১৯৪০ সালের কথা। আমাদের উপমহাদেশ তখন স্বাধীনতার জন্য উত্তাল। স্বাধীনতা দাবীদাররা আবার দুইভাগে বিভক্ত। মুসলিমরা আলাদাভাবে স্বাধীনতা চায়। তারা পাকিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র করতে চায়। এই দাবীর পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি নাম 'মুসলিম লীগ'।
অন্যদিকে হিন্দুরা এক ভারত চায়। ভারত ভাঙ্গুক এটা তারা চায় না। এই দাবীর পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি হলো 'কংগ্রেস'। মুসলিমরা গত ৫০ বছরে কংগ্রেসের ভয়ংকর বর্ণবাদী আচরণে নিশ্চিত হয়েছে ভারত ইংরেজদের থেকে স্বাধীন হয়ে কংগ্রেসের হাতে পড়লে পরস্থিতি আরো ভয়ংকর হবে। মুসলিমরা পাইকারিভাবে নিধন হবে।
শুনতে ভিন্নরকম শোনালেও হিন্দুপ্রধান সংগঠন কংগ্রেসের মতামতের সাথে একাত্মতা পোষণ করলো দেওবন্দী আলেমদের মূল সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। আর তাদের নেতা হুসাইন আহমদ মাদানী ১৯৩৮ সালে ‘মুত্তাহিদা কওমিয়াত আওর ইসলাম’ বা ‘যুক্ত জাতীয়তা ও ইসলাম’ শিরোনামে একটি বই লিখেন। ওনার এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিমদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। একদিকে তাদের মন সায় দিচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি অন্যদিকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় আলেম বলছেন হিন্দুদের সাথে থাকার কথা। তার এই বইয়ের বিপরীতে কিছু দেওবন্দী নেতা বক্তব্য দিলেও তার যুক্তি খণ্ডন করে কেউ কিছু করতে পারে নি। অন্যদিকে আলিয়া মাদ্রাসার আলেমদেরকে তো দেওবন্দীরা পাত্তাই দিত না।
অবশেষে তাত্ত্বিক দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিষয়ে 'মাসয়ালায়ে কওমিয়াত' নামে গবেষণানির্ভর বই লিখেন মওলানা মওদূদী রহ.। সেই বইটি বাংলায় “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” নামে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সেই বইতে হিন্দু-মুসলিম এক জাতি এই ধারণার সব যুক্ত খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর গোটা মানব বসতিতে মাত্র দু’টি দলের অস্তিত্ব রয়েছে; একটি আল্লাহর দল অপরটি শয়তানের দল। তাই এই দুই দল মিলে কখন এক জাতি হতে পারে না, যেমন পারে না তেল ও পানি মিশে এক হয়ে যেতে। মওলানার এই বই তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষত মুসলিম লীগ একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি পায়।
কিন্তু মাওলানা মুসলিম লীগে যোগদান করেননি। তিনি মুসলিম লীগের সাথে এই বিষয়ে একমত যে, মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের দরকার আছে। এটা খুবই জরুরি। কিন্তু মুসলিম লীগের নেতারা সেই রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, যে কর্মসূচি ঘোষণা করছে তা একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নয়। সবচেয়ে বড় কথা একটি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য যে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের দরকার, মুসলিম লীগ সেই লোক তৈরি করছে না এবং লোক তৈরির কর্মসূচিও তাদের নেই। এই নিয়ে মুসলিম লীগের সমালোচনা করেছেন তিনি। মাওলানার এই অবস্থানকে কেউ কেউ পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান বলে মিথ্যাচার করেন।
যাই হোক আমরা মূল প্রসঙ্গে আসি। ১৯৪০ সালে মাওলানা রাষ্ট্রের বিষয়ে তাঁর অবস্থান ক্লিয়ার করেন। এটা সেসময়ের কথা, জামায়াতে ইসলাম তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে মাওলানা একজন ইসলামিক স্কলার হিসেবে সারা হিন্দুস্থানজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন। ১২ই সেপ্টেম্বর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেচি হলে ইতিহাস ও সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা মওদূদীকে অতিথি করা হয়। সে প্রোগ্রামে অতিথির বক্তব্যে মাওলানা মওদূদী ইসলামী রাষ্ট্র গঠন কীভাবে হবে তা নিয়ে আলোচনা করেন।
তাঁর এই বক্তব্য আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বই আকারে বের করে। বইটির নাম হলো 'ইসলামী হুকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হ্যায়'। এই বইটি উপমহাদেশে ব্যাপক তোলপাড় করে। বিচক্ষণ মুসলিমরা এই বইটিকে সাদরে গ্রহণ করে। এই বইটি বাংলায় অনুবাদ হয় প্রথমে 'ইসলামী বিপ্লবের পথ' এই নামে। পরে সংশোধন করে 'ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?' এই নামে প্রকাশিত হয়। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন আব্দুস শহীদ নাসিম।
মাওলানা মওদূদীর এই বক্তব্যকে ৬টি ভাগে ভাগ করা যায়। বলা যায় তিনি ৬ টি বিষয়ে কথা বলেছেন।
১. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন।
২. আদর্শিক রাষ্ট্র।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র ।
৪. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি।
৫. অবাস্তব ধারণা-কল্পনা।
৬. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি।
১. রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন:
রাষ্ট্রব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। একটা সমাজের মানুষের চিন্তা চেতনা, সংস্কৃতি, আচরণ এর মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বিবর্তন হয়। অতএব হুট করে একটি জাহেলি সমাজকে ইসলামী সমাজে পরিণত করা যায় না। এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন ঐ রাষ্ট্রের মানুষের পরিবর্তন। মাওলানা এখানে বুঝাতে চেয়েছেন শুধু একটি ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারণ করলেই ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যায় না। বরং এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে হবে।
২. আদর্শিক রাষ্ট্র:
ইসলামী রাষ্ট্র মানে মুসলিমদের রাষ্ট্র নয়। মুসলিমরা রাষ্ট্র কায়েম করলে সেটি ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যায় না। ইসলামী রাষ্ট্র হচ্ছে সেটি যে রাষ্ট্রে ইসলামের বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়। এখানে জাতীয়তাবাদের লেশমাত্র থাকবে না। আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গোটা মানবজাতিকে তার আদর্শ গ্রহন করে অজাতীয়তাবাদী বিশ্বজনীন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানায়।
মাওলানা তাঁর কাঙ্খিত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন,
১. রাষ্ট্রের আদর্শ হবে ইসলাম
২. সংকীর্ন জাতীয়তাবাদ হতে সম্পূর্ন মুক্ত
৩. অন্যান্য রাষ্ট্রনীতি হতে সম্পূর্ণ পৃথক।
৪. জনগনের অধিকার সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
৫. যোগ্যতার বলে যে কেউ শাসক হতে পারে।
৬. উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
৭. সার্বভৌমত্ব হবে আল্লাহর, প্রতিনিধিত্ব হবে জনগনের।
৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র:
মাওলানা বলেন, আমরা যে রাষ্ট্র কায়েম করতে চাই সেখানে সার্বভৌমত্ব হবে একমাত্র আল্লাহর। তাঁর বিধান, আইনই শেষ কথা। এই রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে, এখানে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবে। এই খিলাফাত প্রতিষ্ঠার কাজে এমন সব লোকই অংশীদার হবে, যারা এই আইন ও বিধানের প্রতি ঈমান আনবে এবং তা অনুসরণ ও কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। এই রাষ্ট্রের সকল কাজের জন্য সামষ্টিকভাবে আমাদের সকলকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ রাষ্ট্রের পরিচালকদের অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকবে। তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের মালিক নয়, আমানতদার হবে। শাসকগণ জনগনের কল্যান চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাবে। শাসক নির্বাচিত হবে জনগণের মতামত নিয়ে। বংশানুক্রমিক বা জবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল করা যাবে না।
৪. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি:
মাওলানা বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য প্রথমে এমন একটি আন্দোলন প্রয়োজন যে আন্দোলনের মধ্যে ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। এখানে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমনসব বিশেষজ্ঞ তৈরি করবে যারা নিজেদের মন মানসিকতা, ধ্যানধারনা ও চিন্তা দর্শনের দিক থেকে হবে পূর্ণ মুসলিম। যাদের ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বাস্তবধর্মী এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নকশা তৈরি করার থাকবে পূর্ণাঙ্গ যোগ্যতা।
৫. অবাস্তব ধারণা কল্পনা:
কিছু লোকের ধারণা মুসলমানরা সংগঠিত হলেই তাদের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মূলত জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকে এই ধারণার উদ্ভব। সত্যিকারভাবে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। তারা ভাবে “মুসলমান” একটি বংশগত বা ঐতিহাসিক জাতির ধারণা। মুসলিমদের ঐক্যের মাধ্যমে সেই জাতিটিরই কেবল উন্নতি সাধন করা এবং একটি জাতীয় রাষ্ট্র অর্জিত হতে পারে। কিংবা কমপক্ষে দেশ শাসনে ভাল একটা অংশীদারিত্ব লাভ হতে পারে। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে এটাকে প্রথম পদক্ষেপও বলা যেতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ইসলামকে আদর্শ হিসেবে ধারণ করা। ইসলামী বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা। মাওলানা এখানে মূলত মুসলিম লীগের সমালোচনা করেছেন। মুসলিম লীগ ভেবেছে মুসলিমদের রাষ্ট্র হলেই সেটা ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যাবে। কিন্তু মাওলানা বলেন, এর দ্বারা মুসলিমদের উপকার হতে পারে, একটি ভালো শাসন পাওয়া যেতে পারে তবে কোনোভাবেই এটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে না। এই রাষ্ট্র দিয়ে খিলাফতের দায়িত্ব পালন হবে না।
৬. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি:
সবশেষে মাওলানা আমাদের কর্মনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এক আল্লাহর একচ্ছত্র ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে মানবজীবনের পরিপূর্ণ ইমারত রচনা করার প্রচেষ্টা ও আন্দোলনকে বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে বলা হয় ইসলাম। আর এর জন্য মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সা:) এর অনুসৃত পথেই ইসলামী আন্দোলনের কর্মনীতি পরিচালনা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই যেখানে আল্লাহর বিধান কায়েম হবে তথা তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। আর মুহাম্মদ সা.-এর সীরাত থেকেই এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি আমরা গ্রহণ করবো।
এটি একটি দারুণ বই! ইসলামী রাষ্ট্র যারা প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদের জন্য এটা টেক্সট বুক। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এটা পড়া দরকার। যারা এখনো পড়েননি তারা অবশ্যই পড়বেন। আপনার চিন্তা পরিশুদ্ধ হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যারা চেষ্টা করছেন তাদের অন্তরে যদি চরমপন্থী ধারণা থাকে তবে তা দূর হবে ইনশাআল্লাহ।
#বুক_রিভিউ
বই : ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : আব্দুস শহীদ নাসিম
প্রকাশনী : শতাব্দী প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ৪৮
মুদ্রিত মূল্য : ২৪
জনরা : থিয়োলজি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন