১৯৪৬ সালের কথা। জামায়াতের বয়স তখন মাত্র ৫ বছর। এসময় জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদী রহ. ভারতজুড়ে চষে বেড়াচ্ছেন, বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন ও ইসলামী আন্দোলন তথা ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন। তেমনি একটি সাধারণ সভার আয়োজন হয়েছিল পাঞ্জাবের শিয়ালকোট জেলার মুরাদপুরে। শিয়ালকোট এখন পাকিস্তানের একটি মোটামুটি প্রসিদ্ধ শহর। ১৯৪৬ সালে তখনো পাকিস্তান গঠিত হয়নি। পাকিস্তানের জন্য জোর আন্দোলন চলছিল।
মুরাদপুরের সেই সভায় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সামনে একটি বক্তব্য রাখেন মাওলানা মওদূদী। সেখানে মাওলানা মওদূদীর রহ.-এর বক্তব্যের বিষয় ছিল একজন মুসলিমের ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য কী? বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী রহ.-এর সেই ভাষণ 'শাহদাতে হক' নামে উর্দুতে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
বাংলায় এই বইটি 'সত্যের সাক্ষ্য' নামে প্রকাশিত হয়েছে। উর্দু থেকে এটি অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম। যেহেতু বইটি একটি বক্তব্যের লিখিত রূপ তাই এখানে অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনা হয়নি। তবে যে কয়টি প্রধান বিষয় এখানে আলোকপাত করা হয়েছে তা হলো, আমাদের দাওয়াত, মুসলিমদের দায়িত্ব, সত্যের সাক্ষ্য, সাক্ষ্যদানের পদ্ধতি, সত্য গোপনের শাস্তি, মুসলিমদের সমস্যা, আমাদের উদ্দেশ্য ও জামায়াত সম্পর্কে কিছু অভিযোগের জবাব।
আমাদের দাওয়াত
মাওলানা মওদূদী এখানে আমাদের দাওয়াত বলতে জামায়াতের দাওয়াত বুঝিয়েছেন। জামায়াতের দাওয়াত দুই শ্রেণির প্রতি। যারা মুসলিম নয় এবং যারা মুসলিম। যারা মুসলিম নয় তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া হয়। আল্লাহকে একক রব হিসেবে মেনে নেওয়া ও মুহাম্মদ সা.-কে তাঁর প্রেরিত রাসূল হিসেবে মানার দাওয়াত দেওয়া হয়। আর যারা মুসলিম তাদেরকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করার আহবান জানানো। আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
মুসলিমদের দায়িত্ব
এই প্রসঙ্গে মাওলানা বলেন, শুধু সত্যের ওপর ঈমান আনলেই হবে না। বরং সে সত্যের ওপর আপনারা ঈমান এনেছেন তার সাক্ষীরূপে সারা দুনিয়ার সামনে দাঁড়াতে হবে। কুরআনে আপনাদেরকে 'মুসলমান' নামে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সাথে এই দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে, আপনারা দুনিয়ার মানুষের সামনে হকের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াবেন। এরপর মাওলানা সূরা আল বাকারার ১৪৩ নং আয়াত পাঠ করেন। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থী জাতি বানিয়েছি। যাতে তোমরা লোকদের জন্য সাক্ষী হও আর রাসূল যেন তোমাদের জন্য সাক্ষী হন।
মাওলানা এই বক্তব্য যখন দিচ্ছিলেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশের আরেকজন মাওলানা বলেছেন। হিন্দু-মুসলিম আমরা এক জাতি। এক মাটির সন্তান। তাই আমরা একসাথে থাকবো। হোসাইন আহমেদ মাদানীর সেই বক্তব্যকেও এখানে খন্ডন করা হয়েছে। কারণ মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতি। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আলাদা। এরপর মাওলানা কুরআনের আরো কিছু কুরআনের আয়াত তিলওয়াত করেন যেখানে মুসলিমদের সত্যের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং সত্যের সাক্ষ্য না দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন। সেগুলো হলো, সূরা নিসা ১৩৫, বাকারা ৬১ ও ১৪০।
সত্যের সাক্ষ্য
মাওলানা বলেন, সত্যের সাক্ষ্য হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, উদ্ভাসিত হয়েছে, তার সত্যতা দুনিয়ার সামনে এমনভাবে প্রকাশ করা যাতে দ্বীনের যথার্থতা প্রমানিত হয়, এটাই সত্যের সাক্ষ্য।
এই সাক্ষ্যের গুরুত্ব প্রসঙ্গে মাওলানা ৫ টি কথা বলেছেন, সাক্ষ্যদানের ভিতিত্তেই হাশরের ময়দানে ফয়সালা হবে। সাক্ষ্যদান সকল নবীর সুন্নাত। সত্যের সাক্ষী না হলে জালেমদের অন্তভূক্ত হবে। সাক্ষ্য না দিলে দুনিয়ার লাঞ্জনা, অপমান, অধ:পতন চেপে বসবে। সাক্ষ্য দান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া দায়িত্ব।
সাক্ষ্য দানের পদ্ধতি
মাওলানা বলেন, দুইভাবে সাক্ষ্য দিতে হবে। মৌখিকভাবে ও বাস্তবে। দুইটাই জরুরি।
নবী সা.-এর মাধ্যমে আমাদের কাছে যে সত্য এসে পৌছেছে তা বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে মানুষের কাছে সহজবোধ্য করাকে মৌখিক সাক্ষ্য বলে। দাওয়াতের সকল পদ্ধতি প্রয়োগ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল উপাদান ব্যবহার করে ইসলামকে একমাত্র সঠিক পরিপূর্ণ বিধান হিসাবে প্রমান এবং প্রতিষ্ঠিত বাতিল মতাদর্শের দোষ ক্রটি তুলে ধরা হচ্ছে মৌখিক সাক্ষ্য। এই যে আমরা ফেসবুকিং বা ব্লগিং করছি এটাও মৌখিক সাক্ষ্য। আর আমরা যা মুখে বলছি, যা লিখছি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের সামনে তার সত্যতা প্রমাণের নাম বাস্তব সাক্ষ্য।
মাওলানা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, আল্লাহর দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে মানতে পারলেই দ্বীনের পূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করা হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকলে দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে মানা সম্ভব হয় না। সুতরাং শুধুমাত্র দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সাক্ষ্যদানের পূর্ণতা সম্ভব। নইলে তা পূর্ণতা পাবে না।
১৯৪৬ সালের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মাওলানা বইলেন, আজ আমাদের সমাজে খুব কম সংখ্যক লোকই মৌখিক সাক্ষ্য দিচ্ছেন। দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোকই ইসলামকে বাদ দিয়ে মানব রচিত মতবাদকে সত্য বলে গ্রহণ করছেন। আজ পত্র পত্রিকা, ব্যবসা-বানিজ্য, আইন-আদালত সর্বোত্রই বাতিল মতবাদকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সমাজে খুব সামান্য সংখ্যক লোক ছাড়া কেউই নিজ জীবনে বাস্তব সাক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের চেয়েও আমাদের সামাজিক রীতিনীতির অবস্থা আরো খারাপ। এমনকি আজ আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ইসলাম বিরোধী মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করছি। এই অভিযোগটা মূলত মাওলানা মুসলিম লীগকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। মুসলিম লীগের অনেক নেতাই প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করার কথা বলেছিলেন।
সাক্ষ্য গোপন বা সত্য গোপনের শাস্তি
মাওলানা বলেন, আজ আমরা সত্য গোপন করে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছি এজন্য অবশ্যই ইহকাল ও পরকালে শাস্তি পেতে হবে। ইহকালে আমাদের সত্য গোপনের জন্য অপর জাতির হাতে লাঞ্চিত হতে হবে। যেমনটি ঘটেছে পূর্ববর্তী জাতিদের ক্ষেত্রে। দুনিয়ার চেয়েও কঠিন শাস্তি আমাদের পেতে হবে পরকালে। যদিও দুনিয়ার অশান্তি ও অনৈসলামিক কাজের জন্য আমরা দায়ী নই তবুও এগুলো দূর করার কাজ না করার জন্য আমাদেরকে শাস্তি পেতে হবে।
মুসলিমদের সমস্যা
১৯৪৬ সালে মুসলিমদের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তারা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। মাওলানা বলেন, এটা আমাদের মূল সমস্যা নয়, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে আমরা বাস্তব জীবনে ইসলামকে মানতে পারিনা। আর এজন্য প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে আমরা সক্ষম হচ্ছি না। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে দ্বীনের হককে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ইসলামের বিধান মোতাবেক যাবতীয় কাজ সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। মাওলানা আরো সুন্দর কথা বলেছেন, শাহদাতে হক বা সত্যের সাক্ষ্যের মাধ্যমে সংখ্যালঘু পরিণত হবে সংখ্যাগুরুতে।
আমাদের উদ্দেশ্য
এখানে মাওলানা আমাদের উদ্দেশ্য বলতে জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্যকে নির্দেশ করেছেন। উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাওলানা বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীনকে নিজের জীবনে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। কথা ও কাজের মাধ্যমে তার যথার্থ সাক্ষ্য দুনিয়ার সামনে পেশ করা। মুসলমান হিসেবে দ্বীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও সত্যের সাক্ষ্য দানই আমাদের জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। এরপর মাওলানা সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, সংগঠন প্রতিষ্ঠা, কাজের ধারা নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনা শেষে তিনি উপস্থিত জনগণকে জামায়াতে শামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
অভিযোগের জবাব
আলোচনার শেষ দিকে মাওলানা জামায়াতের ব্যাপারে উত্থাপিত কিছু অভিযোগের জবাব দেন। এর মধ্যে ছিল জামায়াত নতুন ফিরকা তৈরি করে মুসলিমদের মধ্যে দলাদলি করছে। আমীর শব্দটা কেন ব্যবহার করা হচ্ছে? এর দাবীদার একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক। পৃথক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী? জামায়াত কী অধিকারে যাকাত গ্রহণ করে? বাইতুল মাল কেন বানিয়েছে? ইত্যাদি। এসব কিছু প্রশ্নের দারুণ জবাব দিয়েছেন মাওলানা মওদূদী রহ.।
জবাব দান শেষে মাওলানা বলেন, প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ প্রশ্নই এমনি নিরর্থক যে, এগুলোর জবাব দান করে শ্রোতাবৃন্দের সময় নষ্ট করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তবু আমি নমুনা স্বরূপ কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দান করলাম এ জন্যে যে, যারা নিজেরাও দায়িত্ব পালন করতে চান না, বরং অন্যকেও তা করতে দিতে প্রস্তুত নন, তারা কি ধরণের বাহানা, কুটিল প্রশ্ন এবং সন্দেহজনক বিষয় খুঁজে খুঁজে বের করেন এবং নিজেরা যেমন আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকেন, তেমনি করে অন্যকেও কীভাবে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
বস্তুত অহেতুক ঝগড়া-বিবাদ এবং বিতর্ক-মুনাযারায় লিপ্ত হওয়া আমাদের কাজের পন্থা নয়। যদি কেউ সহজ-সরলভাবে আমাদের কথা বুঝতে চান, তো তাকে বুঝানোর জন্যে আমরা সদা প্রস্তুত। আর যদি কেউ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আমাদের ভূল-ভ্রান্তি ধরিয়েদিতে চান তা-ও আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কেউ বিতর্ক সৃষ্টি করলে এবং আমাদের তাতে জড়িত করতে চাইলে আমরা তার সম্মুখীন হতে মোটেই সম্মত নই। বিরুদ্ধবাদীগণ যতক্ষণ ইচ্ছা এ খেলা চালু রাখতে পারেন।
জামায়াতকে বুঝতে ও মুসলিম হিসেবে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট একটি বই। যারা এখনো বইটি পড়েননি, পড়ে নিন। আপনার মন ভরে যাবে। মুসমানিত্বের দায়িত্ব পালনে আপনি সচেষ্ট হবেন ইনশাআল্লাহ।
#বুক_রিভিউ
বই : সত্যের সাক্ষ্য
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
প্রকাশনী : প্রকাশনা বিভাগ, জামায়াতে ইসলামী।
পৃষ্ঠা : ৪০
মুদ্রিত মূল্য : ১৬
জনরা : আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন
মুরাদপুরের সেই সভায় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সামনে একটি বক্তব্য রাখেন মাওলানা মওদূদী। সেখানে মাওলানা মওদূদীর রহ.-এর বক্তব্যের বিষয় ছিল একজন মুসলিমের ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য কী? বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী রহ.-এর সেই ভাষণ 'শাহদাতে হক' নামে উর্দুতে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
বাংলায় এই বইটি 'সত্যের সাক্ষ্য' নামে প্রকাশিত হয়েছে। উর্দু থেকে এটি অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম। যেহেতু বইটি একটি বক্তব্যের লিখিত রূপ তাই এখানে অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনা হয়নি। তবে যে কয়টি প্রধান বিষয় এখানে আলোকপাত করা হয়েছে তা হলো, আমাদের দাওয়াত, মুসলিমদের দায়িত্ব, সত্যের সাক্ষ্য, সাক্ষ্যদানের পদ্ধতি, সত্য গোপনের শাস্তি, মুসলিমদের সমস্যা, আমাদের উদ্দেশ্য ও জামায়াত সম্পর্কে কিছু অভিযোগের জবাব।
আমাদের দাওয়াত
মাওলানা মওদূদী এখানে আমাদের দাওয়াত বলতে জামায়াতের দাওয়াত বুঝিয়েছেন। জামায়াতের দাওয়াত দুই শ্রেণির প্রতি। যারা মুসলিম নয় এবং যারা মুসলিম। যারা মুসলিম নয় তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া হয়। আল্লাহকে একক রব হিসেবে মেনে নেওয়া ও মুহাম্মদ সা.-কে তাঁর প্রেরিত রাসূল হিসেবে মানার দাওয়াত দেওয়া হয়। আর যারা মুসলিম তাদেরকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করার আহবান জানানো। আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
মুসলিমদের দায়িত্ব
এই প্রসঙ্গে মাওলানা বলেন, শুধু সত্যের ওপর ঈমান আনলেই হবে না। বরং সে সত্যের ওপর আপনারা ঈমান এনেছেন তার সাক্ষীরূপে সারা দুনিয়ার সামনে দাঁড়াতে হবে। কুরআনে আপনাদেরকে 'মুসলমান' নামে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সাথে এই দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে, আপনারা দুনিয়ার মানুষের সামনে হকের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াবেন। এরপর মাওলানা সূরা আল বাকারার ১৪৩ নং আয়াত পাঠ করেন। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থী জাতি বানিয়েছি। যাতে তোমরা লোকদের জন্য সাক্ষী হও আর রাসূল যেন তোমাদের জন্য সাক্ষী হন।
মাওলানা এই বক্তব্য যখন দিচ্ছিলেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশের আরেকজন মাওলানা বলেছেন। হিন্দু-মুসলিম আমরা এক জাতি। এক মাটির সন্তান। তাই আমরা একসাথে থাকবো। হোসাইন আহমেদ মাদানীর সেই বক্তব্যকেও এখানে খন্ডন করা হয়েছে। কারণ মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতি। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আলাদা। এরপর মাওলানা কুরআনের আরো কিছু কুরআনের আয়াত তিলওয়াত করেন যেখানে মুসলিমদের সত্যের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং সত্যের সাক্ষ্য না দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন। সেগুলো হলো, সূরা নিসা ১৩৫, বাকারা ৬১ ও ১৪০।
সত্যের সাক্ষ্য
মাওলানা বলেন, সত্যের সাক্ষ্য হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, উদ্ভাসিত হয়েছে, তার সত্যতা দুনিয়ার সামনে এমনভাবে প্রকাশ করা যাতে দ্বীনের যথার্থতা প্রমানিত হয়, এটাই সত্যের সাক্ষ্য।
এই সাক্ষ্যের গুরুত্ব প্রসঙ্গে মাওলানা ৫ টি কথা বলেছেন, সাক্ষ্যদানের ভিতিত্তেই হাশরের ময়দানে ফয়সালা হবে। সাক্ষ্যদান সকল নবীর সুন্নাত। সত্যের সাক্ষী না হলে জালেমদের অন্তভূক্ত হবে। সাক্ষ্য না দিলে দুনিয়ার লাঞ্জনা, অপমান, অধ:পতন চেপে বসবে। সাক্ষ্য দান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া দায়িত্ব।
সাক্ষ্য দানের পদ্ধতি
মাওলানা বলেন, দুইভাবে সাক্ষ্য দিতে হবে। মৌখিকভাবে ও বাস্তবে। দুইটাই জরুরি।
নবী সা.-এর মাধ্যমে আমাদের কাছে যে সত্য এসে পৌছেছে তা বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে মানুষের কাছে সহজবোধ্য করাকে মৌখিক সাক্ষ্য বলে। দাওয়াতের সকল পদ্ধতি প্রয়োগ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল উপাদান ব্যবহার করে ইসলামকে একমাত্র সঠিক পরিপূর্ণ বিধান হিসাবে প্রমান এবং প্রতিষ্ঠিত বাতিল মতাদর্শের দোষ ক্রটি তুলে ধরা হচ্ছে মৌখিক সাক্ষ্য। এই যে আমরা ফেসবুকিং বা ব্লগিং করছি এটাও মৌখিক সাক্ষ্য। আর আমরা যা মুখে বলছি, যা লিখছি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের সামনে তার সত্যতা প্রমাণের নাম বাস্তব সাক্ষ্য।
মাওলানা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, আল্লাহর দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে মানতে পারলেই দ্বীনের পূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করা হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকলে দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে মানা সম্ভব হয় না। সুতরাং শুধুমাত্র দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সাক্ষ্যদানের পূর্ণতা সম্ভব। নইলে তা পূর্ণতা পাবে না।
১৯৪৬ সালের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মাওলানা বইলেন, আজ আমাদের সমাজে খুব কম সংখ্যক লোকই মৌখিক সাক্ষ্য দিচ্ছেন। দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোকই ইসলামকে বাদ দিয়ে মানব রচিত মতবাদকে সত্য বলে গ্রহণ করছেন। আজ পত্র পত্রিকা, ব্যবসা-বানিজ্য, আইন-আদালত সর্বোত্রই বাতিল মতবাদকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সমাজে খুব সামান্য সংখ্যক লোক ছাড়া কেউই নিজ জীবনে বাস্তব সাক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের চেয়েও আমাদের সামাজিক রীতিনীতির অবস্থা আরো খারাপ। এমনকি আজ আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ইসলাম বিরোধী মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করছি। এই অভিযোগটা মূলত মাওলানা মুসলিম লীগকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। মুসলিম লীগের অনেক নেতাই প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করার কথা বলেছিলেন।
সাক্ষ্য গোপন বা সত্য গোপনের শাস্তি
মাওলানা বলেন, আজ আমরা সত্য গোপন করে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছি এজন্য অবশ্যই ইহকাল ও পরকালে শাস্তি পেতে হবে। ইহকালে আমাদের সত্য গোপনের জন্য অপর জাতির হাতে লাঞ্চিত হতে হবে। যেমনটি ঘটেছে পূর্ববর্তী জাতিদের ক্ষেত্রে। দুনিয়ার চেয়েও কঠিন শাস্তি আমাদের পেতে হবে পরকালে। যদিও দুনিয়ার অশান্তি ও অনৈসলামিক কাজের জন্য আমরা দায়ী নই তবুও এগুলো দূর করার কাজ না করার জন্য আমাদেরকে শাস্তি পেতে হবে।
মুসলিমদের সমস্যা
১৯৪৬ সালে মুসলিমদের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তারা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। মাওলানা বলেন, এটা আমাদের মূল সমস্যা নয়, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে আমরা বাস্তব জীবনে ইসলামকে মানতে পারিনা। আর এজন্য প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে আমরা সক্ষম হচ্ছি না। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে দ্বীনের হককে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ইসলামের বিধান মোতাবেক যাবতীয় কাজ সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। মাওলানা আরো সুন্দর কথা বলেছেন, শাহদাতে হক বা সত্যের সাক্ষ্যের মাধ্যমে সংখ্যালঘু পরিণত হবে সংখ্যাগুরুতে।
আমাদের উদ্দেশ্য
এখানে মাওলানা আমাদের উদ্দেশ্য বলতে জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্যকে নির্দেশ করেছেন। উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাওলানা বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীনকে নিজের জীবনে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। কথা ও কাজের মাধ্যমে তার যথার্থ সাক্ষ্য দুনিয়ার সামনে পেশ করা। মুসলমান হিসেবে দ্বীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও সত্যের সাক্ষ্য দানই আমাদের জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। এরপর মাওলানা সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, সংগঠন প্রতিষ্ঠা, কাজের ধারা নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনা শেষে তিনি উপস্থিত জনগণকে জামায়াতে শামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
অভিযোগের জবাব
আলোচনার শেষ দিকে মাওলানা জামায়াতের ব্যাপারে উত্থাপিত কিছু অভিযোগের জবাব দেন। এর মধ্যে ছিল জামায়াত নতুন ফিরকা তৈরি করে মুসলিমদের মধ্যে দলাদলি করছে। আমীর শব্দটা কেন ব্যবহার করা হচ্ছে? এর দাবীদার একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক। পৃথক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী? জামায়াত কী অধিকারে যাকাত গ্রহণ করে? বাইতুল মাল কেন বানিয়েছে? ইত্যাদি। এসব কিছু প্রশ্নের দারুণ জবাব দিয়েছেন মাওলানা মওদূদী রহ.।
জবাব দান শেষে মাওলানা বলেন, প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ প্রশ্নই এমনি নিরর্থক যে, এগুলোর জবাব দান করে শ্রোতাবৃন্দের সময় নষ্ট করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তবু আমি নমুনা স্বরূপ কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দান করলাম এ জন্যে যে, যারা নিজেরাও দায়িত্ব পালন করতে চান না, বরং অন্যকেও তা করতে দিতে প্রস্তুত নন, তারা কি ধরণের বাহানা, কুটিল প্রশ্ন এবং সন্দেহজনক বিষয় খুঁজে খুঁজে বের করেন এবং নিজেরা যেমন আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকেন, তেমনি করে অন্যকেও কীভাবে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
বস্তুত অহেতুক ঝগড়া-বিবাদ এবং বিতর্ক-মুনাযারায় লিপ্ত হওয়া আমাদের কাজের পন্থা নয়। যদি কেউ সহজ-সরলভাবে আমাদের কথা বুঝতে চান, তো তাকে বুঝানোর জন্যে আমরা সদা প্রস্তুত। আর যদি কেউ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আমাদের ভূল-ভ্রান্তি ধরিয়েদিতে চান তা-ও আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কেউ বিতর্ক সৃষ্টি করলে এবং আমাদের তাতে জড়িত করতে চাইলে আমরা তার সম্মুখীন হতে মোটেই সম্মত নই। বিরুদ্ধবাদীগণ যতক্ষণ ইচ্ছা এ খেলা চালু রাখতে পারেন।
জামায়াতকে বুঝতে ও মুসলিম হিসেবে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট একটি বই। যারা এখনো বইটি পড়েননি, পড়ে নিন। আপনার মন ভরে যাবে। মুসমানিত্বের দায়িত্ব পালনে আপনি সচেষ্ট হবেন ইনশাআল্লাহ।
#বুক_রিভিউ
বই : সত্যের সাক্ষ্য
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
প্রকাশনী : প্রকাশনা বিভাগ, জামায়াতে ইসলামী।
পৃষ্ঠা : ৪০
মুদ্রিত মূল্য : ১৬
জনরা : আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন