনি পরামর্শ সভার আয়োজন করলেন। এটা করলেন যাতে আগের মতো ইরাকে যাওয়ার জন্য সৈন্য পেতে অসুবিধা না হয়। পরামর্শ সভায় আলী রা.-কেও ডাকা হলো। পরামর্শ সভায় উমার রা. ইরাকের ও সিরিয়ার পরিস্থিতি বর্ণনা করে সবার পরামর্শ চাইলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ছাড়া বাকী সবাই পরামর্শ দিলেন উমার রা.-এর নেতৃত্বেই ইরাকে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
আব্দুর রহমান ইবনে আওফ বললেন, আমি আশংকা করছি, ইরাকে যদি আপনি নিহত হন তবে সকল অঞ্চলে মুসলিমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। আমি মনে করি আপনার স্থলে অন্য কাউকে সেনাপতি নিয়োগ করে আপনি মদিনায় ফিরে যান। তাঁর এই কথায় অনেকেই সম্মতি দেন। আলোচনা শেষে বেশিরভাগ সাহাবি পরামর্শ দেন যাতে উমার রা. মদিনায় থেকে যান। অতঃপর উমার রা. সাহাবাদের ইরাক অভিযানের জন্য নতুন সেনাপতির নাম প্রস্তাব করতে বলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.-এর নাম প্রস্তাব করেন। সাহাবারা এই প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হন।
সা'দ রা.-কে উমার রা. ইরাক যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি সা'দ রা.-কে উপদেশ দেন। নসিহত করেন। সা'দ রা. সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা হন ইরাকের উদ্দেশ্যে। উমার রা. তাদের সাথে কিছুদূর পথ অতিক্রম করে তাদের এগিয়ে দেন। ফিরে আসার সময় সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি মদিনায় ফিরে যান।
এদিকে ইরাকে থাকা মুসলিম সেনাপতি মুসান্না গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেতুর যুদ্ধে তিনি আহত হন। সেই ক্ষতস্থান থেকেই তার শরীর খারাপ হতে থাকে। সা'দ রা. ইরাকে পৌঁছলেন। কিন্তু মুসান্না ইবনে হারিসের সাথে দেখা হওয়ার আগেই মুসান্না ইন্তেকাল করেন। সা'দ রা. ইরাকে পৌঁছলে সমস্ত সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব তাঁর হাতে ন্যস্ত হয়। সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। সা'দ রা. পুরো বাহিনীকে উমার রা.-এর নির্দেশনা অনুসারে সাজালেন। উমার রা. সা'দ রা.-কে কাদেসিয়া অভিমুখে রওনা হতে বলেন।
খলিফা উমার রা. আরো নির্দেশ দিলেন মুসলিমরা যেন পাথর ও বালুময় স্থানের মাঝখানে অবস্থান নেয়। তারা যেন পারসিকদের চলাচলের রাস্তা ও সকল পথ আগলে থাকে। আর শত্রুসৈন্যের প্রতি অবিলম্বে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।
তিনি বলেন, ওদের সংখ্যাধিক্য এবং যুদ্ধ প্রস্তুতিকে মোটেই ভয় করবেন না। কারণ ওরা প্রতারক ও ধোঁকাবাজ জাতি। আপনারা যদি ধৈর্যধারণ করেন, ভালো কাজ করেন, আমানত ও বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালনের নিয়ত করেন তাহলে আমি আশা করছি যে, ওদের বিরুদ্ধে আপনারা জয়ী হবেন এবং ওরা এমন ছত্রভঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে যে, কখনো আর একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। ওদের অন্তর ওদের সাথে থাকবে না। আর যদি দ্রুত আক্রমণ সম্ভব না হয় তবে আপাতত পেছনে গিয়ে পাথুরে অঞ্চলে অবস্থান নিন। কারণ পাথুরে এলাকায় অবস্থান নেয়ার সাহস আছে আপনাদের। ওরা কিন্তু পাথুরে এলাকাকে ভয় পায়। তেমন স্থানে যুদ্ধে অনভিজ্ঞ তারা। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা'আলা আপনাদেরকে বিজয় দান করবেন এবং এদের উপর পাল্টা আক্রমণের সুযোগ দিবেন।
খলীফা উমার রা. চিঠিতে আরো লিখেন, নিয়ত অনুপাতে আল্লাহর সাহায্য আসে। নিষ্ঠা অনুপাতে সওয়াব আসে। আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করেন। বেশি বেশি করে “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম” পাঠ করুন। সৈন্যদের সকল অবস্থা ও বিবরণ আমাকে লিখে জানাবেন। আপনারা কোথায় থাকছেন, শত্রুগণ কোথায় থাকছে—সবকিছু অবহিত করবেন। আপনার চিঠির মাধ্যমে আপনাদের অবস্থা আমাকে এমনভাবে জানাবেন যেন আমি আপনাদেরকে স্বচক্ষে দেখছি। আপনাদের সকল বিষয় আমার নিকট উন্মুক্ত রাখবেন। আল্লাহকে ভয় করুন, কোন বিষয় ঝুলিয়ে রাখবেন না।
জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তা'আলা এই বিষয়টি আপনার প্রতি ন্যস্ত করেছেন। এর বিকল্প কিছু নেই। সতর্ক থাকুন— এই দায়িত্ব যেন আপনার নিকট থেকে প্রত্যাহার করতে না হয় এবং এ কাজের জন্যে আপনাদেরকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিযুক্ত করতে না হয়।
সা'দ রা. ওই স্থানের ও ভূমির বিস্তারিত বিবরণ উমার রা.-কে লিখে পাঠান। এভাবে উমার রা. ও সা'দ রা.-এর মধ্যে বহুবার পত্র বিনিময় হয়।
সা'দ রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী কাদেসিয়ার দিকে চলতে থাকে। এর মধ্যে উজায়ব নামক স্থানে শেরজাদের নেতৃত্বে থাকা একদল পার্সিয়ান মুশরিক বাহিনীর মুখোমুখি হয়। মুসলিমদের তৎক্ষণাৎ আক্রমণে তারা খুব সহজেই পর্যদস্তু হয়। প্রচুর ধনসম্পদ পায় মুসলিম বাহিনী। এর একপঞ্চমাংশ মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার বাকী অংশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। এই জয়ে মুসলিমরা উজ্জিবিত হন।
এরপর সা'দ রা. কাদেসিয়ায় তাঁবু স্থাপন করেন। তিনি সেখানে এক মাসেরও বেশি সময় অপেক্ষা করেন কিন্তু সেখানে পার্সিয়ানদের দেখা পাননি। সা'দ রা. উমার রা.-এর নির্দেশক্রমে সেনাবাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করেন। এরপর তাদেরকে আশে পাশের দুর্গগুলোতে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। মুসলিমদের এই আক্রমনে পার্সিয়ানরা ইয়াজদিগার্দের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে। নতুবা তারা দুর্গগুলো মুসলিমদের হাতে ন্যস্ত করবে বলে হুমকি দেয়।
সম্রাট ইয়াজদিগার্দ বিখ্যাত সেনাপতি রুস্তমকে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ দেন। রুস্তম এই দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, এখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ভালো সময় নয়। আসলে রুস্তম তার জোত্যিষ বিদ্যার মাধ্যমে জানতেন যুদ্ধে তিনি হেরে যাবেন। তাই তিনি যুদ্ধে যেতে চাইছিলেন না। অবশেষে জনগণ ও সম্রাটের চাপে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয় রুস্তম। এই খবর মুসলিম গোয়েন্দারা সা'দ রা.-কে দিলে তিনি তা উমার রা.-কে জানান। উমার রা. সাদ রা.-কে রুস্তমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কৌশল ঠিক করে দেন।
রুস্তম প্রায় ৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে সাবাত নামক স্থানে তাঁবু ফেললেন। সা'দ রা. উমার রা.-এর নির্দেশে সম্রাট ইয়াজদিগার্দের কাছে ১৪ জন বংশধর, জ্ঞানী ও বাগ্মী মুসলিমকে পাঠালেন তাকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। আর দাওয়াত না গ্রহণ করে চূড়ান্ত যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়ার জন্য। তারা সম্রাটের কাছে বক্তব্য পেশ করলে ইয়াজদিগার্দ অত্যন্ত রাগান্বিত হয়। সে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। মুসলিমরা শান্তভাবে সেগুলোর জবাব দেয়। অবশেষে ইয়াজদিগার্দ বলে, যদি দূত হত্যার নিয়ম থাকতো তবে অবশ্যই আমি তোমাদের হত্যা করতাম। তোমাদের জন্য আমার কাছে কিছুই নেই। ইয়াজদিগার্দ তার সৈন্যদের নির্দেশ করলো এখানে যে বেশি সম্রান্ত তাকে ধুলো মেখে এদের সবাইকে তাড়িয়ে দাও।
বনু তামিম গোত্রের আসিম ইবনে আমর দাঁড়িয়ে বললেন আমিই এখানের মধ্যে সম্ভ্রান্ত। এই বলে তিনি কিছু ধুলো তুলে হাতে নিয়ে তার বাহনে উঠে গেলেন। এরপর এই ধুলো নিয়ে নিয়ে তিনি সা'দ রা.-এর কাছে আসলে সা'দ রা. বলেন, আনন্দিত হোন, আল্লাহ তায়ালা তাদের রাজ্যের চাবি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
এদিকে রুস্তম তার সেনাবাহিনী নিয়ে কাদেসিয়ার কাছে এসে পৌঁছলো। এসেই সে সা'দ রা.-কে খবর পাঠালো একজন দূতকে পাঠাতে যে তার সাথে আলোচনা করতে পারবে। সা'দ রা. রাবি ইবনু আমরকে পাঠালেন। রুস্তম মুসলিম দূতকে তাদের জাঁকজমক দেখিয়ে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। তাই সে সোনার সুতোয় বোনা কার্পেট বিছিয়েছে। সোনা প্রলেপ দেওয়া বিশাল আসনে সে বসেছে। যাতে মুসলিম দূত তাদের বিশাল অবস্থা দেখে যুদ্ধের সাহস হারিয়ে ফেলে। রাবি বিভ্রান্ত তো হলেনই না বরং তাদের কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিলেন। তিনি সুন্দর কার্পেটের ওপর ঘোড়াসহ উঠে গেলেন। ঘোড়া দিয়ে কার্পেট মাড়ালেন। এরপর ঘোড়া থেকে নেমে সুন্দর বালিশ ছিঁড়ে সেই কাপড় দিয়ে ঘোড়া বাঁধলেন। তার কোমরে খাপসহ তলোয়ার ছিল এবং হাতে ধনুক ছিল।
মুশরিকরা তাকে ইঙ্গিতে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বলেছিল। তিনি বললেন, যদি আমি আমার ইচ্ছেয় আসতাম। তবে তা করতাম। কিন্তু তোমরা ডেকেছ বলে এসেছি, তাই এখানে আমি অস্ত্র নামাব না। এরপর তিনি ধনুকে ভর দিয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে রুস্তমের দিকে এগুতে থাকলেন। যাতে করে ধনুকের খোঁচায় কার্পেট ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর রুস্তমের কাছে এসে ধনুকটি কার্পেটে গেঁথে দিলেন। তাকে বসতে বলা হলে তিনি বললেন, আমরা তোমাদের আসবাবপত্রে বসি না।
মুসলিম দূত রাবির এই ড্যামকেয়ার ভাব দেখে রুস্তমরা মুসলিমদের মানসিক অবস্থা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিমরা যে দুনিয়াবি সম্পদের ব্যাপারে আগ্রহী নয় তারা তা বুঝতে পেরেছে। এরপর রুস্তম ইসলামের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। শুনে তিনি বললেন, আমরা আপনার কথা শুনলাম। আমাদের কিছুদিন সময় দিন, আমরা ভেবে দেখবো।
রাবি বললেন, আমাদের নবী মুহাম্মদ সা. আমাদের শিখিয়েছেন, শত্রুকে তিনদিনের বেশি সময় না দিতে। আপনারা আমাদের ইসলাম নিয়ে ভাবুন। আপনাদের জন্য তিনটি পথ খোলা আছে।
১. মুসলিম হয়ে আমাদের ভাই হয়ে যান।
২. আমাদের অনুগত হয়ে জিজিয়া দিন।
৩. তিনদিন পরে অর্থাৎ চতুর্থ দিন আমাদের সাথে যুদ্ধ করুন।
এরপর রাবি চলে গেলেন।
মুসলিম দূত চলে যাওয়ার পর মুশরিকরা তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। রুস্তমের কমান্ডাররা তার পোষাক পরিচ্ছদ নিয়ে অবজ্ঞা করতে লাগলো। কিন্তু রুস্তম তার ভূয়সী প্রশংসা করে বললো এরকম চমৎকার সাহসী বাগ্মী আমি আর কখনো দেখি নি। রুস্তম তার সাথে আলো আলোচনা করতে চাইলেন। পরদিন রুস্তম আবার খবর পাঠালেন দূত রাবিকে পাঠাতে। কিন্তু এবার সা'দ রা. পাঠালেন হুজাইফা ইবনে মিহসানকে। তার সাথে কথা বলেও বেশ চমতকৃত হলেন রুস্তম। সা'দ রা. রুস্তমকে বুঝাতে চাইলেন বিতর্ক, রাজনীতি ও জ্ঞানে মুসলিমরা সবাই দক্ষ।
তৃতীয়দিন আবারো রুস্তম আলোচনা চালিয়ে যেতে চাইলেন। এবার সা'দ রা. পাঠালেন মুগিরা বিন শুবা রা.-কে। তিনি ছোট ও দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে সোজা রুস্তমের সিংহাসনে তার পাশে বসে পড়লেন। এরপর সভাসদরা তাকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। মুগিরা রা. তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, //আমরা তোমাদের বিজ্ঞতার ব্যাপারে অনেক শুনেছি। কিন্তু তোমরা আসলে বোকা। তোমাদের মতো বোকা জাতি আর নেই। আমরা মুসলিমরা একে অপরকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করি না। আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের মতো তোমরাও সবাইকে একইরকম মানুষ ভাবো। হায়! তোমরা যদি আমাদের আগে জানাতে তোমাদের উচ্চপদস্থরা তাদের অধিনস্তদের মনিবের মতো আচরণ করে, তাহলে তোমাদের আমরা এতোটা বিজ্ঞ মনে করতাম না। এভাবে তোমরা করদিন চলবে? এমন আচরণের ওপর ভিত্তি করে কোনো সাম্রাজ্য বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।//
উপস্থিত সভাসদদের মধ্যে অনেকেই মুগিরা রা.-এর কথাকে সমর্থন করে মন্তব্য করতে শুরু করেন। এতে রুস্তমের অহংবোধে আঘাত লাগে। সে ক্ষিপ্ত হয়ে আরবের দুর্দশাপূর্ণ জীবনের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুগিরা রা. সব মেনে নিয়ে বলেন, আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করেছি। তবে পৃথিবীর পরিস্থিতি সবসময় এক থাকে না। কষ্টের পরেই আসে স্বস্তি। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের যা দিয়েছেন তার প্রতি আপনারা খুব কমই কৃতজ্ঞ হয়েছেন। যথাযথ কৃতজ্ঞতা আদায় না করার ফলে আপনাদের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে এবং হবে।
এরপর তিনি আগের দুইজনের মতোই তিনটি প্রস্তাব দিলেন এবং চলে গেলেন। রুস্তম এদের সবাইকে সাহসী হিসেবে সাব্যস্ত করলেন এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করাটা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন। উপস্থিত পার্সিয়ান কমান্ডাররা সবাই যুদ্ধ করে আরবদের দর্প চূর্ণ করতে মরিয়া ছিল। অবশেষে তারা যুদ্ধকেই বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করলো।
দুইপক্ষই তাদের সৈন্যদের বিন্যস্ত করলো। রুস্তম তার বাহিনীর মধ্যখানে সামিয়ানা টানিয়ে উঁচু আসনে বসেছিল। যাতে সে যুদ্ধের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারে। আর মুসলিম বাহিনীও সা'দ রা.-এর নির্দেশে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে প্রস্তুত হয়ে গেল। এরপর সা'দ রা. মুসলিমদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি সেখানে সূরা আম্বিয়ার ১০৫ নং আয়াত উল্লেখ করলেন, وَلَقَدۡ كَتَبۡنَا فِىۡ الزَّبُوۡرِ مِنۡۢ بَعۡدِ الذِّكۡرِ اَنَّ الۡاَرۡضَ يَرِثُهَا عِبَادِىَ الصّٰلِحُوۡنَ
(আর যবুরে আমি উপদেশের পর একথা লিখে দিয়েছি যে, যমীনের উত্তরাধিকারী হবে আমার নেক বান্দারা।) ভাষণ শেষে তিনি কারিদেরকে সূরা আনফাল উচ্চস্বরে পড়ার নির্দেশ দেন। এতে মুসলিমরা উজ্জীবিত হলেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন