যখন জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয় তখন নঈম সিদ্দিকী ছিলেন ২৫ বছরের যুবক। ১৯৪১ সালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠা থেকেই তিনি এর সাথে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, আলেম, এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন। নঈম সিদ্দিকীর জন্ম ১৯১৬ সালের ৫ জুন পাঞ্জাবে। তিনি উলুম-ই-ইসলামিয়া ফাজিল সম্পন্ন করেন। এরপর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী ও ফার্সি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করেন।
তিনি তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন নসরুল্লাহ খান আজিজের সম্পাদনায় করাচী থেকে বের হওয়া দ্বিমাসিক পত্রিকা 'কাউসার'-এ যোগ দিয়ে। পরবর্তীতে, তিনি মাসিক চেরাগ-এ-রহে যোগদান করেন এবং নয় বছর এটির সম্পাদক ছিলেন। তিনি পত্রিকা, সাময়িকী ব্যবহার করে উপমহাদেশে ইসলামী জ্ঞান প্রচার এবং ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তাঁর লেখা মুসলিমদের মধ্যে ব্যপক সাড়া ফেলেছিলো। তাঁর কবিতাগুলো মুসলিমদের মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত। তিনি ছদ্মনামে রম্যরচনাও করতেন। ১৯৭১ সালের পর থেকে আমরা ওনার দারুণ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ৭১ এর পর থেকে এদেশে মুসলিমদের মধ্যে উর্দু-ফার্সি চর্চা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা ওনার সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হই।
মাওলানা মওদূদী ইন্তেকাল করার পর দীর্ঘদিন তিনি মাসিক পত্রিকা তারজুমানুল কুরআনের সম্পাদকও ছিলেন। মাওলানা নঈম সিদ্দিকীর সেরা কীর্তি মুহসিনে ইনসানিয়াত বা মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা.। এতে মুহাম্মদ সা. এর জীবনের বিভিন্ন দিক দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও তিনি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার ওপরে আরো অনেক বই লিখেছেন।
তাঁর প্রকাশিত বইয়ের পাশাপাশি ইসলামের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর প্রায় ৭০০টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উপমহাদেশের বাইরে আরবেও তাঁর লেখার ভক্ত তৈরি হয়েছিল প্রচুর। তিনি সারাবিশ্বে আরেকটি প্রবন্ধের জন্য পরিচিত। সেটি বাংলায় 'চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান' নামে অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন আব্দুল মান্নান তালিব।
বিশ শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার নঈম সিদ্দিকী একটি প্রবন্ধ লিখেন 'তা'মীরে সিরাত কে লাওয়াজিম' নামে। এটি এখন চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান নামে বই আকারে পাওয়া যায় বাংলায়।
এখানে লেখক জোর দিয়েছেন কীভাবে আমরা আমাদের চরিত্র ঠিক রাখবো। আর চরিত্র ঠিক রাখা মানে হলো ইসলামী আন্দোলনে টিকে থাকা বা ইসলামকে গালিব করার জন্য কাজ করা। চরিত্র নষ্ট বলতে লেখক বুঝিয়েছেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইসলামী আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হওয়া। উনি যেসময় লেখাটি লিখেছিলেন তখন ওনার দৃষ্টিতে দুটি কারণ ধরা পড়ে চরিত্র নষ্ট হওয়া তথা হকের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার।
উনি বলতে চেয়েছেন যখন কোনো মানুষ ইসলামের দিকে ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করে তখন শয়তান ঐ মানুষের প্রতি তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তাকে দুইভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করে।
প্রথমত তাকে দুনিয়ার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লোভ দেখায়। যেটাকে নঈম সিদ্দিকী বলেছেন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপূজারী সভ্যতার হামলা।
দ্বিতীয়ত তাকে সাম্যবাদী সমাজের নামে ইসলামবিমুখ করার চেষ্টা করে। যেটাকে লেখক বলেছেন সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা।
বইটি লেখার প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। বর্তমান সমাজে শয়তানের এই দুটি আক্রমণের মধ্যে ১ম টি প্রবলভাবে অব্যাহত আছে এবং এটি আজীবন থাকবে বলে মনে করি। কারণ এর মাধ্যমে বেশিরভাগ ঘায়েল হয়েছে ও হচ্ছে। মানুষ বরাবরই সম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতার কাঙ্গাল। এটি মানুষের কমন ফিতরাত। নফসের চাহিদাও তাই। ফলে বেশিরভাগ মানুষ দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শয়তানের ধোঁকায় পড়ে।
সমাজতন্ত্র সেসময় ট্রেন্ডি আদর্শ ছিল। মুসলিম যুবকরা কম্যুনিস্টদের কবলে পড়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তারা কিন্তু আদর্শের জন্য ডেডিকেটেড ছিল। যেহেতু তারা আদর্শের জন্য উন্মূখ ছিল তাই ওদের চেয়ে ভালো আদর্শ উপস্থাপন করতে পারলেই সমস্যা কেটে যাবে। জামায়াতে ইসলাম উপমহাদেশে সেই ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামকে সঠিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেছে। ফলে বহু কমিউনিস্ট নেতা তওবা করে সঠিক মুসলমান হয়েছে।
কমিউনিস্টদের আদর্শ বিশ্বব্যাপী মার খাওয়ায় সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা ষাটের দশকের চেয়ে অনেক অনেক কমে গিয়েছে। কিন্তু এই স্থান দখল করে নিয়েছে সেক্যুলারিজম। তারা ইসলাম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে দিয়েছে। ফলে একশ্রেণির মুসলিম তৈরি হচ্ছে যারা পার্সোনালি ইসলামকে ভালোবাসে। নামাজ রোজা করে কিন্তু রাষ্ট্র থেকে অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিহার করতে সচেষ্ট তো থাকেই না। উল্টো রাষ্ট্রকে ইসলামী কানুন থেকে আলাদা রাখতে চায়।
শয়তানের আক্রমনের টুলস পরিবর্তন হলেও চরিত্র সংরক্ষণের টুলস অপরিবর্তিত। নঈম সিদ্দিকী লিখেছেন এর জন্য তিনটি কাজ করতে হবে।
১. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বাড়ানো।
২. সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা।
৩. আন্দোলনের সহকর্মীদের সাথে গুড রিলেশন।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য নঈম সিদ্দিকী চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রথমত মৌলিক (ফরজ-ওয়াজিব) ইবাদতসমূহ সুন্দরভাবে যথানিয়মে আদায় করা। দ্বিতীয়ত ইসলামের বিষয়ে জ্ঞানর্জনের জন্য কুরআন হাদিস সরাসরি অধ্যয়ন করা। এর জন্য যা প্রস্তুতি নেওয়া দরকার তা নেওয়া। টেক্সট বই না পড়ে অন্য কিছু পড়লে যথাযথ জ্ঞান হাসিল হয় না। বরং এর মাধ্যমে মিসগাইডেড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নঈম সিদ্দিকী তাই টেক্সট বই পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তৃতীয়ত নঈম সিদ্দিকী নফল বা অতিরিক্ত ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। নফল নামাজ ও ইবাদত মানুষকে আল্লাহর প্রিয় করে তোলে। সবশেষে সার্বক্ষনিক দোয়া ও জিকিরের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সব কাজে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া ও ইসলামের নীতির মধ্যে থাকাই হলো এর মূল কথা।
সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার ব্যাপারে নঈম সিদ্দিকী দারুণ কথা বলেছেন। এখানে যেমন দায়িত্বশীলের ভূমিকা আছে তেমনি কর্মীরও ভূমিকা আছে। তাই তিনি প্রথমেই আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছেন। নেতা চেষ্টা করবেন এমন আদেশ করতে যা পালনযোগ্য আবার কর্মীও আদেশ পালনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। উভয়ের প্রচেষ্টাই সংগঠনকে টিকিয়ে রাখবে। অন্ধ আনুগত্য করা যাবেনা। নেতা ইসলামবিরোধী কোনো কথা বললে তা সমর্থন করা যাবে না। তার প্রতিবাদ করা ঈমানের দাবী। নেতার কথাই শেষ কথা নয়, নেতার কথা যাচাই হবে শরিয়তের মানদণ্ড অনুযায়ী। নেতা পরিবর্তনে আনুগত্যের কম-বেশি করা যাবে না। যাকে ভালো লাগে তার পূর্ণ আনুগত্য করবো, যাকে কম ভালো লাগে তার আনুগত্য কম করবো এমন যেন না হয়। দায়িত্বশীলদের করণীয় হলো, সকলের সাথে উত্তম আচরণ করা। এমনভাবে আচরণ করা যাতে প্রত্যেক কর্মী মনে করে দায়িত্বশীল আমাকেই বেশি পছন্দ করে। সহযোগীদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমার সাথে দেখে শোধরানোর চেষ্টা করা। সর্বোপরি নেতা ও কর্মী উভয়েই এই সংগঠনকে আল্লাহর আমানত মনে করে এর সংরক্ষণ করবে। কোনো অনৈসলামিক, অসুন্দর ও অসভ্য নিয়ম, প্রথা ও চেতনা যাতে সংগঠনে ঢুকে না পড়ে তার জন্য সচেষ্ট থাকা।
আন্দোলনের সহকর্মীদের সাথে গুড রিলেশনের বেসিক হলো সূরা হুজরাতের শিক্ষা। কারো ব্যাপারে কোনো খবর শোনার সাথে সাথে সিদ্ধান্ত না নেওয়া বরং যাচাই করা। আন্দোলনে এলাকাপ্রীতি তৈরি করে একদল আরেকদলকে বিদ্রূপ না করা। এলাকার নিমিত্তে কারো জন্য সুবিধা বৃদ্ধি করে দেওয়া বা কমিয়ে দেওয়া এমন যেন না হয়। এগুলো স্পষ্ট জাহেলিয়াত। রাসূল সা. জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বড় কঠিন কথা বলে গেছেন। তারা মুসলিম হিসেবেই মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। সহযোগীদের সাথে গুড রিলেশনের বড় অন্তরায় হলো গীবত। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা গীবত করবে না বা অন্যের দোষ নিয়ে চর্চা করবে না।
আমরা যদি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বাড়াই, সংগঠনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকি এবং আন্দলনের কর্মীদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখি তবে আমরা শয়তানের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবো ইনশাআল্লাহ। দুনিয়ার দিকে যেমন ঝুঁকে পড়বো না তেমনি কম্যুনিজম ও সেক্যুলারিজমের প্রতিও অনুরক্ত হবো। আর এভাবেই আমাদের চরিত্র ঠিক থাকবে। চরিত্র ঠিক থাকা মানেই হলো আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা, ইকামাতে দ্বীনের কাজ করা।
#বুক_রিভিউ
বই : চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
লেখক : নঈম সিদ্দিকী
অনুবাদক : আব্দুল মান্নান তালিব
প্রকাশনী : আইসিএস
পৃষ্ঠা : ৩৩
মুদ্রিত মূল্য : ২০
জনরা : আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন