১৭ জুন, ২০২২

শহীদ মুরসি : মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট


আজ ১৭ জুন। শহীদ প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির ৩য় শাহদাতবার্ষিকী। মুহাম্মদ মুরসি ছিলেন মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সামরিক বাহিনী তাকে উৎখাতের আগে মাত্র এক বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা । 'আরব বসন্ত' নামে খ্যাত সরকার বিরোধী বিক্ষোভের পর ২০১২ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তার মাধ্যমে মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ইতিহাসে এই প্রথম মিশর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পায়।

২০১৩ সালের ৩রা জুলাই তাকে মিসরের সেনাবাহিনী উৎখাত করে। এটা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহ ও আমেরিকার যৌথ এজেন্ডা। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার চার মাস পরে, মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনের আরো ১৪জন ঊর্ধ্বতন নেতার সঙ্গে মোহাম্মদ মোরসির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একজন সাংবাদিক ও দুইজন সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীকে হত্যায় প্ররোচনা দেবার অভিযোগ আনা হয় মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

শুনানির প্রথম দিনে মুহাম্মদ মুরসি কাঠগড়া থেকে চিৎকার করে বলেছিলেন, তিনি সেনা অভ্যুত্থানের শিকার এবং তার বিচার করার বৈধতা এ আদালতের নেই। সেনাপ্রধান আব্দুল ফাত্তাহ সিসি পরে হত্যার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়, কিন্তু বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার ও দমনের অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে মুরসির বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ আনা হয়, এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যদিও পরে সে রায় বাতিল করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ১৭ই জুন বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুর সময় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তার বিচার চলছিল।

শহীদ মুহাম্মদ মুরসি ১৯৫১ সালে মিশরের শারকিয়া প্রদেশের আল-আদওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ এর দশকে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন, এরপর পিএইচডি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মিশরে ফিরে এসে তিনি জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান হন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনে যোগ দেন তিনি এবং ক্রমে নেতৃত্বে আসেন। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত এই দলের হয়ে মিশরের সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন।

সংসদ সদস্য হিসেবে ভালো বক্তা বলে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন অনেকবার, বিশেষ করে ২০০২ সালে এক রেল দুর্ঘটনার পর কর্মকর্তাদের নিন্দা করে তার দেয়া বক্তব্য খুবই আলোচিত হয়েছিল। ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের ডেপুটি জেনারেল গাইড, মিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী খাইরাত আল-সাতেরকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। এরপর মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে মুরসিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। 

প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে জিতে ২০১২ সালের জুনে মিশরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন মুহাম্মদ মুরসি। প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে জেতার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারী সরকাররা প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। কারণ তারা তাদের শাসনক্ষমতা নিয়ে চিন্তিত ছিল। তাদের প্ররোচনায় মুরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তৈরি হয়। 

২০১২ সালের নভেম্বর থেকে জনরোষের প্রকাশ ঘটতে থাকে। এর সাথে জুড়ে যায় হোসনি মুবারকের সমর্থকরা ও ইসলামী রাজনীতির বিরোধী শক্তিরা। মুহাম্মদ মুরসি কুরআনের আলোকে সংবিধানের ঘোষণা দেওয়ায় সেক্যুলাররা তীব্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনকে পুঁজি করে জেনারেল আল সিসি ক্যু করে ক্ষমতা দখল করে। আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি ও আমেরিকা মদদ দেয় জেনারেল সিসিকে।  

সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং নতুন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি মুরসিকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। তাকে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক সপ্তাহ তার কোন খোঁজ ছিল না। এরপর মুহাম্মদ মুরসি মুক্তি এবং তাকে অবিলম্বে ক্ষমতায় পুনরায় অধিষ্ঠিত করার দাবিতে কায়রোর রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার সমর্থক। এর রিরুদ্ধে স্বৈরাচার সিসি হাজার হাজার মানুষকে খুন করে। মিশরে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রায় সব শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী।

স্বৈরাচার খুনী ও সন্ত্রাসী আল সিসি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তীতে তাদের ওপর চালানো হয় ব্যাপক নিপীড়ন, এবং ফল হিসেবে হাজার হাজার ব্রাদারহুড কর্মী গ্রেফতার বা নিহত হন। অনেকে কাতার এবং তুরস্কে পালিয়ে যান। এরপর মুহাম্মদ মুরসিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝেমধ্যে মামলার হাজিরা দিতে তাকে আদালতে আনা হলেই কেবল তাকে দেখা যেত। এরপর কারাগারে নির্যাতনে তিনি অসুস্থ হলে বিনা চিকিৎসায় তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।  

২০১৯ সালের ১৭ জুন তিনি কারাগারে শাহাদাতবরণ করেন। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন