৩০ জুল, ২০২২
২৬ জুল, ২০২২
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
২৪ জুল, ২০২২
ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ
২১ জুল, ২০২২
ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
১৯৪০ সালের কথা। আমাদের উপমহাদেশ তখন স্বাধীনতার জন্য উত্তাল। স্বাধীনতা দাবীদাররা আবার দুইভাগে বিভক্ত। মুসলিমরা আলাদাভাবে স্বাধীনতা চায়। তারা পাকিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র করতে চায়। এই দাবীর পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি নাম 'মুসলিম লীগ'।
অন্যদিকে হিন্দুরা এক ভারত চায়। ভারত ভাঙ্গুক এটা তারা চায় না। এই দাবীর পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি হলো 'কংগ্রেস'। মুসলিমরা গত ৫০ বছরে কংগ্রেসের ভয়ংকর বর্ণবাদী আচরণে নিশ্চিত হয়েছে ভারত ইংরেজদের থেকে স্বাধীন হয়ে কংগ্রেসের হাতে পড়লে পরস্থিতি আরো ভয়ংকর হবে। মুসলিমরা পাইকারিভাবে নিধন হবে।
শুনতে ভিন্নরকম শোনালেও হিন্দুপ্রধান সংগঠন কংগ্রেসের মতামতের সাথে একাত্মতা পোষণ করলো দেওবন্দী আলেমদের মূল সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। আর তাদের নেতা হুসাইন আহমদ মাদানী ১৯৩৮ সালে ‘মুত্তাহিদা কওমিয়াত আওর ইসলাম’ বা ‘যুক্ত জাতীয়তা ও ইসলাম’ শিরোনামে একটি বই লিখেন। ওনার এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিমদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। একদিকে তাদের মন সায় দিচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি অন্যদিকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় আলেম বলছেন হিন্দুদের সাথে থাকার কথা। তার এই বইয়ের বিপরীতে কিছু দেওবন্দী নেতা বক্তব্য দিলেও তার যুক্তি খণ্ডন করে কেউ কিছু করতে পারে নি। অন্যদিকে আলিয়া মাদ্রাসার আলেমদেরকে তো দেওবন্দীরা পাত্তাই দিত না।
অবশেষে তাত্ত্বিক দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিষয়ে 'মাসয়ালায়ে কওমিয়াত' নামে গবেষণানির্ভর বই লিখেন মওলানা মওদূদী রহ.। সেই বইটি বাংলায় “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” নামে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সেই বইতে হিন্দু-মুসলিম এক জাতি এই ধারণার সব যুক্ত খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর গোটা মানব বসতিতে মাত্র দু’টি দলের অস্তিত্ব রয়েছে; একটি আল্লাহর দল অপরটি শয়তানের দল। তাই এই দুই দল মিলে কখন এক জাতি হতে পারে না, যেমন পারে না তেল ও পানি মিশে এক হয়ে যেতে। মওলানার এই বই তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষত মুসলিম লীগ একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি পায়।
কিন্তু মাওলানা মুসলিম লীগে যোগদান করেননি। তিনি মুসলিম লীগের সাথে এই বিষয়ে একমত যে, মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের দরকার আছে। এটা খুবই জরুরি। কিন্তু মুসলিম লীগের নেতারা সেই রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, যে কর্মসূচি ঘোষণা করছে তা একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নয়। সবচেয়ে বড় কথা একটি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য যে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের দরকার, মুসলিম লীগ সেই লোক তৈরি করছে না এবং লোক তৈরির কর্মসূচিও তাদের নেই। এই নিয়ে মুসলিম লীগের সমালোচনা করেছেন তিনি। মাওলানার এই অবস্থানকে কেউ কেউ পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান বলে মিথ্যাচার করেন।
যাই হোক আমরা মূল প্রসঙ্গে আসি। ১৯৪০ সালে মাওলানা রাষ্ট্রের বিষয়ে তাঁর অবস্থান ক্লিয়ার করেন। এটা সেসময়ের কথা, জামায়াতে ইসলাম তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে মাওলানা একজন ইসলামিক স্কলার হিসেবে সারা হিন্দুস্থানজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন। ১২ই সেপ্টেম্বর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেচি হলে ইতিহাস ও সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা মওদূদীকে অতিথি করা হয়। সে প্রোগ্রামে অতিথির বক্তব্যে মাওলানা মওদূদী ইসলামী রাষ্ট্র গঠন কীভাবে হবে তা নিয়ে আলোচনা করেন।
তাঁর এই বক্তব্য আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বই আকারে বের করে। বইটির নাম হলো 'ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যায়'। এই বইটি উপমহাদেশে ব্যাপক তোলপাড় করে। বিচক্ষণ মুসলিমরা এই বইটিকে সাদরে গ্রহণ করে। এই বইটি বাংলায় অনুবাদ হয় প্রথমে 'ইসলামী বিপ্লবের পথ' এই নামে। পরে সংশোধন করে 'ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?' এই নামে প্রকাশিত হয়। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন আব্দুস শহীদ নাসিম।
মাওলানা মওদূদীর এই বক্তব্যকে ৬টি ভাগে ভাগ করা যায়। বলা যায় তিনি ৬ টি বিষয়ে কথা বলেছেন।
১. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন।
২. আদর্শিক রাষ্ট্র।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র ।
৪. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি।
৫. অবাস্তব ধারণা-কল্পনা।
৬. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি।
১. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন:
রাষ্ট্রব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। একটা সমাজের মানুষের চিন্তা চেতনা, সংস্কৃতি, আচরণ এর মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বিবর্তন হয়। অতএব হুট করে একটি জাহেলি সমাজকে ইসলামী সমাজে পরিণত করা যায় না। এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন ঐ রাষ্ট্রের মানুষের পরিবর্তন। মাওলানা এখানে বুঝাতে চেয়েছেন শুধু একটি ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারণ করলেই ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যায় না। বরং এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে হবে।
২. আদর্শিক রাষ্ট্র:
ইসলামী রাষ্ট্র মানে মুসলিমদের রাষ্ট্র নয়। মুসলিমরা রাষ্ট্র কায়েম করলে সেটি ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যায় না। ইসলামী রাষ্ট্র হচ্ছে সেটি যে রাষ্ট্রে ইসলামের বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়। এখানে জাতীয়তাবাদের লেশমাত্র থাকবে না। আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গোটা মানবজাতিকে তার আদর্শ গ্রহন করে অজাতীয়তাবাদী বিশ্বজনীন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানায়।
মাওলানা তাঁর কাঙ্খিত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন,
১. রাষ্ট্রের আদর্শ হবে ইসলাম
২. সংকীর্ন জাতীয়তাবাদ হতে সম্পূর্ন মুক্ত
৩. অন্যান্য রাষ্ট্রনীতি হতে সম্পূর্ণ পৃথক।
৪. জনগনের অধিকার সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
৫. যোগ্যতার বলে যে কেউ শাসক হতে পারে।
৬. উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
৭. সার্বভৌমত্ব হবে আল্লাহর, প্রতিনিধিত্ব হবে জনগনের।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র:
মাওলানা বলেন, আমরা যে রাষ্ট্র কায়েম করতে চাই সেখানে সার্বভৌমত্ব হবে একমাত্র আল্লাহর। তাঁর বিধান, আইনই শেষ কথা। এই রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে, এখানে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবে। এই খিলাফাত প্রতিষ্ঠার কাজে এমন সব লোকই অংশীদার হবে, যারা এই আইন ও বিধানের প্রতি ঈমান আনবে এবং তা অনুসরণ ও কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। এই রাষ্ট্রের সকল কাজের জন্য সামষ্টিকভাবে আমাদের সকলকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ রাষ্ট্রের পরিচালকদের অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকবে। তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের মালিক নয়, আমানতদার হবে। শাসকগণ জনগনের কল্যান চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাবে। শাসক নির্বাচিত হবে জনগণের মতামত নিয়ে। বংশানুক্রমিক বা জবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল করা যাবে না।
৪. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি:
মাওলানা বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য প্রথমে এমন একটি আন্দোলন প্রয়োজন যে আন্দোলনের মধ্যে ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। এখানে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমনসব বিশেষজ্ঞ তৈরি করবে যারা নিজেদের মন মানসিকতা, ধ্যানধারনা ও চিন্তা দর্শনের দিক থেকে হবে পূর্ণ মুসলিম। যাদের ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বাস্তবধর্মী এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নকশা তৈরি করার থাকবে পূর্ণাঙ্গ যোগ্যতা।
৫. অবাস্তব ধারণা কল্পনা:
কিছু লোকের ধারণা মুসলমানরা সংগঠিত হলেই তাদের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মূলত জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকে এই ধারণার উদ্ভব। সত্যিকারভাবে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। তারা ভাবে “মুসলমান” একটি বংশগত বা ঐতিহাসিক জাতির ধারণা। মুসলিমদের ঐক্যের মাধ্যমে সেই জাতিটিরই কেবল উন্নতি সাধন করা এবং একটি জাতীয় রাষ্ট্র অর্জিত হতে পারে। কিংবা কমপক্ষে দেশ শাসনে ভাল একটা অংশীদারিত্ব লাভ হতে পারে। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে এটাকে প্রথম পদক্ষেপও বলা যেতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ইসলামকে আদর্শ হিসেবে ধারণ করা। ইসলামী বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা। মাওলানা এখানে মূলত মুসলিম লীগের সমালোচনা করেছেন। মুসলিম লীগ ভেবেছে মুসলিমদের রাষ্ট্র হলেই সেটা ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যাবে। কিন্তু মাওলানা বলেন, এর দ্বারা মুসলিমদের উপকার হতে পারে, একটি ভালো শাসন পাওয়া যেতে পারে তবে কোনোভাবেই এটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে না। এই রাষ্ট্র দিয়ে খিলাফতের দায়িত্ব পালন হবে না।
৬. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি:
সবশেষে মাওলানা আমাদের কর্মনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এক আল্লাহর একচ্ছত্র ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে মানবজীবনের পরিপূর্ণ ইমারত রচনা করার প্রচেষ্টা ও আন্দোলনকে বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে বলা হয় ইসলাম। আর এর জন্য মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সা:) এর অনুসৃত পথেই ইসলামী আন্দোলনের কর্মনীতি পরিচালনা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই যেখানে আল্লাহর বিধান কায়েম হবে তথা তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। আর মুহাম্মদ সা.-এর সীরাত থেকেই এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি আমরা গ্রহণ করবো।
এটি একটি দারুণ বই! ইসলামী রাষ্ট্র যারা প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদের জন্য এটা টেক্সট বুক। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এটা পড়া দরকার। যারা এখনো পড়েননি তারা অবশ্যই পড়বেন। আপনার চিন্তা পরিশুদ্ধ হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যারা চেষ্টা করছেন তাদের অন্তরে যদি চরমপন্থী ধারণা থাকে তবে তা দূর হবে ইনশাআল্লাহ।
#বুক_রিভিউ
বই : ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : আব্দুস শহীদ নাসিম
প্রকাশনী : শতাব্দী প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ৪৮
মুদ্রিত মূল্য : ২৪
জনরা : থিয়োলজি
১৯ জুল, ২০২২
একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ
১৯৭১ সালের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত অনেক খুব পড়ে যায়। রাজনীতি করার অধিকার হারিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। আওয়ামীলীগের পতনের পরে আস্তে আস্তে জামায়াত রাজনীতিতে ফিরে আসতে শুরু করে।
১৯৮৪ সালে জামায়াত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলার প্রস্তাব দেয় রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে। কারন সে সময়ের ধূর্ত শাসক লে জে হু মু এরশাদের অধীনে নির্বাচন কারো পক্ষে মানা সম্ভব ছিল না। জামায়াতের এই ফর্মুলা সেসময় সরকারি দলতো গ্রহন করেইনি। বিরোধী দলের মধ্যেও কেউ গ্রহন করেনি। একই ফর্মূলা সকল বিরোধী দল গ্রহন করেছে ১৯৮৯ সালে। সকল বিরোধী দল তখন এই ফর্মূলা বাস্তবায়নের জন্য যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। তারই প্রেক্ষিতে গণঅভ্যুত্থান হয় এরশাদের পতন হয়।
১৭ জুল, ২০২২
সত্যের সাক্ষ্য
মুরাদপুরের সেই সভায় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সামনে একটি বক্তব্য রাখেন মাওলানা মওদূদী। সেখানে মাওলানা মওদূদীর রহ.-এর বক্তব্যের বিষয় ছিল একজন মুসলিমের ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য কী? বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী রহ.-এর সেই ভাষণ 'শাহদাতে হক' নামে উর্দুতে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
বাংলায় এই বইটি 'সত্যের সাক্ষ্য' নামে প্রকাশিত হয়েছে। উর্দু থেকে এটি অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম। যেহেতু বইটি একটি বক্তব্যের লিখিত রূপ তাই এখানে অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনা হয়নি। তবে যে কয়টি প্রধান বিষয় এখানে আলোকপাত করা হয়েছে তা হলো, আমাদের দাওয়াত, মুসলিমদের দায়িত্ব, সত্যের সাক্ষ্য, সাক্ষ্যদানের পদ্ধতি, সত্য গোপনের শাস্তি, মুসলিমদের সমস্যা, আমাদের উদ্দেশ্য ও জামায়াত সম্পর্কে কিছু অভিযোগের জবাব।
আমাদের দাওয়াত
মাওলানা মওদূদী এখানে আমাদের দাওয়াত বলতে জামায়াতের দাওয়াত বুঝিয়েছেন। জামায়াতের দাওয়াত দুই শ্রেণির প্রতি। যারা মুসলিম নয় এবং যারা মুসলিম। যারা মুসলিম নয় তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া হয়। আল্লাহকে একক রব হিসেবে মেনে নেওয়া ও মুহাম্মদ সা.-কে তাঁর প্রেরিত রাসূল হিসেবে মানার দাওয়াত দেওয়া হয়। আর যারা মুসলিম তাদেরকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করার আহবান জানানো। আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
মুসলিমদের দায়িত্ব
এই প্রসঙ্গে মাওলানা বলেন, শুধু সত্যের ওপর ঈমান আনলেই হবে না। বরং সে সত্যের ওপর আপনারা ঈমান এনেছেন তার সাক্ষীরূপে সারা দুনিয়ার সামনে দাঁড়াতে হবে। কুরআনে আপনাদেরকে 'মুসলমান' নামে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সাথে এই দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে, আপনারা দুনিয়ার মানুষের সামনে হকের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াবেন। এরপর মাওলানা সূরা আল বাকারার ১৪৩ নং আয়াত পাঠ করেন। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থী জাতি বানিয়েছি। যাতে তোমরা লোকদের জন্য সাক্ষী হও আর রাসূল যেন তোমাদের জন্য সাক্ষী হন।
মাওলানা এই বক্তব্য যখন দিচ্ছিলেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশের আরেকজন মাওলানা বলেছেন। হিন্দু-মুসলিম আমরা এক জাতি। এক মাটির সন্তান। তাই আমরা একসাথে থাকবো। হোসাইন আহমেদ মাদানীর সেই বক্তব্যকেও এখানে খন্ডন করা হয়েছে। কারণ মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতি। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আলাদা। এরপর মাওলানা কুরআনের আরো কিছু কুরআনের আয়াত তিলওয়াত করেন যেখানে মুসলিমদের সত্যের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং সত্যের সাক্ষ্য না দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন। সেগুলো হলো, সূরা নিসা ১৩৫, বাকারা ৬১ ও ১৪০।
সত্যের সাক্ষ্য
মাওলানা বলেন, সত্যের সাক্ষ্য হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, উদ্ভাসিত হয়েছে, তার সত্যতা দুনিয়ার সামনে এমনভাবে প্রকাশ করা যাতে দ্বীনের যথার্থতা প্রমানিত হয়, এটাই সত্যের সাক্ষ্য।
এই সাক্ষ্যের গুরুত্ব প্রসঙ্গে মাওলানা ৫ টি কথা বলেছেন, সাক্ষ্যদানের ভিতিত্তেই হাশরের ময়দানে ফয়সালা হবে। সাক্ষ্যদান সকল নবীর সুন্নাত। সত্যের সাক্ষী না হলে জালেমদের অন্তভূক্ত হবে। সাক্ষ্য না দিলে দুনিয়ার লাঞ্জনা, অপমান, অধ:পতন চেপে বসবে। সাক্ষ্য দান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া দায়িত্ব।
সাক্ষ্য দানের পদ্ধতি
মাওলানা বলেন, দুইভাবে সাক্ষ্য দিতে হবে। মৌখিকভাবে ও বাস্তবে। দুইটাই জরুরি।
নবী সা.-এর মাধ্যমে আমাদের কাছে যে সত্য এসে পৌছেছে তা বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে মানুষের কাছে সহজবোধ্য করাকে মৌখিক সাক্ষ্য বলে। দাওয়াতের সকল পদ্ধতি প্রয়োগ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল উপাদান ব্যবহার করে ইসলামকে একমাত্র সঠিক পরিপূর্ণ বিধান হিসাবে প্রমান এবং প্রতিষ্ঠিত বাতিল মতাদর্শের দোষ ক্রটি তুলে ধরা হচ্ছে মৌখিক সাক্ষ্য। এই যে আমরা ফেসবুকিং বা ব্লগিং করছি এটাও মৌখিক সাক্ষ্য। আর আমরা যা মুখে বলছি, যা লিখছি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের সামনে তার সত্যতা প্রমাণের নাম বাস্তব সাক্ষ্য।
মাওলানা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, আল্লাহর দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে মানতে পারলেই দ্বীনের পূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করা হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকলে দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে মানা সম্ভব হয় না। সুতরাং শুধুমাত্র দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সাক্ষ্যদানের পূর্ণতা সম্ভব। নইলে তা পূর্ণতা পাবে না।
১৯৪৬ সালের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মাওলানা বইলেন, আজ আমাদের সমাজে খুব কম সংখ্যক লোকই মৌখিক সাক্ষ্য দিচ্ছেন। দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোকই ইসলামকে বাদ দিয়ে মানব রচিত মতবাদকে সত্য বলে গ্রহণ করছেন। আজ পত্র পত্রিকা, ব্যবসা-বানিজ্য, আইন-আদালত সর্বোত্রই বাতিল মতবাদকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সমাজে খুব সামান্য সংখ্যক লোক ছাড়া কেউই নিজ জীবনে বাস্তব সাক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের চেয়েও আমাদের সামাজিক রীতিনীতির অবস্থা আরো খারাপ। এমনকি আজ আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ইসলাম বিরোধী মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করছি। এই অভিযোগটা মূলত মাওলানা মুসলিম লীগকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। মুসলিম লীগের অনেক নেতাই প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করার কথা বলেছিলেন।
সাক্ষ্য গোপন বা সত্য গোপনের শাস্তি
মাওলানা বলেন, আজ আমরা সত্য গোপন করে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছি এজন্য অবশ্যই ইহকাল ও পরকালে শাস্তি পেতে হবে। ইহকালে আমাদের সত্য গোপনের জন্য অপর জাতির হাতে লাঞ্চিত হতে হবে। যেমনটি ঘটেছে পূর্ববর্তী জাতিদের ক্ষেত্রে। দুনিয়ার চেয়েও কঠিন শাস্তি আমাদের পেতে হবে পরকালে। যদিও দুনিয়ার অশান্তি ও অনৈসলামিক কাজের জন্য আমরা দায়ী নই তবুও এগুলো দূর করার কাজ না করার জন্য আমাদেরকে শাস্তি পেতে হবে।
মুসলিমদের সমস্যা
১৯৪৬ সালে মুসলিমদের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তারা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। মাওলানা বলেন, এটা আমাদের মূল সমস্যা নয়, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে আমরা বাস্তব জীবনে ইসলামকে মানতে পারিনা। আর এজন্য প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে আমরা সক্ষম হচ্ছি না। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে দ্বীনের হককে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ইসলামের বিধান মোতাবেক যাবতীয় কাজ সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। মাওলানা আরো সুন্দর কথা বলেছেন, শাহদাতে হক বা সত্যের সাক্ষ্যের মাধ্যমে সংখ্যালঘু পরিণত হবে সংখ্যাগুরুতে।
আমাদের উদ্দেশ্য
এখানে মাওলানা আমাদের উদ্দেশ্য বলতে জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্যকে নির্দেশ করেছেন। উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাওলানা বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীনকে নিজের জীবনে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। কথা ও কাজের মাধ্যমে তার যথার্থ সাক্ষ্য দুনিয়ার সামনে পেশ করা। মুসলমান হিসেবে দ্বীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও সত্যের সাক্ষ্য দানই আমাদের জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। এরপর মাওলানা সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, সংগঠন প্রতিষ্ঠা, কাজের ধারা নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনা শেষে তিনি উপস্থিত জনগণকে জামায়াতে শামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
অভিযোগের জবাব
আলোচনার শেষ দিকে মাওলানা জামায়াতের ব্যাপারে উত্থাপিত কিছু অভিযোগের জবাব দেন। এর মধ্যে ছিল জামায়াত নতুন ফিরকা তৈরি করে মুসলিমদের মধ্যে দলাদলি করছে। আমীর শব্দটা কেন ব্যবহার করা হচ্ছে? এর দাবীদার একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক। পৃথক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী? জামায়াত কী অধিকারে যাকাত গ্রহণ করে? বাইতুল মাল কেন বানিয়েছে? ইত্যাদি। এসব কিছু প্রশ্নের দারুণ জবাব দিয়েছেন মাওলানা মওদূদী রহ.।
জবাব দান শেষে মাওলানা বলেন, প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ প্রশ্নই এমনি নিরর্থক যে, এগুলোর জবাব দান করে শ্রোতাবৃন্দের সময় নষ্ট করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তবু আমি নমুনা স্বরূপ কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দান করলাম এ জন্যে যে, যারা নিজেরাও দায়িত্ব পালন করতে চান না, বরং অন্যকেও তা করতে দিতে প্রস্তুত নন, তারা কি ধরণের বাহানা, কুটিল প্রশ্ন এবং সন্দেহজনক বিষয় খুঁজে খুঁজে বের করেন এবং নিজেরা যেমন আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকেন, তেমনি করে অন্যকেও কীভাবে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
বস্তুত অহেতুক ঝগড়া-বিবাদ এবং বিতর্ক-মুনাযারায় লিপ্ত হওয়া আমাদের কাজের পন্থা নয়। যদি কেউ সহজ-সরলভাবে আমাদের কথা বুঝতে চান, তো তাকে বুঝানোর জন্যে আমরা সদা প্রস্তুত। আর যদি কেউ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আমাদের ভূল-ভ্রান্তি ধরিয়েদিতে চান তা-ও আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কেউ বিতর্ক সৃষ্টি করলে এবং আমাদের তাতে জড়িত করতে চাইলে আমরা তার সম্মুখীন হতে মোটেই সম্মত নই। বিরুদ্ধবাদীগণ যতক্ষণ ইচ্ছা এ খেলা চালু রাখতে পারেন।
জামায়াতকে বুঝতে ও মুসলিম হিসেবে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট একটি বই। যারা এখনো বইটি পড়েননি, পড়ে নিন। আপনার মন ভরে যাবে। মুসমানিত্বের দায়িত্ব পালনে আপনি সচেষ্ট হবেন ইনশাআল্লাহ।
#বুক_রিভিউ
বই : সত্যের সাক্ষ্য
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
প্রকাশনী : প্রকাশনা বিভাগ, জামায়াতে ইসলামী।
পৃষ্ঠা : ৪০
মুদ্রিত মূল্য : ১৬
জনরা : আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন
১৬ জুল, ২০২২
ইসলাম পরিচিতি
এর মধ্যে ১ম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় খিলাফত পরাজিত হওয়ার সূত্র ধরে মুসলিমদের আশা ভরসার শেষ ঠিকানাও নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৯২৩ সালে খিলাফত ভেঙ্গে দেওয়া হয়। সারা পৃথিবীতে মুসলিমরা এলাকাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিভক্ত হয়ে যায়। মুসলিম উম্মাহ বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
এদিকে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে কম্যুনিস্টদের বিপ্লব মুসলিম আদর্শবাদীদের কম্যুনিস্টদের দিকে ধাবিত করে। সব মিলিয়ে মুসলিম সমাজের অবস্থা ছিল হযবরল। মুসলিমরা নিশ্চিত হয়ে গেছে তত্ত্ব হিসেবে ইসলাম আর ফাংশনাল না। ইসলাম দিয়ে সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব না।
মুসলিম যুবকদের কেউ পশ্চিমা পুঁজিবাদী সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কেউ কম্যুনিস্টদের বাম বিপ্লবে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বাজে অবস্থায় ইসলামের স্বরূপ তুলে ধরে মুসলিমদের ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও সংগঠক সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ.।
১৯৩২ সালে তিনি নিজেও যুবক। তাঁর তখন ২৯ বছর। তিনি ইসলাম বলতে কী বুঝায় ও ইসলামের সঠিক তত্ত্ব সবার সামনে উপস্থাপন করার জন্য একটি বই লিখেন 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' নামে। বইটিতে তিনি ইসলামের স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। এই বইটি উপমহাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পৃথিবীর সকল প্রধান ভাষাসহ প্রায় ২৩ টি ভাষায় বইটি অনুবাদ হয়।
বইটি সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখে আফগানিস্তানে। ১৯৬০ সালের পর থেকে আফগানিস্তানের মানুষ পার্শ্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে কম্যুনিস্ট হতে শুরু করে। এই বইটি তাদেরকে কম্যুনিজম থেকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। আর এই বই নিয়ে আফগানিস্তান চষে বেড়িয়েছেন তৎকালীন কাবুল ভার্সিটির শিক্ষক ও পরবর্তিতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী।
বাংলায় 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' বইটি অনুবাদ হয় 'ইসলাম পরিচিতি' নামে। অনুবাদ করেন সৈয়দ আব্দুল মান্নান। আন্তর্জাতিক দায়ি বিলাল ফিলিপ্স বলেছেন তাঁর ইসলামের দিকে আসার জন্য দুইটি বই ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে একটি হলো রিসালায়ে দ্বীনিয়াত।
বইটিকে মাওলানা মওদূদী রহ. ৭ টি চ্যাপ্টারে ভাগ করেছেন।
১ম অধ্যায়ের নাম 'ইসলাম'
এই অধ্যায়ে মাওলানা কেন ইসলাম নাম দেওয়া হয়েছে, ইসলামের অর্থ, এর তাৎপর্য আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি কুফর কী? কুফরের তাৎপর্য কী? এই আলোচনা করেছেন। অধ্যায়ের শেষে কুফর তথা ইসলামকে অস্বীকার করার কুফল ও ইসলামের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
২য় অধ্যায়ের নাম 'ঈমান ও আনুগত্য'
এই অধ্যায়ে তিনি প্রথমে আনুগত্যের জন্য জ্ঞান ও প্রত্যয়ের প্রয়োজন এটা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেছেন, মানুষ ততোক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য করতে পারে না, যতোক্ষণ না সে কতগুলো বিশেষ জ্ঞান লাভ করে এবং সে জ্ঞান প্রত্যয়ের সীমানায় পৌঁছে। সবার আগে মানুষের প্রয়োজন আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ প্রত্যয় লাভ। কেননা আল্লাহ আছেন, এ প্রত্যয় যদি তার না থাকলো, তা হলে কি করে সে তার প্রতি আনুগত্য পোষণ করবে?
এরপর তিনি ঈমানের পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এর ভিত্তিতে মানুষকে চারভাগে ভাগ করেছেন। এরপর তিনি জ্ঞানর্জনের মাধ্যম তথা ওহি নিয়ে নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের শেষে তিনি ঈমান বিল গায়েবের আলোচনাও করেছেন।
৩য় অধ্যায়ের নাম নবুয়্যত
এখানে মাওলানা মওদূদী নবুয়্যত নিয়ে আলোচনা করেছেন। নবুয়্যতের মূলতত্ত্ব ও এর পরিচয় কথা বলেছেন। নবীর আনুগত্য ও তাদের ঈমানের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি নবীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করেছেন। তাদের সাথে মানুষের বিভিন্ন আচরণেরও বর্ণনা দিয়েছেন। নবী হিসেবে মুহাম্মদ সা.-এর প্রমাণ ও নবুয়তের ভূমি হিসেবে আরবকে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। সবশেষে মুহাম্মদ সা. যে শেষ নবী সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
৪র্থ অধ্যায়ের নাম 'ঈমানের বিবরণ'
এখানে মাওলানা মূলত কালেমা তাইয়েবার তাৎপর্য উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে বলেন, এ কালেমা-ই হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদ-যা দিয়ে এক কাফের এক মুশরিক ও এক নাস্তিক থেকে মুসলিমের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। এ কালেমার স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি দ্বারা এক মানুষ ও অপর মানুষের মধ্যে বিপুল পার্থক্য রচিত হয়। এ কালেমার অনুসারীরা পরিণত হয় এক জাতিতে এবং অমান্যকারীরা হয় তাদের থেকে স্বতন্ত্র জাতি। এর অনুসারীরা দুনিয়া থেকে শুরু করে আখেরাতে পর্যন্ত উন্নতি, সাফল্য ও সম্মানের অধিকারী হয় এবং অমান্যকারীদের পরিণাম হচ্ছে ব্যর্থতা অপমান ও পতন। কালেমা তাইয়েবা সম্পর্কে একটি চমৎকার আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে। সাথে ঈমানের অন্যান্য বিষয় যেমন রাসূল, কিতাব, ফেরেশতা, আখিরাত, তাকদির ইত্যাদি নিয়েও আচোলনা করেছেন মাওলানা মওদূদী।
৫ম অধ্যায়ের নাম 'ইবাদত'
এখানে মাওলানা ইবাদতের হাকিকত ও গুরুত্ব উল্লেখ করেন। সেই সাথে সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্ব ও জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেন। জিহাদ ও জিহাদের পরিব্যপ্তি নিয়ে এখানে একটি সুন্দর আলোচনা রয়েছে।
৬ষ্ঠ অধ্যায়ের নাম 'দ্বীন ও শরিয়ত'
এখানে মাওলানা দারুণভাবে দ্বীন ও শরিয়তকে বুঝিয়েছেন। দ্বীন ও শরিয়তের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। শরীয়ত জানাত মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকাহ ও এর ডেবলেপমেন্ট নিয়ে কথা বলেছনে। সবশেষে তাসাউফ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকহ ও তাসাউফের মধ্যে সম্পর্ক সূচিত করেছেন।
৭ম ও শেষ অধ্যায়ের নাম 'শরীয়াতের বিধি-বিধান'
এই অধ্যায়ে মাওলানা দারুণভাবে শরিয়তে সবার অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। মাওলানা বলেন, শরীয়াত হচ্ছে একটি চিরন্তন বিধান। এর কানুন সমূহ কোন বিশেষ কওম ও কোন বিশেষ যুগের প্রচলিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর গড়ে ওঠেনি, বরং যে প্রকৃতির ভিত্তিতে মানুষ সৃষ্ট হয়েছে, সেই প্রকৃতির নীতির বুনিয়াদেই গড়ে ওঠেছে এ শরীয়াত। এ স্বভাব-প্রকৃতি যখন সকল যুগে সকল অবস্থায় কায়েম রয়েছে, তখন এরই নীতির বুনিয়াদে গড়া আইনসমূহ ও সর্ব যুগে সর্ব অবস্থায় সমভাবে কায়েম থাকবে।
এই বইটি পড়লে ইসলামের ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান অল্পতেই গোছানোভাবে জানা সম্ভব। ইসলাম কী? কেন? কীভাবে? ও কী চায়? সব জানা সহজ হয়ে যাবে। যারা এখনো পড়েননি বইটি পড়ে দেখুন। আপনার দিগন্ত উন্মোচন হয়ে যাবে। ইসলামের ব্যাপারে জোরালো আস্থা তৈরি হবে।
#বুক_রিভিউ
বই : ইসলাম পরিচিতি
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : সৈয়দ আব্দুল মান্নান
প্রকাশনী : আধুনিক প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ১১১
মুদ্রিত মূল্য : ৬৫
জনরা : থিয়োলজি
১৫ জুল, ২০২২
চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান