শেখ আবুল কাসেম মিঠুন। ছিলেন চলচ্চিত্রের অভিনেতা। ইসলামী আদর্শের দাওয়াত পেয়ে সেই পঙ্কিল জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ২০০০ সালে তিনি সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন। তারপর তিনি স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে করা তার অনুষ্ঠানটিও ছিল জনপ্রিয়। অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাশেম মিঠুন আজীবন সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিক-এর মৃত্যুর পর শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতিক কেন্দ্র’র হাল ধরেন। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের উপ-পরিচালক। আজ ২৪ মে। শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মহান রাব্বুল আলামিন তার প্রচেষ্টাগুলো কবুল করুন। তাঁকে সম্মানিত করুন।
সুন্দরবনের লোনাপানিতে বেড়ে ওঠা এই মানুষটি এক সময় বাংলাদেশের রূপালী পর্দা কাঁপালেও হেরার রশ্মি তাঁকে সেখানে টিকে থাকতে দেয়নি। তিনি ফিরে আসেন তাওহীদের পথে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। শুরু করেন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারের নতুন জীবন। নিজ প্রতিভার গুণেই তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের বাংলা মিঠুন। সদালাপী মানুষ হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর ছিল ব্যাপক পরিচিতি। শুধু নায়ক বা অভিনেতা হিসেবেই নয়, তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির। এই সংগঠনের তিনি সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, এফডিসি পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হতে হলে একজন ব্যক্তিকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে কতটা জনপ্রিয় হতে হয়। পিতা মাতা প্রদত্ত নাম শেখ আবুল কাশেম। কিন্তু বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন ‘মিঠু’ বলে। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করে ‘মিঠু’ হয়ে যান ‘নায়ক মিঠুন’। এই নামটি শুনলেই বাংলাদেশের মানুষ তাকে এক নামেই চেনেন।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন ঘেষা আশাশুনি উপজেলার দরগাঁহপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ আবুল হোসেন ও মা হাফেজা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়। শেখ আবুল কাশেম মিঠুন সঙ্গীতা ও তরী নামের দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর পূর্ব পুরুষ শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদী ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদ থেকে আসেন। আশাশুনি উপজেলার দরগাহপুর এসে তিনি এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে তিনি এখানেই বসতি গড়ে তোলেন। দরগাহপুর গ্রামেই তাঁর দুই সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। উক্ত পুত্রদ্বয়ের বংশধরগণ দরগাহপুরের আদি অধিবাসী। শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদী অন্যতম সপ্তম উত্তর পুরুষ মরহুম শেখ আব্দুল মতিন। শেখ আব্দুল মতিনের দৌহিত্র শেখ আবুল কাশেম মিঠুন। পারিবারিকভাবেই শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ছিলেন অভিজাত ইসলামী পরিবারের সন্তান।
১৯৭২ সালে তিনি পাইকগাছা উপজেলা হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে খুলনা সিটি কলেজে থেকে এইচএসসি পাশ করে একই কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। এ সময় তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতি অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে নূর মোহাম্মদ টেনা সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কালান্তর’ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ‘কালান্তর’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবেও কাজ করেন। সাংস্কৃতিক মনা শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৮০ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। সেখানে বেশ সাফল্য পান। ২০০০ সালে তিনি সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন। তারপরও তিনি স্ক্রিপ রাইটার ও গীতিকার হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে করা তার অনুষ্ঠানটিও ছিল জনপ্রিয়।
অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাশেম মিঠুন আমৃত্যু সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নৈতিকতাসম্পন্ন সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া প্রজন্মকে এগিয়ে নেয়া যাবেনা । ২০১০ সালের ১১ আগস্ট বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, কবি ও গীতিকার, ইসলামী সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মতিউর রহমান মল্লিক ইন্তেকাল করেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিকেরই নিরলস প্রচেষ্টায় সারা দেশে নতুন ধারার ইসলামী সঙ্গীত চর্চা শুরু হয় এবং এর বিস্তৃতি ঘটে। খ্যাতিমান এই কবির মৃত্যুর পর শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র’র হাল ধরেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ২০১৪ সালের মার্চে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন। একটু সুস্থবোধ করলেই তিনি আবার শুরু করেন সংস্কৃতি চর্চা। রাজধানী ছেড়ে ছুটে বেড়ান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি যে কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন তার কথাবার্তায় তা কখনো ফুটে ওঠেনি।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন কিডনি, লিভার, হার্ট ও লান্সের সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই ২০১৫ সালের ১১ মে তিনি তাঁর অসুস্থ মা হাফেজা খাতুনকে দেখতে খুলনায় যান। অসুস্থ মাকে দেখতে এসে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৪ মে বিকেলে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৮ মে পর্যন্ত তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯ মে সকালে তাকে ভারতের কোলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডা. পিবি শুকলা এবং কোটারি হাসপাতালের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ শামীমুল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোটারি হাসপাতালে ২৪ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
“ হাজারো স্বপ্ন ছিল যে আমার জাহেলি জীবনে
অন্তর ছিল অস্থির আর অশান্ত অকারণে।
ধন, মান আর সম্পদ ঘিরে, স্বপ্নগুলো কিলবিল করে
নিশিদিন যেন রক্ত ঝরে, কাল সাপের দংশনে।”
তার এই গানটির হৃদয়গাহী আকুলতা প্রমাণ করে রূপালী পর্দা থেকে হেরার পথে চিত্রনায়ক আবুল কাশেম মিঠুনের ফিরে আসাটা ছিল অনিবার্য। এক সময়কার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মিঠুন ফিরে আসেন ইসলামী সংস্কৃতি ধারায়। এরপর তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে কাজ করে গেছেন। গানের পাখি ও চির সবুজের কবি মতিউর রহমান মল্লিকের পথের পথিক হয়ে ২০১৫ সালের ২৪ মে দিবাগত রাত ২টায় চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সম্মানিত করুন। জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন