যুদ্ধ শুরুর আগে মুশরিক সেনাপতি ফররুখজাদ রুস্তমের সাথে মুসলিমদের দীর্ঘ আলোচনা হয়। এই আলোচনার জন্য মুসলিমরা রুস্তমকে তিনদিনের সময় দেয়। তিনিদিন পার হলে উভয়পক্ষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। যুদ্ধের ১ম দিন মুসলিম সেনাপতি সা'দ রা. মুসলিম সেনাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তাদের উজ্জিবীত করেন। ভাষণ শেষে তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন, তোমরা যেখানে আছো সেখানেই থাকো। যুহর নামাজের পর আমি তাকবির দিলে তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। ২য় তাকবির দিলে তোমরাও তাকবির দিবে। ৩য় তাকবির দিলে তোমরাও তাকবির দিবে এবং অশ্বারোহী দল ঘোড়া চালাতে শুরু করবে। ৪র্থ তাকবির দিলে তোমরা সবাই এগিয়ে যেতে শুরু করবে যতক্ষণ না শত্রুর মুখোমুখি হবে। তোমরা সবাই এসময় 'লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ' পড়তে থাকবে।
যুহরের নামাজের আগ পর্যন্ত কারিরা সূরা আনফাল থেকে কুরআন তিলওয়াত করতে লাগলেন। এতে মুসলিম সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্ব পরিকল্পনা মতো সা'দ রা. যুহর নামাজ পড়ে তাকবির দিতে লাগলেন। মুসলিমদের তাকবির শুনেই পার্সিয়ানরা মুসলিমদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। ৩য় তাকবিরের পর মুসলিম অশ্বারোহীরা ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে গেলে পার্সিয়ান ঘোড়সওয়ারদের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হলো এবং শত্রুদের বেশ কয়েকজন বীর যোদ্ধাকে হত্যা করলো। কয়েকজনকে এরেস্টও করা হলো।
রুস্তম এই অবস্থা দেখে একটু পিছু হটলো। সে বুঝতে পারলো দ্বন্দ্বযুদ্ধে পার্সিয়ানরা মুসলিমদের সাথে পেরে উঠবে না। তাই সে পুরো সেনাবাহিনীকে আদেশ করলো মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, সা'দ রা. কিন্তু এখনো ৪র্থ তাকবির দেননি। অর্থাৎ মুসলিমদের শুধু ছোট একটি অশ্বারোহী দল যুদ্ধে জড়িয়েছে। এই পর্যায়ে রুস্তমের আদেশের কারণে মুসলিমদের ছোট একটি দলের ওপর পার্সিয়ানরা পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেছিল। মুসলিমদের ছোট দল বেশ ভালো সাহসীকতার সাথে পার্সিয়ানদের আক্রমন ঠেকিয়ে যাচ্ছিলেন।
পার্সিয়ানদের একটি বড় শক্তি ছিল হাতি। সা'দ রা. ধীরে ধীরে সৈন্য খরচ করতে চাইলেন। তিনি এখনো পুরো মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধে নামিয়ে দেননি। তিনি আসিম ইবনে আমর ও তার বাহিনীকে নির্দেশ দিলে হাতিদের কন্ট্রোল করার জন্য। আদেশ পেয়ে আসিম তার তীরন্দাজ বাহিনী নিয়ে একশন শুরু করলেন। হাতির ওপরে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকা বাক্স। আর সেই বাক্সে বসে পার্সিয়ান সৈনিকেরা যুদ্ধ করে ও তীর ছুঁড়ে। আসিমের বাহিনীর একটি অংশ হাতির দড়ি কাটতে থাকে আরেকটি অংশ তীর দিয়ে হাতির চোখ নষ্ট করে দিতে লাগলো। এতে দারুণ ঘটনা ঘটলো। হাতিগুলো এলেওমেলো ছুটোছুটি করতে লাগলো। হাতির ওপরে থাকা সৈন্যরা ছিটকে পড়ে যেতে লাগলো। হাতি পার্সিয়ান সৈন্যদের পিষ্ট করে পালাতে লাগলো।
এরপর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো। পার্সিয়ানরা হাতির ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে পদাতিক যুদ্ধ শুরু করলো। রাতের ১ম ভাগ পর্যন্ত যুদ্ধ চললো। এদিন মুসলিমদের হতাহত হলো প্রায় ৫০০ জন। পার্সিয়ানরা ১ম দিন অনেকটাই রক্ষনাত্মক যুদ্ধ করলো। তাদের হাজারের ওপর সৈন্য নিহত হলো। বিশাল সংখ্যক আহত থাকায় রাতে সা'দ রা.-এর নির্দেশে মেডিক্যাল ক্যাম্প তৈরি করা হলো এবং আহত সৈন্যদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলো।
রাতে সিরিয়া ফ্রন্ট থেকে কা'কা ইবনে আমরের নেতৃত্বে মুসলিমদের একটি বাহিনী যুদ্ধে যুক্ত হলো। উমার রা. নির্দেশে খালিদ রা.-এর নিজস্ব বাহিনীর একাংশকে এখানে পাঠানো হয়। তবে খালিদ রা.-কে সিরিয়া থেকে সরতে মানা করেছেন। কারণ রোমানদের সাথে যুদ্ধে খালিদ রা.-এর প্রয়োজন ছিল।
কাদেসিয়া যুদ্ধের ২য় দিন সম্মুখভাগে ছিল সিরিয়া ফ্রন্ট থেকে আসা সৈন্যরা। কা'কা যুদ্ধ শুরুর হুংকার ছাড়লেন এবং পার্সিনাদের কোনো বীর যোদ্ধাকে তার মোকাবিলা করতে বললেন। তাদের মধ্যে দুজন সেরা বীর এগিয়ে এলো। একজন বাইরুজান আরেকজন বান্দাওয়ান। কা'কার পাশে এসে দাঁড়ালে ইবনে যাবিয়ান। কা'কা বাইরুজানকে হত্যা করলেন। আর বান্দাওয়ানকে হত্যা করলেন ইবনে যাবিয়ান। দিনের শুরুতে মুহুর্তেই দুই বীরকে হারিয়ে পার্সিয়ানরা হতাশ হয়ে পড়লো।
এরপর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো। এদিনও পার্সিয়ানরা হাতিকে ব্যবহার করে যুদ্ধ শুরু করলো। গতকাল থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা হাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করলো ঘোড়া দিয়ে। এর ফলে পার্সিয়ানরা সাফল্য পেতে থাকলো। কা'কার নির্দেশে মুসলিমরা উট ব্যবহার করে ওপরে উঠে যুদ্ধ শুরু করলো। উটকে বর্ম পরিয়ে সুরক্ষা দেওয়া হলো। এরপর উটের ওপর থেকে তীরন্দাজরা সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করলো। এতে সাম্যবস্থা ফিরে এলো। মুসলিমরা আবার পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধে ফিরে এলো। এদিন মধ্যরাত পর্যন্ত যুদ্ধ চললো। যুদ্ধ বিরতি হলে মুসলিম মহিলারা সৈনিকদের চিকিৎসা সেবা দিতে লাগলেন। শহীদ সৈন্যদের কবরস্ত করা হলো।
৩য় দিন কা'কা একটি কৌশল করলেন। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, সা'দ রা. নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন না। তার শরীরে ফোঁড়া ওঠায় তিনি হাঁটাচলা করতেই পারছিলেন না। তাই তার অনুমতিক্রমে কা'কাই যুদ্ধ এগিয়ে নিচ্ছিলেন। সা'দ রা. পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কা'কা বাহিনীকে শেষ রাতে ঘোড়া সহ দূরে পাঠিয়ে দিলেন। দিন শুরু হওয়ার পর কয়েকজন করে মুসলিম বাহিনীর সাথে গগনবিদারী তাকবির দিয়ে যুক্ত হয়। তাদের যুক্ত হওয়ার সময় মাঠে উপস্থিত সৈন্যরাও তাকবির দেয়। এভাবে বহুক্ষণ ধরে চলতে থাকে। মুশরিকরা ভেবেছিলো হাজার হাজার সৈন্য যুক্ত হচ্ছে মুসলিম বাহিনীতে। তাদের মনোবল দূর্বল করে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য।
৩য় দিনে মুসলিমদের পরিকল্পনা ছিল হাতিদের শেষ করে দেওয়া। এরা পার্সিয়ান বাহিনীর বড় ঢাল হিসেবে অবস্থান নিয়েছে। হাতির দলের মধ্যে দুইটি বড় সাদা হাতি ছিল নেতৃত্বে। কা'কা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই দুই হাতিকে শেষ করতে পারলে যুদ্ধ গোছানো হয়ে যাবে। তাই তিনি তীরন্দাজ আসিমের সাথে পরিকল্পনা করলেন। তারা দুইটি দলে বিভক্ত হলে কমান্ডো হামলা করলেন হাতি দুইটির ওপর। বিশাল হাতি দুইটিকে মারতে তারা সক্ষম হন। এরপর দারুণ ঘটনা ঘটলো। বাকী সব হাতি ভয় পেয়ে পালাতে লাগলো। কাদেসিয়ার মাঠ হাতিশূন্য হয়ে পড়লো। এরপর মুসলিরা সর্বাত্মক আক্রমণ করলেন বিশাল পার্সিয়ান বাহিনীর ওপর।
এই দিন উভয় পক্ষ যুদ্ধের একটি চূড়ান্ত সমাধান চেয়েছে। তাই কেউ রণে ভঙ্গ দিতে রাজি ছিল না। যুদ্ধ চলতে লাগলো সারা রাতজুড়ে। মুসলিম কমান্ডাররা ঘুরে ঘুরে সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করতে লাগলেন। সা'দ রা. পড়ে রইলেন সিজদায়। আল্লাহর কাছে বিজয় চাইছেন।
পরদিন অর্থাৎ ৪র্থ দিন কা'কা টার্গেট নির্ধারণ করলেন রুস্তমকে। তিনি তার কমান্ডো বাহিনী প্রস্তুত করলেন। কা'কার নেতৃত্বে কমান্ডো বাহিনী শত্রুদের লাইন ভেঙ্গে পার্সিয়ান বাহিনীর পেটের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তারা অবিশ্রান্তভাবে তলোয়ার চালিয়ে পৌঁছে গেলেন রুস্তমের সিংহাসনের কাছে। অবস্থা বেগতিক দেখে সে তার আসন ছেড়ে সৈন্যদের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সে একটা খচ্চরের পেছনে আশ্রয় নিয়েছিল। ভিড়ের চাপে খচ্চর তার ওপর পড়ে তাকে আহত করলো। এসময় হিলাল তামিমি তাকে ধরে ফেললেন। তাকে টেনে হিঁচড়ে মুসলিম কমান্ডোদের কাছে নিয়ে আসলেন এবং কুপিয়ে তার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। এরপর তার সিংহাসনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, কা'বার মালিকের দয়ায় আমি রুস্তমকে হত্যা করেছি। কে আছো আমার মোকাবেলা করবে? আছো কি কেউ?
এই ঘোষণায় থমকে গেলে পুরো যুদ্ধ। পালাতে লাগলো পার্সিয়ানরা। পার্সিয়ান কমান্ডার জালিনুস যখন বুঝলো রুস্তমের মৃত্যু হয়েছে তখন সে সবাইকে পিছু হটার নির্দেশ দিল। সা'দ রা. যুদ্ধ শেষ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি মুসলিমদের আবার নতুনভাবে সাজিয়ে পার্সিয়ানদের ধাওয়া করতে বললেন। কিছুদূর গিয়ে জালিনুস আবার পার্সিয়ান সৈন্যদের একত্রিত করতে চেয়েছে। মুসলিম বাহিনী ধাওয়া দিলে সে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। অবশেষে মুসলিমরা তাকেও হত্যা করে এবং পার্সিয়ানদের বহুদূর পর্যন্ত ধাওয়া দেয়।
বিজয়ের সুসংবাদ জানিয়ে সা'দ রা. পত্র দিলেন উমার রা.-কে। বললেন, আল্লাহ পার্সিয়ান বিরুদ্ধে আমাদের জয়ী করেছেন। এদিকে মদিনায় উমার রা. নির্ঘুম দিন কাটাচ্ছিলেন। অস্থিরতায় তিনি প্রতিদিন মরুভূমিকে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ইরাক থেকে কেউ আসলেই মুসলিম বাহিনীর কথা জিজ্ঞাসা করতেন। অবশেষে বিজয়ের সংবাদ পেলেন। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এরপর মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে মদিনাবাসীকে সুসংবাদ দিলেন। তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন।
এই যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হলেও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুসলিম সেনা ইন্তেকাল করেছেন। এটা ছিল সেসময়ের সবচেয়ে বড় প্রাণহানি। তাই মুসলিমরা ইরাক বিজয়ের পরও ভাই হারানোর কষ্টে ভারাক্রান্ত ছিল। এই যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যরা ব্যাপক কষ্ট স্বীকার করেন। তাই উমার রা. নিজস্ব ইজতিহাদে যুদ্ধে প্রাপ্ত সকল গনীমত সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেন। ১ পঞ্চমাংশ যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার কথা তা তিনি সৈন্যদের পুরষ্কার হিসেবে দিয়ে দেন।
যেদিন যুদ্ধ শুরু হয় সেদিন ফজরের আজানের সময় রুস্তম বেশ ভড়কে যায়। ফজরের আজান শুনে সে বিচলিত হয়ে যায়। সে সকল সৈন্যকে ডেকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলে। সে বলেছিল আমি যেন উমারের কন্ঠ শুনছি। সে আমাকে হত্যা করতে আসছে। মুসলিম বাহিনীর এই মুয়াজজিন যুদ্ধে শাহদাতবরণ করেন। তার এই ঘটনার স্বরণে অনেকেই মুয়াজজিন হওয়ার প্রতিযোগিতা করতে থাকে। সকলে আজান দিয়ে নিজেকে যোগ্য মুয়াজজিন হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। এক পর্যায়ে প্রতি ওয়াক্তে সা'দ রা.-কে লটারি করে মুয়াজজিনের দায়িত্ব দিতে হয়!
মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাদেসিয়ার ভয়াবহ যুদ্ধে পরাজয়ের পর পার্সিয়ানদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। পার্সিয়ানদের ৪০ হাজার সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়। সা'দ রা. ইরাক পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। যেসব ইরাকিরা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল তারা আবার আত্মসমর্পন করেছে। অনেকে পালিয়ে গেছে। যারা আত্মসমর্পন করেছে তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে উমার রা.-এর নির্দেশে। তারা জিজিয়া দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস ও ধর্ম পালনের অধিকার পেল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন